#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস (২)
#পর্ব_১৩
#মোহনা_হক
সতেরো দিন পর আজ আয়াজ বাসায় আসবে। গতকাল মায়া চৌধুরী কে কাল কল দিয়ে জানিয়েছে। সতেরো দিন পর বাসায় আসছে। সে অনুযায়ী মায়া চৌধুরী সকাল থেকে আয়োজন করা শুরু হয়েছে। যেনো কয়েক বছর পর তার ছেলে বাসায় ফিরছে। কোনো রকম যোগাযোগ ছিলো না আয়াজের সাথে কারো। সেই যে রুয়াতের সাথে একবার কথা বলেছিলো আর বলেনি। একটিবারের জন্যও মোবাইল অন করেনি। ফজলুল চৌধুরী কিছুটা ভয়ে পেয়েছেন। তবে তার ছেলের উপর ক্ষোভ থাকার কারণে আর মায়া চৌধুরী কে জিগ্যেস করেননি। এতো দিন পর আয়াজ আসবে শুনে সবাই মোটামুটি খুশি হয়েছে। ঘরের ছেলে অবশেষে ঘরে ফিরবে।
নিমি খবর শোনামাত্র দৌড়ে রুয়াতের কাছে আসে। কিছু সময় আগে মায়া চৌধুরী সবাই কে জানিয়েছিলো। কাল মধ্যরাতে আয়াজ কল দিয়েছিলো। তাই সে মুহুর্তে তিনি কাউকেই জানায়নি কিছু। এমনকি ফজলুল চৌধুরী কে ও না। আজ সকালেই সবাইকে জানানো হয়েছে। নিমি দৌড়ে উপরে উঠে হাঁপিয়ে গিয়েছে।
নিমি তড়িঘড়ি করে বলে-
-‘আয়াজ ভাই আসছে রে রুয়াত।’
ব্যালকনিতে অন্যমনষ্ক হয়ে রুয়াত বাহিরের দিকটায় তাকিয়ে আছে। অসুস্থতার কারণে মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে। এলোমেলো চুল। শুষ্ক অধর। যেনো কয়েক বছর নিজের প্রতি কোনো নজর দেয়নি। এমন অবস্থা হয়েছে। মুলত আয়াজের প্রতি তার আগে থেকেই একটু আধটু দূর্বলতা ছিলো। আয়াজ ভালোবাসে এটা বলার পর মায়া বেড়ে গিয়েছিলো। এখন সে লোকটির শূন্যতায় হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। সেখান থেকেই তার আজ শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। নিমির কথায় ঈষৎ কেঁপে ওঠে রুয়াতের। বক্ষে ধুকপুক শব্দ আরম্ভ হতে শুরু করে। এক হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে। দূর্বল স্বরে বলে-
-‘কি বলেছিস? আবার বল।’
-‘বলেছি যে আজ আয়াজ ভাই বাসায় আসছে। বড় মায়ের কাছে কাল রাতে কল দিয়ে বলেছে। অবশেষে তোর অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলছে। কতদিন পর তোর চক্ষুজোড়া তাকে দেখবে। সে তো অপেক্ষা করেই চলেছিলো। আজ সেটার অবসান ঘটবে।’
রুয়াত চুপ হয়ে যায়। দৃষ্টি সরিয়ে বাহিরে তাকায় ফের। নিমির কথা মোটেও মিথ্যে নয়। এর শতভাগ মিল রয়েছে। আয়াজ কে একবার চোখে দেখার জন্য চাতক পাখির ন্যায় বসে থাকতো। সব সময় মনে হতো এখনই মনেহয় আয়াজ কল দিবে তার প্রেয়সীর কাছে। সেই কাঙ্খিত শব্দ বারংবার উচ্চারণ করবে। প্রেয়সীর সাথে কথা বলার জন্য আকুল হয়ে বসে থাকবে। কিন্তু সেসব শুধু রুয়াত কল্পনা করে যেতো আপন মনে। সেই একবার কল ধরার পর আর ধরেনি। দেয় ও নি। মনে খুব আক্ষেপ মেয়ের। একদম ঠিক করে রেখেছে আয়াজ আসলে কোনো কথা বলবে না। বোঝাতে চাইবে অভিমান করে আছে। তার অভিমান ভাঙানো লাগবে। সেসব কি আর হবে আদোও। রাগ গুলো যে এখনই নিমিষেই মুছে যাচ্ছে এখনই। আর একবার চোখে দেখায় দেখলে হয়তো যতো রাগ, অভিমান যা ছিলো সব উধাও হয়ে যাবে।
-‘কি রে রুয়াত কথা বলছিস না কেনো? ওনি আসবে আর তুই খুশি না? তুই তো তার সাথে একবার কথা বলার জন্য কত অপেক্ষা করেছিস। কত ছটফট করেছিস। তাহলে আজ খুশি না কেনো?’
