#প্রেয়সী
#নন্দিনী_নীলা
৩.
সমুদ্র বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে লাল বেনারসি পরিহিত মধুর দিকে। ভয়ে মধুর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। গ্রিরিলের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে হাতা কাটা গেঞ্জি পরা সমুদ্রের দিকে। ও থেকে থেকে ঢোক গিলছে।
আমতা আমতা করে বলল,,” আ প নি এখানে কেন? এটা কার রুম?”
” আমার রুমে এসে আমাকেই জিজ্ঞেস করছ আমি এখানে কেন? সো ফানি।”
মধু মাথা নিচু করে বলল,,” সরি ভাইয়া আমি বুঝতে পারি নি। আমি ভেবেছিলাম এটা রাহী আপুর রুম তাই ঢুকে পেরেছি।”
মধু কথা শেষ করেই দরজার কোনা দিয়ে বেরিয়ে এল তাড়াতাড়ি। কি বিব্রতকর অবস্থা। রাহীর রুম ভেবে এক কার রুমে এসে পড়ল। সমুদ্র ভ্রু কুটি করে মধুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মধু রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই চোখ সরিয়ে নিল।
মধু নিচে নেমে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে। না ভাই আর একা একা খুঁজবে না আবার কার রুমে গিয়ে বিপদে পরবে কে জানে। একটা অপরিচিত পুরুষের রুমে গিয়ে ও দাঁড়িয়ে ছিল ছি ছি। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই রাহীর ডাক কানে এল। পেছনে থেকে চিকন কন্ঠে ওকে ডাকছে।
” এই মধু কোথায় যাচ্ছ?”
মধু চমকে পেছনে ঘুরে তাকাল। রাহী ওর দিকে এগিয়ে এসেছে ওর পরণে নীল স্কার্ট ও গোলাপি টপস গলায় গোলাপি ওরনা পেঁচানো।
” কোথায় গিয়েছিলে?” কাছে এসে বলল।
মধু লজ্জিত মুখে বলল,,” আন্টি তোমার রুমে যেতে বলল। আর আমি ভুলে অন্য রুমে চলে গিয়েছিলাম।”
” ইটস ওকে। চলো আমার সাথে।” রাহী মধুকে নিয়ে নিজের রুমে এল। মধু খেয়াল করল এই রুমের সামনে ও এসেছিল ভেতরে থেকে বন্ধ ছিল। এটাই কি তাহলে রাহীর রুম? রাহী বন্ধ বেডরুম ক্রস করে পরের রুমটায় ওকে নিয়ে ঢুকল। ওটা তারমানে অন্য কারো রুম। ওটায় নক করলে আরেক ঝামেলা হতো। রাহী খুব কথা বলছে নিজের রুমে ঢুকে এটা ওটা দেখাচ্ছে। কথায় কথায় জানতে পারল রাহী এবার অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ছে। দেখে মনেই হয়না। বয়স অনেক কম মনে হয়। মধুকে নিজের একটা পোশাক দিল রাহী। দুজনের গায়ের গরণ অনেকটা এক রকম তাই মধুর রাহীর ড্রেস পরতে সমস্যা হলো না। মধু গায়ের গহনা খুলে রাহী কে রাখতে বলল। তারপর রাহীর দেওয়া সাদা টপস ও কালো লেডিস প্যান্ট হাতে ওয়াশরুমে
ঢুকে গেল। সময় নিয়ে মধু গোসল করল। গরমে সিদ্ধ হয়ে গেছিল ঠান্ডা পানি গায়ে পরতেই শান্তিতে চোখ বন্ধ করে নিল। মধু গোসল শেষ করে বেরিয়ে দেখল রাহী ফোন হাতে খাটে বসে আছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে ফোনে স্কল করছে। মধু আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। মাথার কোঁকড়ানো কোমরের উপর পর্যন্ত কালো চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পরে মধুর সাদা টপস ভিজে যাচ্ছে।
রাহী বলল,,” তোয়ালে নাও।”
মধু চুল হালকা মুছে বলল।
” আপু হেয়ার ড্রায়ার দাও। চুল শুকিয়ে একটু ঘুমাব।”
” এই তুমি আমাকে আপু আপু বলছো শুধু আমি কি খুব বেশি বড় নাকি। তোমায় তো আমার সমবয়সী লাগছে।”
রাহী গাল ফুলিয়ে বলল উঠে হেয়ার ড্রায়ার বের করে দিল। মধু হেসে বলল,,” বেশি বড় না মাত্র চার বছরের বড়।”
” বলো কি? তোমায় দেখে তো আমার সমবয়সী লাগে। তোমার বাসা কোথায়? কিসে পড়ো? জানা হলো না। আচ্ছা তোমরা কয় ভাই বোন?”
মধু বলল,,” এতো প্রশ্ন! এইতো দুই মাস আগে এইচএসসি পরীক্ষা দিলাম। তোমাকে দেখে তো আমি বিশ্বাসই করিনি অনার্স পড়। আপু খুব ক্লান্ত লাগছে একটু ঘুমাই পড়ে গল্প করব।” শেষের কথা মধু ক্লান্ত গলায় বলল।
” খাবে না?”
