#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
১২.
একটু আগেই রাহী একটা জামা এনে দিয়েছে। মধু বাইরে ছিল তাই ওকে নিয়ে আবার রুমে এসেছে। মধু এদিক ওদিকে তাকাচ্ছিল কেউ নাই রুমে। ব্যাপার টা কি হলো। এরা গেল কোথায় সব? ড্রেস চেঞ্জ করে এসে দাঁড়াল। রুমে ড্রেসিং টেবিল নাই তাই দেখতে পারল না। কিন্তু খুব টাইট লাগছে জামাটা।
হাঁসফাঁস করে বলল,” এটা কার জামা এনেছো আপু?”
রাহী উত্তর দিল,,” মিতুল ভাবি তো নিচে। তার কাছে গেছিলাম কিন্তু বলতেই পারলাম না। ভাবির ছোট বোন নিহার কাছ থেকে ড্রেসটা আনলাম।”
” ওহ আচ্ছা। সে মনে হয় অনেক চিকন তাই না আপু।”
” তোমার কি খারাপ লাগছে জামা টা পরে?”
” একটু টাইট লাগছে। সমস্যা নাই। আর কতক্ষন এখানে থাকবে?”
” ভাবি তো থাকতে বলছে।”
মধু আঁতকে উঠা কন্ঠে বলল,,” থাকবে নাকি তুমি?”
এই অবস্থায় আর থাকতে পারছে না মধু। এই ড্রেস পরেও বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়। কেমন জানি লাগছে।
মধুর আতঙ্কিত মুখ দেখে রাহী বলল,,” তোমার কি এখানে খারাপ লাগছে মধু?”
মধু ঢোক গিলে বলল,,” না তেমনটা নয়। তিন্নি অসুস্থ তাই তাড়াতাড়ি করছিলাম।”
” আমি থাকলেও তোমায় পাঠিয়েই দেব চিন্তা করো না।”
” আচ্ছা। এভাবে থাকতেও অস্বস্তি হচ্ছে একটু তাড়াতাড়ি যেতে পারলে ভালো লাগতো।”
” কেক কাটা হবে। তারপর কিছু খাবে তবেই না যাবে।”
মধু আর কিছু বলল না। রাহী ওকে নিয়ে বাইরে আসলো। সামনেই পেল সমুদ্র কে। ওদের অপেক্ষায় হয়তো দাঁড়িয়ে ছিল। এগিয়ে এসে মধুকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল,,” প্রবলেম সলভ হলো তাহলে।”
মধু বলল,,” হুম হলো।”
” আসো এদিকে তাহলে।”
মধু ও রাহী সমুদ্রের পেছনে যেতে লাগল। সমুদ্র এসে থামল মিতুলের কাছে। কেক কাটা হবে এখন। সবাই ঘিরে ধরেছে তাকে। মিতুলের পাশে একটা মেয়ে দেখতে পেল চিকন করে।
রাহী তার দিকে আঙুল তুলে বলল ওটাই নাকি নিহা। ওমন শুঁটকি মেয়ের জামা পরে আছে ও অবাক হতে তাকাল নিজের দিকে। লাল রঙের ফ্রকটা গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। ও ওরনা নিয়ে ভাবে করে শরীর ঠেকেই দাঁড়িয়ে আছে। দম আটকে আসছে এতো মানুষের ভীড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। এসি থাকা সত্ত্বেও ঘামে ভিজে যাচ্ছে শরীর। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে। মিতুল চাকু হাতে নিতেই চিৎকার শুরু হলো। এবার আর কেউ বাঁচাতে পারবে না মধু কে। দুই কানে আঙুল চেপে কপাল কুঁচকে নিল। আল্লাহ আমার কানের তালা ফাটিয়ে দিবে এরা। একেতে টাইট জামা পরেছে,তার উপর ভীড় ঠেলে দাঁড়িয়ে আছে। আবার চিৎকার উফ দম বন্ধ হয়ে আসছে। মধু রাহীর পাশে থেকে ভীড় ঠেলে বের হয়ে এল। ওর পেছনেও কয়েকজন মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ও তাদের ঠেলে বের হয়েছে ঠিকই কিন্তু ওর লাল ওরনা আটকে গেছে কারো সাথে। সেটা টান লেগে অর্ধেক গা থেকে সরে গেছে। ও এগিয়ে এসে ওরনা টানছে। এখন ওরনা ওর কাঁধের একপাশে ঝুলছে। আরেকপাশে ফাঁকা। ও ওরনা টেনে ধরে পিছিয়ে যাচ্ছে। পেছনে পা ফেলে টানছে ওরনা খুলে আসতেই ঠাস করে পেছনে কারো সাথে বারি খেল।
