প্রেয়সী পর্ব ২৫

0
709

#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
২৫.

ফুয়াদ হন্তদন্ত হয়ে মধুর রুমে আসতেই সমুদ্র উঠে দাঁড়ায়। মধু এখনো নিজেকে সামলাতে পারেনি। প্রচুর ভয় পেয়ে আছে। ওর পাশেই বসে আছে তিন্নি আর রাহী। মিতুল পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বিরক্তিকর মুখ করে। ফুয়াদ এসে মধুকে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে? মধু কোন সারা শব্দ করল না। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে র‌ইল। প্রয়োজনে কথা না বললে মেজাজ খারাপ হ‌ওয়াটাই স্বাভাবিক ফুয়াদ মধুর নিরবতা দেখে রেগে গেল। কিন্তু নিজের রাগ প্রকাশ করতে চাইল না ‌ তাই যেভাবে হন্তদন্ত হয়ে এসেছিল সেভাবেই রুম ত্যাগ করল। যাতে রাগ দেখানো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে। যাওয়ার আগে সমুদ্র কে ইশারা করে গেল কিছু।
ফুয়াদ এসে আবার চলে যাওয়াতে মিতুল খুশিতে বাকবাকুম করে উঠল। তাড়াতাড়ি ফুয়াদের পেছনে পা বাড়াল।
সমুদ্র আবার মধুর পাশে বসে ঠান্ডা গলায় বলল,,” মধু!”
মধু সমুদ্রের দিকে তাকাল। মধু সমুদ্রের প্রশ্ন জানে। এতোক্ষণ অনেক বার করেছে এক‌ই প্রশ্ন কিন্তু মধু বলতে পারে নি। ওর মনে ভয় জেগেছে যদি সব জেনে ভাইয়ার হাতে তুলে দেয় ওকে।
মধু বলল,,” আমরা বাসায় ফিরে যাব কবে?”
সমুদ্র কপাল কুঁচকে বলল,,” ফিরে যেতে চাইছ নাকি?”
” হুম কয়েকদিন চলে গেল। আর ভালো লাগছে না।”
” ঠিক আছে। কিন্তু নিচে তুমি…!”
মধু সমুদ্রের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,,” আপনারা কি ব্রেকফাস্ট করেছেন? আমার খুব খিদে পেয়েছে।”
সমুদ্র একটা লম্বা শ্বাস ফেলে তাকিয়ে র‌ইল মধুর ভীত মুখের দিকে। মধু ওকে কিছুই বলবে না ও বুঝতে পারছে। তাই ওকে এরিয়ে যাচ্ছে কথায়। সমুদ্র মধুর দিকে তাকিয়ে থেকেই উঠে দাঁড়াল।
” আমাদের কারো খাওয়া হয়নি। নিজেকে শান্ত করে বাইরে আসো এখন সবাই খেতে যাব।”
মধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। সমুদ্র বেরিয়ে গেল। তিন্নি এবার চেপে ধরল মধু কে। মধু আগে হলে হয়তো সব বলতো কিন্তু এখন বলল না। তিন্নি অসহায় মুখ করে তাকিয়ে থেকে ওকে নিয়ে বাইরে এল।

