#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
৩৪.
মধু লেহেঙ্গা পড়ে আছে সেই বারোটা থেকে। গোসল করে বেরিয়ে আর মুখে একটু কিছু দেওয়ার সময় ও পায়নি। চুলটাও মুছার সময় পায়নি তারপর কত কিছুর সম্মুখীন হতে হলো। ফুয়াদের সাথে দেখা হতেই সে ওকে নিয়ে রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে আসে তারপর শুরু হয় এদিকে ওদিকে ঘোরাঘুরি। জাহানারা বেগম যিনি নাঈম ভাইয়ের আপন ফুপি তিনি ওকে চিনে। ওর বাবার পরিচিত। তার মাধ্যমে ওর ভাইয়ের কাছে খবর চলে গেছে। ভাই আসছে ওকে নিতে সেই খবর ফুয়াদের কাছে কিভাবে গিয়েছে মধু জানে না। কিন্তু ফুয়াদ এই খবর ওকে দিয়েছে। ও জিজ্ঞেস করেছিল আপনি এসব জানলেন কি করে? ফুয়াদ শুধু রহস্যময় হাসি দিয়েছে।
বিয়ে থেকে এনে ফুয়াদ ওকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিল লাঞ্চ করাতে। মধু খিদের জ্বালায় খেয়েছে কিন্তু আফসোস ও কম করেনি। বিয়ে বাড়ির খাবার রেখে বাইরে খাচ্ছে। ফুয়াদ ওর আফসোস দেখে রেস্টুরেন্টে থেকে বিয়ের সব আইটেম অর্ডার করে দিয়েছিল। মধু কিচ্ছুটি মুখে নেয় নি। মুখ ভেংচি কেটে শুধু পাস্তা খেয়েছে।
মধু বসে আছে হোটেল রুমে। ওর পরনে লেহেঙ্গা। চুল রাবার দিয়ে আটকে রাখা। এই লেহেঙ্গা পরে থাকতেও এখন রাগ লাগছে। শরীর চুলকাচ্ছে। ওরনা বিছানায় ফেলে মধু রুমে আয়নার সামনের দাঁড়াল। ওর মুখের অবস্থা বাজে হয়ে আছে। কেমন রুক্ষ দেখাচ্ছে। সারা দিন মুখে কিছু দিতে পারেনি। খালি পাগলের মতো ফুয়াদের সাথে ঘুরেছে। এমন পাগল বেসে দুনিয়া ঘুরে এল। সব ফুয়াদের জন্য হয়েছে। ওর উপর মধুর রাগ বাড়ল। ও ফোন হাতে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল। ফোনটা তাও আনা হয়েছিল ফুয়াদ মধু কে নিয়ে যখন বিয়ে থেকে প্রস্থান করবে তখন মধু ফুয়াদ কে বলেছিল,” রুম থেকে আমার ফোন নিয়ে আসুন নয়তো আমি কোথাও যাব না।” ফুয়াদ মধুর কথা শুনে আবার ফিরে গিয়ে ফোন নিয়ে এসেছিল। মধু নিজের কথা ফুয়াদ কে শুনাতে পেরে ওর সাহস বেড়ে গিয়েছিল।
মধু দরজা খোলার আগেই ওর দরজায় নক পড়ল। ও দরজা না খুলে বলল,,” কে?”
ফুয়াদ বলে উঠল,,” আমি দরজা খোলো।”
মধু দরজা খুলে কোমরে হাত রেখে বলল,” জোর করে ধরে নিয়ে আসলেন। এখন আমি এই ড্রেস পরে রাত পার করব কি করে? এভাবে থাকা যায়? সারা দিন পাগলের বেসে ঘুরলাম ছিহ”
চোখ মুখ বিকৃত ভাব করে বলল মধু। ফুয়াদ ওর দিকে একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলল,,” এখানে ড্রেস আছে চেঞ্জ করে নাও।”
মধু ব্যাগ হাতে নিয়ে সন্দেহ চোখে তাকিয়ে বলল,,” আপনি এখানে ড্রেস কোথায় পেলেন?”
” উড়ে আসে নাই। পাশেই শপিং মল আছে সেখানে থেকে নিয়ে আসলাম।”
” পাশেই শপিং মল আছে জানেন যেহেতু আমাকে নিয়ে গেলেন না কেন? আমার ড্রেস আমি চুজ করে আনতাম। আপনার পছন্দ আমার কি ভালো লাগবে নেব না এটা আমি।”
বলেই শপিং ব্যাগ ফেরত দিতে উদ্যত হয় মধু। ফুয়াদ ওর হাত থেকে ব্যাগ না নিয়ে বলল,,” তোমার কাছে টাকা আছে?”
মধুর আওয়াজ নিভল। ওর কাছে তো টাকা নাই। কেমন বদমাইশ লোক। টাকার খোটা দিচ্ছে।
” টাকা আনার মতো পরিস্থিতি রাখছিলেন? কীভাবে ধরে আনছেন মনে নাই?”
