কান্নাভেজা রাত পর্ব ৪

0
441

#কান্নাভেজা_রাত
#৪র্থ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



রাতুল ঘরে এসে গা থেকে শার্ট খুলে আলনায় রাখলো। তারপর বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এলো। এসে আমার পাশে শুয়ে আমার মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে মৃদু স্বরে ডাকলো সে।
‘ জেসি? এই জেসি?’
আমি ঘুমের ভান করেই পরে রইলাম।
রাতুল জোর করেই আমার মুখটা তার দিকে টেনে ঘুরিয়ে নিলো। তারপর মাথার দুপাশে আলতো করে ধরে বললো,’ চোখ খুলো জেসি।আমি জানি তুমি জেগে আছো।’
আমি তবুও চোখ খুললাম না। বন্ধ করে রাখলাম চোখের পাতা।
সে ধমক দিয়ে বললো,’ চোখ খুলতে বলেছি শুনছো না তুমি? খুলো।’
আমি ভয়ে ভয়ে চোখ খুললাম।
সে এবার আমার মুখের উপর তার মুখ নামিয়ে এনে সাপের মতো ফিসফিস করে বললো,’ জানলা দিয়ে কি দেখছিলে তুমি জেসি?’
আমি শিউরে উঠলাম।আমি তো খুব স্বতর্ক ছিলাম। একটুখানি ফাঁক করেছিলাম মাত্র জানলা।তাও আমার ঘর পুরো অন্ধকার ছিল। তবুও বুঝলো কি করে সে?
আমি আমতা আমতা করে বললাম,’ কই? কখন? আমি জানলার কাছে যাবো কেন? আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম এতোক্ষণ।’
রাতুল হাসলো। মৃদু হেসে
বললো,’আমি কি তোমার দুধের বাচ্চা? আমার বয়স কি দেড় বছর যে তুমি যা বলবা তাই বিশ্বাস করে বসবো? আমাকে ফাঁকি দিবে তুমি? আমার চোখ কটা তুমি জানোই না তাহলে! জানলার কাছে তুমি গিয়েছিলে। এবং এটাই সত্য।আমি জানি।আমি দেখেছি। কেন গিয়েছিলে তা বলতে হবে আমায়।বলো।’
আমি এক কথায়ই বললাম।
‘ ঘুমে ছিলাম আমি। জানলার কাছে আমি যাবো কিভাবে তবে?আমি যাইনি ওখানে।’
রাতুল শক্ত করে একটা চড় বসিয়ে দিলো আমার গালে। তারপর মেজাজ তিরিক্ষি দেখিয়ে বললো,’ ভালো করে বললে হয় না তাই না? তোমাকে মা নিষেধ করেনি বার বার অতো কৌতুহল না দেখাতে? বলেনি? ‘
আমি ওর দিকে চোখ লাল লাল করে তাকালাম। রাগে আমার গা কাঁপছে।
সে আমায় দু হাতে শক্ত করে ধরে ফেললো। তারপর কি রকম করে যেন বললো,’ এভাবে চোখ উল্টেছো কেন? আমায় রাগে খেয়ে ফেলবে নাকি? কিভাবে খাবে? আচ্ছা আরেকটা থা*প্পড় দেই তোমায়? দিবো?’
বলতে বলতে সে আরেকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো আমার গালে।
আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলেও কুলিয়ে উঠতে পারলাম না ওর সাথে। কিন্তু আমি খুব করে চেষ্টা করছি ওর থেকে ছুটে যেতে।
রাতুল হাসতে শুরু করলো।হাসির মাঝেই সে বললো,’ তোমার এই অতি আগ্রহের কারনে তুমি ভয়াবহ রকমের বিপদে পড়বে।ভয়াবহ রকমের বিপদে!’
তারপর সে আমায় ছেড়ে দিলো। আজান হয়ে গেছে ফজরের। সে বললো,’ আমি এখন এক জায়গায় যাবো।কাজ আছে।কাজ না করলে টাকা আসবে কিভাবে? টাকা না এলে সংসার চলবে কি করে? তাছাড়া আমি ভেবেছি এই বছরের মধ্যেই বাচ্চা নিবো আমরা। তুমি মা হবে।আমি বাবা হবো। আগামী বছর আমার বাচ্চা আমার কোলে থাকবে।বুঝলা? এখন আমি যাই। ভবিষ্যত সুন্দরের জন্য পয়সা উপার্জন করি গিয়ে।যাবার আগে তোমারে আবার সাবধান করে যাই। তুমি আবার উঁকিঝুঁকি মেরো না গিয়ে মেহেরুনের রুমে।ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করো না শুধু শুধু।ওর সঙ্গে কথা বলে তোমার লাভ নাই। তুমি তোমার সংসারের দিকে মনোযোগ দাও।ওর দিকে মনোযোগ দিলে তোমার লাভ হবে না জেসি।ক্ষতি হবে! ক্ষতি!’
আমি তার কথার কোন উত্তর দিলাম না। সে চলে গেল।ও চলে যাবার পর ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এলাম।মন খুব অশান্ত লাগছে। ভাবলাম নামাজ পড়ে দেখি মন ঠিক হয় কি না।যদি একটু প্রশান্তি আসে।নামাজে বসে ঠিক ভাবে আমি নামাজই পড়তে পারছি না।সূরা কিংবা দোয়া গুলো জপতে পারছি না ঠিক ভাবে। খুব কান্না পাচ্ছে আমার। কোনভাবে নামাজ শেষ করে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে আমি কাঁদলাম।সব অভিযোগ, অনুযোগ আল্লাহর কাছেই করলাম। নামাজ শেষ হলে দেখি রাতুল চলে গেছে।ও যে হুটহাট কোথায় গিয়ে মিলিয়ে যায় কিছুই বুঝি না।কখনো দিনের বেলা যায়।কখনো রাতে।রোজ করে একবার যায়। এবং ওখান থেকে সে ফিরে দীর্ঘ সময় পর।বলে কাজ করে।কিসের কাজ কিছুই বুঝি না!
আমি নিজেকে কিছুতেই আর ধরে রাখতে পারছি না।ভয় গুলোকে আস্তে আস্তে দূরে রাখবার চেষ্টা করছি। জায়নামাজ গুটিয়ে আলনায় রেখে বারান্দায় বেরুলাম।ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে চারদিকে।একটা কাক ডাকছে। খুব কর্কশ তার গলা।শুনেছি কাক ডাকলে বাড়িতে বিপদ আসে।এ বাড়িতে একটা বড় সড়ো বিপদ আসতে পারে না!