খাবার টেবিলে বসেও মধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে বারবার। তাড়াতাড়ি খাওয়ার চেষ্টা করছে। বেশি তাড়াতাড়ি করতে গিয়েই গলায় আটকে ফেলল খাবার। গলায় খাবার আটকে চোখ উল্টিয়ে ফেলল। টেবিলের সবাই খাওয়া বাদ দিয়ে চমকে উঠে মধুর অবস্থা দেখে। ফুয়াদ এতোক্ষণ মধুর কান্ড কারখানা দেখছিল। বারবার ওর ভীতু চাহনি এদিক ওদিক ঘুরছিল। ও ওকেই লক্ষ্য করছিল। আচমকা এমনটা হ‌ওয়ায় ও নিজেও চমকে উঠে। উঠে যে মধু কে ধরবে সেই চিন্তা ও নাই হতবুদ্ধি চোখে তাকিয়ে আছে মধুর বেক্কেল পনা দেখে। রাহী মধুর গলায় মালিশ করে দিচ্ছে। তিন্নি ওকে পানি খাইয়ে দিল। মধু এক ঢোক পানি খেয়ে গলায় হাত চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে র‌ইল।
মধু আর কিছুই খেল না উঠে চলে গেল ফুয়াদ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজেও পিছু নিল।
মধু গলার ওরনা খুলে মাথা ও মুখ ঢেকে দ্রুত রুমে যাচ্ছে। ও এগিয়ে এসে পেছনে থেকে মধুর হাত চেপে ধরে সিঁড়ির গোড়ায় থামিয়ে দিল। মধু যেন কারেন্টের শক খেল এমন করে আঁতকে উঠল।
ফুয়াদ মধুর হাত ধরতেই ওর ভয় পাওয়া টের পেয়ে গেছে। ও মধুর সামনে এসে দাড়িয়ে বলল,,” আমি, এতো ভয় পাচ্ছ কেন?”
মধু শুকনো ঢোক গিলে বলল,,” আপনি আমার পিছু নিয়েছেন কেন?”
” পিছু নিলাম কোথায়? আমি তো তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
” হাত ছাড়ুন।” হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল মধু।
মধুর হাত মোচড়ানো দেখে ফুয়াদ আরো শক্ত করে ধরল।
” আগে এ্যান্সার দাও‌। ভয় পেলে কেন?”
মধু হাতের ব্যথায় কান্না করে দিল। এর আগেও একবার ফুয়াদ এমন শক্ত করে হাত ধরে ব্যথা করে দিয়েছিল। মধুর ফট করেই সেই কথাটা মনে পরে গেল!
ও কটমট চোখে তাকাল ফুয়াদের দিকে আর বলল দাঁতে দাঁত চেপে,,” আপনার আর কত রুপ দেখতে হবে বলেন তো?”
ফুয়াদ ভ্রু কুটি করে বলল,,” মানে?”
মধু বলল,,” আপনি তো গিরগিটির থেকে দ্রুত রং বদলান।”
” সব রুপ বদলালেও ভালোবাসার রুপ এক‌ই‌।”
বলেই ফুয়াদ চোখ টিপল।
” হাত ছাড়ুন ব্যথা পাচ্ছি।” কঠিন মুখ বজায় রেখেই বলল মধু।
ফুয়াদ ওর চোখ ভর্তি পানির দিকে চেয়ে বলল,,” অশ্রুসিক্ত নয়ন, রাগান্বিত মুখশ্রী এক সাথে দুই রুপ বজায় রাখছো। দারুন তো আই এ্যাম ইমপ্রেস।”
হার মেনে মধু অসহায় মুখ করে ফেলল।
ফুয়াদ মধুর হাত ছাড়ল না ওভাবেই সামনে হাঁটতে লাগল মধু ওর হাতের টানে নিজেও পা মেলাতে লাগল।
ফুয়াদ ওকে নিয়ে রুমে এসে দরজা লক করে বলল,,” এবার বলো বাইরে কাকে দেখে এতো ভয় পেয়েছ? কাকে ভীতু চোখে খুঁজেছ? কার থেকে নিজেকে লুকাতে চাইছ?”
মধু মাথা নিচু করে বসে আছে বেডে। ফুয়াদ ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওর নিচু মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে ছিল। ফুয়াদ ওর সামনে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে ওর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নরম স্বরে বলল,,” মধু।”
মধু ফুয়াদের ডাকে চমকে উঠল। ওর হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠল প্রতিটা লোমকূপ। চোখ তুলে সরাসরি তাকাল ফুয়াদের চোখের দিকে। আর বলল,,” একটা কথা রাখবেন?”
” একটা কেন তুমি বললে হাজার টাও রাখব‌।” অনিমেষ গলায় চেয়ে বলল।
” আজকে এই মুহূর্তেই ঢাকা ব্যাক করবেন?”

