হৃদয়জুড়ে প্রেয়সীর আভাস (২) পর্ব ২২+২৩

0
1134

#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস (২)
#পর্ব_২২+২৩
#মোহনা_হক

-‘রুয়াত আয়াজ ভাইয়ার সাথে তোর কিছু হয়েছে?’

ব্যালকনির চেয়ারে শরীর হেলিয়ে বসে আছে রুয়াত। চারপাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই মধ্যেই সন্ধ্যা নামবে। মৃদু বাতাস বইছে আশেপাশে।বিকেলে কিছু সময় ঘুমানোর পর রুয়াত সোজা ব্যালকনিতে আসে। নিমিও তার সাথে এসেছে এখানে। কিন্তু তার সেদিকে খেয়াল নেই। একদম নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। নিমি বার বার আড়চোখে তাকাচ্ছে। বেশ আগ্রহ নিয়ে রুয়াতের উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। নিমির এহেন কথায় আচমকা কেঁপে ওঠে রুয়াত। দ্রুত গতিতে তার দিকে তাকায়। আয়াজের সাথে কি হয়েছে এটা কি নিমি জানে? হঠাৎ এটাই বা জিগ্যেস করছে কেনো? শুষ্ক অধর জিহ্বা দ্বারা ভেজায়। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। অতঃপর স্বাভাবিক স্বরে বলে-

-‘এটা জিগ্যেস করার কারণ?’

ভ্রু কুচকে নিমি রুয়াতের দিকে তাকিয়ে আছে। এরকম অস্বাভাবিক আচরণ এ প্রথম প্রতিফলিত হয়েছে মেয়েটার মাঝে। যা আগে কখনো হয়নি। বা নিমির চোখে কখনোই ধরা পড়েনি। কি হলো হঠাৎ তার? গত কয়েকদিন ধরে রুয়াতের এরূপ আচরণ নিমির মোটেও ভালো লাগছে না। হাসিখুশি মেয়েটা হুট করে চুপ হয়ে যাওয়াটা একটু রহস্যজনক। এখন আবার কিছু জিগ্যেস করলেও বলে না। তাই আর নিমির সঠিক কারণটা জানা নেই। রুয়াতের কাঁধে হাত দিয়ে নিমি বললো,

-‘এই যে সারাদিন চুপচাপ থাকিস। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলিস না। আবার কারণ জিগ্যেস করলেও বলতে চাস না। তাই মনে হয়েছে যে ভাইয়ার সাথে তোর কিছু হয়েছে। গতবার যখন ওনার সঙ্গে কথা বন্ধ ছিলো তখন কারণ অন্তত বলেছিস। এবার কি হয়েছে সেটাও তো বলিসনি। তাই ধরে নিয়েছি ভাইয়ার সাথে তোর কিছু একটা হয়েছে। নাহয় ওনি তোকে এভাবে এড়িয়ে চলতো না। তা এজন্য তোর মন খারাপ তাইনা?’

রুয়াত বেশ কিছু সময় নিয়ে একটা কথা ভাবে। নিমির শেষের কথা একদম সত্য। আয়াজ তাকে এভাবে এড়িয়ে চলছে দেখেই তার খারাপ লাগছে। ভুল সবার হয়। তাই বলে এরকম ব্যবহার সত্যিই দুঃখজনক। রুয়াত কথা বলার জন্য এগিয়ে গেলে আয়াজ সে জায়গা প্রত্যাখান করে। সেখানে মেয়েটা আর কিইবা বলবে? একবার ক্ষমা চাওয়ার ও সুযোগ দিলো না। তার আগেই এড়িয়ে যায়। এসব কথা বাদ দেওয়ার জন্য রুয়াত বললো,

-‘আমার সেজন্য মন খারাপ না। অপ্রাসঙ্গিক কথা বাদ দে। ওনার ইচ্ছে হয়েছে তাই দেখলে এড়িয়ে যায়। আর মন খারাপ হলে কেনো এ কারণেই হতে হবে?’