মেহেরুনের দরজার কাছে গিয়ে ব্যর্থ হলাম আমি। দরজা বন্ধ। চুপচাপ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ফিরে এলাম আবার। বাবাকে ফোন করলাম। কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম।মা তো নাই।আজ হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ছে ।চোখ ভিজে উঠেছে জলে।মা মারা গিয়েছেন আমার শৈশবে। আমার এখনও মনে আছে।ক্লাস ফোরে পড়ি তখন। একদিন ক্লাস থেকে ফিরে দেখি বাড়ি ভর্তি লোক।মা নাই।স্ট্রোক করে মা মরে গেছে। এরপর বাবা আর বিয়ে করেননি। আত্মীয় স্বজনেরা অনেক বুঝিয়েছে। বলেছে বিয়ে করতে।বাবা করেননি। শুধু আমার জন্য। আমাকে যদি সৎ মা কষ্ট দেয়। সারা জীবন বাবা আমায় আগলে রেখেছেন।অফিস করে এসে নিজেই রান্না করতে শুরু করতেন।নিজে মাছ কাটা শাক বাছা সবকিছুই করতেন।আমি যখন বড় হলাম তখনও। বাবার বয়স হয়েছে। আমার তো আর ভাই -বোন নাই। বাবার সব সময় অসুখ বিসুখ লেগেই থাকে। কদিন আগেই তো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে।হার্টের খুব বাজে অবস্থা।একা একা ওখানে কিভাবে থাকবে বাবা! আমার বড় ইচ্ছে ছিল, বিয়ের পর বাবাকে সাথে রাখবো।সারা জীবনভর পরিশ্রম করে যাওয়া বাবাকে একটুখানি সুখ দিবো। কিন্তু ভাগ্য যে আমার এরকম! বাবা যদি একবার জানে, তার মেয়ে এরকম কষ্টে আছে তবে বাবা বাঁচবে না আর!
বিকেল বেলা আমার শাশুড়িকে দেখলাম বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে। আমার কাছে কিছুই বলে যায়নি। বিকেল হয়েছে। রান্নার আয়োজন করতে হবে।সবজি টবজি কিছুই নাই বাসায়। সম্ভবত বাজার করতে গেছে। তিনি বেরিয়ে যাবার পর পরই আমি গেটের কাছে গেলাম। বাইরে থেকে গেট আটকে রাখা। গেটের শিকে ঝুঁকি দিয়ে গলা খানিকটা উপরে নিয়ে বাইরে তাকালাম। আশেপাশে কেউ নাই।তার মানে চলে গেছে।ওখান থেকে ফিরে এসে ভাবলাম মেহেরুনের কাছে যাবো। কিন্তু মেহেরুনের ঘরের দরজায় বিশাল এক তালা ঝুলছে।লক করে রেখে গেছে ঘর। এদের কান্ড কারখানা মোটেও সুবিধার না। আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে। কোন মা কি তার ছেলেকে এসব নোংরা কাজে সাহায্য করবে? তাছাড়া মা ছেলে একসঙ্গে এরকম চক্রান্ত সাজাতে পারে কিভাবে? কিছুই বুঝে উঠতে পারি না আমি।
এরিমধ্যে হঠাৎ মনে হলো, জানলা তো আছে ওর ঘরের।জানলায় গিয়ে টোকা দিয়ে দেখি। জানলার কাছে গেলাম আমি। অনেকক্ষণ ধরে টোকা দিলাম।ডাকলাম।
‘ মেহেরুন? এই মেহেরুন? আমি জেসি। তুমি কি জানলার কাছে আসতে পারবে কষ্ট করে? প্লিজ মেহেরুন! একটু উঠে আসো না। জরুরী কথা আছে তোমার সাথে।প্লিজ!’
অনেক ডাকাডাকির পর মেহেরুন এসে জানলার একটা পাটা খুলে দিলো।ওর দিকে তাকিয়ে আমি আঁতকে উঠলাম। চেহারা কেমন মলিন হয়ে গেছে।কি যে শুকনো দেখাচ্ছে ওকে।মনে হচ্ছে বারো মাস রোগে পড়ে থাকে এই মেয়ে!