রুয়াত নিমির কথায় তার দিকে তাকায়। পরক্ষণেই মনে পড়ে এই মেয়েটি ও একজন কে ভালোবেসেছিলো। তার জন্য কতোই না পাগলামো করেছিলো। পরিবারের সবার সামনে অপমানিত হয়েছিলো। আয়াজের হাতে থা’প্প’ড় খেয়েছিলো। তার বাবা মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। নিজের প্রতি অবহেলা করেছে। এখন তাকে ভুলে দিব্যি জীবন কাটাচ্ছে। ভালোবাসলেই কি ভোলা যায়? রুয়াত তো ভুলেনি। তাহলে কি আয়াজ ভুলে গিয়েছে তার প্রেয়সী কে। যদি নাই ভুলে যেতো তাহলে নিশ্চয়ই একবার না একবার হলেও রুয়াতের কাছে কল দিতো। বিষয়টি ভেবে দেখার পর বক্ষ কেঁপে ওঠে।
-‘নিমি ওনি আমায় ভুলে গিয়েছে? ওনার ভালোবাসা শেষ হয়ে গিয়েছে? কেনো কল দেয়নি একবারও? আমার মনেহয় ওনি এখন আর আমাকে ভালোবাসে না। বড্ড স্বার্থপর হয়ে গিয়েছে। আচ্ছা তুই ও তো একজন কে ভালোবেসেছিলি তাইনা! এক সময় কি ভালোবাসা কমে যায়? এর ভালো উত্তর তুই আমাকে দিতে পারবি নিমি। দয়া করে বল না আমায়।’
হকচকিয়ে যায় নিমি। এমন মুহুর্তে রুয়াতের থেকে মোটেও এরূপ প্রশ্ন আশা করেনি। পুরোনো ঘটনা মনে পড়তেই নিঃশ্বাস বড় হয়ে যায়। চারপাশটায় তাকায় একবার। এর যথাযথ উত্তর সে নিজেও দিতে পারবে না। আর কখনো রুয়াতের থেকে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে সেটাও ভাবতে পারেনি। যে মেয়েটা এক সময় নানান কথা বলে এগুলো থেকে তাকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করতো আজ সেই মেয়েটি এমন প্রশ্ন করেছে। মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, মনের অবস্থা সব সময় এক রকম থাকে না। রুয়াত হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। মেয়েটির সাথে এরকম অবস্থা হবে ভাবতেই নিমির অবাক লাগে। এক সময় ভালোবাসা শব্দটি নিয়ে কতোই না হাসাহাসি করতো সে। আজ সেই বলছে এক সময় কি ভালোবাসা কমে যায়?
