দূর আলাপন
পর্ব-৩
____________
নিনাদ সামনে এসে ভুরু কুঁচকে তিহার দিকে তাকাল। রাগি স্বরে বলল,’লিলি কি বলতে এসেছিল ওকে?’
তিহা ফ্যাকাসে মুখে বলল, ‘কি আবার! তার যা কাজ। ফোন নাম্বার নিতে এসেছিল।’
-‘তোর বোন কি করলো? দিয়ে দিল ফোন নাম্বার? ‘
-‘হু, আমি ওকে ইশারায় নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু ও তো কিছু বুঝলই না।’
নিনাদ এবার রুষ্ট হয়ে বলে উঠল,’বাহ! তাহলে তো আর কথাই নেই।এবার তাহলে রং নাম্বার থেকে কল এলে বলিস তোর বোনকে জমিয়ে পিরিত করতে !’
তিহা বলল,’ধুর বাদ দে তো।লিলির স্বভাবই তো অমন। এর ওর জন্য মেয়ে খুঁজে বেরানো। কেউ ডিস্টার্ব করলে তখন দেখা যাবে। তুই তো আছিস ই। দেখবি তখন ব্যাপার টা। এই মেয়ের চক্করে পরে আমার খাওয়াটা ঠিকঠাক হলো না।জানিস! ‘
-‘কতো আর খাবি? সেই কখন থেকেই তো দেখছি খেয়ে যাচ্ছিস শুধু। তোর আর খেতে হবে না। বাকিটা আমায় দে।কামলা খাটতে খাটতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল করে ফেললাম। এখনো কিছু খেতে দিলো না আমাকে ওরা।ভেবে দেখ একবার। পাপড়িটারও হুশ নেই। ছবির পোজ দিতে দিতে মুখ বেঁকে যায় যায় অবস্থা।পুরাই আজীব এরা সব !’ এই বলে তিহার আধখাওয়া প্লেট এক প্রকার জোর করে নিয়ে ঘুরে বসতে যেতেই ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেল।তিতিক্ষা হাত ধুয়ে এদিকেই আসছিল। নিনাদ খেয়াল করে নি।ওদিকে তিতিক্ষা ভেবেছিল সে এখানে অর্থাৎ নিনাদের পেছন দিকটায় দাঁড়িয়ে থাকবে যেন নিনাদের সাথে তার চোখাচোখিটা কোনো মতেই না হয়।নিনাদ এভাবে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে ভাবেই নি।ফলাফল দুজন মুখোমুখি হতেই ভয়ানক এক সংঘর্ষ ঘটে গেল।নিনাদের হাতে থাকা খাবারের প্লেট গিয়ে পড়লো তিতিক্ষার গায়ের ওপর।নিনাদের সাথে ধাক্কা খেতে যাচ্ছে দেখে আগেই সে চোখ বুজে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছিল।এবার সে চোখ খুলে যা দেখলো তাতে তার কান্না পেয়ে গেল।দুধ-চা রঙা তার সুন্দর বোরকাটা মাংসের লাল ঝোলে চিকচিক করছে।কয়েকটা পোলাও ও লেগে আছে বোরকায় সেই ঝোলের সাথে।নিনাদ বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে ।
কি অঘটন সে ঘটিয়েছে বুঝতে পারা মাত্রই নিনাদ ব্যাস্ত হয়ে উঠল।টেবিল থেকে একসাথে অনেক গুলো টিস্যু টেনে নিয়ে আচমকা তিতিক্ষার পায়ের কাছেই বসে পরলো।তিতিক্ষা চমকে লাফিয়ে উঠে হঠাৎ সরে যেতে গিয়েও পারলো না।নিনাদ তার বোরকার নিচের অংশ টেনে ধরেছে। টিস্যু দিয়ে মুছে দিচ্ছে।আর বারবার বলে চলেছে সে খুবই দুঃখীত।তার পেছনেই যে তিতিক্ষা ছিল সে একদম খেয়াল করে নি।তিতিক্ষা এবার কাঁদোকাঁদো মুখে বোনের দিকে তাকালো।তিহা তখনো সম্বিত ফিরে পায় নি।তাকিয়ে আছে হা করে।
আশেপাশে একটা শোরগোল পড়ে গেল। যে যেখানে ছিল সেখান থেকেই তাকিয়ে ব্যাপার টা উপভোগ করছে।একটি মেয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার সারা পোশাক মাংসের লাল ঝোলে মাখামাখি। তার খুব কাছে একটি আকাশী-নীল রঙা পাঞ্জাবি পড়া গাঢ় শ্যামলা বর্ণের, বড় বড় চুলওয়ালা ছেলে বসে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে সেসব পরিষ্কার করছে।কেউ কেউ তাদের স্বামী-স্ত্রী ভেবে নিনাদকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘লাভ নেই ভাই।এভাবে পরিষ্কার হবে না। ভাবিরে নিয়ে বাসায় যান।’
একটুকু হলেও বোধহয় চলতো।কিন্তু তিহার বন্ধুমহলের সবাই যখন একসাথে এসে জুটলো তখন তাদের কথা শুনে তিতিক্ষার কান আঙুল দিতে মন চাইল। আগে থেকেই নিনাদ, তিতিক্ষাকে নিয়ে কৌতুক করতে তারা পছন্দ করতো।এবার সুযোগ পেয়ে তা চরম মাত্রায় এসে পৌঁছালো! কথার সাথে সাথে কেউ কেউ আবার শিস বাজাতে শুরু করলো। তিতিক্ষা শেষ বারের মতো বোনের দিকে তাকালো।তিহা এখনো বুঝতে পারছে না সে কি করবে। এই নিতান্ত স্বাভাবিক একটা বিষয় যে নিনাদ-তিতিক্ষা কে কেন্দ্র করে হতেই এতো অস্বাভাবিক হয়ে উঠবে বেচারি ভাবেনি বোধহয়। নিনাদ উঠে দাঁড়ালো। ছাড়া পাওয়া মাত্র আর কারো পরোয়া না করে তিতিক্ষা গটগট করে হেটে চলে গেল বাইরে। তৎক্ষনাৎ তিহা ছোটনের হাত ধরে বোনের পিছু পিছু ছুটল।