আজকে ঘুরতে যাওয়ার প্লান ছিল সবার কিন্তু হঠাৎ করেই সব ক্যান্সেল করে ফুয়াদ ঢাকা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানাল। যা শুনে মিতুল ক্ষেপে গেল। হঠাৎ কেন এমন করে ফিরে যাওয়া হবে গতবার বান্দরবান থেকেও এইভাবেই ফুয়াদ ফিরেছিল ট্যুর থেকে এবার ও তাই রাগে ওর মস্তিষ্ক কাঁপছে। কেন জানি ওর মন বলছে এর পেছনে মধুর কারসাজি আছে। মিতুল নিজের রাগ এসে খাটাচ্ছে নিজের টলি ব্যাগের উপরে।
মধু রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর মুখ ঢাকা। ওকে মুখ ঢেকে রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সবাই চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে আছে।
ফাহাদ এগিয়ে এসে বলল,,” মৌমাছি ভাবি তুমি মুখ ঢেকে রেখেছে কেন?”
সবার মনে মধু কে দেখে যে প্রশ্ন উদয় হয়েছিল তা ফাহাদ জিজ্ঞেস করে বসল। তাই আর কেউ জিজ্ঞেস করল না। সবাই মধুর উত্তর শোনার অপেক্ষায় র‌ইল।
মধু কে যতবার ফাহাদ ভাবি বলেছে মধু ততবার‌ই ওকে ধমক দিয়ে ওর মুখ থেকে আপু ডাক বের করেছে। এই প্রথম মধু ফাহাদের সম্বোধন নিয়ে কোন উচ্চ স্বর প্রধান করল না। স্বাভাবিক ভাবেই বলল,,” এমনিই।”
এদিকে মিতুল ফাহাদের এমন সম্বোধন শুনে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। ওর চোখে মুখে চরম বিষ্ময়। মধু কে কেন ভাবি ডাকছে ফাহাদ? মধু ওর কোন ভাইয়ের বউ?

মিতুল ফুয়াদের সাথে যাওয়ার জন্য এক বিরাট ঝামেলা শুরু করে দিল গাড়িতে উঠা নিয়ে। জোর করেই ফুয়াদ এর গাড়িতে গিয়ে উঠে বসল। কিন্তু এতো ঝামেলা করেও শেষ রক্ষা করতে পারল না ফুয়াদ মিতুল কে ওর গাড়িতে দেখে নিজেই গাড়ি চেঞ্জ করে ফেলল। সমুদ্র কে পাঠিয়ে দিল নিজের গাড়িতে। পেছনে ফাহাদ, নাঈম ও রাহী উঠে বসল। মিতুল এসব দেখে রাগে ফুঁসতে লাগল।
” সমুদ্র” চিৎকার করে বলে উঠল মিতুল।
” হুম বলো।” শান্ত সুরেই বলল।
” ফুয়াদ আমার সাথে অন্যায় করছে তুমি দেখেও সাপোর্ট করছো?”
” আমি কোথায় সাপোর্ট করলাম?” অবাক স্বরে বলল সমুদ্র।
মিতুল বলল,,” তুমি ওর ব‌ড়ো ভাই। তোমারি সামনে ও নিজের ফিয়ান্সে কে রেখে বাইরের মেয়ের সাথে মেলামেশা করছে তুমি কিছু বলছো না।”
” আমি ওর বড়ো ভাই হলেও ওর ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারি না । নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বয়স ছোটোর হয়েছে। তাই এখানে আমার কিছুই বলার নেই।”
মিতুল চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। সমুদ্র এক মনে ড্রাইভ করছে। মিতুলের ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠেছে কষ্টে। ও ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। পেছন থেকে রাহী হতভম্ব হয়ে ওদের কথা শুনল। রাহী বাদে সবাই ফুয়াদের ব্যাপারটা জানত। রাহী হঠাৎ এসব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল।
চমকিত গলায় নাঈম কে জিজ্ঞেস করল,,” এসব কি বলছে?”
নাঈম রাহীর হা করা মুখটা বন্ধ করে দিল। রাহী লজ্জা পেয়ে মুখ বন্ধ করে বলল,,” ফুয়াদ ভাইয়ার জীবনে কে আছে? সে কি মিতুল ভাবি নয়?”
নাঈমের উত্তর দেওয়ার আগেই পাশ থেকে ফাহাদ বলল,,” ফুয়াদ ভাই মৌমাছি কে ভাবি বলতে বলেছে।”
রাহী হতবিহ্বল কন্ঠে বলল,,” হোয়াট!”