সহসা নিমি বলে উঠে,
-‘তুই এক সময় আমাকে অনেক বুঝিয়েছিস যাতে আমি এসব থেকে দূরে সরে আসি। মনে আছে আমার সবচেয়ে খারাপ সময়ে কি বলেছিস? আমি জানি তোর ভালো করেই মনে আছে। একবার ভেবেছিস তখন আমি কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম? কেউ ভেবে দেখিসনি। উল্টো আমাকে অনেক কথা বলে বুঝ দিয়েছিলি। তার জন্য আমি তোর আর আয়াজ ভাইয়ের প্রতি সত্যিই কৃতজ্ঞ। তবে এটা ঠিক মনে থেকে ও ভালোবাসা ভোলা যায়। যদি প্রথম ভালোবাসা হয় তাহলে সেটা ভুলতে কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে। এক সময় মানুষ ঠিকই ভালোবাসা ভুলে যায়। যেমন আমিও এখন তা ভুলে প্রাণ খুলে বাঁচতে পারছি। আমি শুধু আমার কথা বলেছি। বাকিটা জানা নেই। আর আয়াজ ভাইয়েরটা ও জানি না। যেটা শুনতে চেয়েছিস আমি শুধু সেটাই বলেছি।’
মনোযোগ সহকারে রুয়াত নিমির কথা শোনে। তার জীবনটা এভাবে এসে পরিনত হবে আগে ভেবেও দেখেনি। কখনো কল্পনা ও করেনি। আজ তার এই অবস্থা দেখে নিজেই অবাক হচ্ছে। বড় নিঃশ্বাস টানে রুয়াত। নিমি ফের বলে-
-‘তুই ঔষধ খেয়েছিস? ছোট মা কিন্তু পরে আবার বকবে। যদি দেখে তুই ঔষধ খাসনি।’
-‘খাইনি।’
নিমি রুয়াতের প্রেসক্রিপশন দেখে ঔষধ দেয় তার হাতে। রুয়াত কিছু না বলে খেয়ে নেয়। রুয়াতের ঔষধ খাওয়া শেষ হলে নিমি নিচে চলে আসে।
(*)
বিকেল তিনটার মধ্যে আয়াজ বাসায় উপস্থিত হয়। তার সাথে ইনিমা কে ও নিয়ে এসেছে। কারণ ইনিমার পরীক্ষা শেষ। তাই বোন কে নিয়ে একেবারে বাসায় এসেছে। মায়া চৌধুরী একসঙ্গে তার দুটো’ ছেলে মেয়ে কে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। ইনিমার আসার কথা ছিলো না। বলেছে এখন আসবে না। হঠাৎ আয়াজের সাথে ইনিমা কে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় মায়া চৌধুরী। ছেলে মেয়ে কে ঝাপটে ধরে। এখন যেনো তার ভিতরের প্রাণ ফিরে এসেছে। আয়াজ তার মায়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করার চেষ্টায় আছে। ইনিমা খানিকটা বিরক্তি ভাব নিয়ে বলে-
-‘মা আমরা কত দূর থেকে এসেছি। তুমি আমাদের ভিতরে নিয়ে যাবে তা না বাহিরে দাঁড়িয়েই কাঁদছো।’
মেহরুবা এগিয়ে আসে। আয়াজ, ইনিমার থেকে মায়া চৌধুরী কে সরায়। কারণ যেভাবে ধরে কাঁদা শুরু করেছে। মেহরুবার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে আয়াজ কে আবারও জড়িয়ে ধরে। ছেলের এমন কান্ডে তার মায়ের মন যে সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকতো। সে খবর কি রেখেছে সে? আয়াজের দু গাল ধরে কপালে চুমু খায় মায়া চৌধুরী। অস্থির হয়ে বলে-
-‘কেনো এমন করেছিস বাবা? মা কতো চিন্তায় ছিলাম তোর জন্য। এই কয়টা দিন কল দেসনি। আমার কাছে যে কেমন লেগেছে বলে বোঝাতে পারবো না। মা কে কষ্ট দিতে ভালো লাগে তোর? আমার মনের অবস্থা একবারও ভেবে দেখলি না।’
আয়াজ তার মায়ের মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরে। ইচ্ছে করেই কল দেয়নি। বাবার প্রতি রাগ থাকার কারণে এ কাজটা করেছে। ফজলুল চৌধুরী ও একবারও আয়াজ কে কল দেয়নি। দু’জনের মধ্যে মনমালিন্য লেগেই আছে। আয়াজ তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলে-
-‘আমি ঠিক ছিলাম। এটাও জানি তুমি খুব চিন্তায় ছিলে আমাকে নিয়ে। এখন তো কাজ শেষ। বাসায় ও এসেছি তাহলে পুরোনো কথা কেনো তুলছো মা? তুমি আর কাঁদবে না।’
-‘কখনো ভুলেও আর এমন কাজ করিস না বাবা। মায়ের চিন্তা হয় তো।’
আয়াজ হেসে মাথা ঝাঁকায়। মায়া চৌধুরী ইনিমার সাথে কথা বলছে। আয়াজ মেহরুবার দিয়ে এগিয়ে যায়। শান্তস্বরে বলে-
-‘কেমন আছো ছোট মা?’