-‘আচ্ছা বুঝলাম। তা তোর মন খারাপের কারণ কি? আমারও কিন্তু তোকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না।’

জোরপূর্বক রুয়াত হাসে। তখন তাকে বুঝ দেওয়ার জন্য মিথ্যে বলেছে। চায় না কারো সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে। আর শোনার পর বিশ্বাস ও করবে না। তাহলে বলে লাভ কোঁথায়? নিমির চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে রুয়াত বলে-

-‘শরীরটা খারাপ কয়েকদিন ধরে। এখন তাকিয়ে দেখ আমি হাসছি কিনা! নিচে চল। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। এখানে বসে থেকে আর কি করবো?’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় নিমি। আযান দিচ্ছে চারপাশে। রুয়াত আর নিমি নিচে না গিয়ে বরং ইনিমার রুমে যায়। সারাদিন ইনিমা রুম থেকে বের হয়নি। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গিয়েছে মেয়েটা। সে কারণে আর বের হওয়া হয়নি। যদিও নিমি দু তিনবারের মতো গিয়েছিল। কিন্তু রুয়াত একবারও যায়নি। তাই নিমি জোর করে ইনিমার রুমে নিয়ে আসে রুয়াত কে। দু দুবার ডাকার পর দরজা খোলা হয়। রুমে ঢুকতেই দেখে ইনিমার বিধ্বস্ত চেহেরা। রুমের মধ্যে প্রবেশ করে রুয়াত বললো,

-‘কি হয়েছে তোমার আপু?’

রুয়াতের এহেন কথায় ইনিমা বললো,
-‘তেমন কিছু হয়নি। বোস তোরা। আজ যে দু’জন একবারও আমার সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য আসলি না? কি ব্যাপার? নিমির রাগ করে থাকতে পারে। কারণ তাকে সেদিন আমি উল্টো পাল্টা কথা বলেছিলাম। কিন্তু সে তো তাও এসেছে। রুয়াত আসেনি কেনো তার আপুর রুমে? হু?’

সৌজন্যবোধক হাসি দিয়ে রুয়াত বলে-
-‘আমার ভালো লাগছিলো না দেখে আসিনি। একবার ভেবেছিলাম আসবো পরে বিকেলে ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণে আর আসতে পারিনি।’

-‘আচ্ছা। আমারও ভালো লাগছে না। আয় কিছুক্ষণ বসে বসে আড্ডা দিই। তাহলে একদম সবার আলসেমি কেঁটে যাবে।’

নিমি খুশি হয়ে যায়। যে জায়গায় সারাক্ষণ আড্ডা দেওয়া হবে সেখানে পুরো জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। সে মানা করলো না আর। তড়িঘড়ি করে বসে পড়ে। রুয়াত ও সায় দেয়। মন খারাপ নিয়ে থাকতে পারছে না। তার মনটা কে একটু ভালো করার প্রয়োজন। রুয়াত রাজি হয়ে গেলো। কথা বলার মাঝে চা দিতে এসে জেবাও কিছুক্ষণের জন্য তাদের আড্ডায় যোগ হয়। পরে মাহের চৌধুরী বাড়িতে আসার পর তিনি চলে যায়।

(*)

