বামনের ঘরে চাঁদ
সাজিয়ানা মুনির
৭.
( কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)
গরম ধোঁয়া উড়া চায়ের কাপ আর পরোটা প্লেট হাতে আলতো পায়ে ঘরে ঢুকল চাঁদ। আয়নার সামনে কারখানার জন্য তৈরি হচ্ছে আষাঢ়। সকাল বেলা ভারী খাবার পছন্দ না তার। চায়ের সাথে বিস্কুট কিংবা পরোটা খেয়ে কারখানার জন্য বেরিয়ে যায়। টেবিলে চা রাখতে যেয়ে আষাঢ়ের হাতের ক্ষততে চোখ আটকালো চাঁদের। ডান হাতের পিঠে বেশ খানিকটা ফাঁড়া। চিরে রক্ত জমে আছে হাতটায়। প্রচন্ড মাথা ব্যথা থাকায় গতরাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল চাঁদ। আষাঢ় যখন বাড়ি ফিরেছে টের পায়নি। খানিক ঘাবড়ে গেল চাঁদ। কপালে ভাঁজ পড়ল তার। উৎকণ্ঠা সুরে বলল,
‘ এত খানি কি করে কা/টল? হাতে কিছু লাগাননি! এতক্ষণ খোলা রেখেছেন কেন? বসুন, আমি ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছি।’
চাঁদের কথায় পেছন ফিরে তাকালো আষাঢ়। হাতের ক্ষততে একপলক চোখ বুলিয়ে নিজের কাজে মনযোগ দিলো আবার। বলল,
‘ ঔষধ লাগানোর মত তেমন কোন আঘা/ত না এটা। বাতাসে এমনি ঠিক হয়ে যাবে। আজ অনেক কাজ আছে। তাড়াতাড়ি বের হতে হবে।’
আষাঢ়ের সামনে যেয়ে দাঁড়ালো চাঁদ। কন্ঠে খানিক রাগ ঢেলে বলল,
‘ জানি! আষাঢ় ইয়াসির অনেক বেশি স্ট্রং, কোনো আঘা/ত তাকে ছোঁয় না। কিন্তু এটা শারীরিক আঘা/ত। কিসের সাথে লেগে কে/টেছেন কে জানে! প্রচন্ড পিড়া হবে । খোলা ছেড়ে দিলে ইনফেকশন হতে পারে। সামান্য ঔষধে আপনি সবার কাছে দুর্বল হয়ে যাবেন না।’
নিষ্পলক চোখে চেয়ে উত্তর দিলো আষাঢ়,
‘ আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবেনা। আমি নিজের খেয়াল রাখতে জানি চাঁদ।’
‘ সত্যিই কি তাই! তাহলে শরীরের প্রতি কেন এমন উদাসীনতা?’
আষাঢ় চলে যেতে চাইল পারল না। চাঁদের জে/দ তাকে আটকালো। বিছানায় বসে পড়ল আষাঢ়। ঔষধ এনে মুখোমুখি বসলো চাঁদ। স্যাভলন দিয়ে আলতো হাতে পরিষ্কার করে দিচ্ছে চাঁদ। নিগূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আষাঢ়। ফ্যানের বাতাসে এলোমেলো উড়ছে চাঁদের কেশ। ঠোঁট জোড়া গোল করে ফু দিয়ে ব্যথা তাড়ানোর চেষ্টা তার। মুখশ্রী চিন্তায় ভার। বাচ্চাবাচ্চা আদুরে মুখখানায় কেমন জানো ভীতু গম্ভীর ভাব। চোখমুখের নয়নকশা নিখুঁত ভাবে আঁকানো। অপরূপ সুন্দরী, বিন্দুমাত্র খাঁদ নেই তার সরলতাতে।
হাতের ক্ষত পরিষ্কার করতে করতে চাঁদ বলল,
‘ গতরাতে নেহালকে আপনি পি/টিয়েছেন। সেকারণেই হাতের এই চো/ট তাইনা?’