এখন ওরনা পুরোটাই ওর হাতে। ও দু হাতের মুঠোয় ওরনা নিয়ে বুকে চেপে ধরেই পেছনে ঘুরে দেখল ফুয়াদ রক্তচক্ষু মেলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
একটু আগেই মধুর সাথে তর্ক করে ওই রুমে গিয়ে ফুয়াদ নিরাশ হয়েছে। রুম একেবারে ফাঁকা। বেলকনি হীন রুম। রুম থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে। মধু পাথরের মতো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল মাথা নিচু করে।ও মধুকে সম্পুর্ণ ইগনোর করে চলে আসে। কেক কাটার সময় মিতুল ওকে কল দিয়ে কাছে ডাকছিল ও যায় নি। ইচ্ছে করেই যায় নি। এতো মানুষের মধ্যে থাকতে বিরক্ত লাগে বাবা মা বোন আছে সেখানে ওকে কি দরকার? মিতুলের অতিরিক্ত কাজ ওর বিরক্তির সীমা লঙ্ঘন করে। তাইতো ফোনের কল ইগনোর করে সবাই যখন কেক কাটার পর্ব দেখতে ব্যস্ত হইহুল্ল করছিল ও একাই আলাদা হয়ে ছিল। চেয়ার টেনে বসে ছিল একা নিরিবিলি হয়ে। তখনি দেখতে পায় মধু কে একটা লাল পোশাক গায়ে ভীড় ঠেলে বেরিয়ে আসছে। চোখ মুখে বিরক্ত স্পষ্ট। নাকের মাথায় ঘাম, ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে। মধু বের হলো ঠিক কিন্তু ওরনা আটকে রইল ভীড়ে। সেটা নিয়ে মধু যুদ্ধ করছে। ও বসে মধুর কাজকর্ম দেখছিল।আর অজান্তেই ওর ঠোঁটে হাসি আসছিল। হঠাৎ ভ্রু কিশ্চিৎ কুঁচকে খেয়াল করল একটু আগে মধুর সাথে যখন ঝগড়া করছিল তখন ওর পরণে অন্য পোশাক ছিল এখন আরেকটা ঘন্টায় জামা পরিবর্তন করে নাকি?
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ফুয়াদ। কেন জানি মধু কে সাহায্য করতে ইচ্ছে হলো। মধু কে সাহায্য করতেই এগিয়ে আসে। একদম মধুর পেছনে এসে দাঁড়ায়। তখনি দেখতে পায় মধু নিজের ওরনা ছাড়াতে সক্ষম হয়ে গেছে। ও চলে যাবে নিঃশব্দে কিন্তু যেতে পারে না। মধু হেলে পরে পেছনে। ফুয়াদ ওর পিছনে ছিল বিধায় মধু একদম ওর বুকের উপর গিয়ে পরে। আচমকা মধু ফুয়াদের বুকের উপর হেলে পরায় তাল সামলাতে না পেরে পেছনে পরে যেতে নেয় ফুয়াদ। দ্রুত নিজের ব্যালেন্স ঠিক রাখার জন্য মধুর পেট জড়িয়ে ধরে। এই মুহূর্তে মধু বিহীন আর কিছুই ওর হাতের নাগালে ছিল না ধরে নিজেকে সামলানোর। মধুকে ধরে ফুয়াদ মধু কে নিয়েই সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ফুয়াদ পেট থেকে হাত সরিয়ে নিতেই মধু আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ে আর ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ায়। আর পেছনে ঘুরে তাকায়। ওর শরীর কাটা দিয়ে উঠেছে। ফুয়াদ কে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মধু প্রশ্ন করল,,,” আপনি এখানে কি করছেন?”