আয়াজ সায়হানের সাথে দেখা করেছে। যার কথা ফজলুল চৌধুরী বলেছিলো ইনিমার জন্য। ছেলেটা কে মোটামুটি তার ভালো লেগেছে। এক কথায় বলতে গেলে পছন্দ হয়েছে। নম্র, ভদ্র, কথাবার্তায় যথেষ্ট মাধুর্য রয়েছে। ছেলেটার সাথে দেখা করার আগে সর্বপ্রথম খোঁজ নেয় তার সম্পর্কে। কথাটি একবারও ফজলুল চৌধুরী কে জানায়নি। সবার অগোচরেই নিয়েছিলো। যেসব কথা প্রথমে শুনেছিলো সবগুলোই সত্যি। মন থেকে আয়াজ ও রাজি এই সম্মন্ধে। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে ফজলুল চৌধুরী এসব নিয়ে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে আছেন। প্রতিবারই আয়াজ নাকোচ করে দিয়েছে। একে তো তার কাজের চাপ, দ্বিতীয়ত খোঁজ খবর নিয়েছিলো ছেলেটার সম্পর্কে। রাতে বাসায় আসার পর পরই ফজলুল চৌধুরী আয়াজের রুমে বসে অপেক্ষা করছে। সাথে মায়া চৌধুরী ও আছে। আপাতত ফজলুল চৌধুরী জানতে চান আয়াজের পছন্দ হয়েছে কিনা। সবটা তার উপর নির্ভর করে। সে যদি বলে পছন্দ হয়নি তাহলে তারা আর এগোবে না। এখন আয়াজের কথাই সবকিছু।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে ফজলুল চৌধুরী আর মায়া চৌধুরী কে দেখে খানিকটা ভড়কে যায় আয়াজ। পরক্ষণেই মনে পড়ে তারা এখানে কেনো বসে অপেক্ষা করছে। মুহূর্তেই হেসে বললো,

-‘তোমাদের মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য এতো তাড়া? আমি মাত্রই বাসায় ফিরে ফ্রেশ হতে গেলাম আর তোমরা হাজির আমার রুমে।’

কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় ফজলুল চৌধুরী। তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,

-‘সেরকমটা নয়। তুমি কয়দিন ধরে আমাকে এক বিষয় নিয়ে ঘোরাচ্ছ সে খেয়াল আছে? আজ একটা সমাধান দিয়েই যাবে।’

-‘আমি কি সমাধান দিবো? বিয়েটা কি আমি দিবো নাকি? তোমাদের মেয়ে তোমরা যেটা বলো তাই হবে। এখানে আমি কিইবা বলবো?’

-‘তুমি ওর ভাই। সেদিন তুমিই তো বললে তোমার পছন্দ হলে এসব নিয়ে ভাবতে। তাই আমি ঠিক করেছি তোমার পছন্দ হলে তারপর ভাববো সব কিছু।’

উত্তর দেওয়ার জন্য কিছু সময় নেয় আয়াজ। যেহেতু ছেলেটা কে তার মোটামুটি পছন্দ হয়েছে তাহলে সেখানে এক বিষয় নিয়ে বারবার ঘোরানোর মানে হয় না। একবার তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

-‘আমার পছন্দ হয়েছে। পুরোপুরিই হয়েছে। তোমরা এবার এগোতে পারো।’

মায়া চৌধুরী খুশি হয়ে যায়। ফজলুল চৌধুরী ও বেশ খুশি হয়। অবশেষে তার ছেলের পছন্দ হয়েছে। তিনিও নিশ্চিত ছিলেন যে আয়াজের পছন্দ হবে কারণ ছেলেটা যথেষ্ট ভালো। কথাবার্তা, আচরণ, ব্যবহার সবকিছু।

-‘এখন কি ছেলের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিবে। নাকি আমি আবারও নিবো।’

আয়াজ পানি খাওয়া শেষ করে বললো,
-‘খোঁজ খবর সব নেওয়া শেষ। যা যা বলেছো সব সত্যি। এজন্যই এতদিন এসব নিয়ে কথা বলিনি। তুমি সবার সাথে আলাপ আলোচনা করে তারপর ওর পরিবার কে বাসায় আসতে বলো।’

প্রথম কথা শুনে ফজলুল চৌধুরী অবাক হয়ে যায়। তাকে না বলেই আয়াজ সব খবর নিয়ে ফেলেছে। যাক আয়াজের যে পছন্দ হয়েছে সেটাই বেশি। আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফজলুল চৌধুরী চলে যায়। শুধু রয়ে গেলেন মায়া চৌধুরী। ছেলের কাঁধে হাত দিয়ে চিন্তিত হয়ে বললেন,

-‘বাবা ইনিমাকে কে বোঝাবে?’