বাড়ি ফিরেই তিতিক্ষা সেদিন দ্বার রুদ্ধ করলো।অনেক ধাক্কাধাক্কিতেও সে দ্বার খুললো না।মারুফ সাহেব খানিক পর পর এসে মেয়ের ঘরের সামনে চিন্তিত মুখে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।মেয়েকে তিনি জানতেন।তাই ডাকার সাহস বা আগ্রহ কোনোটাই ঠিকঠাক সঞ্চয় করতে পারলেন না। শেষে বড় মেয়ের কাছে গেলেন। এই ভেবে যে সে হয়তো তার এই অভিমানী কন্যার হঠাৎ হওয়া অভিমানের কারণ জানে। তিহা বাবাকে চিন্তামুক্ত করতে হেসে ব্যাপার টা খুব হালকা ভাবে উড়িয়ে দিল।কিন্তু সবকিছু ওড়ালেই যে তারাও মুক্ত বিহঙ্গের স্বাদ নিতে বাধ্যগত হয়ে আকাশে উড়াল দেয় ব্যাপার টা তা নয়! সেদিনের ঘটনার রেশ সহজে কাটলো না। রয়ে গেল বেশ কিছুদিন। তিতিক্ষা এ’ কদিন প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেরোলো না একদমই। তারপর একদিন ফজরের সালাতের পর তিহা রান্নাঘরে চা করছিল।সহসা তিতিক্ষা সেখানে এসে দাঁড়ালো। শীতল স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, ‘আজকের আবহাওয়া টা বেশ! হাটতে যাবে বুবু?’
তিহা মনে মনে ভয়ানক খুশি হলো। মুখে প্রকাশ করলো না তার একভাগও! দুখী দুখী চেহারা করে বললো, ‘ হাটতে যাবি? আচ্ছা চল। দ্বারা চা’টা খেয়ে নে আগে।’ বোনের এই চতুরতা তিতিক্ষা বুঝলো না।বুবুর নিষ্প্রভ মুখখানি দেখে তার মনে ততক্ষণে করুণা জাগ্রত হয়ে উঠেছে। এ’ কটাদিন বুবুর সাথে সে খুব সাবধানে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। বুবু হয়তো কষ্ট পেয়েছে ভীষণ!
তিতিক্ষা ভাবলো, ছি! সে এমন কিভাবে করতে পারলো। এই কি তার শিক্ষার যথাযথ পরিচয় ? তার দ্বীন কি কখনো তাকে এই আদব শিক্ষা দিয়েছে? তিতিক্ষা অনুতপ্ত হলো। বুবুর হাত ধরে সেদিন হাটতে বেরোলো। ঘুরে বেড়ালো ভোরের স্নিগ্ধ-শীতল শান্তিময় আবহাওয়ায় এক পথ থেকে অন্য পথে। দুদিনের অবিরত বর্ষণে ধানমন্ডি লেকের স্বচ্ছ পানি তখন আরও স্বচ্ছ, ঝলমলে হয়ে উঠেছে।ভোরের তরুণ সূর্য পুরো লেক জুড়ে ছড়িয়ে রেখেছে তার সোনালী আলোর ঝিলিক।তারা সেখানে হেটে বেরালো অনেকক্ষণ । বাড়ি ফিরে সেদিন তিতিক্ষা আবার আগের মতো হাসিখুশি, প্রানবন্ত হয়ে উঠল।
_______________________
সেদিনের বিয়ে বাড়ির ঘটনার পর একমাস কেটে গেছে। এরমধ্যে একবারও নিনাদ তিতিক্ষাদের বাড়িমুখো হবার সাহস দেখায়নি।সেদিনের ঘটনাটা খুব বড় কিছুই ছিল না। তিতিক্ষার জায়গায় অন্য যেকোনো মেয়ে হলে হয়তো হেসেই উড়িয়ে দিতো ব্যাপার টা।তবে দূর্ভাগ্যবশত মেয়েটা তিতিক্ষা ছিল এবং সেখানে বন্ধু রূপী কিছু শত্রুর উপস্থিতিও ছিল। তাদের কথাগুলো জ্বলন্ত অগ্নিতে ঘৃতাহুতির কাজ করলো। যদিও নিনাদের বন্ধুরা শুধুমাত্র কৌতুক করেই কথাগুলো বলছিল।কিন্তু তাদের হয়তো ধারণা ছিল না সে কথাগুলো কারো অন্তঃকরণে এতো গভীর আঘাত হানতে পারে। নিনাদও অনুতপ্ত হয়েছিল।অপরাধ সে জেনে-বুঝে কিছুই করেনি।তবু হয়তো সে আর কখনো তিহাকে একটা কল দিতেও সাহস করতো না । এমনই এক গভীর ছায়া পরেছিল তার মনে।তবে এই সবকিছুই স্বাভাবিক করে দিল একটা ফোন কল।
তিহার স্বামী রওশান বান্দরবান থেকে ফিরে তিহার মুখে সবকিছু শুনলো।নিনাদ কে সে বিশেষ পছন্দ করতো। নিনাদের সোজাসাপ্টা কথা বলার ধরনের জন্য। তাছাড়া ভার্সিটিতে তুখোড় মেধাবী হিশেবে যথেষ্ট সুনাম থাকলেও আচরণে তার কিছু অপরিপক্কতা রয়েই গেছিলো।সেই দূর্বলতা দিয়ে সে খুব সহজে অন্যের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারতো। তদতিরিক্ত! যে সুদর্শন, মেধাবী, বাক্যে পটু অথচ নীতিতে সরল। অন্যের ভালোবাসা অর্জনে তার কিই বা বাঁধা !
