মরীচিকাময় ভালোবাসা পর্বঃ১

0
1890

১.
‘৬ মাসের জন্য তোকে আমার বউ হয়ে থাকতে হবে। বল, তুই কি আমার সাথে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করতে পারবি মৌরী?’

নিজের ভালোবাসার মানুষটার মুখে এমন কথা শুনে চমকে উঠল মৌরী৷ তার হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠল। সম্বিৎ জ্ঞান যেন হারিয়ে ফেলল সে। কন্ঠ থেকে চেয়েও কোন বাণী নিঃসৃত করতে পারছে না।

মৌরীর থেকে কোন জবাব না পেয়ে প্লাবণ পুনরায় শুধাল,
‘তুই কি আমার প্রস্তাবে রাজি?’

মৌরী স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল। লম্বা একটা শ্বাস দিয়ে ধীর গলায় বলল,
‘এসব তুমি কি বলছ প্লাবণ ভাইয়া? বিয়ে তো হয় সারাজীবনের জন্য। ৬ মাসের জন্য কি কেউ বিয়ে করে নাকি?’

মৌরীর উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারল না প্লাবণ। মুখ বেজার করে বলল,
‘অবশ্যই হয়। তুই চাইলেই সম্ভব।’

মৌরী হাতের তালু চুলকাতে লাগল। যখনি সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে তখনই এমন করে। প্লাবণ ততক্ষণে ফোন বের করে সেখানে মগ্ন হয়েছে। মৌরী নানান চিন্তাভাবনার পর বলল,
‘আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি। তবে আমার একটা শর্ত আছে।’

প্লাবণ ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলল। সন্ধিহান চোখে তাকালো মৌরীর দিকে। ধীর গলায় শুধাল,
‘কি শর্ত আছে তোর?’

মৌরী একটু বিরতি নিয়ে বলল,
‘আমরা নাহয় ৬ মাসের জন্য কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করব। তবে এই ৬ মাসের মধ্যে যদি তোমার মনে আমার জন্য অনুভূতি তৈরি করতে পারি, তুমি যদি আমাকে ভালোবেসে ফেল?’

মৌরীর কথা শুনে গগণবিদারী হাসি দিল প্লাবণ৷ যেন কোন কৌতুক শুনছে। প্লাবণকে এভাবে হাসতে দেখে মৌরী বিরক্ত হলো। তার ফর্সা মুখশ্রীতে সূর্যের লাল আভা ফুটে উঠল। মৌরী কন্ঠে বেজায় রাগ দিয়ে বলল,
‘তুমি এভাবে হাসছ কেন ভাইয়া?’

প্লাবণ বুকে দু-হাত ভাঁজ করে বলল,
‘তুই হাসির কথা বলবি আর আমি হাসলেই দোষ?’

‘আমি কোথায় হাসির কথা বললাম? আমি তো তোমায় চ্যালেঞ্জ দিলাম। তাও আবার ৬ মাসের চ্যালেঞ্জ। যদি সাহস থাকে তো চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেখো। এই ৬ মাসেই তুমি আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য হবে দেখে নিও।’

প্লাবণ এবার একটু গাম্ভীর্য রূপ ধারণ করল। মৌরীর দিকে কড়া দৃষ্টি নি’ক্ষেপ করে বলল,
‘তোর ভাবনা সঠিক নয়। এখন তোর আবেগের বয়স তাই তুই আবেগ দিয়ে বিচার করছিস। কিন্তু জানিস তো আবেগ দিয়ে না জীবন চলে না। আমার হৃদয় পাথর সমতূল্য। এই পাথরে কোন অনুভুতির ফুল তুই ফোঁটাতে পারবি না।’

মৌরী অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে উঠল,
‘আমি নিজের প্রেমের পরশ দিয়ে তোমার ঐ পাথর হৃদয়ে, ফুলের কানন সাজাবো। এট আমার প্রতিজ্ঞা।’

প্লাবণ মৌরীর দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসল। মৌরীর জেদ বেড়েই চললো। অষ্টাদশী তরুণী হৃদয় যেন বদ্ধপরিকর হলো তার প্রেমিক পুরুষের মন জয়ের এই সংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্য।

