দু’মুঠো_প্রেম
ফারজানা_আফরোজ
২
আদুরীর কথা শোনে ভয়ে তার গালে,কপালে বেঘোরে চুমু দিতে লাগলো সে। মরে যাবে কথাটা যেনো তার বুকে তীরের মতো লেগেছে। কাছের কোনো মানুষ যদি বলে মরে যাবে তাহলে মনের ভিতর কি চলে তা সেই মানুষটা ছাড়া আর কেউ বুঝে না। ভয়ে ভয়ে আদুরীর কপালে গায়ে হাত বুলিয়ে বলল,
– জ্বর তো নেই তাহলে কি হয়েছে তোর?
– আমার সাথে আসো আমার পড়ার টেবিলের কাছে পরে বলছি।
আদুরী আদিবাকে নিয়ে গেলো তার পড়ার টেবিলের কাছে। দরজার দিকে তাকিয়ে মা বাবাকে দেখতে না পেয়ে বলল,
– আমাদের স্কুলের সিয়াম ভাইয়া আমাকে হুমকি দিচ্ছে আপু। আমি যদি জিসান ভাইয়ার কাছ থেকে চকোলেট নেই তাহলে নাকি আমাকে মারবে। এই দেখো একটা চিঠি।
চিঠিটা ধরিয়ে দিল আদিবার হাতে। বাচ্চা হাতের লেখা দেখেই বুঝা যাচ্ছে, চিঠিতে লিখা আছে,
আদুরিনী,
তুই ওই জিসানের কাছ থেকে চকোলেট নিবি না। এখন থেকে চকোলেট আমি তোকে কিনে দিবো। কথা না শুনলে মাইর হবে মাইর।
বেশ অবাক হলো আদিবা। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো,
– কোন ক্লাসে পড়ে সিয়াম?
– ক্লাস থ্রী।
আদিবার মাথায় চিন্তার ভাঁজ। ক্লাস থ্রির ছেলে এই ধরনের চিঠি লিখতে পারে তার কাছে অজানা। তার ছোট বোন আদুরী সবে প্লের গণ্ডি ছাড়িয়ে নার্সারিতে উঠেছে। মেধা ভালো থাকায় বাংলা বানান খুব সহজেই সে শিখে নিয়েছে। আর এখন কিনা সেই নার্সারি পড়া মেয়েকেও লাভ লেটার পাঠানো হয়? ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন যে সত্যিই ডিজিটাল হয়ে গেছে। কিন্তু ছোট বোনকে এই বয়সে এইসবে জড়ানো একদম ঠিক না তাই মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে আদুরীকে কোলে নিয়ে বলল,
– বনু, তুমি এখন থেকে জিসান কিংবা সিয়াম কারো সাথেই কথা বলবে না কেমন?
– কেন আপু?
– কারণ তোমার এখন খেলাধুলা এবং পড়ালেখা করার বয়স। মাথার মধ্যে বড়দের চিন্তা ভাবনা নেওয়ার বয়স না। তুমি জানো যেদিন তুমি ডক্টর হবে তখন কত কত মানুষ তোমার কাছে আসবে সেবা নেওয়ার জন্য। তোমার খুব ইচ্ছা মানুষের সেবা করা তাই না?
– হুম তো। এখন তো ছোট আমি তাই পারছি না। জানো সেদিন একটা নানু আসছিল, কি ময়লা কাপড় তাই আমি আম্মুর আলমারি থেকে অনেক সুন্দর একটা শাড়ি ওই নানুকে দিয়ে দিছি। নানুটা বলছিল তার নাকি ক্ষুধা লাগছে তাই আমি ফ্রিজ থেকে আইস্ক্রিমের বক্স,পাউরুটির প্যাকেট দিয়ে দিছিলাম। নানু তখন হেসে হেসে বলেছিল, আজ অনেকদিন পর আমার সোহাগ বড়োলোকের আইসক্রিম খাইবো। আচ্ছা আপু বড়োলোকের আইসক্রিম কি?
আদিবা বুঝলো কোনো বয়স্ক মহিলা ভিক্ষা করার জন্য এসেছিল। আম্মু হয়তো ঘুমিয়েছিল সেইজন্যই এই বুড়ি যা মনে হয়েছিল তাই করেছে। বুকের বাঁ পাশে এক ধরনের শান্তির বাতাস বইতে লাগলো। আদুরীকে বলল,
– তুমি যে তাকে ভালোবেসেছো সেইজন্যই উনি খুশি হয়েছেন। আচ্ছা বাসায় ভাত ছিলো না?