রাতে রওশান তিহা,ছোটনকে নিয়ে ছাদে গেল। ছাদের মাঝখানে কাঠের বেঞ্চি পাতা ।রওশান তিহা দুজন দু’দিকে বসলো। মাঝে ছোটন তার ছোট ছোট হাত দিয়ে বাবা-মা দুজনেরই হাত চেপে ধরে বসে রইলো। তার মুখ দেখে মনে হল এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী শিশুটি সে।
অনবরত কল বেজে চলেছে। কেউ ফোন কানে তুলছে না।রওশান ভাবলো কল টা বোধহয় অসময়ে করেছে সে।এর আগে দু’বার রিং বেজে বেজে কেটে গেছে ।এবার সে নিজেই কল কেটে দেয়ার কথা ভাবলো। তখনই ওপাশ থেকে একটা ক্লান্ত বিষন্ন গলার স্বর ভেসে এলো,’আসসালামু আলাইকুম। কি অবস্থা ভাইয়া?’
রওশান সালামের জবাব দিয়ে আমুদে ভাব নিয়ে বললো, ‘তোমার সহচার্য যার নিত্য অভ্যাস, তার সাথে মানুষ যেমন অবস্থায় থাকতে পারে আমিও তেমন অবস্থায়-ই আছি।হাটছি, ফিরছি, খাচ্ছি, ঘুরছি। আর মুখ দিয়ে তার’ অপছন্দনীয় কথা কিছু বের হওয়া মাত্রই পিঠে আঘাত অনুভব করছি।এইতো! ‘
তার কথা শেষ হওয়া মাত্র তিহা হেসে পিঠে তার একটা চিমটি কাটলো।রওশান সাথে সাথে ফোনের ওপাশের জনকে উদ্দেশ্য করে বললো , ‘এইতো! মাত্রই সে আবারো আমার কথার সত্যতা প্রমাণ করে দিল।পিঠে আঘাত অনুভব করলাম আমি ! ‘
নিনাদ আর মুখ গোমড়া করে থাকতে পারলো না। ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো। রওশান উৎফুল্ল হয়ে বললো, ‘যাক! অবশেষে মেঘ কাটলো। এই ভাগ্যবান শ্রবণেন্দ্রিয় জোড়া তোমার সুমধুর হাসির শব্দ শুনতে পেল!’
নিনাদ ফের হাসলো। বললো, ‘ভাই, আর লজ্জা দিয়েন না।ঢাকায় এলেন কখন ? কবে দেখা করছেন সেটা বলুন।’
-‘আমার আর আসার সময়-অসময়! যখন মন চাচ্ছে তখনই হুট করে চলে আসছি।এখন আর আগের মতো পাহাড় দেখলেই কবিতা আসে না। ওখানে থেকে কি করি বলো !
ছাড়ো এসব। আমার কথা বাদ দাও।তোমার আলাপ বলো।আমার রেজিস্ট্রি করা সত্যিকারের ছোট গিন্নির সাথে নাকি কিসব গন্ডগোল বাঁধিয়েছ? একেবারে নাকি ফিল্মি ব্যাপার স্যাপার? ‘
নিনাদের কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটা পড়ার মতো অবস্থা হলো। সে লজ্জিত হয়ে চুপ করে রইল। বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না।’
ব্যাপার টা বুঝতে পেরে ফোনের এপাশে রওশান মিটিমিটি হাসতে লাগলো। তিহাও যোগ দিল সে হাসিতে।ছোটন একমনে আকাশের তারা গুনছিল।এবার সে তারা গোনা বাদ দিয়ে তাকিয়ে দেখলো তার মা বাবা ফোনের ওপাশে নিনাদকে কিসব বলে খুব হাসছে। অতএব সে হাসিতে যোগ দেয়াকে সে নিজের কর্তব্য বলেই ভাবলো। এবং কর্তব্য পালনে গুরুতর ভাবে হাসিতে যোগ দিল!