আষাঢ় চোখ লুকিয়ে বলল,
‘ নেহালকে আমি কেন পেটা/তে যাবো। বড়লোক বাবার ছেলে ও পেটা/নোর সাধ্যি আমার আছে কি? আর কোন কারণ ছাড়া কেন ঝামেলায় জড়াতে যাবো।’
‘ কারণ আপনার বাড়িতে ঢুকে আপনার বউয়ের সাথে অস/ভ্যতা করেছে।’
চাঁদ গতকাল আষাঢ়ের বলা কথাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলল তাকে। আষাঢ় খানিক চুপ থেকে বলল,
‘ তুমি ভুল ভাবছ। কল্পনায় গল্প বুনছ। এসবকিছু আবেগ, মিলিয়ে যাবে আবেশে।’
চাঁদের হাতটা থেমে গেল। গতকাল বউ বলে সম্মোধন করা মানুষটা আজ চোখ লোকাচ্ছে, মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কি এমন দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে? অগাধ ভালোবাসে জেনেও অস্বীকার করছে। চোখ তুলে আষাঢ়ের মুখপানে তাকালো চাঁদ। বুকে যন্ত্র/ণা হলো। চোখজোড়া ভরে এলো। নিমিষ সুরে বলল সে,
‘ আচ্ছা, মানলাম ভালোবাসেন না আমায়। আমার সব অনুভূতি সামান্য সময়ের আবেগের। ঠুনকো! এই যে আমি মেনে নিলাম। এখন আপনি ভালো থাকবেন? অন্ত দহ/নে পুড়/বেন না তো আবার?’
চোখ তুলে তাকালো আষাঢ়। হাত জোড়া কচলাচ্ছে অনবরত। অসার কন্ঠে বলল,
‘আমাকে পড়তে যেওনা চাঁদ, বারবার আশাহত, নিরাশ হবে!’
‘আমি নিরাশ হতে আসিনি আষাঢ় ভাই। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না একটা মেয়ে কাউকে কতটুকু ভালোবাসলে নিজের নাম পরিচয় সব ছেড়ে চলে আসতে পারে! আপনার কঠিন ব্যক্তিত্ব আপনাকে ভালোবাসতে বাধ্য করে। আপনি বারবার বলেন পছন্দ করেন না আমায়! অথচ এই যে আপনার যত্ন নেওয়া, দায়িত্ব জুড়ে আগলে রাখা, চুপচাপ কোনো উক্তি বিহীন আমার সকল জে/দ মেনে নেওয়া ভালোবাসার অংশ নয়কি?’
আষাঢ় চুপ। চাঁদ বলল,
‘ আমি মুখ ফিরিয়ে নিলে ভালো থাকবেন তো? মেনে নিতে পারবেন!’
তাচ্ছিল্য হাসলো আষাঢ়। বলল,
‘ আমাকে ভয় দেখাচ্ছ চাঁদ?’
‘ আপনি ভয় পাচ্ছেন?’
চাঁদের কথার প্যাঁচে উত্তর খুঁজে পেল না আষাঢ়। ঝটপট উঠে গেল। অনুভূতি লুকাতে বোধহয় পালানোটাই একমাত্র পথ। যাওয়ার পূর্বে ফিসফিস করে বলে গেল,
‘ বড্ড বেশি বুঝদার তুমি চাঁদ। খোলা কিতাবের মত কি করে পড়তে পারো আমায়! একটু অবুঝ হলে খুব কি মন্দ হতো?’