আদুরী মুখ কালো করে বলল,
– আমি ভাতের পাতিলে ধরতে পারিনি। ভীষণ ছোট তো আমি। আম্মুকে ডাকতে গিয়েছিলাম পরে দেখি আম্মু ঘুমাচ্ছে। তুমি তো জানোই ঘুম থেকে ডাকলে আম্মুর মাথা ব্যাথা করবে সেইজন্যই হাতের কাছে যা পেয়েছি তাই দিয়েছি।
আদুরীর কপালে চুমু দিয়ে বলল আদিবা,
– এই না হলে আমার বোন। এখন থেকে জিসান কিংবা সিয়াম কারো সাথেই কথা বলবে না। আজ থেকে চকোলেট আমি কিনে দিবো তবে বেশি নয় কারণ,,,,,।
আদিবা বলার আগেই আদুরী বলল,
– দাঁতে পোকা হতে পারে হিহিহিহি।
আদুরীর কথায় হাসলো আদিবা।
_______________
আজকের দিনটা হলো শেয়াল মামার বিয়ে। আকাশে দেখা যাচ্ছে এই বৃষ্টি এই রোদ। সূর্য মামার কঠিনতম আলোর মাঝে পড়ছে ঝিরঝির বৃষ্টি। আবার দেখা যাচ্ছে ঢাকঢোল পিটানোর মতো বজ্রপাতের শব্দ। বড্ড একগুঁয়ে লাগছে ফয়সালের। আকাশের এই রঙ ঢং তাকে আটকিয়ে রেখেছে বাসায়। জামতলার মোড়ে আজ বিচার হবার কথা কিন্তু আকাশের রঙ তামাশার কারণে হচ্ছে না। একা একা যখন বোরিং ফিল করছিল সে, তখনি তার বন্ধু আরিফ এসে দাঁড়ালো তার পাশে। আরিফের মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে আজ সে ফয়সালের পিছনে লাগার জন্য এসেছে। বিরক্তি নিয়ে বলল ফয়সাল,
– কি চাই?
– আরেহ দোস্ত রাগ করছিস কেন? ওহহ বুঝছি একা একা বোরিং হচ্ছিস। একে তো ঝিরঝির বৃষ্টি তার উপর বউ ছাড়া বোরিং তো হওয়ারই কথা।
– বাজে কথা বন্ধ কর। কেন এসেছিস? নিশ্চয় আব্বু কিছু বলেছে?
সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো ফয়সাল। আরিফ মুখে দুষ্টু হাসি রেখেই বলল,
– এইজন্যই তোকে এত ভালোবাসি দোস্ত। মুখ দেখেই মনের কথা বুঝে ফেলিস। তো সেই বাঘিনীর পরিচয় কি রে? শুনলাম মেয়েটার বাবার ফোন বন্ধ।
– ওই মেয়ে আব্বুকে ভুল নাম্বার দিয়েছে। আব্বু সেটা না বুঝলেও আমি কিন্তু ঠিকই বুঝে গেছি।
– বলিস কি! সত্যিই তাহলে মেয়েটার বুকে দম আছে বন্ধু। তোর আব্বুকে ভুল নাম্বার দেওয়ার জন্যও এমন একটা ভাবী চাই।
ধমকের সুরে বলল ফয়সাল,
– তুই এইখান থেকে যাবি। আর ওই মেয়ের প্রশংসা আবার করলে এক্ষুনি তোকে ধাক্কা মেরে জানালা দিয়ে ফেলে দিবো। শুধু ওই ফাজিল মেয়ের সাথে দেখা হোক দেখিস কি করি। ভুল নাম্বার দেওয়া তাই না বুঝাবো ভুল নাম্বার কাকে দিয়েছে।
রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে পড়ল ফয়সাল। কিছুতেই সে এই অপমানটা মেনে নিতে পারছে না। ফয়সালের পিছু পিছু আরিফও ছুটলো।
___________________
দুধ চা হাতে নিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে আদিবা। বাইরে থেকে মিষ্টি বাতাস তার খোলা চুলগুলো বারবার এলোমেলো করে দিচ্ছি। চা এর কাপে শব্দ করে চুমুক দিল সে আর বলতে লাগলো,
– আহা। কি সাধের চা আমার। বাহিরে বৃষ্টি আর আমি গরম চা হাতে নিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছি ব্যাপারটা ভীষণ ধারুন। তবে আজকের বৃষ্টিটা কেমন যেন মানানসই মনে হচ্ছে না আমার কাছে। বৃষ্টি হওয়া উচিত একদম ঝর্ণার মতো। আকাশ থেকে ঝিরঝির করে শুধু পড়বে, সেই বৃষ্টিতে আমি আমার রাঙা হাত দুটো ভিজিয়ে বৃষ্টি বিলাস করবো কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে রোদের সাথে তাল মিলিয়ে। এই রোদ এই বৃষ্টি। রোদ বৃষ্টির লুকোচুরি।
আদিবার কথার মাঝে উপস্থিত হলো আদুরী। কোমড়ে হাত রেখে গোলগোল চোখ করে কপালে চিন্তার ভাঁজ করে বলল সে,
– ইসসসসসস বাচ্চা মেয়েটা আবারো জানালা খুলে রেখেছে। দেখছো আপু , বাতাসে বৃষ্টির পানি রুমে এসে পড়ছে। এইগুলো কে পরিষ্কার করবে শুনি? এই আদুরীনি ছাড়া তো ঘর মোছার মানুষ এই বাসায় আর দুটি নেই। সকাল থেকে কাজ করতে করতে শরীর বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে আমার।
কথাগুলো বলেই আদুরী বিছানায় গা এলিয়ে দিল। আদিবা চোখ দুটো ছোট ছোট করে বলল,
– তুই আবার কবে থেকে ঘর মোছার দায়িত্ব নিয়েছিস? আচ্ছা বেতন কত তোর?