স্বামীর সাথে হাসিতে যোগ দিলেও তিহা বুঝল কথাটা নিনাদের বেজেছে খুব।তাই সে এবার নিজেই ফোন টেনে নিয়ে কথা শুরু করলো। প্রথমেই নিনাদকে বিশাল আকারের একটা ঝারি দিল আজকাল তার দেখা পাওয়া এমন অসম্ভব হয়ে উঠেছে কেন তা জানতে চেয়ে। তারপর তুললো ট্যুরের কথা। বললো এবার শীতে তারা বান্দরবানে ট্যুর দেবে।রওশান তো সেখানে আছেই।সে-ই তাদের সবাইকে ঘুরে ঘুরে দেখাবে সব। নিনাদ এবিষয়ে কোন মন্তব্য করলো না। নিরবে সায় দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত গাম্ভীর্যের সাথে শুধু বললো,’হু’। তিহা অবাক হলো সাথে অপ্রতিভ ও। নিনাদ আর যাই করুক, তার ওপর যত ঝড়ই বয়ে যাক এতটা নির্লিপ্ত সে কখনো থাকে না। তিহা রাগত্ব স্বরে বলল, ‘কিরে, হু বললি যে শুধু ? কিছু তো বল।’
নিনাদ শীতল স্বরে বলল,’কি বলবো? তোরা প্ল্যান কর।’
-‘প্রতিবছর তো তুই-ই সবকিছু প্ল্যান করিস।বরং আমরাই থাকি চুপচাপ। এবার উল্টো নিয়ম কেন ? কি এমন হয়েছে হঠাৎ ? ‘
-‘কি হবে? কিছুই না।তোরা প্ল্যান চালিয়ে যা।’
-‘সত্যি করে বলতো নিনাদ কি হয়েছে তোর ? কথা এমন ভাবে বলছিস যেন এবার আমাদের ট্যুর আসার আগেই তুই দেশ ছেড়ে উড়াল দিবি !’
নিনাদ স্থির কণ্ঠে বলল, ‘হতেও পারে। ‘
-‘ফাজলামো ছাড়। আসল কথাটা বল।অনেকক্ষণ ধরেই মনে হচ্ছে খুব বড় কিছু একটা তুই আমাদের থেকে লুকোচ্ছিস।’
নিনাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো তিহা জানে না নিজের অজান্তেই কখন সে নিনাদের না বলা কথাটা বলে ফেলেছে।
রাত বারছে।সেই সাথে ধীরে ধীরে বারছে রাতের বাতাসের শীতল ভাব।শ্রাবণের অনাকাঙ্ক্ষিত স্বচ্ছ রাতের আকাশে ছোট বড় অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে।পশ্চিম আকাশ থেকে ভেসে আসা সাদা মেঘের আড়ালে মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ছে তারাগুলো। কি আশ্চর্য সুন্দর এই মধ্যরাতের আকাশ, পৃথিবী ! শুধুমাত্র এই সৌন্দর্য দেখার জন্য কি কেউ কখনো জাগতে পারে? রাতের পর রাত? যে পারে সে নিশ্চয়ই প্রেমিক! প্রেমিক ছাড়া আর কার চোখই বা এই রাতের কাব্য বোঝে!
তিহা আর রওশান দুজনেই এবার বুঝলো কিছু একটা গন্ডগোল নিশ্চয়ই আছে নিনাদের সাথে।তার কথাগুলো খাপছাড়া,বড় এলোমেলো।অতএব স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে নিনাদকে ধরলো।যে করেই হোক নিনাদের গোপন কথাটা আজ তারা জেনে তবে ছাড়বে। তিহা তো ফোনেই প্রায় নিনাদের গলা চেপে ধরতে চাইল যেন! নিনাদ ভয় পেল,হার মানলো।বুঝলো এরা নাছোড়বান্দা।না বললে আর এই যন্ত্রণার মুক্তি নেই।ফলাফল, সে রাতে নিনাদ তাদের দুজন কে একটা বিস্ফোরক তথ্য জানাতে বাধ্য হল!
চলবে………
অদ্রিজা আহসান
দূর আলাপন
পর্ব-৪
________________________
শ্রাবণের আরও একটি বিষন্ন দুপুর। আকাশ জুড়ে ভেসে থাকা ছিন্ন কিছু সাদা মেঘ আর সোনালী রোদ। শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা দুপুরের মিষ্টি সে রোদের লুকোচুরি খেলা। কখনো বা ছাদের এককোণে, কখনো আবার গাছের ডালে, পাতায় পাতায় একফালি রোদ্দুর।
তিতিক্ষাদের বাড়ির উঠোন এখনো পুরোপুরি শুকোয়নি। সকালের ঝুম বৃষ্টির রেশ এখনো রয়ে গেছে ভিজে মাটিতে। অতিবৃষ্টির ফলে এই অসময়েও কামিনী ফুলের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। এই মধ্যদুপুরে বাড়ির আর সকলে যখন ভাতঘুম দিচ্ছে নিশ্চিন্তে , তিতিক্ষা তখন একখানা ইংরেজি কবিতার বই হাতে তাদের সোঁদা গন্ধ ওঠা ভেজা মাটির উঠোনে ধীর পায়ে হাটছে। চোখ বুজে মাঝে মাঝে আওড়াচ্ছে কবিতার দু একটা লাইন ।
As I looked into his eyes
And found his longing stare
I stopped myself from saying words
That would show how much I care….