” ওভাবে নিয়ে না আসলে এখন নিজের পৈত্রিক বাড়িতে থাকতে।” চড়াও গলায় বলল ফুয়াদ।
মধু বলল,” নিচ্ছি আপনার ড্রেস এটার টাকাও দিয়ে দেব। আমি মধু কারো জিনিস নেয় না।”
” আমার অনেক জিনিস নিয়েছ সব ফেরত দাও।”
মধু আশ্চর্যজনক কন্ঠে বলল,” আমি আপনার কি নিয়েছি?”
ফুয়াদ বলল,,” আমার মন চুরি করেছ।”
” ফাউল কথা বলবেন না। অসহ্য।”
বলেই ফুয়াদের মুখের উপর ধরাম করে দরজা আটকে দেয় মধু।
ফুয়াদ ওর বন্ধ দরজায় টোকা দিয়ে বলে,,” ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসো খেতে যাব।”
মধু কিছু না বলেই শপিং ব্যাগ খুলতে লাগে। ড্রেস বের করে বাথরুমে চলে যায় গোসল করে
ড্রেস পরিবর্তন করে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। ড্রেসটা এতোটা ফিটিং কিভাবে হলো ওর গায়ে? ও হতভম্ব হয়ে দেখছে। ও নিজে কখনো এতোটা ফিটিং করে জামা কিনতে পারে না। কিন্তু ফুয়াদ ওর মাপ জানল কি করে?
চিন্তিত মুখে চুল আঁচড়ে নেয় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। এখানে চিরুনি ছিল।
মধু দরজা খুলে বাইরে আসতেই একটা অপরিচিত লোকের সাথে ঠাস করে ধাক্কা খায়। লোকটা ওর দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল ও বের হতেই তার সাথে ধাক্কা খেয়েছে। ও কাঁধে হাত চেপে বিরক্তিকর চোখে তাকায় লোকটার দিকে। লোকটা আচমকা ওকে বের হতে দেখে ভয় পেয়ে গেছে হয়তো। লোকটা কেমন ভয়ার্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মধু কিছু বলবে লোকটা দ্রুত বেগে চলে যায়। মধু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে লোকটার যাওয়ার দিকে।
ফুয়াদ দরজা খুলে তখনি বাইরে আসে। আর মধুকে ভ্যাবলার মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে। ওর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,,”কি হয়েছে? এমন স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
মধু ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,,” কিছু বললেন?”
” কোন ধ্যানে থাকো?”
” একটা লোকের।”
ফুয়াদ কপাল কুঁচকে বলল,,” মানে কোন লোকের?”
” আমার রুমে উঁকি দিচ্ছিল হয়তো। আমি বের হতেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে পালালো।”
ফুয়াদ রাগী কন্ঠে বলল,,” কার এতো বড়ো স্পর্ধা তোমাকে ধাক্কা দেয়।”
মধু ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলল,,” ঢং চলেন খেয়ে আসি। খিদে পেয়েছে। রাহী আপুর বিয়ের রোস্ট তো খেতেই পারলাম না।”
” কে ছিল লোকটা বলো। সন্দেহ জনক কেউ?”
” উফফ আমি চিনি নাকি তাকে?” বিরক্তিকর কন্ঠে বলল মধু।
ফুয়াদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,” তুমি ওতো খাওয়ুনি দেখে তো মনে হয় না। অথচ আসার পথ থেকে শুধু খেতে পারলে না সেই আফসোস করে যাচ্ছ।”
মধু ওকে ভেংচি কেটে বলল,,” করব না আপনার জন্য আমি রাহী আপুর বিয়ে, বিদায় কিছুই দেখতে পারলাম না।”
” নিজের বিয়ে বিদায় দেখতে পারবে, খেতেও পারবে এটা ভেবে শান্ত হও। কান্না করো না।”
“আমি কান্না কোথায় করছি?” অবাক গলায় বলল মধু।
ফুয়াদ বলল,,” সরাসরি না কাঁদলেও ভেতরে ভেতরে কেঁদে বন্যা করে ফেলছো।”
” আপনি আমার ভেতরে দেখতে পারছেন মনে হয়।”
” দেখতে না পারলেও অনুভব করতে পারছি। যাইহোক ভালোবাসার মানুষ বলে কথা। এতো টুকু না বুঝলে কি হয় নাকি।”
মধু দাঁত কিড়মিড় করে বলল,” খেতে চলুন।”
ফুয়াদ আর মধু হোটেলে রেস্টুরেন্টে আসলো। খাবার অর্ডার দিয়ে বসে আছে। দুজনের হাতে দুটো ফোন। এদিকে অজ্ঞতা ব্যক্তি কিচেনে গিয়ে ফুয়াদের অর্ডার করা খাবারে ডিংক্স মিশিয়ে দিল। তার ইচ্ছে ফুয়াদ কে নেশাক্ত করে মধু কে অপহরণ করা। সে নিজের কাজ করেই শয়তানি হাসি হাসল। সার্ভেন্ট কে এক ব্যান্ডেল টাকা দিয়ে দিল সে ও টাকা পেয়ে লাফাতে লাফাতে খাবার নিয়ে চলে এল। মধু ফোন টিপতে টিপতে ফুয়াদের দিকে আড়চোখে তাকাল। ফুয়াদ ফট করেই মধু কে টেনে নিজের কাছে এনে জড়িয়ে ধরল দুজনের গাল এক করে। মধু নাক মুখ কুঁচকে টেরা চোখে ফুয়াদের দিকে তাকাল। ফুয়াদ ধরেই ফোন উঁচু করে একটা নয় দুইটা সেলফি নিল।
অতঃপর মধু কে ছেড়ে দিল ফুয়াদ। মধু গালে হাত দিয়ে ঘষে ওর দিকে রক্তচক্ষু করে তাকাল।
” এসব কি ধরনের অসভ্যতা?”