মেহরুবা আয়াজের কথা শোনামাত্র হাসি দেয়। প্রতিউত্তরে বলে-
-‘ভালো আছি বাবা। তুই কেমন আছিস? কেমন শুকিয়ে গিয়েছিস।’
সৌজন্যবোধক হাসে আয়াজ।
-‘আলহামদুলিল্লাহ। তা তোমার ছেলে মেয়ে কোঁথায়? দেখতে পাচ্ছি না যে? আর সময় হলে তো নিচেই থাকতো তারা।’
মেহরুবা একটু চিন্তিত হয়ে বলে-
-‘আর বলিস না। ছেলেটা স্কুলে গিয়েছে। সব সময় তো তোর সাথে যায়। এই কয়েকদিন আরহাম গিয়ে দিয়ে এসেছে। রুয়াত মেয়েটা খুব অসুস্থ। শরীর দূর্বল হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ। ডাক্তার দেখিয়েছি। ঔষধ দিয়েছে। কিন্তু কোনো উন্নতিই দেখছি না।’
আয়াজ অধর কামড়ে ধরে কিছু একটা ভাবে। রুয়াত তার চিন্তায় নিজের প্রতি এতো অবহেলা করেছে। সেদিন কিভাবে কেঁদেছিলো। আয়াজের অনুশোচনা হয়। মেহরুবা কে বলে-
-‘আচ্ছা আমি চেঞ্জ করে আসি তারপর ওকে দেখতে যাবো। দেখবো যে কি অবস্থা এখন ওর। তুমি চিন্তা করো না। ও সুস্থ না হলে আমি আবার ডক্টর দেখাবো।’
আয়াজ তার রুমে চলে আসে। আগে ফ্রেশ হবে। চেঞ্জ করবে। এরপর রুয়াত কে দেখতে যাবে।
(*)
ইনিমা নিমি কে নিয়ে রুয়াতের রুমে এসেছে। রুয়াত শুয়ে আছে। মেহরুবা অনেক বার ডেকেছে নিচে আসতে কিন্তু আসেনি। তার নাকি ভালো লাগছে না। তাই সে রুমে শুয়ে আছে। কিছু অবাস্তব জিনিস নিয়ে ভেবেই যাচ্ছে অনেক্ক্ষণ যাবত।
-‘রুয়াত হঠাৎ এ সময়ে শুয়ে আছিস কেনো?’
বড় বড় চোখ করে রুয়াত ইনিমার দিকে তাকায়। এমন সময়ে ইনিমা কে দেখে ভড়কে যায়। হঠাৎ ইনিমা কিভাবে আসলো। রুয়াত তাড়াতাড়ি করে উঠে বসে। নিমি আর ইনিমা এসেছে তার রুমে। তারা দু’জন রুয়াতের পাশে এসে বসে।
-‘তুমি কখন এলে আপু?’
-‘এসেছি অনেক্ক্ষণ হলো। তুই তো দেখা করতে যাসনি। তাই আমিই চলে আসলাম। কি অবস্থা এখন তোর? ছোট মা বললো তুই নাকি অসুস্থ? এখন ঠিক আছিস?’
-‘জ্বী আপু। এখন মোটামুটি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? কার সাথে এসেছো? একবারও তো বলোনি আমাদের।’
রুয়াতের এরূপ কথায় ইনিমা হেসে দেয়।
-‘আরে আমার আসার ইচ্ছে ছিলো না। ভেবেছিলাম পরীক্ষা শেষ কয়েকদিন বান্ধুবীদের সাথে ঘুরবো। কিন্তু কাল রাতে ভাইয়া কল দিয়ে বলে সকালে আমায় নিতে আসবে। তাই আমিও রাজি হয়ে যাই। আবার এটাও বলেছে যাতে বাসার কাউকে না জানাই। মা তো একদম অবাক হয়ে গিয়েছে।’
ছোট্ট করে উত্তর দেয় রুয়াত
-‘ওহ।’
-‘আচ্ছা রুয়াত আমি যাই হ্যাঁ? এখনো চেঞ্জ করিনি। ফ্রেশ হয়েই আসছি। তোরা কথা বল।’
এটা বলেই ইনিমা দৌড় দেয়। নিমি রুয়াতের উদ্দেশ্যে বলে-
-‘আয়াজ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাবি না রুয়াত?’