লোকে ভাবে, যে ধর্ম নিজেকে আড়াল করতে শেখায়, অট্টহাসিতেও নিষেধ দেখায় সে ধর্ম তো সন্ন্যাসেরই নামান্তর! যে নামায পড়ে, কোরআন পড়ে, সে হাতে তবে কেন আবার ইংরেজি নভেল উঠবে! তিতিক্ষা চোখ বুজে কথাটা ভেবে আনমনে হেসে ওঠে। এই ধারার কথা জীবনে সে কম বার তো শোনেনি! স্কুলের দিনগুলোতে টিফিন টাইমে বাকিরা যখন কানামাছি খেলতে ছুটে মাঠে যেত, তিতিক্ষা তখন সেই ফাঁকা ক্লাসে বসে ফরজ সালাতটুকু শেষ করে উপন্যাসের পাতা ওল্টাতো। মেয়েরা তখন মুখ ভেঙচিয়ে বলত, ‘দেখ কান্ড! দিনরাত হাদিসের বুলি ঝেড়ে এখন আবার প্রেমের উপন্যাস পড়া হচ্ছে! আর কি কি যে দেখবো! ‘
কথাগুলো ভেবে তিতিক্ষার এখন দুঃখ হয়না আর। সবাই ত্যাগ করেছে তাকে। সমাজ, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব। ছাড়তে পারেনি শুধু সে নিজে। অথচ সমাজের কাছে তার ভুলের কোনো অবধি নেই। সে দাম্ভিক, হিংসুক, পরশ্রীকাতর, অমিত্রোচিত, গেয়ো ভূত আরো কত কি! অতএব সমাজে তার স্থান অতি ন্যূন!
সেই নিস্তব্ধ দুপুরে বিষন্ন মনের অনুকূল আবহাওয়ায় তিতিক্ষা আরো অনেক কথা ভাবে। নানান ভাবনার মাঝে একটা অপ্রিয় ভাবনাও উঁকি মেরে যায় থেকে থেকে। তিতিক্ষা ভাবতে চায় না। আবার এই অভেদ্য রহস্য ভেদ করতে না পেরে শান্তিও পায় না। কি ভীষণ জ্বালা!
ওড়না প্রান্তে হেচঁকা টান পড়তেই তিতিক্ষা ঘুরে তাকায়। ছোটন দাঁড়িয়ে আছে। তার ঘুম ভাঙা ফোলা ফোলা চোখ মুখ, এলোমেলো হয়ে থাকা মাথার চুলে তাকিয়ে তিতিক্ষার হাসি পায়। সে আঙুল দিয়ে আঁচড়িয়ে চুলগুলো ঠিক করে দেয় তারপর ছোটনকে কোলে তুলে নিয়ে আচমকা তার গাল চেপে ধরে চুমু খায়। বলে,’ছোট মিয়ার ঘুম এতো জলদি শেষ? মা জানলে পিঠে যে দুরুম দুরুম পড়বে। জানা আছে তো? ‘
ছোটন ভেংচি কাটে। ভাবটা এমন দেখায় যেন মা জেনে গেলে কি ছাই করবে সে তার জানা!
তিতিক্ষা ফের মুচকি হাসে। বলে, ‘ তা এই ভরদুপুরে এখানে তোমার কি চাই? এর চেয়ে কি মায়ের সাথে ঘুমটাই ভালো ছিল না? ‘
ছোটন ডানে-বামে মাথা নাড়ে। বলে, ‘আম্মো তো ঘুমায় না। আম্মোর মন খারাপ। তাই রাগে শুধু আমাকে মারে। সেজন্যই চলে এসেছি আমি। আর যাবোই না।’
মারের কথা শুনে তিতিক্ষার ভুরু কুঁচকে যায়। বুবুর এই স্বভাব টা সে ভয়ানক অপছন্দ করে। কিছু হলেই ছেলেটার গায়ে হাত তোলে। তিতিক্ষা ছোটনের গালে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘ফের মেরেছে তোমাকে? দাঁড়াও আজ তোমার মায়ের নামে বিচার বসাবো আমি।’
ছোটন সায় পেয়ে তার মিমির কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
তিতিক্ষা বই রেখে এবার তাকে কোলে নিয়েই উঠোন জুড়ে হাটতে থাকে। অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করে, -‘ছোট মিয়া?’