” সেলফি নিলাম। দেখো কি কিউট লাগছে।”
বলেই ফুয়াদ ছবিটা ওকে দেখাল। মধু দেখল ফুয়াদ ছবিটা তুলেই ওয়ালপেপার করে দিয়েছে। ও চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,” কাটেন আমার ছবি।”
” সরি সুইটহার্ট কাটার জন্য তো তুলি নাই।”
মধু দাঁত কিড়মিড় করে উঠে দাঁড়াল আর রাগে গজগজ করতে লাগল। ফুয়াদ ওর হাত ধরে টেনে বসিয়ে বলল,” না খেয়েই উঠছ কেন?”
মধু রাগে ফুঁসতে লাগল বসে। খাবার দিয়ে গেল তখনি। ফুয়াদের খাবার আগে দিয়ে গেল। মধু শয়তানি হাসি দিয়ে তাকাল খাবারের দিকে। ফুয়াদ খাবার টেনে ও খেতে লাগল। ফুয়াদ অবাক কন্ঠে বলল,,” এটা আমার খাবার।”
মধু রাক্ষুসীর মতো খেতে খেতে বলল,,” আপনি আমারটা খান।”
মধুর খাবার ও চলে আসছে।
ফুয়াদ ওর খাবারে দিকে তাকিয়ে বলল,,” আমি এসব খাই না।”
ফুয়াদ এসব খায় না জানে মধু তাইতো ইচ্ছে করে এই কাজ করেছে। ফুয়াদ মধুর খাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,,” মধু আস্তে খাও।”
” আপনি খাওয়া বাদ দিয়ে আমার খাওয়ার দিকে নজর দিচ্ছেন কেন?”
ফুয়াদ চোখ বড়ো করে বলল,,” আমি তোমার খাবারে নজর দিচ্ছি?”
” হ্যা।”
এদিকে ডিংক্স মেশানো লোকটা ফুয়াদের খাবার মধুকে খেতে দেখে টেনশনে পড়ে গেল।
মধু খাবার খেতে খেতে অদ্ভুত ভঙ্গিতেই হেসে ফুয়াদের দিকে তাকাল। ফুয়াদ অনিচ্ছা সত্ত্বেও মধুর অর্ডার করা খাবার একটু মুখে দিচ্ছিল সেই মুহূর্তেই মধুর আজব মার্কা হাসি দেখে ফুয়াদ চমকে তাকাল ওর দিকে।
পফুয়াদ মধু কে উদ্দেশ্য করে বলল,,” কি হয়েছে আজব বিহেভ করছো কেন? খাবার মাঝে কেউ এমন করে হাসে?”
মধু বলল,,” আপনার খাওয়া দেখে হাসি পাচ্ছে।”
” কেন আমার খাওয়ায় কি হলো?”
” কিছু না।”
বলেই মধু নিজের খাওয়ায় মনোযোগী হয়ে উঠল। খাওয়া শেষ করে হতেই ওর মাথা ঘুরাতে লাগল। ও সব কিছুই ডাবল দেখতে লাগল। ও চোখ বড়ো করে তাকাল ফুয়াদের দিকে। দেখল ফুয়াদ খাবার মুখে দিতে হা করছে ওর মুখ দুটো দেখা যাচ্ছে। হা ও দুটো দেখা যাচ্ছে। ওর কেন জানি এটা দেখে আরো হাসি পেল ও মাথা ঝুঁকিয়ে টেবিলে কপাল ঠেকিয়ে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে আবার হেসে উঠল।
খাওয়ার পর মধু কে মাথা টেবিলে ঠেকাতে দেখে ফুয়াদ ভাবল ওর হয়তো বেশি খাওয়া হয়েছে তাই এমন করছে। কিন্তু ওর দিকে চোখ গোল গোল করে চেয়ে হাসতে দেখে ওর সন্দেহ হলো। ফুয়াদ ওর চাহনি দেখে খেতে পারছে না।
ফুয়াদ মধুর দিকে ঝুঁকে বলল,,” পেট ব্যথা করছে নাকি?”
মধু মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো।
” এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
মধু চোখ কচলে কচলে তাকাচ্ছে। মাথা সোজা চারপাশে তাকাল সব কিছুই দুটো লাগছে ও চোখ বন্ধ করে খুলল। মাথা কেমন ঘুরাচ্ছে। ও কপাল চেপে ধরে চোখ খিচে বন্ধ করল। ফুয়াদ মধুর কান্ড কারখানা দেখছে। আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না।
#চলবে……