” না পরে খাব।”
মধু বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাহী ফোন টিপতে টিপতে বেরিয়ে এল। ও মেসেজে কথা বলছে ওর এক বিশেষ মানুষের সাথে। ও মেসেজে রিপ্লাই দিচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। হঠাৎ কারো গম্ভীর গলায় স্বর শুনে চমকে ফোনের স্ক্রিনে থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখল ফুয়াদ দাঁড়িয়ে আছে। রাহী ভয়ার্ত চোখে তাকায় ফুয়াদের দিকে। ফুয়াদ গমগমে গলায় বলল,,” প্রেম করছিস নাকি কারো সাথে?”
ফুয়াদের সরাসরি প্রশ্নে রাহীর বুক ধক করে উঠল। ফুয়াদ কে রাহী বাঘের মতো ভয় হয়। ফুয়াদ রাহীর সামনে এসে দাঁড়াল।
” ফোনটা দে।”
রাহী ভয়ে ফোন শক্ত করে ধরে রেখেছে পাঁচ আঙুলের মুঠোয়। তখনি দরজা খুলে বেরিয়ে এল সমুদ্র। রাহী আর ফুয়াদ কে সিরিয়াস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,,” কি হয়েছে ফুয়াদ। কি নিয়ে জেরা করছিস।”
সমুদ্রের প্রশ্নের জবাবে ফুয়াদ কিছু বলল না। রাহীর দিকে তাকিয়ে বলল,,” কি হলো দে।”
সমুদ্র রাহীর ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখে বলল,,” রাহী তুই যা এখান থেকে।”
সমুদ্র বলতে দেরি রাহীর স্থান ত্যাগ করতে দেরি হলো না। ছুটে চলে এল রুমে। সমুদ্র ফুয়াদের পিঠে চাপড় মেরে বলল,,” কি হয়েছে?”
” কিছু না।” ফুয়াদ দাঁত চেপে বলল।
” রাহীকে তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিস। আরেকটু হলে কেঁদেই দিত।”
” আমার মন বলছে রাহী প্রেম করছে।”
” করতেই পারে স্বাভাবিক।”
” কোন খারাপ ছেলের পাল্লায় পরল নাকি দেখতে হবে না?”
” তোর যুক্তি তর্কের কাছে নিজেকে নাদান বাচ্চা লাগে।”
ফুয়াদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। দুজনে নিচে নেমে এল।
রাহী নিজের রুমে ফিরে এসে এক গ্লাস পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিল আগে। ভয়ে ওর হাত পা অসাড় হয়ে আসছিল। ভাইয়া ফোনটা নিলে কেলেঙ্কারি হয়ে যেত। রাহী যে তার বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে এটা ভাইয়া জানলে কি হতো? আল্লাহ তাআলা জানেন! সমুদ্র ভাইয়া ঠিক সময়ে না আসলে আজ কিছুতেই ও ফুয়াদ ভাইয়ার জেরা থেকে বেঁচে ফিরতে পারত না। আর এই ভুল করা যাবে না। হোয়াটসঅ্যাপ থেকে কাঙ্খিত নাম্বারে থেকে আসা সব মেসেজ ডিলিট করে দিল। আবার যদি চেক করতে আসে তাই আগেই সাবধান হয়ে গেল।
মধু চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে দেখল চারপাশ অন্ধকার। পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়াচ্ছে যেন। ও পেটে হাত চেপে উঠে বসল। রাত কয়টা বাজে? পাশেই রাহী বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। গোলা কোঁকড়ানো চুল নিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করে ঘুমানোর ফলে চুল এলোমেলো কাকের বাসা হয়ে আছে। ও হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কার্পেট ছাড়া ফ্লোরে পা দিতেই শীতল অনুভব হলো। ওর কপাল কুঁচকে এল। গরমের দিনে এমন শীত শীত ফিল হচ্ছে কেন? ড্রিম লাইটের আলোয় ও রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এল। একটা কাক পক্ষি ও জেগে নাই। পিনপিন নীরবতা ছেয়ে গেছে বাসার প্রতিটা দেয়াল। মরার মতো ঘুমাচ্ছে সবাই। বাসার সাথেই যেহেতু মেইন রোড তাই দুই একটা গাড়ির হনের শব্দ কানে আসছে শুধু। মধুর ঘুম একবারে শেষ ও আর ঘুমাতে পারবে না। একেতে ঘুম নাই চোখে তার মধ্যে খিদে লেগেছে তখন কয়টা খেয়ে নিলে এখন এই মাঝ রাত্রিতে কষ্ট করতে হত না। মধু পা টিপে টিপে চোরের মতো সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করল। এর কারণ আছে সবাই ঘুমাচ্ছে ওর