-‘হু’
-‘তোমার আম্মোর আজ হঠাৎ মন খারাপ কেন হলো? ‘ তিতিক্ষা উত্তরের অপেক্ষা করে না।মনের বেখেয়ালে আনমনেই প্রশ্নটা সে করেছিল।
ছোটন এতো কিছু জানে না। তবে সেদিন রাতে তার ভবিতব্য শ্বশুর নিনাদ ওরফে তার বেস্টু ফোন রাখার পর থেকেই সে দেখছে মায়ের মন খারাপ। সেটাই সে তিতিক্ষাকে বোঝাতে লাগলো। এর আগেও কয়েকবার নানান কথা দিয়ে ব্যাপার টা সে তিতিক্ষা কে বোঝাতে চেয়েছে। তবে ছাত্রীটি নিতান্ত অমনোযোগী হওয়ায় বারবারই সে ব্যার্থ হয়েছে। তিতিক্ষা কিছুই বোঝেনি। শুধু এটুকু বুঝেছে, আড়ালে কিছু একটা চলছে। গভীর কিছু। তবে সে যাই হোক আনন্দদায়ক কিছু যে নয় এটা সে নিশ্চিত! গত দুদিনে সে দেখেছে বুবুর হাবভাব ভালো নয়। ভেবেছিল রওশান ভাই চলে গেছে তাই হয়তো মন খারাপ। কিন্তু রওশান ভাই তো কিছুদিন পর পর আসে, আবার চলেও যায়। আর সময় তো বুবু এমন গুম মেরে বসে থাকে না কখনো। তারপর বুঝলো ব্যাপার যাই হোক, সেখানে নিনাদ জড়িত। এর মাঝে থাকা তার চলে না । অতএব তিতিক্ষা আগ্রহ হারালো। তাই সে এখন নিশ্চুপ বুবুর এই অতর্কিত গুমরে যাওয়া দেখেও।
ক্রমে ক্রমেই বেলা পেরিয়ে অপরাহ্ন হয়ে এলো। তিতিক্ষা সোফায় হেলান দিয়ে বসে একটা বাচ্চাদের গল্পের বই হাতে জোরে জোরে পড়ে শোনাচ্ছে। ছোটন তার পাশে গা এলিয়ে দিয়ে আধশোয়া হয়ে বই পড়া শুনছে। তখন শেষ মধ্যাহ্নে উঠোনে হাটাহাটির পর আসরের আযান পড়তেই তারা দুজন ঘরে ফিরে এসেছিলো। তারপর তিতিক্ষা ছোটনকে পাশে নিয়েই সালাত আদায় করেছে। এরপর থেকেই এখানে বসে এরূপে তাদের বইপড়া চলছে। মারুফ সাহেব এখনো মসজিদ থেকে ফেরেননি। তিহা রান্নাঘরে আলুর চিপস ভাজছে। ক্রিংক্রিং করে টেলিফোনটা বেজে উঠল। তারপর অনবরত বাজতেই থাকলো। ছোটন গভীর মনোযোগে শুনছিল রাজকন্যার রাক্ষসপুরীতে বন্দী হওয়ার কাহিনি। তাই হঠাৎ এভাবে বাঁধা পরায় সে যেন একটু বেশিই বিরক্ত হলো। তার ছোট ছোট গাঢ় কালো ভ্রু জোড়া কুঁচকে সে টেলিফোনের দিকে তাকাল। টেলিফোন তখনো বেজে চলেছে। তিতিক্ষা বই উল্টে রেখে টেলিফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ফোন কানে তুলে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম। কাকে চাই?’
ওপাশে নিরবতা।
‘হ্যালো, কে বলছেন? ‘
আবারো নিরবতা।
তিতিক্ষা ভুরু কুঁচকে নাম্বার টা দেখে নিয়ে হাতের ইশারায় ছোটনকে কাছে ডাকলো। মাঝে মাঝেই বাজে ছেলে ছোকরারা এভাবে রং নাম্বার থেকে কল করে ডিস্টার্ব করে। ছোটন কাছে এলে টেলিফোনে হাত চেপে সে ফিসফিস স্বরে বললো, ‘দেখো তো ছোট মিয়া কি বলে।’
এতবড় দায়িত্ব পেয়ে আত্ম অহামিকায় ছোট মিয়ার বুক ফুলে উঠল। টেলিফোন হাতে নিয়ে সে যতটা সম্ভব গলার স্বর কঠিন করে বলল, ‘হ্যালো।’
এবারেও ওপাশে স্থির নিরবতা।
ছোট মিয়া ফের ‘হ্যালো’ বলল। এবারেও উত্তর নেই। অতএব ছোট মিয়ার রক্ত গরম হতে বেশি সময় লাগলো না। সে এবার তার ছোট্ট শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,’হ্যালোওওওওও।’ এবার ঠিক কাজ হলো। ওপাশ থেকে একজন বৃদ্ধার খড়খড়ে গলায় আওয়াজ পাওয়া গেল। তিনি বিষম বিরক্ত কণ্ঠে বলছেন, ‘ও মারে মা….আমার কান শ্যাষ। ওই নিনাইদ্দা। তুই এইডা কারে ফোন করলি? চিককুর পাইরা তো আমার কানের পুক লারায়ালছে! ওরে আল্লাহ!’
নিনাদ লাফিয়ে ফের ফোন হাতে নিল। কল করে প্রথমে তিতিক্ষার কণ্ঠ শুনেই সে চুপ করে ছিল। তারপর বৃদ্ধার হাতে ফোন দিতে যতটা সময় লাগে। এর মাঝেই কি আবার হলো! নিনাদ বলল,’ হ্যালো। ‘
তিতিক্ষা ছোটনের দিকে কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে ছিল। এবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কে ছোট মিয়া?’
ওপাশে বৃদ্ধার খড়খড়ে গলার কথা শুনে ছোট মিয়ার ততক্ষণে মুখ শুকিয়ে এসেছে। সে টেলিফোনে কান থেকে নামিয়ে নিয়েছিল তৎক্ষনাৎ। বললো, ‘জানি না। ‘ বলেই টেলিফোন তার হাতে ছেড়ে ভোঁ দৌড় দিল। তিতিক্ষা মস্ত বিপদে পড়লো। ছোটন কেন এভাবে হঠাৎ ভয় পেয়ে পালালো? ওপাশে কে আছে? না জেনে তার একদম কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ওদিকে তার হাতে থাকা টেলিফোন তখনো ভাইব্রেট হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ওপাশে নিশ্চয়ই কেউ কিছু বলছে। তিতিক্ষা সংকোচ নিয়ে ফোন কানে তুললো। বলল, ‘হ্যালো।’
এই স্বর চিনতে নিনাদের দেরি হলো না। সে তৎক্ষনাৎ পাশে থাকা বৃদ্ধার হাতে ফোন দিয়ে বললো, ‘ নাও, কথা বল।’
বৃদ্ধা ফোন নিলেন। হেসে বললেন, ‘তিহা নাকি তুমি? কেমুন আছো? কউ তো আমি কেডা?’
