#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
২১.
গায়ে জ্বর নিয়েই মধু সমুদ্রে নেমেছে। সমুদ্রের গভীরে যাওয়ার ভয় ছিল মধুর। কারণ ও সাঁতার জানে না। কিন্তু ভয় কে জয় করে তিন্নি ও ফাহাদ কে নিয়ে একপাশে লাফালাফি করেছে। প্রথম সমুদ্র দর্শন ও সমুদ্রের নোনা জলে গা ভিজিয়ে দিয়েছে। ভোরের পাওয়া শক নিয়ে সূর্যদয় উপভোগ করতে না পরলেও সমুদ্র বিলাস করতে কার্পণ্যতা করল না। সব কিছু একপাশে ফেলে নিজেকে আনন্দ দিয়েছে। মনে সকল দুঃখ কষ্ট সাগরের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে যেন।
” তিন্নি, ফাহাদ এবার উঠে আয় তোরা।” ফুয়াদের গলার উচ্চ স্বর পেয়ে দুই ভাই বোনই সুরসুর করে উঠে গেল। মধু কে ও উঠতে বলল কিন্তু উঠল না।
মধু থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল শক্ত হয়ে। ওর অপলক দৃষ্টি সাগরের জলে। যেন কিছু শুনতেই পায়নি। ফুয়াদের উপস্থিতি পেতেই মধু ফুয়াদের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে পরেছে। হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঢেউ আসছে যাচ্ছে। মধু সেই ঢেউয়ের গতি দেখছে। ওর সামনে শুধু অথৈ পানি। চোখের দৃষ্টি দূর থেকে দূর পর্যন্ত যতদূর গেল শুধু সচ্ছ চোখ ধাঁধানো সুন্দর পানি দেখতে পেল। চোখে খেলে গেল মুগ্ধতা।
ফুয়াদ রুক্ষ গলায় ঢেকে উঠল মধু কে। মধু সারা দিল না। ও কি শুনতে পেল নাকি সাগরের বুকে হারিয়ে গিয়েছে।
ফুয়াদ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে আছে রেড ড্রেস পরা মধুর দিকে। দমকা হাওয়ায় লাল গলায় জড়ানো ওরনা নেচে বেড়াচ্ছে।
ফুয়াদ তিন্নির দিকে তাকিয়ে বলল,,” তোর সাথে কথা বলেছে?”
তিন্নি অসহায় কন্ঠে বলল,,” না।”
থেমে আবার বলল,,” মধু খুব রাগ করেছে ভাইয়া। মধু তোমার থেকেও আমার উপর বেশি রাগ করেছে।। ও আমাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস, ভরসা করেছিল তাই তো সব ফেলে আমার কাছে এসেছিল। বিশ্বাস না থাকলে কি এভাবে আমার কাছে আসার সাহস করত বলো। সেই বিশ্বাস আমি ভেঙেছি। সকালের পর আর একটা কথাও বলেনি। আমার সাথে চলছে থাকছে কিন্তু মুখটা বন্ধ করে। একটা কথাও বের করতে পারিনি।”
ফুয়াদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,,” হা করে তাকিয়ে আছিস কেন?”
” ভাইয়া মিতুল ভাবি না মৌমাছি ভাবি কাকে ডাকব ঠিক করে দাও?”
” থাপ্পড় খাবি কিন্তু চোখের সামনে থেকে দূর হ।”
ফাহাদ কথা বলতে বলতে তাকাল মধুর দিকে। দেখল মধু এদিকেই এগিয়ে আসছে।
” ভাইয়া মৌমাছি!”
ফুয়াদ ঘাড় কাত করে তাকাল মধুর দিকে। মধু ফাহাদের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল।
ফাহাদের উচ্চ স্বরে ফুয়াদ কে বলা কথাটা ওর কানে গিয়েছে।
” আমাকে দেখে তোমার ভাইয়াকে হুঁশিয়ার দেওয়ার কি আছে?”
ফাহাদ মধুর গম্ভীর কন্ঠ স্বর শুনে বলল,,” আসলে ভাবি হয়েছে কি!”
মধু জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে ফাহাদের দিকে। ফাহাদ শান্ত প্রাণবন্ত মধুর রাগান্বিত মুখ দেখে ভয় পেয়ে গেল। ঢোক গিলে আমতা আমতা করতে লাগল।
মধু ফাহাদ কে শাসানো গলায় বলল,,” কে তোমার ভাবি?”
