মরীচিকাময় ভালোবাসা ৫

0
881

#মরীচিকাময়_ভালোবাসা
#পর্বঃ৫
#লেখিকাঃদিশা_মনি

মৌরীর মুখে মৃদু মৃদু হাসি শোভা পাচ্ছে। গতকাল রাতের সুমধুর স্মৃতি সে এখনো ভুলতে পারছে না। প্লাবণের সাথে কা’টানো তার স্বপ্নের রাত। কিন্তু হঠাৎ করেই মৌরীর কাছে সবটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। গত রাতের কথা ভেবে সে স্বগতোক্তি করে বলল,
“প্লাবণ তো শুধু দেহের টানে আমার কাছে এসেছিল! কিন্তু আমি তো ওর মনের কোণে স্থান পেতে চাই। তাহলে কি এটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেল!”

মৌরীর ভাবনার মাঝেই প্লাবণ গায়ে একটা তোয়ালে পেচিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। মৌরী কিছুক্ষণ প্লাবণের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল। প্লাবণ মৌরীর কাছে এসে বলল,
“আমি আবারো বলছি কাল রাতের দায়ভার কিন্তু আমি নিতে পারব না। সবটাই তোর জেদের জন্য হয়েছে।”

মৌরী কিছু বলতে পারে না। তার নিজের কাছেও সবটা এলোমেলো লাগছে। হয়তো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে একটু ভুলই করে ফেলেছে সে। এখন বড্ড আফসোস হচ্ছে। প্লাবণ মন থেকে তাকে মেনে নিলে তারপর এমন কিছু করলে ভালো হতো। মৌরী নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে প্লাবণকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
‘চিন্তা করবে না। আমি তোমাকে কোন কিছুর দায়ভার নিতে বলব না। আমি নিশ্চিত তুমি নিজে থেকেই দায়ভার নেবে।’

প্লাবণ কিছু না বলে বেরিয়ে যায়। মৌরী ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে।

★★★
দুপুরে আতিফা বেগমের সাথে বসে একসাথে লাঞ্চ করছিল মৌরী৷ কিন্তু সে যেন এখানে থেকেও নেই। নিজের ভাবনার জগতে পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে গেছে। কিছুই ভালো লাগছে না তার কাছে। সবটাই এলোমেলো লাগছে।

মৌরীকে অন্যমনস্ক দেখে আতিফা বেগম বলে ওঠেন,
‘কি হয়েছে রে তোর মৌরী? তোকে এত অন্যমনস্ক লাগছে কেন?’

“না, তেমন কিছু নয়।”

“তোকে আমি পে’টে না ধরলেও ছোটবেলা থেকে কিন্তু আমিই তোকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। তাই আমার থেকে বেশি তোকে কেউ চেনে না। তাই বলছি আমার থেকে কিছু লুকানোর চেষ্টা করবি না।”

“আমি কিছু লুকাচ্ছি না বড়মা। আসলে সকাল থেকে মাথাটা কেমন ব্যথা করছে।”

আতিফা বেগম আর কথা বাড়ালেন না। আসলে বাচ্চারা বড় হয়ে যাওয়ার পর তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যাপার সহজে বড়দের সাথে শেয়ার করতে চায়না। আতিফা বেগম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মৌরীকে আর কোন প্রশ্নই করলেন না। শুধু এটুকুই বললেন,
“সমস্যা চেপে রাখলে কোন সমাধান হয়না। তুই নিজের মধ্যে কোন কথা চেপে রাখিস না। কোন সমস্যা হলে সবার আগে আমার সাথে শেয়ার করবি।”

★★★
ঘড়ির কা’টায় রাত ১২ টা বাজতে চলেছে৷ কিন্তু প্লাবণ এখনো বাড়ি ফেরেনি। দুশ্চিন্তায় মৌরীর কপালে ভাজ পড়েছে। সেই থেকে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে মেয়েটা। একটু থেকে থেকেই অস্থির পায়চারি করছে।