মায়া চৌধুরী কে আশ্বাস দেয় আয়াজ।
-‘আমি যাবো এখন ওর সাথে কথা বলতে। তুমি খাবার তৈরি করো। ওর সাথে কথা বলা শেষ করে এসে খাবো।’

আয়াজ চলে যায় ইনিমার রুমের উদ্দেশ্যে। মায়া চৌধুরী আয়াজের খাবার রেডি করতে গিয়েছে। ছেলের এরূপ কথায় কিছুটা হলেও ভরসা পান তিনি।

(*)

সোফায় আরাম করে বসে ফোন দেখছে ইনিমা। রুয়াত আর নিমি চলে যাওয়ার পর সে ফোন নিয়ে বসে। আয়াজ একবার চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করে। ইনিমার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। মাথায় হাত রাখে। আচমকা এমন হওয়াতে ভড়কে যায় ইনিমা।

-‘ভাইয়া তুমি?’

আয়াজ নিঃশব্দে হেসে বলে-
-‘ভয় পেয়েছিস?’

তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায় ইনিমা।
-‘সে তো একটু আধটু পেয়েছিলাম।’

সোফায় বসে আয়াজ আবারও ইনিমার হাত ধরে বসায়। বোনের কাঁধে হাত রেখে আহ্লাদী স্বরে বললো,

-‘চেহেরায় এ অবস্থা কেনো?’

-‘তেমন কিছু নয় ভাইয়া। কিছু বলতে এসেছিলে?’

-‘তা তো বলতে এসেছিলাম। আচ্ছা কথা বেশি বড় করার দরকার নেই। আমি সোজাসাপ্টাই বলে দিচ্ছি সব। বাবা যার কথা বলেছিলো তোর জন্য। মানে যার সাথে তোর বিয়ে নিয়ে কথা বলেছিলো। তার সাথে আমি দেখা করেছি।’

এইটুকু বলেই আয়াজ থেমে যায়। ইনিমার মুখের দিকে তাকায়। মেয়েটার মুখে কেমন জানি চিন্তার ছাপ। পরক্ষনে আয়াজ ইনিমার হাত ধরে বলে,

-‘ভাইয়া কে বিশ্বাস করিস? ভরসা করিস?’

দু দুবার মাথা ঝাঁকায় সে। তাই আয়াজ আর থেমে না থেকে বললো,
-‘ছেলেটা কে আমার পছন্দ হয়েছে। সবকিছুই ভালো। ছেলেটাও ভালো। এমনকি তোর ভাইয়ের থেকেও। তোর ব্যাপারে আমি অন্তত বা’জে সিদ্ধান্ত নিবো না। একটা মাত্র বোন বলে কথা। ছেলেটা খারাপ হলে আমি অবশ্যই সব মানা করে দিতাম। তোর মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ছেলেটা যে ভালো তা আমি জানলাম কিভাবে। এরকমটা ভাবছিস না? আসলে মানুষের ব্যবহারে তার আসল চরিত্র ফুঁটে ওঠে। তখন আমি বাবাকে এসব নিয়ে বলতে মানা করেছিলাম ছেলেটার সাথে আমার দেখা হয়নি। তার সম্পর্কে আমি নিজে কোনো খোঁজ খবর নেইনি। সেজন্য তখন মানা করেছিলাম। এখন সব জানার পর দেখার পর আমার ছেলেটা কে পছন্দ হয়েছে। আমিও চাই বিয়েটা হোক। আমি কখনো তোর খারাপ চাইনি। আজও চাইবো না। আর সবচেয়ে বড় কথা তোর পছন্দ হলেই তবে বিয়েটা হবে। কোনো কারণে যদি তোর পছন্দ না হয় তাহলে আমিই সবার আগে মানা করে দিবো। তুই এখন আর ছোট নেই। বড় হয়েছিস। যথেষ্ট বোধ, বুদ্ধি রয়েছে। কি জন্যে বলেছি বুঝেছিস।’

কোনো প্রকার না থেমে আয়াজ সম্পুর্ণ কথাগুলো শেষ করলো। এবার ইনিমার বলার সময়। খানিক সময় ইনিমা ভাবে। অতঃপর বলে উঠে,