তিতিক্ষা হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কে এই বৃদ্ধা, এভাবে পরিচিতের মতো কথা বলছেন। সে বুঝতে পারলো না। মিনমিনে স্বরে বলল, ‘জ্বি……আসলে। আপু তো এখানে নেই। আমি ওর ছোট বোন। দাঁড়ান, এক্ষুনি আমি আপুকে ডেকে দিচ্ছি। ‘
এই বলে কান থেকে ফোন নামানোর আগেই তিতিক্ষা শুনল ভদ্র মহিলা বেশ উৎসুক কণ্ঠে বলছেন, ‘ও তুমি তিতিক্ষা! তোমারেও তো আমি চিনি। কেমুন আছো তুমি? ‘
-‘জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো আছেন? ‘
-‘আল্লায় রাখছে কোনো রকম। তোমার আপায় কই? তারে ডাকো। বল শিউলি ফুআম্মা ফোন দিসে। ‘
-‘জ্বি….জ্বি। এক্ষুনি ডাকছি।’ বলে ফোন নামিয়ে রেখে তিতিক্ষা যেন হাফ ছেড়ে বাচঁলো। দৌড়ে গেল রান্নাঘরে তিহাকে ডাকতে। তিহাকে বাইরের ঘরে টেলিফোনের ওখানে পাঠিয়ে দিয়ে এবার সে নিজেই চিপস ভাজায় হাত দিল। এরপর অনেক সময় কেটে গেলেও তিহার আর দেখা নেই। সে এলো বিস্তর সময় পর মুখে একরাশ হাসি নিয়ে।
-‘কে ছিলো বুবু? এতো সময় ধরে যে কথা বললে? ‘ তিতিক্ষা চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে বলল।
-‘ শিউলি ফুআম্মা কে মনে আছে তোর? একবার কলেজে থাকতে তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম নিনাদের বাসায়। তখন যে এসেছিল? ‘
নিনাদের নাম শুনেই তিতিক্ষার সমস্ত উৎসাহ মুহুর্তে উড়ে গিয়ে সেখানে রাশি রাশি বিরক্তি এসে জমা হলো। সে বিরস মুখে বলল, ‘নাহ মনে নেই।’
নিজের খুশিটুকু যেভাবেই হোক প্রকাশ করতে তিহা উতলা তখন। সে তাই চুপসে না গিয়ে দিগুণ উৎসাহে বলল,’ ফুআম্মা যে কি ভালো মানুষ! কি ভালো টাই না বাসতেন আমাদের সে সময়। একদম নিজের আপন চাচি-ফুফুর মতো।
তোর মাথায় যে কি! কিছু মনে রাখতে পারিস না। তোকে নিয়ে যাওয়ায় কতো যত্নআত্তি করল সেবার। সব ভুলে গেলি?’
-‘তোমার কলেজে পড়ার সময়। সে অনেকদিন আগের কথা বুবু। মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক। ‘
-‘ছাই! আচ্ছা শোন, আসল কথাটাই তো বলা হয়নি। ফুআম্মা কেন ফোন করেছিল। নিনাদ তো চলেই যাচ্ছে তাই ফুআম্মা কে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে বুঝলি? নিনাদের চলে যাওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবেন ফুআম্মা । ও যাবার আগে ওর সাথে সাথে আমাদের কেও তিনি একবার দেখতে চান। তাই নিজেই দাওয়াত দিলেন। সামনের শুক্রবার নিনাদের বাড়িতে। আমি, ছোটন আর তুই। ইশশ দারুণ হবে। ফুআম্মার হাতের রান্না কি যে ভালো! খাওয়ার এই বড় সুযোগ।’
এসব কোন কথাই তখন আর তিতিক্ষার কানে যাচ্ছে না। সে তখনো বুবুর বলা ওই একটা কথাতে আটকে রইল। বুবু বলল নিনাদ চলে যাচ্ছে। হঠাৎ সে কোথায় যাচ্ছে? কেনই বা যাচ্ছে? এজন্যই বুঝি বুবুর এ’ কদিন এতো মন খারাপ ছিল! নিনাদ তো ছেলেমানুষ নয়। যদি দিন কয়েকের জন্য কোথাও যায়ই বা, তবে বুবুর এতো বাজছে কেন? আর সেই সুদূর গ্রাম থেকে নিজের ফুফুকে আনিয়ে তার এত আয়োজনই বা কেন? এই অভদ্র, বেহায়া লোকটা হঠাৎ যাচ্ছেই বা কোথায়!