সাহিত্য ড্রাইভ করছে। ওর পাশেই বসে আছে তিন্নি। পেছনে ফুয়াদ আর মধু বসেছে‌। মধু তিন্নিকে পেছনে বসার জন্য অনেক টানাটানি করেছিল তিন্নি ও বসতে চেয়েছিল কিন্তু ফুয়াদ এসে তাকে বসতে দিল না।
তিন্নি কে বলে বসল,” তিন্নি ভাই ভাবিকে একটু স্পেস দে সব সময় কাবাব মে হাড্ডি হতে তোর কেমন লাগে?”
তিন্নি নাক টেনে বলল,,” কিহ আমি হাড্ডি?”
” হ্যা।”
” মধু আমি এখানে বসতে পারব না। আমি সামনে বসি।”
একথা বলে তিন্নি সামনে গিয়ে বসেছে। ফুয়াদ বাঁকা হেসে মধুর পাশে গিয়ে বসতে যাবে। মধু দাঁত কিড়মিড় করে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে গাড়ির সিটের মাঝখানে শক্ত হয়ে বসে আছে। এমন ভাবে বসেছে যেন ফুয়াদ কোন পাশ দিয়েই ওর পাশে বসতে না পারে। ফুয়াদ কোন তাল বাহানা না করেই বাম পাশ দিয়ে উঠে গেল মধু সরে বসছে না দেখে ভেতরে পা না রেখে আগে মাথা ঢুকিয়ে মধু কে উদ্দেশ্য করে বলল,,”সুইটহার্ট আমার গা ঘেঁষে বসতে তোমার এতো ভালো লাগে যে নড়ছ‌ই না।”
মধু আগুন গরম চোখে তাকাল ওর দিকে।
ফুয়াদ ভয় পাওয়ার মতো মুখ করে বলল,,” রাগী মুখটা দেখতে পাচ্ছি না। মিস করছি। মুখ খোলো একটু তোমার রাগ মাখা মুখটা দেখি।”
মধু চোখ সরিয়ে নিল কিন্তু সরে বসল না।
” সুইটহার্ট সরে আমাকে বসতে দাও নচেৎ তোমার স্থান হবে আমার কোলে। অবশ্য তোমাকে কোলে করে রাস্তা পাড়ি দেওয়া আমার জন্য আনন্দ ও রোমাঞ্চকর‌ই হবে।”
মধু আঁতকে উঠা চোখে তাকাল ফুয়াদের দিকে আর লাফিয়ে সরে গেল মাঝখানে থেকে একদম ডান পাশের জানালার সাথে লেপ্টে বসল। ফুয়াদ ওর সরে যাওয়া দেখে ঠোঁট টিপে হাসল। তারপর আয়েশ করে বসল গাড়িতে। বসেই বলল,,” বন্ধু গাড়ি আস্তে চালাও। যাতে এই পথ জার্নি দীর্ঘ হয়। আমার মন প্রেয়সীর মনে আমার জায়গা যেন এই পথেই তৈরি হয়।”

#চলবে…..
( ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here