-‘সমস্যা নেই। তোমরা যা বলবে তাই হবে। একটু আগেই তো বললে আমি এখন আর ছোট নেই। বড় হয়েছি। তাই এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা পাগলামো ছাড়া আর কিছুই হবে না। তুমি, মা, বাবা রাজি থাকলেই আমি রাজি।’

আয়াজ হতভম্ব হয়ে যায় ইনিমার কথা শুনে।
-‘তোকে এখন কেউ রাজি হতে বলেনি। আরেকটা কথা শুন কাল ও ছেলের বাড়ি থেকে আসবে তোকে দেখার জন্য। আজ মায়ের জায়গায় আমি কথাগুলো বলছি কারণ তুই নাকি আমায় ভরসা করিস। ধরে নিতে পারিস সেকারণেই আজ এগুলো বলা।’

ইনিমা নিঃশব্দে মাথা নাড়ায়। আয়াজ উঠে দাঁড়ায়। রুম থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হয়। ইনিমার মাথা নিচু করে থাকা দেখে আয়াজ আবারও বললো,

-‘খেতে যাবি না?’

-‘তুমি যাও। আমি পরে খাবো রুয়াত আর নিমির সাথে।’

আয়াজ আর কিছু না বলে চলে আসে সেখান থেকে। এখন তার বোন কথা গুলো বুঝতে পারলেই হলো।

(*)

সকাল সকাল সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে কাজে। ফজলুল চৌধুরী আর মাহের চৌধুরী তারা তাদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। বাড়িতে একটা আনন্দমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বাড়ির বড় মেয়ে কে দেখতে আসবে আজ। সে জন্য কেউ আর আজ কাজে যায়নি। এমনকি আয়াজ ও না। ফজলুল চৌধুরী মানা করেছেন যাতে আয়াজ আজ কোঁথাও না যায়। কিন্তু তার যে কয়েক শত কাজ পড়ে আছে। তাই আয়াজ তার দলের কয়েকজন লোক কে বাসায় আসতে বলেছে। বাসায় তেমন কাউকে আয়াজ আসার অনুমতি দেয় না। যেহেতু তার শত্রুর অভাব নেই। কে আবার কোন সুযোগে কি করে ফেলে সেটা ভেবেই আয়াজ তার বাসায় কাউকে এলাউ করে না। আয়াজের সে রুমে সবাই বসে আছে। যেখানে সব পলিটিক্যাল কাজ করে থাকে। সেখানেই সবাই বসে বসে আয়াজের কথা শুনছে। আর কাজ করছে যে যার মতো।

রান্নাঘরে মায়া চৌধুরী কে জেবা আর মেহরুবা সাহায্য করছে। তারা দুপুরের মধ্যেই এসে পড়বে। কারণ ফজলুল চৌধুরী তাদের দুপুরে দাওয়াত দিয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে রুয়াত আর নিমি এসে একটু আধটু হেল্প করে আবার ইনিমার কাছে চলে যায়। কাটাকুটি জেবা আর মেহরুবা করছে। রান্নাবান্না একা হাতেই মায়া চৌধুরী সামলাচ্ছে।

রুয়াত নিচে আসে তার মায়ের কাছে। হঠাৎ কেউ একজন সামনে এসে বললো,

-‘ম্যাম ওয়াশরুমটা কোনদিকে?’

ভড়কে যায় রুয়াত। আচমকা এরকম একটা কথা কেউ একজন সামনে এসে বলবে মোটেও আশা করেনি সে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। হুট করে আরহাম এসে বললো,

-‘সোজা গেলেই ওয়াশরুমটা পেয়ে যাবেন ভাইয়া।’

লোকটা হেসে সেদিকে পা বাড়ায়। আরহাম রুয়াতের উদ্দেশ্যে বলে,
-‘তুমি ভয় পেয়েছো ঠিক না? আরে আয়াজ ভাইয়ের দলের কয়েকজন লোক বাসায় এসেছিল। ওনিই তাদের মধ্যে একজন। আর ওনার নাম প্রিতম।’

আরহামের কথাশুনে রুয়াত স্বস্তিবোধ করে। এতক্ষণ সাহেদ বসে বসে সব দেখছিলো। আজকেই স্যারের কানে লাগাবে কথাটা। এ বাড়িতে আসলে প্রিতমের হাবভাব সুবিধাজনক লাগে না তার কাছে। এ কথা জলদি জানাতে হবে আয়াজ কে।

.