★★★
বাড়ির মূল ফটকে বড় বড় অক্ষরে লেখা “সুখ নিবাস”। নাম সুখ নিবাস হলেও সুখ যেন এই গৃহ থেকে অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। অর্থ ছাড়া যেমন জীবন অচল, তেমনি অর্থই সকল অনর্থের মূল।

এই বাড়িতেও ঠিক একই ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এই বাড়ির কর্তা আব্দুল্লাহ চৌধুরী অনেক সাধ করে বাড়ির নাম রেখেছিলেন “সুখ নিবাস”। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে আমিনুল চৌধুরী ও আজাদ চৌধুরী এই সুখ নিবাসের সারমর্মই বদলে দিয়েছে। টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে তৈরি করেছে অদৃশ্য দেয়াল৷ এক আকাশের নিচে থেকেও যেন তারা ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা।

ডাইনিং টেবিলে বসে দুই ভাই ব্রেকফাস্টের জন্য অপেক্ষা করছে। আজাদ চৌধুরী অনেক তাড়াহুড়োয় আছেন। আজ তার গুরুত্বপূর্ণ একটা বিজনেস ডিল আছে। তাই খাবার দিতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হওয়ায় বেজায় চটেছেন তিনি। গলা খাকারি দিয়ে বললেন,
‘খাবার দিতে এত দেরি হচ্ছে কেন ভাবি?’

আমিনুল চৌধুরী বলে উঠলেন,
‘নিচু গলায় কথা বল আজাদ। আতিফা এ বাড়ির বউ, তোর ঠিক করা কোন কাজের লোক নয়।’

নিজের বড় ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে খাবার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ালেন আজাদ চৌধুরী। তেজি গলায় বললেন,
‘আমাকে এভাবে বলে তুমি ঠিক করলে না ভাইয়া। আমি তো শুধু আমার দেরি হচ্ছিল জন্য তাড়া দিচ্ছিলাম। আমার একটা ইম্পোট্যান্ট বিজনেস ডিল আছে। অবশ্য তুমি সেসব বুঝবে না। করো তো সামান্য একটা হাইস্কুলের শিক্ষকতা।’

‘আজাদ!’

চিৎকার করে উঠলেন আমিনুল চৌধুরী। আতিফা বেগম ততক্ষণে খাবার নিয়ে ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত হয়েছেন। দুই ভাইকে এভাবে ল’ড়তে দেখে তিনি বললেন,
‘তোমরা থামো এখন। আমি খাবার নিয়ে এসেছি। আজাদ এসো খেতে বসো। এভাবে না খেয়ে যেও না।’

‘ভাইয়ার কথা শুনে আমার পে’ট ভরে গেছে ভাবি। এখন আর এই খাবার মুখে রুচবে না।’

আজাদ চৌধুরী প্রস্থানের জন্য পা বাড়াতেই মৌরী এসে তার পথ আটকে নিল। মায়াভরা কন্ঠে বলল,
‘এভাবে না খেয়ে যেও না বাবা। তুমি না খেয়ে গেলে আমিও কিন্তু সারাদিন না খেয়ে থাকব।’

নিজের মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে আর যেতে পারলেন না আজাদ চৌধুরী। মা ম’রা মেয়েটিকে বড্ড ভালোবাসেন যে তিনি। তাই সকল দম্ভকে দূরে ঠেলে পুনরায় খেতে বসলেন। আতিফা বেগমের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসল মৌরী। আতিফা বেগমও মিষ্টি হাসি উপহার দিলেন।

নিজের বাবার পাশের টেবিলেই খেতে বসলো মৌরী। সকালের ব্রেকফাস্ট শেষ করে আজাদ চৌধুরী বেরিয়ে গেলেন। আমিনুল চৌধুরীও ব্রেকফাস্ট শে’ষ করে হাতে পত্রিকা নিয়ে সোফায় বসে পড়লেন।

মৌরী দ্রুত খাওয়া শেষ করে আতিফা বেগমকে খাবার ডাইনিং টেবিলে দিয়ে বলল,
‘অনেক কাজ করেছ বড়মা। এখন তুমি চুপচাপ খেতে বসো। আমি তোমায় খাবার পরিবেশন করছি।’

‘বাহ, আমার ছোট্ট মেয়েটা দেখছি বড্ড হয়ে গেছে। থাক মা, তোকে কিছু করতে হবে না। আমি নিজেই নিয়ে খেতে পারবো।’

মৌরী গাল ফুলিয়ে বলল,
‘একদম না। তুমি চুপ করে বসে থাকো। আমি দেব মানে আমিই দেবো।’

‘পাগলী মেয়ে একটা!’