তিহা তখন দারুণ খুশিতে হড়বড় করে একের পর এক কথা বলেই চলেছে। তিতিক্ষা চিন্তান্বিত। তার বুবুর ওই বেহায়া বন্ধুর হঠাৎ চলে যাওয়া নিয়ে সে চিন্তিত নয়। ওই লোক যেখানে খুশি যাক! তার তাতে কি! তবে সে চিন্তিত হচ্ছে যাওয়ার এই আয়োজন দেখে। বুবু, দুলাভাই আর সেই ফুআম্মা। সবার ব্যাস্ততা দেখে মনে হচ্ছে নিনাদ বহুদূর যাচ্ছে, বহুদিনের জন্য। একটা সুখস্বপ্ন নিয়ে। যেকারণে এই বিচ্ছেদও সবার কাছে এতটা আনন্দের!
________________________
সেদিন রাত্রিবেলা তিহা, রওশানের জোরের কাছে হেরে বাধ্য হয়ে নিনাদকে সব বলতে হয়েছিল। নিনাদ মুখ ভয়ানক গম্ভীর করে জানালো মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই সে দেশের বাইরে যাচ্ছে। বাইরে মানে আমেরিকা। ঢাবিতে অনার্স-মাস্টার্স শেষে একমাত্র যে লক্ষ্যটার পেছনে দিনরাত সে মরিয়া হয়ে ছুটেছিল। এখন সেই লক্ষ্যপূরনের দোর গোরায় সে দাঁড়িয়ে। জিআরই আর আয়েল্টস এর রেজাল্টের পর আমেরিকার তিনটা ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করেছিল সে। এরমধ্যে টলেডো থেকেই শুধু গ্রীন সিগনাল আসে। তার প্রোফাইলও তাদের পছন্দ হয়। ভিসা আবেদনও শেষ। এবার শুধু ভিসা ইন্টারভিউ টা বাকি। আর দিন পনেরোর মধ্যে বোধহয় সেটাও হয়ে যাবে। এরপর সামনের মাসেই কোন একটা দিন আকাশে উড়াল দিতে হবে।
তার কথা শেষ হতেই ফোনের এপাশে তিহা রওশান সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। ফোন লাউড স্পিকারে ছিল। তিহা চেচিয়ে বলল,’তুই সত্যি বলছিস? সত্যি তোর স্কলারশিপ টা হয়ে গেছে? আমি একটুও বিশ্বাস করি না। তুই এক্ষুনি কসম কাট তো।’
নিনাদ অস্ফুট স্বরে হাসলো। বলল,’কসম কাটতে পারবো না। ভয় ডর নেই নাকি আমার?’
-‘যদি সত্যি যেতে পারিস তাহলে একটা কসমে তোর কি সমস্যা? আমি কিছু শুনবো না। তুই কসম কাট জলদি।’
-‘আচ্ছা, যা বইন কসম। সত্যি যাবো। ওরা যদি শেষ সময়ে আমাকে নিতে না চায় তবুও ওদের পা ধরে হলেও আমি যাবো। এখন ঠিক আছে তো?’
তিহা হাসলো। আর কিছু বলতে পারলো না। খুশিতে তার চোখে জল আসছে। সে জানে, তার এই বন্ধু রূপী ভাইটার পুরো জীবন কেমন শূন্যতায় মোরানো। মা, বাবা, ভাই, বোন কাছের আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। সবাই তাকে রেখে বহু আগেই ওপারে নৌকা ভিরিয়েছে। শুধু রয়ে গেছে সে একা। জীবনের লড়াইটা সে তাই একাই লড়ে গেছে সবসময়। নিজের সর্বোচ্চ টা দিয়ে। আজকের এই অর্জন তো সে সত্যিই ডিজার্ভ করে। তিহা চোখ মুছতে লাগলো। সে কাঁদলে নিনাদ কষ্ট পাবে ভীষণ।
নিনাদের কথা শুনে রওশান তখন থেকে হা হয়েই ছিল কিছুক্ষণ। এবার বলল, ‘নিনাদ, শালাবাবু, মাথা টাথা ঠিক আছে তো তোমার? ‘
নিনাদ কিছু বুঝতে না পেরে বলল, ‘কেন ভাই?’
-‘নাহয় এমন একটা খবর কি আর কেউ এমন মুখ গম্ভীর করে দেয়! মনে হচ্ছে স্কলারশিপ পেয়ে নয়। তুমি নিতান্ত অনিচ্ছায় আমেরিকার কোনো এক কারাগারে দাসত্ব বরণে যাচ্ছো!
একথার উত্তর নিনাদ মুখে দিল না। তার গগনবিদারী হাসি মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে চূড়ে খানখান করে দিল।
তিহার ধ্যান তখন এখানে আর নেই। সেই অন্ধকার রাত্রিতে, সবার মাঝে থেকেও যেন সে খুব একা অনুভব করলো। দু’হাত একত্রে তুলি আকাশের দিকে তাকিয়ে বারবার শুকরিয়া জানাতে লাগলো আরশের মালিকের দুয়ারে।
বহুদূরের কোনো এক অন্ধকার ছাদে ঠিক এভাবেই একা বসে নিনাদের হঠাৎ করা গগনবিদারী হাসির শব্দ কি আর কারো কানেও এসে পৌঁছেছিল? সেও কি কেঁপে উঠেছিল অজানা অনুভূতির শিহরণে। কে সে? তিতিক্ষা নয়তো? কে জানে!
চলবে……
★অদ্রিজা আহসান