-‘শুনো প্রিতম তোমার স্বভাব চরিত্রে একটু পরিবর্তন আনা দরকার। হয় সেটা করবে নাহয় আমার দলের হয়ে তোমার কাজ করার দরকার নেই। একদম হাসিমুখে বিদায় দিবো।’

আয়াজের এহেন কথায় প্রিতম অবাক হয়ে যায়। সে আবার কি করলো বুঝে উঠতে পারছে না। পাশেই সাহেদ কে এভাবে গোমড়ামুখে বসে থাকতে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুচকায়। আয়াজ আবারও বললো,

-‘তোমাদের স্যারের হবু বউয়ের উপর চোখ তুলে তাকানো একদম নিষিদ্ধ। আর সে হচ্ছে রুয়াত। লাস্ট একবার যদি দেখি তুমি তাকিয়েছো তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না প্রিতম। এবারের মতো তোমায় ক্ষমা করে দিলাম।

এখন বুঝলো আয়াজ ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছে। কিন্তু তার এরকম কোনো ভাবনা কাজ করেনি। সে তো ওয়াশরুম কোঁথায় সেটার কথা বলেছিলো। মাথা নিচু করে প্রিতম নিঃশ্বাস ছাড়ে। শুধু কথাগুলো শুনেই গেলো। কিছু বললো না। তবে তার সন্দেহ হচ্ছে সাহেদের উপর। কারণ সে যখন উঠে এসেছিল তখন আয়াজ ছিলো না। আরও কয়েকবার ও সাহেদ এসব বলে অনেক কথা শুনিয়েছিল আয়াজ কে দিয়ে। এবার ও প্রিতম সাহেদ কেই সন্দেহ করছে। কারণ সাহেদ ছাড়া আর কেউ অন্তত তার নামে আয়াজের কাছে কিছু বলে না।

(*)

ইনিমা কে দেখতে আসে বিকেলের দিকে। যদিও বলেছে দুপুরে আসবে কিন্তু হঠাৎ তাদের কিছু সমস্যা হয়ে যাওয়ার কারণে আর আসতে পারেনি। লিভিং রুমে সবার কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ফজলুল চৌধুরী আর মাহের চৌধুরী কথা বলছেন৷ ইনিমা কে রুয়াত আর নিমি মিলে সাজিয়ে দিয়েছে। মায়া চৌধুরী একবার ইনিমা কে গিয়ে শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে এসেছেন। আয়াজ মাত্রই সবাই কে বিদায় দিয়ে এসে বসেছে। শুধুমাত্র ছেলের মামা আর তার বাবা ছাড়া আর কেউই আসেনি। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার ইনিমা কে নিয়ে আসা হয়। সবার মোটামুটি পছন্দ হয়েছে ইনিমা কে। সায়হানের মামা আতিফ আহমেদ বলে উঠে,

-‘ফজলুল সাহেব আমাদের মনেহয় ছেলে মেয়ে দু’জন কে আলাদা কথা বলতে দেওয়া দরকার। তারপর নাহয় আমরা সিদ্ধান্ত নিবো।’

ফজলুল চৌধুরী মাথা নেড়ে সায় দেয়। আয়াজ ইনিমা কে উঠিয়ে নিয়ে যায়। পেছন পেছন সায়হান ও আসে। তাদের দু’জন কে এক রুমে দিয়ে আয়াজ চলে যায়। এতক্ষণ পর রুয়াত আর নিমি একটু কথা শোনার জন্য দরজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত তারা কিছু শুনতে পাচ্ছে না। এক প্রকার অযথা দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ বিরক্ত লাগছে তাদের।

