#মরীচিকাময়_ভালোবাসা
#পর্বঃ৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি
মৌরী ভার্সিটির গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে প্লাবণের অপেক্ষায়। হঠাৎ করেই আকাশে ঘন মেঘের আগমন। মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই ঝড় উঠবে।
প্লাবণ নিজের বাইক নিয়ে বাইরে আসল। মৌরী আশা নিয়ে এগিয়ে গেল কিন্তু প্লাবণ মৌরীকে না নিয়ে একা একাই চলে গেল। মৌরীর মুখটা মলীন হয়ে গেল। প্লাবণ যে তার ভালোবাসার বিনিময়ে এত ঘৃ’ণা উপহার দেবে সেটা ভাবতে পারে নি। মৌরী এবার পণ করল আর মুখ বুজে সব সহ্য করবে না। স্বগতোক্তি করে বলল,
“ঘৃণার বদলে ঘৃণা আর ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা।”
এরমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। মৌরীর কাছে ছাতা ছিল না। তাই সে পাশেই একটা ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। অপেক্ষা করতে লাগল বৃষ্টি কমার।
ঘন্টাখানেক কে’টে গেল। কিন্তু বৃষ্টি কমার কোন নামগন্ধ দেখা যাচ্ছে না। মৌরী বিরক্ত হলো খুব। আর কোন উপায় না দেখে ভাবলো হেটে হেটে সামনে এগিয়ে যাবে। তারপর কোন রিক্সা পেলে সেটায় করে যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। মৌরী পা বাড়াতে যাবে এমন সময় একটা গাড়ি এসে তার সামনে থামলো। মৌরী ভ্রু কুচকে রইল৷ সেই গাড়িটা থেকে নেমে এলো শামিম। মৌরীকে দেখে বলল,
“ভাবি,আপনি এখানে কি করছেন?”
“বৃষ্টির জন্য আটকে গিয়েছিলাম।”
খুব বিরক্তির সাথে কথাটা বললো মৌরী। সুমাকে দেখার পর থেকে তার মন মেজাজ খা’রাপ। আর সুমা যেহেতু শামিমের বোন তাই শামিমের উপরেও তার রাগ হচ্ছে ভীষণ। শামিম মৌরীকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
“চলুন আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।”
“না, তার কোন দরকার হবে না। আমি দেখি কোন রিক্সা নিয়ে নেব।”
“এখানে আশেপাশে আপনি কোন রিক্সা পাবেন না। আপনার কাছে তো ছাতাও নেই। বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হতে পারে। তার উপর নির্জন রাস্তা। সেফটির ব্যাপারটাও তো আছে।”
মৌরী শামিমের কথাটা মনযোগ দিয়ে ভাবতে লাগল। সত্যি তো সে ভুল কিছু বলছে না। মৌরী কিছুটা রাজি হয়েছে বুঝতে পেরে শামিম বলে,
“আসলে আমি আমার বোন সুমাকে নিতে এসেছিলাম। ও এখানে ভার্সিটিতে অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিল। কিন্তু শুনলাম ও ওর কিছু বন্ধুদের সাথে চলে গেছে। আমি এখন আপনাদের বাসার ঐদিকেই যাব। কিছু জরুরি কাজ ছিল। তাই বলছিলাম আরকি..”
“ঠিক আছে,ভাইয়া। চলুন।”
মৌরী গাড়ির পিছনের সিটে উঠে পড়লো। শামিমও গাড়িতে উঠে গাড়ি চালানো শুরু করল। লুকিং গ্লাসে মৌরীকে বিষন্ন দেখে শামিম বলল,
“আপনাকে এমন লাগছে কেন ভাবি?”
“তেমন কিছু না।”
আর কোন কথা বাড়ালো না শামিম। এরপর ২৫ মিনিটের মধ্যে তারা দুজনে মৌরীদের বাড়িতে পৌঁছে গেল। মৌরী গাড়ি থেকে নেমে এলো। শামিমের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“আপনাকে ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনি আজ আমায় অনেক সাহায্য করেছেন। আমাকে নিজের বোন মনে করে আরো একটা সাহায্য করতে পারবেন প্লিজ?”
“হ্যাঁ, বলুন। আমি নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করবো।”
“খুব বেশি কিছু করতে হবে না। শুধু সত্য প্রকাশ করতে হবে।”
“মানে?”
মৌরী শামিমকে সব খুলে বলে যে প্লাবণ কিভাবে তাকে ফাসিয়েছে। সব শুনে শামিম দুঃখ প্রকাশ করে বলে,
“প্লাবণ যে এমন কিছু করবে আমি ভাবতেও পারিনি। ওর সাথে আপনার কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের ব্যাপারে আমি জানি কিন্তু ও যে এভাবে আপনাকে সবার সামনে নিচু করবে সেটা ভাবিনি।”
“আপনি কি সত্য প্রকাশে আমায় সাহায্য করবেন?”
শামিম একটু ভেবে বলে,
“আমি অবশ্যই করব। চলুন।”
★★★
প্লাবণ দাঁড়িয়ে আছে আতিফা বেগম ও মৌরীর সামনে। মৌরী প্লাবণকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“তোমার সব ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে বড় মা জেনে গেছে প্লাবণ। এবার তুমি ওনার মুখোমুখি হও।”
প্লাবণ মৌরীকে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। আতিফা বেগম রাগী স্বরে বললেন,
“তুই যে এত নিচে নামতে পারিস আমি ভাবতে পারিনি প্লাবণ৷ তুই তো নিজে থেকে মৌরীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলি। তাহলে এখন এমন কেন করছিস?”