” আমার তো অনেক ভাই তাই ভাবি ও অনেক। তাই ভুলে তোমাকেও ভাবি বলে ফেলছি। সরি।” মাথা নিচু করে বলল ফাহাদ।
মধু রাগে ফুঁসে উঠল। কিন্তু তবুও আর কথা বাড়াল না দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল।
মধু শুয়ে আছে চাদর গায়ে চাপিয়ে। ওর গায়ে জ্বর। জ্বর ওকে কাবু করতে না পারলেও কাবু করেছে কষ্ট। তিন্নির বিশ্বাসঘাতকতা ও মানতেই পারছে না। যাকে অন্ধের মতো বিলিভ করল সেই ওকে ঠকালো। সব কিছু লুকিয়ে গেল। গরম নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে মধুর চোখের কোনা বেয়ে। যা গড়িয়ে বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছে। গায়ে জ্বরের মাত্রা বাড়ছে। অধিক সময় সাগরে নেমে থাকার ফলে গায়ের উৎতাপ বেড়েছে অত্যধিক। শীতের প্রলেপ বাড়ছে। সবাই রিসোর্টের এক পাশে কাঠের তৈরি বসার বেলকনিতে গিয়ে আড্ডা জমিয়েছে। শুধু সেই আড্ডায় শামিল হয়নি মধু। এতো দিন ফুয়াদ কে নিয়ে দেখা সব কল্পনা যখন কল্পনা বলে নয় বাস্তব বলে ধরা দিল তখন থেকে ওর বিশ্বাস ভেঙেছে। ফুয়াদ ওর আশে পাশে স্বপ্নের মতো ঘুরাফেরা করত ওকে অনুভুতি জড়ানো কথা বলতো সব কিছুই ছিল সত্য। এই সত্য টা ও মানতেই পারছে না। থমকে গেছে যেন ওর পৃথিবী। ফুয়াদের দিক থেকে ওর জন্য এমন অনুভূতি থাকতে পারে ও কল্পনাও করেনি। এটা ঠিক লোকটার ধারালো দৃষ্টি ওকে থমকে দিত। ভীতু করে দিত। তাই বলে তা ভালোবাসা হবে?
আর এই সত্যের সবটাই জানতো তিন্নি। তিন্নি সব সময় ফুয়াদ কে হেল্প করেছে আমায় নিয়ে খেলা করেছে দু’জন। সেইদিন শপিং মলে ঘটনা ওর কাছে অনর্থক ভ্রম মনে হয়েছিল। কিন্তু সেসব ভ্রম নয় সত্য। যদি কোনোটা স্বপ্ন হয় সেটা হলো আজ ভোরে দেখা ঘটনাটাই শুধু।
মাঝে মাঝে মধু মাঝ রাতেও ফুয়াদের উপস্থিতি টের পেত। ফুয়াদের গায়ের পরিচিত পারফিউম এর ঘ্রাণ। ওর ঘুম পাতলা হওয়ায় অনেক বার মাঝরাতে উঠে বসেছে। তখন দেখতে পেতো ফুয়াদ ওর দিকে চেয়ে বসে আছে ওর সম্মুখে। কি অদ্ভুত? ও চমকে কথা বললেও ফুয়াদ বলতো না। মধু চোখ কচলে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলতো। তারপর ঘুমিয়ে পড়ত হতভম্ব হয়েই। সকালেই সেটা মধু স্বপ্ন ভেবে চালিয়ে দিত। যার সবটা ছিল সত্য আর তা বলেছে ফুয়াদ নিজেই। তিন্নি এসব জানে ফুয়াদ বলেছে। এখন ফাহাদ আর তিন্নি জানে কারণ তিন্নি কে মধু সকালে রাগের মাথায় ফাহাদের সামনেই এসব নিয়ে প্রশ্ন করে ফেলেছিল।
তিন্নি মাথা নিচু করে শুধু বলেছিল,,” ভাইয়া তোকে অনেক ভালোবাসে মধু। ভাইয়ার কথায় ই আমি তোকে বিয়ে না করে পালিয়ে আমার কাছে চলে আসতে বলেছিলাম। নাহলে বল আমার মতো ভীতু, ভাইয়ের ভয়ে থাকা মেয়ের কি সাহস আছে কোন বন্ধুকে নিজের বাসায় এনে রাখার। তাও সবাইকে না জানিয়ে। আমাদের শত্রুর অভাব নাই আমি তো কোন বন্ধুকে বাড়িতেও আনিনা বেশি কিন্তু তোকে এনেছি আনার সাহস করেছি কেন জানিস? ফুয়াদ ভাইয়া চেয়েছিল তুই এখানে এসে থাক। ভাইয়া কথা রেখেছি আমি। তোকে তার কাছে এনে দিয়েছি। কিন্তু আমি কিন্তু তোর ক্ষতি চায়নি। বন্ধুত্বের খাতিরে ও ভাইয়ার চাওয়া পূরণ করেছি শুধু।”
” মিতুল আপু তার ফিয়ান্সে। এসব জানা সত্ত্বেও তুই বলছিস উনি আমায় ভালোবাসে?”