নিমি রুয়াত কে জ্বালানোর জন্য কথাটি বলেছে। এটা বুঝতে রুয়াতের মোটেও অসুবিধে হলো না। একটু রাগ দেখিয়ে বলে-
-‘বাজে বকিস না। তুই এখান থেকে যা এখন।’
নিমি মুখ ভেঙায়।
-‘তার কাছে কল দিয়ে কাঁদতে পারিস। অথচ আমি কিছু বললেই দোষ।’
রুয়াত কিছু না বলে ব্যালকনিতে চলে যায়। নিমি অপর পাশ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে চলে আসে সেখান থেকে।
(*)
ব্যালকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রুয়াত। রাতের শহরের যে যানবাহন গুলো ছুটে চলেছে সেগুলোই মনোযোগ দিয়ে দেখছে। আশে পাশে তার মন নেই। রাস্তার পাশের ফুটপাতের ওপর মানুষের হাঁটাচলা দেখছে। চাইলে ছুটে চলে যেতে পারে। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতেই তার ভালো লাগছে। পিছন থেকে আয়াজ অনেক্ক্ষণ পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। মেহরুবার থেকে বলে এসেছে। রুয়াতের সাথে দেখা করতে আসবে।
-‘যদি বাহিরটা দেখা শেষ হয় তাহলে পেছনে তাকাও।’
পরিচিত সেই কন্ঠস্বর। তড়িৎ চৌম্বকের মতো রুয়াত পেছনে তাকায়। আয়াজ কে দেখে পিছিয়ে যায় কিছুটা। কিন্তু সে আগায়নি। তার জায়গায় আগের মতো করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখে শান্তভাব। ভ্রু জোড়া কিছুটা কুচকে আছে। রুয়াত তার কপালের পাশ থেকে ওড়নার সাহায্য নিয়ে ঘাম মুছে ফেলে। এতদিন পর লোকটা কে দেখে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে মনের এক কোনায়।
-‘রোগী কি বেশি অসুস্থ নাকি? চেহেরায় এ অবস্থা বানিয়েছে কেনো?’
পরপর দুটো প্রশ্ন করলো আয়াজ। রুয়াত এক নাগাড়ে চেয়ে আছে। কোনোরূপ উত্তর দিচ্ছে না। খানিকটা বিরক্ত লাগলো আয়াজের। বেশি বিরক্ত লেগেছে রুয়াতের চেহেরার এরকম অবস্থা দেখে।
-‘আচ্ছা কথা যেহেতু বলছো না, তাহলে আমি চলে যাচ্ছি। তুমি থাকো।’
যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় আয়াজ। রুয়াত পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে। ব্যাস ওমনিই থেমে যায় বলিষ্ঠ শরীর। আয়াজ কিছু করলো না বরং চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। কাঁদার শব্দ নেই অথচ আয়াজের টি-শার্টে ভেজা ভেজা লাগছে। রুয়াত কে সরিয়ে দেয়। কন্ঠে কঠোরতা এনে বলে-
-‘আমি শুধুমাত্র দেখতে এসেছি তুমি সুস্থ আছো কিনা। কেঁদে আমার টি-শার্ট ভেজাবে নিশ্চয়ই সেজন্য আসিনি তাইনা!’
রুয়াত চোখের পানি দ্রুত মুছে ফেলে।
-‘শুধু কি এটার জন্যই এসেছেন? সবাই বাহিরের অসুখটা দেখে। মনের ভেতর যে এক অন্য রকম অসুখ বাসা বেঁধেছে সেটা কেউ দেখতে চায় না। যার জন্য এমন অসুখ সৃষ্টি হয়েছে সেও দেখতে চাচ্ছে না। আমি ভালো আছি। খুব ভালো আছি। আপনি চলে যান এখান থেকে। স্বার্থপর পুরুষ।’
অন্য দিকে ফিরে গেলো রুয়াত। আয়াজ আবার তার দিকে ফিরে দাঁড় করায়। স্বাভাবিক স্বরে বলে-
-‘কি অসুখ হয়েছে তোমার?’