আমি বললাম,’ তোমার একটা হাত দেও তো মেহেরুন।’
মেহেরুন তার হাত দিলো। সেই হাত থরথর করে কাঁপছে।আমি এই হাত ধরে বললাম,’ মেহেরুন, তুমি বিষ খে*য়েছিলে কেন?’
মেহেরুনের চোখ থেকে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। সে বললো,’ মরে যেতে। কিন্তু মরতে তো পারিনি। ওরা বাঁচিয়ে ফেলেছে! ‘
‘কেন মরতে চাও তুমি মেহেরুন? কি এমন দুঃখ তোমার? ‘
মেহেরুন চুপ করে থাকে।
আমি আবার বলি।
সে বলে,’ আমি বলতে পারবো না। তুমি চলে যাও।আমি জানলা আটকে দিবো।’
আমি ওর দু হাত ধরে ফেলি।অনুনয় করে বলি,’ প্লিজ বলো মেহেরুন।’
মেহেরুন বলে,’ আমি আমার পাপের শা*স্তির জন্যই মরতে চেয়েছিলাম।আমি পাপ করেছি। ভয়া*বহ রকমের পাপ। এরচেয়ে বড় পাপ হয় না!’
আমি শুনে আঁতকে উঠলাম। এমন কোমল মেয়ে, যাকে এতো দিন দেখে এসেছি তার উপর রাতুল আর তার মা অ*ত্যাচার, নি*র্যাতন করছে সব সময়।আর এখন কি না সে বলছে, সে নিজেই পাপ করেছে।তাও সবচেয়ে বড় পাপ!
আমি ওকে তাড়া দিলাম। বললাম,’ বলো কি করেছিলে তুমি? প্লিজ বলো! ওরা আবার এসে যাবে!’
মেহেরুন বললো,’ নিজের স্বামীকে খু*ন করেছি আমি।জ*বাই করেছি। নিজের গ*র্ভপাত করেছি নিজে।’
ওর কথা শুনে আমার শরীর হিম হয়ে গেল। চোখে কেমন ঝাঁপসা দেখতে শুরু করলাম।
এরপর শুধু ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,’ তোমার স্বামীকে যদি তুমি নিজের হাতে জ*বাই করে থাকো তবে রাতুল তোমার কে হয়? ‘
মেহেরুন বললো ,’ তুমি যাও বলছি।অতো সব জিজ্ঞেস করছো কেন? আমি আর কিছুই বলতে পারবো না!’
আমি বললাম,’ বলো। আমি কাউকে কিছু বলবো না।’
মেহেরুন বললো,’স্বামী হয়। রাতুল আমার স্বামী।’
আমার মাথা খারাপের অবস্থা হলো। বললাম,’ এসব কি বলছো তুমি? তোমার কথার কিছুই বুঝতে পারছি না আমি!’
মেহেরুন কিছু বলার আগেই গেটে শব্দ হলো।স্টিলের গেট।তালা খোলা হচ্ছে বাইরে থেকে।ঝনঝন শব্দ হচ্ছে। মেহেরুন বললো,’ আল্লাহর দোহাই লাগে বোন, এখান থেকে চলে যাও।প্লিজ! তুমি চলে গেলে তোমার ভালো, আমারও ভালো।’
বলে ঝনাৎ করে মুখের উপর কাঁচের জানলাটা লাগিয়ে দিলো। আমিও আর এখানে দাঁড়িয়ে রইলাম না। ভয়ে শরীর কাঁপছে। খুব দ্রুত এখান থেকে ঘরের দিকে চলে গেলাম।আর এই প্রথম বুঝতে পারলাম, মানুষ চেনা সবচেয়ে কঠিন কাজ। হয়তো যাকে আমরা বাইরে থেকে সবচেয়ে কোমল দেখছি। শিশুর মতো নিষ্পাপ মনে করছি।হতে পারে সে-ই নির্মম ঘা*তক। ভ*য়ংকর কোন পাপী।

(আমি কিচ্ছু লিখতে পারছি না।আমি মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। আমার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন আমার মন শান্ত করে দেন দ্রুত!)

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here