” হ্যা বলছি। সত্য বলতে সমস্যা কোথায়? মিতুল আপুর সাথে ভাইয়ার বিয়ে ঠিক করেছে চাচি। ভাইয়া এসবের কিছুই জানতো না। তিনি নিজের কাজ নিয়েই দিন রাত পার করে এসবের টাইম আছে নাকি। মিতুল আপুকে আমরা সবাই জানতাম সমুদ্র ভাইয়ার হবু বউ হিসেবে। সমুদ্র ভাই বিয়েতে রাজি ছিল না কোন এক অগত্যা কারণে। তার সু স্পষ্ট কারণ ও কাউকে বলেনি। ওদিকে নাকি মিতুল আপুও রাজি নয়। একদিন মিতুল আপুর বাড়ি গেল চাচি তার বাবা মায়ের বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে। সেদিন চাচি থেকে গেল। দুই দিন পর এসেই জানাল তিনি ফুয়াদ ভাইয়ের সাথে মিতুল আপুর বিয়ে ঠিক করেছে। শুধু ঠিক করেনি আংটি ও পড়িয়ে এসেছে। এসব শুনে ফুয়াদ ভাই রাগ করে এক সপ্তাহ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। চাচির বেহাল অবস্থা ছেলের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। ফুয়াদ ভাই কোনভাবে খবর পেয়ে ছুটে আসে।”
মধু রাগে ফেটে পড়ে বলল,” আমি কিছু শুনতে চাই না। তুই আমায় ঠকিয়ে ছিস এটাই সত্যি। আমি তোর থেকে এটা আশা করিনি।”
এই ছিল তিন্নির সাথে শেষ কথা। মধুর গায়ে কাঁপুনি দিয়ে উঠছে। শরীর খুব খারাপ লাগছে এতো কিছু ও সহ্য করতে পারছে না। মায়ের সাথে কথা বলতে মন চাইল। অসুস্থ হলে সন্তান সবার আগে মায়ের খোঁজ করে মধু ও জ্বরের ঘোরে মা মা করতে লাগল। কতদিন মাকে দেখে না। মধু জ্বরের তাপে তাকাতে পারছে না। মনে হচ্ছে চোখের পাতায় আগুনের কন্ডলি দেওয়া হয়েছে। মধু জ্বরের ঘোরে মাকে ডাকছে। বেহুঁশ অবস্থায় মধু অনুভব করল একটা ঠান্ডা হাত ওর কপাল স্পর্শ করছে। পুরুষ কন্ঠ সে কিছু বলছে মধু কে। মধু কিছুই শুনতে পেল না অচেতন হয়ে গেল।
যখন চোখ পিটপিট করে তাকাল দেখতে পেল তিন্নি ও রাহী চিন্তিত মুখে বসে আছে ওর পাশে। মধু আগুন গরম শরীরটা টেনে উঠে বসল। ওর ফর্সা মসৃন গালটা জ্বরের তাপে লাল হয়ে আছে। মধু কে উঠতে দেখেই তিন্নি বলল,,” এই অবস্থায় উঠছিস কেন?”
মধু বিছানা থেকে নেমে গেল। রাহী হাত ধরে বলল,,”এই মধু কই যাও।”
” ওয়াশরুমে যাব আপু।”
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মধু ফাহাদ, সমুদ্র, সাহিত্য সবাইকে দেখল। ও কেমন আছে জিজ্ঞেস করল সবাই।
দূর্বল গলায় ভালো বলে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। ওভাবে ফোন বালিশের নিচে থেকে নিয়ে মায়ের নম্বর এ কল করল। রিসিভ হলো না।
তিন্নি মধুর মুখের উপর থেকে চাদর সরিয়ে বলল,,”তোর যে গায়ে এতো জ্বর কাউকে বলিস নি কেন?”
” বলে কি হবে তোরা কি কেউ ডক্টর?”
” ডক্টর না হই। জ্বরের ঔষধ খাওয়াতে তো ডক্টর হওয়ার প্রয়োজন পরে না।”
মধু উত্তর দিল না।
” কথা বলছিস না কেন? কখন থেকে জ্বর? এভাবে রাগ করে থাকিস না।”
” সকাল থেকেই।”
” জ্বর নিয়ে পানিতে নামলি কেন?”
” হচ্ছে করেছিল তাই।”
” এটা কোন কথা?”
থেমে আবার বলল,,” ফুয়াদ ভাই ডাক না দিলে তো জানতাম ই না জ্বরে অজ্ঞান হয়ে গেছিলি। কত ভয় পেয়ে গিয়েছিল সবাই জানিস।”
” এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জ্বর হলেই কেউ মরে যায় না। তোর ভাই কে আমার থেকে দশ হাত দূরে থাকতে বলবি।”
তিন্নি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মধু আবার কল করল মায়ের নাম্বারে। রাহী রুমে ছিল না হলে ওদের কথোপকথন শুনে ফেলতো। তিন্নি দেখল মধু মা দিয়ে সেভ করা নাম্বার এ কল করছে। ও কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
#চলবে…..