“কি হচ্ছে আজ? প্লাবণ তো বাড়ি ফিরতে এত রাত করে না। সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার কথা বলে বেরিয়েছে কিন্তু এখনো ফেরার কোন নামই নেই।”

মৌরীর দুশ্চিন্তার পরিমাণ বাড়তে লাগল। এদিকে প্লাবণকে ফোন করলেও সে ফোনটা রিসিভ করছে না। বারংবার রিং হয়ে কে’টে যাচ্ছে। আতিফা বেগম সহ বাড়ির সকলে এখন গভীর ঘুমে মত্ত। তাই তাদের কাউকে বিরক্ত করতে চাইছে না মৌরী। এবার আর কোন উপায় না পেয়ে ভাবল বাইরে বেরিয়ে প্লাবণের খোঁজ করবে। এই চিন্তা মাথায় আসতেই থমকে গেল সে!

এত রাতে একা একটা মেয়ে কিভাবে বাইরে যাবে? তাছাড়া প্লাবণ কোথাও আছে সেটাও তো জানে না।

এমন সময় মৌরীর ফোনে হঠাৎ করে ফোন এলো। মৌরী দেখল প্লাবণ ফোন করেছে। সে দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে নিলো। ফোনটা রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে কেউ একজন বলে উঠল,
“ভাবি আমি প্লাবণের বন্ধু শামিম বলছি। প্লাবণ আমাদের সাথে একটা নাইট ক্লাবে আছে। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। আপনি এসে ওকে নিয়ে যান।”

মৌরী বুঝল না এখন কি করবে৷ একটু ভাবনা চিন্তা করে বলল,
“আপনি আমায় ঠিকানাটা বলুন আমি যাচ্ছি।”

শামিম ঠিকানাটা দিতেই মৌরী চলে যেতে লাগল সেখানে৷ বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার বাবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ভাগ্যিস আজ ড্রাইভার এখনো অব্দি ছিল। নাহলে যে কি হতো!

মৌরী কিছু সময়ের মধ্যে নাইট ক্লাবে পৌঁছে গেল। এর আগে কখনো নাইট ক্লাবে আসে নি। এখানকার পরিস্থিতিও তার কাছে ভালো লাগছে না। তাড়াতাড়ি এখান থেকে যেতে পারলেই যেন বেঁচে যায়।

নাইট ক্লাবে ভেতরে ঢুকে মৌরী আরো বেশি অবাক হয়ে যায়। কিছুটা খুঁজে প্লাবণকে দেখতে পায়। ঝিমোচ্ছিল সে। একটা ছেলে তাকে সামলাচ্ছিল।

মৌরী তাদের কাছে গিয়ে বলে,
“আপনি কি শামিম ভাইয়া?”

“জ্বি,আপনি নিশ্চয়ই প্লাবণের ওয়াইফ? এই নিন সামলান আপনার স্বামীকে। আমি অনেকক্ষণ থেকে ওকে সামলাচ্ছি।”

“আপনাকে ধন্যবাদ ভাইয়া ওর খেয়াল রাখার জন্য।”

প্লাবণের কাছে আসতেই মদের গন্ধে মৌরীর বমি পেয়ে যায়। অনেক কষ্টে সে নিজেকে সামলে রাখে। প্লাবণকে নিয়ে গাড়িতে ওঠায় সে। এরপর তাকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসে। ড্রাইভারের সাহায্য নিয়ে প্লাবণকে রুমের ভেতরে নিয়ে আসে।

প্লাবণকে বিছানায় শোয়ানোর পর ড্রাইভার চলে যায়। প্লাবণ চোখ মেলে তাকায়। তখনো তার নেশার ঘোর কা’টে নি। মৌরীকে নিজের কাছে টেনে বলে,
“আই হেইট ইউ। তোর মনে হয় ৬ মাসের মধ্যে আমি তোকে ভালোবাসবো…কিন্তু তুই ভুল। আমি শুধু আর শুধু তোকে ঘৃ’ণা করি।”