রমজান মাস চলছে। চারিদিকে প্রচন্ডরকম গরম। ঈদের বাজার করে মাত্রই বাড়ি ফিরেছে আষাঢ়। এবার ত্রিশ রোজা হচ্ছে। ভাড়া মিটিয়ে রিকশা থেকে নামতে বাড়ির সামনে বড় গাড়ি দেখতে পেল। গাড়িটা রুবেলের। চিনতে খুব একটা অসুবিধা হলোনা। বাড়িতে কি রুবেল এসেছে? ভাবতে কপাল কুঁচকে গেল তার। বাজারের ব্যাগ হাতে ঘরে ডুকল। বসার ঘরে উঁকি দিতে দেখল পৃথা এসেছে। হাতে অনেক গুলো শপিং ব্যাগ। সবার জন্য ঈদের কেনাকা/টা করেছে। চাঁদের জন্য বেশ দামী পোশাক এনেছে। ব্যাগ খুলে খুলে সব দেখাচ্ছে। পাশেই চাঁদ আর মালা বেগম বসে। মালা বেগমের চোখমুখে সামান্য চিন্তার ছাপ। ছেলের দিক চোখ পড়তে উঠে গেল মালা বেগম। ব্যাগপত্র রাখতে রান্নাঘরের দিক এগিয়ে গেল। আষাঢ়ের সাথে পৃথার চোখাচোখি হলে সৌজন্যের হাসি হাসে। প্রত্যুত্তরে আষাঢ় এক চিলতে হেসে ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। চাঁদের জন্য কিনে আনা শাড়ির ব্যাগটা আলমারির পেছনের দিকে আড়াল করে রাখলো। বিয়ের পর চাঁদকে নিজের হাতে কোন কিছু কিনে দেয়নি। মায়ের কাছে টাকা দিয়েছে, তিনিই প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দিয়েছে। ঈদ উপলক্ষে চাঁদের জন্য একটা কালো জামদানী কিনেছিল। কালোতে মেয়েটিকে ভীষণ মানায়। মার্কেটে ঘুরাঘুরি করার সময় কালো জামদানীতে হুট করেই চোখ আটকায়। খুব বেশি দামী না বেশ সামান্য টাকার তার সাধ্যের ভেতর। কিন্তু ভাবীর আনা এত দামী সুন্দর পোশাকের মাঝে তার এই সামান্য মূল্যের জামদানীটা কি চোখে পড়বে চাঁদের? এত ভালো ভালো পোশাকের সামনে তার আনা জামদানীটা বেশ নগণ্য। নিজের ভেতর কেমন যেন লজ্জা কাজ করল। শাড়ির ব্যাগটা আড়াল করে রাখলো। শার্টের বোতাম খুলে কলার ছাড়িয়ে বিছানায় গা এলাতে যেতেই, মালা বেগমের গলার ভাঁজ পেল,
‘ ঘুমিয়ে পড়েছিস বাপ!’
আধশোয়া থেকে উঠে বসলো আষাঢ়। কপাল কুঁচকে বলল,
‘ কিছু বলবা মা। কোন কিছু প্রয়োজন?’
মালা বেগমের চোখেমুখে জড়তা সামান্য। আমতা আমতা করে বলল,
‘ চাঁদের ভাবি সবার জন্য কেনাকা/টা করে ইফতার নিয়ে এসেছে। খালি হাতে কি করে বিদায় করে দেই! রান্নাবান্না বসিয়েছি তুই ভালো দেখে একটা থ্রিপিস এনে দে। মানুষ বুঝে উপহার দিতে হয়। যাতা জিনিস তো আর দেওয়া যায় না! বড় বাড়ির মেয়ে বউ কিনা! এই মাসের খরচের টাকা থেকে কিছু টাকা বেঁচেছিল আর আমার বেতনের কিছু্টা অবশিষ্ট ছিল। এগুলো দিয়ে একটা ভালো থ্রিপিস এনে দে।’
মায়ের টাকা মুঠোবন্দী হাতটা সরিয়ে দিলো আষাঢ়। বিছানা ছেড়ে উঠে, শার্টের বোতাম আটকাতে আটকাতে বলল,
‘ এইগুলা তোমার হাত খরচের টাকা তোমার কাছেই রাখো। আমার কাছে টাকা আছে সেগুলো দিয়ে কিনে আনবো।’
আষাঢ় বেরিয়ে গেল।
পৃথা চাঁদকে বোঝাচ্ছে। তার কিনে আনা জামাকাপড় জিনিস গুলো নিতে চাঁদের তীব্র নাকচ। বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