পিনপতন নীরবতা অবলম্বন করছে দু’জন। অবশেষে বেশ সাহস নিয়ে মুখ খুলে সায়হান।

-‘আমি সায়হান তালুকদার।’

ইনিমা নিশ্চুপ। সায়হান ফের বলে,
-‘আমি কি চলে যাবো? আপনি অস্বস্তিবোধ করলে বলতে পারেন।’

এবার ইনিমা চুপ না থেকে বললো,
-‘জ্বী। আমি ইনিমা ত্বায়ীম চৌধুরী।’

নরম স্বরের মেয়েলী কন্ঠে সায়হান হেসে দিলো নিঃশব্দে। যদিও এখনো মাথা তুলে তাকায়নি। তখন যা একটু নজর পড়েছিলো।

-‘নামটা সুন্দর ভীষণ। আমায় আপনি চেনেন না। আমিও আপনাকে চিনিনা। আর হুট করে জীবন নিয়ে এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও কষ্ট সাধ্যকর। প্রতিটি মানুষের তার জীবন নিয়ে আলাদা স্বপ্ন থাকে। আপনার ও আছে নিশ্চয়?’

-‘জ্বী।’

-‘আচ্ছা এসব ব্যাপারে সবার নিজস্ব মতামত থাকে। আমি আমারটা নাহয় পরেই বললাম। আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি। সম্পুর্ণটা আপনার উপর নির্ভর করছে। ইচ্ছেমতো যেকোনো কিছু একটা বলুন।’

ইনিমা নাক টানে বারবার। শর্দি লেগেছে। সায়হান পকেট থেকে টিস্যু বের ইনিমার সামনে রাখে। স্বাভাবিক স্বরে বলে উঠে,

-‘টিস্যুটা নিন।’

ইনিমা টিস্যু হাতে নিলো। নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
-‘আপনি আমার ইচ্ছেমতো একটা কিছু বলতে বলছেন। আমি হ্যাঁ বলছি।’

সায়হান কিছুটা অবাক হয়। এত তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে গেলো? ব্যাপারটা কেমন ঘোলাটে লাগলো তার কাছে। অতঃপর বললো,

-‘পরিবারের চাপে পড়ে রাজি হয়ে গেলেন?’

-‘আমাকে আগেই বলা হয়েছে সম্পূর্ণটা আমার উপর নির্ভর করছে। আমি না বলার সাথে সাথে প্রস্তাব থেকে দূরে সরে আসা হবে। আর আমি এখনো বাচ্চা মেয়ে নই যে পরিবারের চাপে পড়ে রাজি হয়ে যাবো। আমার পরিবার ও এমন নয় এসব বিষয়ে চাপ দিবে। এখানে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।’

কিঞ্চিৎ হাসে সায়হান। মেয়েটার কথা অসম্ভব সুন্দর। কি সুন্দর করে কথাগুলো বললো। ফের সায়হান বললো,

-‘তাহলে আমি কি ধরে নিবো আপনি রাজি?’

-‘জ্বী।’

-‘আচ্ছা তাহলে উঠছি। ভালো থাকবেন। নিজের প্রতি যত্নবান হবেন। আসছি।’

হাসিমুখে সায়হান বেরিয়ে যায়। উত্তর পেয়ে গিয়েছে। সায়হান যাওয়ার পর বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ে ইনিমা। লোকটার দিকে বারবার অগোচরে তাকাচ্ছিলো। কারো কথায় ভুল ছিলো না। যেমনটি বলেছিলো ঠিক সেরকম। তাই ইনিমা আর না বলেনি।
ইনিমা আর সায়হানের পুরো কথা শোনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এ সপ্তাহের মধ্যেই তাদের বাগদান সম্পন্ন করা হবে। পরিবারের সবাই এই সংবাদে ভীষণ খুশি।

(*)

ছাদের রেলিং ধরে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে আয়াজ। পেছন থেকে কেউ ধীর পায়ে হেঁটে আসছে। তা উপলব্ধি করতে পারলেও একবারও পেছনে ফিরে চাইলো না। হঠাৎ হাঁটা বন্ধ হয়ে যায়। আমতা আমতা করে কেউ বলে উঠে,

-‘শুনছেন?’