প্লাবণ ভাবল যেহেতু আতিফা বেগম সব জেনেই গেছে তাই এখন আর কোন কিছু লুকিয়ে লাভ নেই। তাই সে বলল,
“আমাকে এসব জিজ্ঞেস করো না আম্মু। মৌরীকে বলো ও কিভাবে আমাকে বিরক্ত করছিল ক’দিন ধরে।যার কারণে আমি যে ওকে ভালোবাসিনা এটা প্রমাণ করার জন্য আমার ওকে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করতে হয়েছে।”
“কি বললি তুই, তোরা কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করেছিস।”
” হ্যাঁ, আর ৬ মাস পর আমি মৌরীকে নিজের লাইফ থেকে ছু’ড়ে ফেলে দিবো।”
প্লাবণের কথাটা বলতে দেরি কিন্তু আতিফা বেগমের তার গালে থা’প্পর মা’রতে মোটেই দেরি হলো না। ঠা’স করে থা’প্পর মে’রে তিনি বললেন, “মৌরীর জীবনকে কি তুই ছেলেখেলা পাইছিস নাকি? যখন ইচ্ছা হলো বিয়ে করবি আবার ডিভোর্স দিবি!”‘
প্লাবণ গালে হাত দিয়ে শক্ত গলায় বলল,
” তুমি আমায় মা’রলে আম্মু?”
“বেশ করেছি মেরেছি। দরকার হলে আরো মা’রবো। তুই পেয়েছিস টা কি?”
অতঃপর মৌরীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তুই এটা কি করলি? অন্তত আমাকে সবটা বলতে পারতি তাহলে আমি তোকে এত বড় একটা ভুল করতে দিতাম না।”
মৌরী কান্নাজড়ানো গলায় বলে,
“ভালোবাসায় অ’ন্ধ হয়ে গেছিলাম আমি। তাই ঠিক ভুলের তফাৎ বুঝতে পারি নি।”
“ভুল তো করেছিস এখন এই ভুলের শা’স্তিও তোকে ভো’গ করতে হবে। আরে প্লাবণ তো ছেলে ওকে কেউ কিছু বলবে না কিন্তু সমাজ তো তোর দিকেই আঙুল তুলবে। তুই কিভাবে এমন ছেলেমানুষি করলি বল তো?”
মৌরী নিশ্চুপ। প্লাবণ বলে উঠল,
“আমি আগেও বলেছি এখন আবারো বলছি আমি কারো কোন দায়ভার নিতে পারব না।”
আতিফা বেগম বলে ওঠেন,
“তোকে কারো দায়ভার নিতে হবে না। আমার মেয়ের দায়িত্ব আমি নিতে পারবো। আমি বেঁচে থাকতে মৌরীর চিন্তা আর কাউকে করতে হবে না।”
মৌরী ছলছল নয়নে আতিফা বেগমের দিকে তাকায়। আতিফা বেগম মৌরীকে বলে,
“তুই আমার সাথে আমার রুমে চল। এই পা’ষাণ ছেলেটার সাথে তোকে আর থাকতে হবে না।”
বলেই মৌরীকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যান তিনি।
★★★
আতিফা বেগমের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে মৌরী। ঘড়ির কা’টায় রাত ১২ টা বাজতে চলল কিন্তু তাদের কারো চোখেই ঘুম নেই। আতিফা বেগম মৌরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“তোর খুব খা’রাপ লাগছে তাই না মৌরী?”
“খারাপ তো লাগছেই বড়মা। আচ্ছা তুমিই বলো কাউকে ভালোবাসা কি অপ’রাধ?”
“না। একদম না। কিন্তু হ্যাঁ, ভুল মানুষকে ভালোবাসা অবশ্যই অপরাধ।”
“আমি কি তাহলে সেই অপরাধটাই করেছি?”
“হ্যাঁ রে মা। আসলে তোর এটা আবেগের বয়স তাই হয়তো বিবেকটা কাজ করছে না। তোর মতো বয়স আমিও পেরিয়ে এসেছি তাই আমি ব্যাপারটা বুঝি। এই বয়সে চোখে রঙিন পর্দা লাগানো থাকে। এই বয়সে ভালোবাসা হলো মরীচিকাময় ভালোবাসা। যার পেছনে ছুটে আদৌ কোন লাভ নেই। হ্যাঁ, এই বয়সের অনেক ভালোবাসাই সফল হয়। তবে সেটা ব্যতিক্রম। আর ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হতে পারে না।”
মৌরী মনযোগী শ্রোতার মতো আতিফা বেগমের কথা শুনছিল। সেটা ঠাহর করতে পেরে তিনি বলেন,
“ভালোবাসা কখনো বে’হায়াপনা করতে শেখায় না আত্মসম্মানী হতে শেখায়। পরস্পর দুজন মানুষের একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে ভালোবাসা। ভালোবাসা কখনো জোর করেও আদায় করে নেওয়া যায়না মৌরী৷ ভালোবাসা তো মন থেকে আসতে হয়।”
“আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি বড়মা। আমি প্লাবণের যোগ্য নই।”
“ভুল ভাবছিস তুই। প্লাবণই তোর যোগ্য নয়। তুই একদম চিন্তা করিস না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। ৬ মাস যাক,তারপর ডিভোর্স দিয়ে তুই নিজের মতো চলবি। আর একটা কথা মনে রাখিস নিজেকে আত্মসম্মানী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা কর। আর কখনো বেহা’য়ামো করবি না।”
“আমি তাই করব বড়মা। এখন থেকে আমি নিজের সম্মানকেই সবথেকে গুরুত্ব দেব।”
“হুম মনে রাখিস মান+হুশ=মানুষ। একজন প্রকৃত মানুষ হতে গেলে আত্মসম্মান থাকা দরকার।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