‘ ভাবি এসব জিনিস আমি নিতে পারবোনা। আষাঢ়ের ভালো লাগবেনা।তাছাড়া আমাদের সাধ্যের বাহিরে এসব জিনিস।’
পৃথা তপ্ত শ্বাস ফেলল। চাঁদ তার বয়সের তুলনায় ভীষণ বুঝদার। মান, আত্মসম্মানে টইটুম্বুর। কোনকিছুর জেদ ধরলে যেমন হাসিল করে ক্ষান্ত হয়। তেমনি বেঁকে গেলে তাকে বোঝানো, মানানোর মত ক্ষমতা কারো নেই। হয়তো ছোট থেকে মায়ের আদর, শাসন পায়নি বলেই নিজে থেকে এতোটা গোছানো সে। প্রতি ঈদে নিজে সাথে গিয়ে ডিজাইনার শোরুম থেকে চাঁদের জন্য কেনাকা/টা করে। এবার তার চাঁদ সাধারণ পোশাকে ঈদ করবে? আদৌ পোশাকআশাক কিনেছে তো! মেয়েটি এখানে এমসাদামাটা ভাবে দিন কাটাবে পৃথা ওইখানে কি করে আনন্দময় ঈদ কা/টাবে? একভাবে বললে কোনদিন এসব জিনিস রাখবেনা চাঁদ। চাঁদকে ইমোশনালি টাচ করতে হবে।
পৃথা বলল,
‘ এসব তোর ভাইয়ের টাকায় কেনা না চাঁদ। এসব আমার নিজের টাকার। ওদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিস বলে কি আমার সাথেও সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। তুই আমার ননদ না সন্তান। এইটুকু জিনিস দেওয়ার মত অধিকার তো আমার আছে। তাই না চাঁদ?’
ভাবি প্রশ্নসূচক ইমোশনাল কথাবার্তায় চাঁদ আবারও ভাবতে লাগল। দ্বিধাদ্বন্দে ফোসফাস করে অবশেষে জিনিস গুলো রাখতে হলো চাঁদকে।
ঈদের দিক সকালে নামাজ শেষে বাড়ি ঢুকতে থমকে গেল আষাঢ়। আচমকা চোখের সামনে কিছু গেল। চোখজোড়া সেখানে আটকে গেল। পা জোড়া থমকে গেল। কালো জামদানীর আঁচলে চোখ আটকালো। চোখ তুলে সামনে তাকালো। লোকে বলে, কালো শোকের রঙ, তার কাছে কালোকে সৌন্দর্যের চিহ্ন কেন মনে হয়? স্বর্গলোকের অপ্সরী যেন গায়ে কালো রঙ জুড়িয়ে তার দিক এগিয়ে আসছে। নুপুরের শব্দ মাদালের মত বা/জছে। তার খোলা কেশ কদমের সাথে নড়ছে। চোখজোড়ায় উজ্জ্বল দীপ্ত ছড়িয়ে। ওষ্ঠ জোড়ায় হাস্যোজ্জ্বল হাসি মাখিয়ে এদিকে আসছে। আষাঢ়ের বুকের ধুকপুক বাড়ছে। আনমনে ডান হাতটা বুকের বাঁপাশে যেয়ে থামলো। তার নিশ্বাসের গতি বাড়ল। ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল। ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করতে চাইল। চাঁদকে এড়িয়ে চলে যেতে চাইল। চাঁদ মুখোমুখি দাঁড়ালো। চোখেমুখে বিশ্বজয়ের হাসি ছড়িয়ে। আঁখিজোড়ায় অদ্ভুত চমক। সামান্য একটা শাড়ি পেয়ে কেউ এত খুশি হয়!
চাঁদ আষাঢ়ের সামনা সামনি দাঁড়ালো। আমোদিত সুরে বলল,
‘ কারো জন্য কিছু আনলে তাকে নিজ হাতে দিতে হয়। এতে আনন্দ বাড়ে। আড়ালে লুকিয়ে রাখতে নেই। শাড়িটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে আষাঢ় ভাই। ধন্যবাদ।’
মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আষাঢ়। ফিসফিসিয়ে মনে মনে বলল,
‘ এই অমূল্য চাঁদ একান্ত আমার। শুধু-ই আমার।’
চলবে………
( ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অনেক দিন পর গল্প দিচ্ছি পেজের রিচ কম। গল্প পৌঁছালে রেসপন্স করবেন)
টাইপোগ্রাফি করেছে Maksuda Ratna আপু❤️🌺