তৎক্ষনাত আয়াজ পেছনে তাকায়। রুয়াত কে দেখে বেশ অবাক হয়। ঘড়িতে এখন ন’টা বাজে। কিন্তু এখন এই মুহুর্তে রুয়াত এখানে? পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই রুয়াত আবার বললো,

-‘যাবেন না। আমার কিছু কথা বলার আছে। না শুনে দয়া করে চলে যাবেন না।’

-‘বলো কি বলবে।’

ইষৎ কেঁপে ওঠে রুয়াতের। তবুও নিজেকে স্বাভবিক করে বললো,
-‘আমাকে ক্ষমা করা যায় না এমপি সাহেব?’

-‘ক্ষমা চাচ্ছো কিসের জন্য?’

-‘সেদিন না বুঝে আপনাকে দোষ দিয়েছিলাম।’

শান্ত স্বরে আয়াজ বলে,
-‘খু’নিদের কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে হয় না।’

অধর কামড়ে রুয়াত কান্না থামানোর চেষ্টা করে। তার নিজেরই আর সহ্য হচ্ছে না এ শব্দটা।

-‘এ শব্দ আর উচ্চারণ করবেন না।’

-‘তুমিই সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেছো। তা কান্না আসছে কেনো তোমার?’

মাথা নিচু করে রুয়াত এবার সত্যি সত্যিই কেঁদে দেয়। যা দেখে আয়াজের হৃদয় আহত হয়। মন চাচ্ছে এখনই বলে দিতে তোমায় আমি ক্ষমা করে দিয়েছি প্রেয়সী। চেয়েও প্রেয়সীর প্রতি কঠিন হতে পারছে না। নিজেকে দেওয়া কথা রাখতে পারছে না। তবুও নিজেকে শক্ত করলো। কন্ঠে গম্ভীরতা এনে বললো,

-‘নিচে চলে যাও তুমি। খারাপ ভাববে কেউ দেখলে। এক কথা দ্বিতীয়বার বলবো না কিন্তু।’

মুলত প্রেয়সীর কান্না থামানোর জন্য আয়াজ এটা বলে। রুয়াত চোখ মুছে নিজেকে শান্ত করে। হাঁ করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আয়াজ আবারও বলে,

-‘তোমাকে আমি বলেছি নিচে চলে যেতে। আমার মতো মানুষের সাথে কথা বলতে নেই।’

রুয়াত আর দাঁড়ালো না বরং নিচে চলে আসলো পুরো কথা না শুনে। মেহরুবা ডেকে বেড়াচ্ছে রুয়াত কে। মায়ের এমন চিৎকার শুনে রুয়াত আর দেরি না করে চলে আসে। আয়াজ আবার উল্টো ঘুরে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,

-‘তোমাকে দেওয়া কষ্ট সইতে পারছি না ভেবেছো কিভাবে তোমার কান্না সহ্য করবো? ভেবেছিলাম নিজের ভুল বুঝবে কিন্তু তা না উল্টো এসে আমার সামনে কেঁদে দিলে? তোমার এমন কষ্টের মুহূর্তের প্রহর শেষ হয়ে যাচ্ছে। সুখময় মুহূর্ত ঘনিয়ে আসছে প্রেয়সী।’

#চলবে…

[আসসালামু আলাইকুম। কালকে গল্প না দেওয়ার কারণ জানিয়েছি। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের কথায় ভীষণ কষ্ট লেগেছে। যাই হোক সেসব বাদ দিলাম। এখন অনেকেই আজকের পর্ব পড়ে বলবে ইনিমা আর আরহামের মিল হবে না? না তাদের মিল নেই। যেহেতু আরহাম ইনিমার থেকে ছোট। তাই তাদের এই সিজনে মিল নেই। আশাকরি ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়েছে। সবার জন্য সারপ্রাইজ পর্ব অপেক্ষা করছে। বেশি বেশি রেসপন্স করার অনুরোধ রইলো। ভুলত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here