চলার মৃদু শব্দ ও এখন নিস্তব্ধ বাসায় তীব্র লাগবে। এজন্য এতো সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। মধু ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে রান্না ঘর ফ্রিজ খুলে ভালো করে দেখল কিচ্ছুটি নাই। হায় কি কপাল আমার। একটু খাবার ও বেশি হয় না এদের? এখন আমি খাব কি? সেই ফল? নো নো ফল খেলে এবার বমি হবে। বারবার ফল খেতে পারে কেউ এখন তো ভাতের খিদে লেগেছে। মুখটা ভোঁতা করে মধু ফিরে আসছিল হঠাৎ শব্দ পেল। এক জোড়া পা ধপাধপ শব্দ করে এগিয়ে আসছে। মধু তাড়াতাড়ি সোফার পেছনে লুকিয়ে পড়ল। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় দেখতে পেল ফুয়াদ পরিপাটি হয়ে এই মাঝ রাতে ফোন কানে কারো সাথে ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে সদর দরজা খুলল খুব আস্তে করে। তারপর খুব আলগোছে দরজা চাপিয়ে বাইরে চলে গেল।
মধু চোখ বড়ো বড়ো উঠে দাঁড়াল সোফার পেছনে থেকে। চোখে ওর চরম উত্তেজনা, বিষ্ময়, নিজের হতভম্ব দৃষ্টি সংযত করতে পারছে না। এই সাদা পাঞ্জাবি লোকটা যাচ্ছে কোথায় এই মধ্যরাতে? নিজের কৌতুহল দমাতে পারল না মধু। পা টিপে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল আর খুব সাবধানে দরজা ফাঁক করে উঁকি মারল। বাইরে ফুয়াদ শার্টের হাতা গুটিয়ে গ্যারেজে চলে গেল একটু পর গ্যারেজে থেকে গাড়ির হনের শব্দ হলো। সাদা গাড়িটা চালিয়ে ফুয়াদ বাসার বাইরে মেইন রোডে চলে গেল। হতভম্ব মধু হতবুদ্ধি চোখে ফুয়াদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
” তুমি এখানে কি করছ এই অসময়ে?”
কারো তীক্ষ্ণ কন্ঠে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল মধু। সন্ধ্যার মতো এখনো সমুদ্রের কাছে ধরা খেয়ে ওর লজ্জায় মাটির সাথে মিছে যেতে ইচ্ছে করছে।
মধু আমতা আমতা করতে লাগল,,” কি হলো উত্তর দিলে না?”
” আসলে হয়েছি কি ভাইয়া!” ঢোক গিলল মধু।
সমুদ্র বলল,,” হ্যা বলো তারপর?”
” আমার খুব খিদে পেয়েছিল তখন তো না খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন এসে দেখি কোন খাবার নাই তাই ফিরে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম উনি বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই মাঝরাতে উনাকে বাইরে যেতে দেখে কিছুটা না অনেকটাই বিস্মিত হয়েছি তাই দেখছিলাম।”
সমুদ্র বলল,, ” ছোটো মাঝে মাঝেই নিজের কাজের জন্য বেরিয়ে যায় এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি এভাবে ওকে নজরে রাখছিলে জানলে তোমার খবর হবে। এমনিতেই ও তোমাকে সন্দেহ করে শত্রু বলে।”
” কেন আমাকে শত্রু কেন ভাবে? আর এই মাঝরাতে কিসের কাজ উনি কি কাজ করে?” কৌতুহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করল সমুদ্র কে।
সমুদ্র বলল,,” তোমার না খিদে পেয়েছে। বাম পাশের কর্নারে একটা ফ্রিজ আছে দেখ ওখানে খাবার আছে গরম করে খেয়ে নাও। গুড নাইট।”
বলেই সমুদ্র চলে গেল। মধু বোকা চোখে তাকিয়ে রইল সমুদ্রের দিকে। তারপর তার বলা ফ্রিজ খোলে
সত্যি খাবার পেল। ঠান্ডা হয়ে আছে। ওর শরীর ম্যাচম্যাচ করছে। গা কাটা দিচ্ছে। ও হাত নিল কাঁপা হাতে। কিন্তু এটা গরম করবে কি করে? ও তো জীবনেও রান্নাঘরের ধারের কাছেও যায়নি। ও তো জানেই না চুলা জ্বালাতে হয় কি করে?
ঠান্ডা ভাত মুরগির গোশত দিয়ে খেতে লাগল। কিন্তু মুখটা কেমন রুচি হীন লাগছে। গা কেমন কাঁপছে। তাও খিদের জন্য কয়েক লোকমা খেয়ে উঠে দাঁড়াল। এমন অসুস্থ লাগছে কেন নিজেকে জ্বর হবে নাকি? মধু হাত ধুয়ে উপরে চলে এল আর রাহীর পাশে শুয়ে পড়ল। শুয়ে পড়েও ঘুমাতে পারছে না ফুয়াদ কোথায় গেল এই মাঝ রাতে কি কাজ করতে গেল জানার জন্য ছটফট করতে লাগল।
#চলবে…