মৌরী আতিফা বেগমের পাতে খাবার দিতে দিতে বলল,
‘দেখবে এই পাগলী মেয়েই তোমার পাগল ছেলেকে ব’শ করবে।’

আতিফা বেগম সবেমাত্র খাবারের লহমা মাখছিলেন। মৌরীর কথা শুনে থেমে গেলেন তিনি। জিজ্ঞাংসু দৃষ্টিতে মৌরীর দিকে তাকিয়ে শুধালেন,
‘ঐ ক্ষে’পাটার সাথে কথা হয়েছে নাকি তোর? হ্যাঁ মনে পড়েছে! সকালে তো দেখলাম ও তোকে ছাঁদে নিয়ে যাচ্ছে। তখন কাজে ব্যস্ত ছিলাম তাই খেয়াল করিনি। কি বলেছে রে ও?’

‘আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে।’

‘কি!’

রাজ্যের বিস্ময় ফুটে উঠল আতিফা বেগমের চোখে। মৌরী লাজুক হাসল। আতিফা বেগম পুনরায় শুধালেন,
‘তুই নিশ্চয়ই আমার সাথে মজা করছিস?’

‘মজা করব কেন বড়মা? তোমার সাথে কি আমার মজা করার সম্পর্ক?’

আতিফা বেগম উত্তেজিত হয়ে বেশ জোরেশোরে বললেন,
‘তুই ঠিক বলছিস তো?’

আমিনুল চৌধুরী সোফা থেকেই ভ্রুযুগল কুঁচকে তাকালেন আতিফা বেগমের দিকে। আতিফা বেগম কন্ঠ নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
‘সত্যি ক্ষ্যাপাটা তোকে বিয়ে করতে চাইছে! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না!’

‘বিশ্বাস করে নাও বড়মা। এখন থেকেই আমাকে বধূবরণ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে না!’

‘আমি তো সেই কবে থেকে তোকে নিজের ছেলের বউ বানাতে চাই। তোর মতো লক্ষী মেয়ে আমি আর কোথায় পাবো, বল? কিন্তু ঐ ক্ষ্যাপাটা রাজি হচ্ছিল না জন্যই কিছু করতে পারছিলাম না।’

‘এখন তো ক্ষ্যাপাটা রাজি হয়েছে। তাহলে বিয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করো।’

আতিফা বেগম কিছু বলতে গিয়ে মৌরীর মুখপানে তাকিয়ে থেমে গেলেন। গম্ভীরমুখে মৌরীকে শুধালেন,
‘সত্যি করে বল তো সব ঠিক আছে কিনা! তোর মুখ দেখে কেন জানি আমার মনে হচ্ছে তুই আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছিস।’

‘আমি আবার কি লুকাবো?’

‘সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।’

‘তুমি ভুল ভাবছ বড়মা। আমি কিছু লুকাচ্ছি না।’

আতিফা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে মৌরীকে ধরে নিজের পাশে বসিয়ে বললেন,
‘তোকে জন্ম না দিলেও আমিই কিন্তু তোকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। তুই মুখ ফুটে না বললেও তোর মনের কথা আমি বুঝতে পারি। তাই আমি বলছি, আমার থেকে কিছু লুকাবি না। যদি কোন কিছু লুকিয়ে থাকিস তো বলে দে।’

মৌরী পুনরায় বলল,
‘কিছু লুকাই নি বড়মা। আমাকে বিশ্বাস করো তুমি।’

আতিফা বেগম আর কথা বাড়ালেন না। তিনি বেশ ভালোই জানেন মৌরী তার থেকে কিছু লুকাচ্ছে। কিন্তু সেটা বলতে চাইছে না। তাই তাকে জোর করে কোন লাভ নেই।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

#মরীচিকাময়_ভালোবাসা
#পর্বঃ১
#লেখিকাঃদিশা_মনি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here