ফুয়াদ উত্তর দেয় না।
মধু নিজের ওরনা জামা ঠিক করে বলে,” আপনার ফিয়ান্সে তো ওখানে কেক কাটছে। আপনি ওখানে না থেকে এখানে কি করছেন?”
ফুয়াদ উত্তর দিল না। কটমট চোখে মধুর দিকে এক পলক তাকিয়ে পেছনে ঘুরে দাঁড়াল আর আগের স্থানে গিয়ে আবার চেয়ার টেনে বসল। মধু চোখ ছোটো ছোটো করে হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল ফুয়াদের যাওয়ার দিকে। ফুয়াদ ফোন টিপছে ভাবলেশহীন মুখে। মধু খুব অপমানিত বোধ করল কথা বলল কিন্তু অসভ্য লোকটা তার কথার প্রেক্ষিতে নিরবতা পালন করল। আবার ইগনোর করে চলে গেল। হঠাৎ ওর মনে পরে গেল নিজের করা কাজ। সমুদ্রের সাথে প্রথম দেখায় ও নিজেও তার কথার প্রেক্ষিতে নিরবতা পালন করেছিল। সমুদ্র কে ইগনোর করে ফুয়াদ আর মিতুল এর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেদিন ও এই লোকটা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। একটা কথাও বলেনি। ওর বেশ ও সাহায্য চাওয়া নিয়ে সবাই কম বেশি কৌতুহল দেখিয়েছে এটা ওটা জিজ্ঞেস করেছে কিন্তু ফুয়াদ সেই ব্যক্তি যে না ঘাবড়ে গিয়েছিল আর না ওকে নিয়ে বিন্দুমাত্র কৌতুহল দেখিয়েছিল। সম্পূর্ণ ইগনোর করেছিল। কিন্তু বাসায় যেতেই কেমন সিংহ হয়ে উঠেছিল ওকে কত অপবাদ দিয়েছিল।
মধুর হঠাৎ মনে হলো আজ ফুয়াদ ওর কথার উত্তর দিল না বলে ওর খারাপ লাগল। সেদিন সমুদ্রের কথার উত্তর ও দেয়নি তার মানে তার ও খারাপ লেগেছিল। অন্যের সাথে ঘটলে তার কষ্ট আমরা বুঝি না কিন্তু নিজের সাথে একই ঘন্টা পুনরাবৃত্তি হলে তখন ঠিকি বুঝতে পারি। মধু ভাবল সেদিনের জন্য সমুদ্রের কাছে ক্ষমা চাইবে।
ফুয়াদ কোল্ড ডিংক্স খাচ্ছে ও সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুখটা যথেষ্ট গম্ভীর ফুয়াদের। চেয়ালদ্বয় বিরক্তে কিশ্চিৎ কুঁচকে আছে। লম্বাটে মুখটা সব সময় সিরিয়াস করে রাখে। এই লোকটাকে খুব তাড়াতাড়িই পাগল হয়ে পাবনা যেতে হবে। বিড়বিড় করে ফুয়াদ কে পর্যবেক্ষণ করল তারপর সরে গেল।
” এই মধু এখানে কেন তুমি। কখন থেকে খুঁজছি।” রাহী ও ফাহাদ এগিয়ে আসছে মধু ওদের দেখে এগিয়ে এল।
” আসলে আপু ভীড়ের মধ্যে খারাপ লাগছিল তাই চলে এসেছি।”
রাহী বলল,,” আমি আরো তোমায় খুঁজেছি কোথায় গেলে হঠাৎ।”
মধু চেয়ার টেনে বসে বলল,,” এবার খাবার খেয়ে চলে যাব আমার আর ভালো লাগছে না আপু।”
ফাহাদ হাত লুকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল হঠাৎ হাত বের করে মধুর গালে মাখিয়ে দিয়ে বলল,,” একি চলে যাবে কেন আজ তো আমি আর রাহী আপু তুমি এখানেই থাকব।”