প্লাবণের কথা শুনে মৌরীর চোখে জল চলে আসে। খুব সন্তর্পণে সেই চল মুছে নিয়ে প্লাবণকে শুইয়ে দিয়ে তার পাশে শুয়ে পড়ে মৌরী।

★★★
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর যেন মৌরীর জীবনে ঝড় নেমে আসে। ব্রেকফাস্ট করতে নিচে নামতেই সবার থমথমে মুখ দেখে মৌরী কিছু বুঝতে পারে না।

আতিফা বেগমও মৌরীর দিকে কেমন রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল৷ সবাইকে এভাবে দেখে মৌরী বলে ওঠে,
“কিছু কি হয়েছে?”

আতিফা বেগম বলে ওঠেন,
“কিছু হয়নি মানে? কোন মুখ তুই এই কথা বলছিস।”

“তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না বড়মা।”

আমিনুল চৌধুরী বিদ্রুপ করে বলেন,
“এসব নাটক করিস না মৌরী।”

আজাদ চৌধুরী থমথমে গলায় বলেন,
“তোর মা’য়ের মৃত্যুর পর কি আমি তোকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি? তাই আজ এই দিন দেখতে হচ্ছে।”

সবার কথা মৌরীর মাথার উপর দিয়ে যায়। সে বলে ওঠে,
“তোমরা কি বলছ একটু বুঝিয়ে বলো প্লিজ।”

প্লাবণ মৌরীর মুখের দিকে কিছু ছবি ছু’ড়ে দিয়ে বলে,
“সারারাত নাইট ক্লাবে কা’টিয়ে এসে এখন নাটক করা হচ্ছে।”

মৌরী ছবিগুলো তুলে নিয়ে দেখে গতকাল রাতে তার নাইট ক্লাবে যাওয়ার ছবি এগুলো। কিন্তু সবগুলো ছবিতে সে একা। প্লাবণের সাথে দেখা করার আগের ছবিগুলো।

মৌরী সবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আমি তো গতকাল রাতে প্লাবণকে আনতে নাইট ক্লাবে গিয়েছিলাম।”

প্লাবণ চিৎকার করে বলে,
“খবরদার নিজের দো’ষ আমার উপর চাপাবি না। আমি এমন ছেলেই নই।”

মৌরী বলে,
“এমন কথা কেন বলছ তুমি? কাল রাতে তো আমি আর ড্রাইভার মিলে তোমাকে নাইট ক্লাব থেকে নিয়ে এসেছি।”

“আমি কাল রাতে আমার বন্ধু শামিমের বাড়িতে ছিলাম। আর এই সুযোগে তুই এসব করে বেরিয়েছিস। এখন ধরা পড়ে আমার দো’ষ দিচ্ছিস।”

“ঠিক আছে,আমি এক্ষুনি ড্রাইভারকে নিয়ে আসছি৷ তারপর তিনিই সব সত্য বলবেন।”

মৌরী বাইরে গিয়ে ড্রাইভারকে ডেকে আনে। তাকে এসব কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
“আপনি এসব কি বলছেন ম্যাডাম? কাল রাতে তো আপনি একাই নাইট ক্লাবে গেছিলেন আর একাই ফিরে এসেছিলেন।”

“আপনি মিথ্যা বলছেন কেন? আপনিই তো কাল রাতে সব দেখেছেন।”

আতিফা বেগম বলে ওঠেন,
‘থাক। অনেক নাটক হয়েছে। তোর থেকে আমি এটা আশা করিনি মৌরী৷ এখন তো আমার মনে হচ্ছে তোর সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিয়ে ওর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম।’

আতিফার চোখে জল চলে আসে। এত বা’জে ভাবে যে সে ফেসে যাবে সেটা কখনো ভাবতেও পারে নি। প্লাবণ মৌরীর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“কেমন লাগল আমার সারপ্রাইজ? ৬ মাস পর তোকে ডিভোর্স দেওয়ার পর যাতে কেউ আমায় কথা শোনাতে না পারে এখন থেকেই সেই ব্যবস্থা করছি।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here