ছোট দুটো গাল ফুলালো আদুরী। অভিমানী কণ্ঠে বলল,
– তুমি বাসায় না থাকলে শেফালী আর মুনমুনকে নিয়ে ওই জায়গায় খেলি আমি। এখন বৃষ্টির কারণে জায়গাটা ময়লা হয়ে গিয়েছে সেইজন্যই এখন আমার পরিষ্কার করতে হবে।
শেফালী আর মুনমুন হলো আদুরীর দুইটা পুতুলের নাম। ভীষণ ভালোবাসা এই পুতুল দুটোকে সে। আদিবা হেসে বলল,
– ওকে যা আজ তোর পুতুলের থাকার জায়গা আমি পরিষ্কার করে দিবো। কষ্ট নেই তো আর?
আদুরী ভীষণ খুশি হয়ে আদিবার দু গালে চুমু দিলো।
______________
অরিন ও আদিবা কলেজের উদ্দেশ্য হাঁটা দিল। পার্কের সামনে দিয়ে যেতেই আদিবার চোখ দুটি চড়ক গাছ হয়ে গেলো। পাবলিক প্লেসে একজন ছেলে একজন মেয়ে গভীরভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করছে। চোখে হাত দিয়ে অরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ছিঃ কি নির্লজ্জ। এদের মা বাবা দেখে না এইসব। আমার শরীর শিউরে উঠছে বারবার। ছিঃ আল্লাহ কি দেখালো আমাকে। এই অরিন আমার চোখ পাপী হয়ে গেছে।
আদিবার কথা শোনে অরিন তাকালো সেই জুটির দিকে। চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
– ওরা রোমান্স করছে তোর সমস্যা কি?
– এইটা রোমান্স করার জায়গা?
– তো তোর বাসায় গিয়ে করবে বুঝি। জানিস আজকাল পার্ক তৈরি করা হয়েছে শুধু মাত্র প্রেমিক প্রেমিকার জন্য। যেদিন প্রেম করবি সেদিন বুঝবি।
রাগী কণ্ঠে বলে উঠলো আদিবা,
– ছিঃ কি বাজে বকছিস। প্রেম ভালোবাসা শুধু দৈহিক চাহিদা নয়। প্রেম ভালোবাসা হলো মনের চাহিদা। সত্যি কারের প্রেম ভালোবাসায় বিয়ের আগে এই অসামাজিক কার্যকলাপ কখনো কেউ করে না। দেখিস এই ভালোবাসা দুইদিন পর শেষ হয়ে যাবে যখন যে যার চাহিদা পূরণ করে ফেলবে।
– এইটা ঠিক। চল এই জায়গা থেকে তাড়াতাড়ি চলে যাই। পাশ ফিরে তাকালেই শরীর ঘিনঘিন করে আমার।
দুই বান্ধবী দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেলো। কলেজে আসা মাত্রই অঘটন ঘটলো তবে তাদের দুইজনের সাথে নয়। অঘটন ঘটলো,,,,,,,,,,
চলবে,
বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আদুরী ওর সামর্থ্য অনুযায়ী সেবা করেছে, সে যদি আজ বড় থাকতো ভাতের পাতিলে তার হাত যেতো, সেই মহিলাকে সে ভাত খাওয়াতে পারতো। ঠিক তেমনি আজ আমরা যদি আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আশে পাশের গরীব মানুষদের সাহায্য করি এক বেলা তারা ভালো কিছু খেতে পারবে।