মধু গালে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল।
” এটা কি করলে ফাহাদ।” চেঁচিয়ে উঠে বলল মধু।
রাহী নিজেও কিছু বলতে যাবে শয়তান ফাহাদ ওর গালেও লাগিয়ে দিয়েছে। এবার রাহী ও চিৎকার করে উঠল।
” তুই এটা করলি কি ফাহাদ এমনিতেই আমার মুখে ব্রণ উঠে একটুতেই আর তুই কেকের ক্রিম লাগালি
এবার তো একেবারে শেষ হয়ে যাবে। আজ তোর খবর আছে।”
রাহী ফাহাদকে ধরার জন্য পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে। মধু ওয়েটার ডেকে কেক নিল হাতে তারপর নিজেও ফাহাদের পেছনে গেল। কিন্তু দৌড় দেয়নি। ও লুকিয়ে দেখছে ফাহাদ কোনদিকে যাচ্ছে ও লুকিয়ে একটা টেবিলের আড়ালে দাঁড়াল গিয়ে। দেখল ফাহাদ উল্টো ঘুরে ওর দিকেই আসছে ও মুঠোয় থাকা কেক ছুঁয়ে মারল ওর দিকে। ছুঁড়ে মেরেই জিভে কামড় দিল। মুখে হাত দিয়ে ঢোক গিলল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো তখনি রাহী ছুটে এসে ফাহাদের শার্ট টেনে ধরেছে পেছনে থেকে আর ফাহাদ সামনে আসতে পারেনি। এগিয়ে ফুয়াদ এগিয়ে এসেছে। মধুর ছুঁড়ে মারা কেক গিয়ে ফুয়াদে কপালে লেগেছে। কপাল ও চুলে লেগেছে। মধু চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। ভয়ে ওর হৃদপিন্ড কাঁপছে। ফুয়াদ এদিকে ওদিকে খুঁজছে কে এই কাজ করল ওর সাথে জানার জন্য। রাগে ফুয়াদের মুখ লাল হয়ে গেছে। মধু ধপ করে সেখানেই বসে পরেছে।
মধু হাঁটু ভাঁজ করে টেবিলের নিচে লুকিয়ে আছে। থরথরিয়ে ওর শরীর কাঁপছে উঁকি মেরে দেখল ফুয়াদ চলে গেছে নাকি ও দেখল ফুয়াদ নাই। ও বুকে হাত দিয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়াল। আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছে যে রাগী উনি এসব জানলে ওকে কি করতো আল্লাহ তাআলা জানেন। মধু একটা টিস্যু নিল টেবিলে থেকে তারপর নিজের গাল ও হাত মুছতে লাগল। হঠাৎ পেছনে থেকে একটা হাত ওর বাম বাহু শক্ত করে চেপে ধরতেই ও চমকে উঠল। চট করেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই কেকের ক্রিম মাখানো চুল, কপালে কুঁচকানো কেক লাগানো সাদা ভ্রু দেখে ও এতো ভয় পেল যে ওর মনে হলো আজরাইল দাঁড়িয়ে আছে ওর জান কবজ করতে। ওর শরীর অবশ হয়ে গেল। ও নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিল। চোখ বন্ধ হয়ে গেল ঘন অন্ধকারে। ঢলে পরল ফুয়াদের উপর।
#চলবে…..