-‘আপনি নামক অসুখে যে আমি আক্রান্ত সেটা কি আপনি জানেন? আপনি সব জানেন। শুধু ইচ্ছে করেই না বোঝার ভান ধরে থাকেন। কেনো এতো কষ্ট দিয়েছেন আমায়? কি অসহনীয় কষ্ট! আপনার মতো মানুষ কি আর তা বুঝবে? মন নামক জিনিসটায় তো পাথর চাপা দিয়ে দিয়েছেন। আপনি সত্যি একটা স্বার্থপর সুবিধাবাদী পুরুষ।’
রুয়াতের হাত টেনে বক্ষে জড়িয়ে ধরে মেয়েটা কে। খানিকটা জোরে কথা বলার কারণে তার শরীর কাঁপছে। শরীর দূর্বল তার উপর আয়াজের উপর জমে থাকা রাগ। টি-শার্টের দু পাশ রুয়াত চেপে ধরে। আয়াজ তার প্রেয়সীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
-‘আমি জানি প্রেয়সী তুমি কষ্ট পেয়েছো। খুব কষ্ট পেয়েছো। তোমাকে ভালোবাসা জিনিসটা ঠিক কি সেটা বোঝানোর জন্যই এরকম একটা পরিস্থিতির দরকার ছিলো। কিছুদিন আগে তুমি বলেছিলে না আমায় ভালোবাসো না। তাহলে আজ কেনো এতো পাগলামো তোমার?’
হেঁচকি উঠে যায় রুয়াতের। অনিচ্ছার চোখের নোনাপানি মিলিয়ে যাচ্ছে টি-শার্টে। চেয়েও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। কতশত কষ্ট সহ্য করেছে। সেগুলোর কাছে এসব চোখের পানি সামান্য মাত্র।
-‘যদি ভালোইবেসেছেন তাহলে দূরে গিয়ে কষ্ট কেনো দিয়েছেন? মাঝেমধ্যে অসহ্যকর ব্যাথা অনুভব হতো। আমার সহ্য করা কষ্টকর ছিলো এমপি সাহেব। কেনো এভাবে দূরে চলে গিয়েছেন আমার থেকে?’
স্মিত হাসে আয়াজ।
-‘এর উত্তর দিয়েছি। তুমি সহ্য করে নিতে তাহলে আর এমন হতো না। যাই হোক তোমার শরীরের এই অবস্থা কেনো? এর জন্যও কি আমি দায়ী প্রেয়সী।’
-‘সব দোষ আপনার। আপনার জন্য সব হয়েছে। আপনি এভাবে দূরে না গেলে আমায় এমন অবস্থা হতো না।’
-‘আচ্ছা তাহলে সেই মনের অসুখ ও আমার জন্য হয়েছে। সব বুঝলাম। কিন্তু তুমি আমার টি-শার্ট এভাবে ভিজিয়ে দিচ্ছো কেনো? জামাই মরেছে তোমার? যেভাবে কাঁদছো।’
রুয়াত আয়াজের থেকে সরে আসে।
-‘আপনার থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা যায়না।’
আয়াজ মুখটা রুয়াতের কানের পাশে নেয়। ফিসফিস করে বলে-
-‘তুমি কি অন্য কিছু চাচ্ছো?’
পরক্ষণেই মুখটা সরিয়ে আনে। রুয়াত বে’ক্ক’লের মতো চেয়ে আছে। আয়াজ আবারও বলে-
-‘ছিহ্ প্রেয়সীর চিন্তাভাবনা তার এমপি সাহেবের থেকে কতো দ্রুত এগিয়ে চলছে।’
-‘আপনিই প্রথম বলেছেন।’
আয়াজ রুয়াতের হাত ধরে বলে-
-‘হয়তো তোমার আমার পথচলা এতোটা সহজ সরল হবে না প্রেয়সী। অনেকটা সংগ্রাম করতে হবে। তবে ঠিক একদিন দিন শেষে তুমি আমার হয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতি বারবার আসতে পারে নিজেকে আরও শক্ত করো। ভেবেছিলাম বাসায় এসে তোমাকে আরও কড়া কথা শোনাবো৷ তবে তোমার চোখ মুখ দেখে আর সাহস পেলাম না। ভালোবেসেছো না কষ্ট পেতেই হবে। এটাই নিয়ম। নিজেকে শক্ত করো। উহু দূরে সরে গিয়েছিলাম তবে ভালোবাসা একটুও কমেনি। প্রেয়সী শুনো রুয়াতের প্রেমের উপন্যাসের প্রতিটি পাতায় আয়াজ নামটি থাকবে। আমি কথা দিলাম তোমায়।’
#চলবে…