” আমি এ বিয়ে করতে পারবো না৷ আমার পক্ষ থেকে আপনার ফ্যামিলিকে এ কথা বলে দিবেন আর আপনার জন্য অন্য মেয়ে খুঁজতে বলবেন। ”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ছোট্ট করে দম ফেললো মিম। তার এহেন কথায় কিঞ্চিৎ আশ্চর্যান্বিত হলো আদ্রিশ। সে বহুক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছিলো, স্বল্পভাষী চরিত্রের সামনের মেয়েটি কখন মুখ ফুটে কথা বলবে। কিন্তু সে মোটেও আশা করেনি যে বিশ মিনিট যাবত নীরবে থাকার পর মিম এমন কিছু বলে বসবে। সরাসরি বিয়ে ভাঙার কথা!
আদ্রিশ ঈষৎ নড়েচড়ে বসলো। মিমের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিজোড়া স্থাপন করে কিঞ্চিৎ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” হঠাৎ এ কথা বলছো কেনো! গত পরশুই তো তোমাকে দেখে এসে বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি করে এসেছে আব্বু আম্মু। তাহলে আজ এ সিদ্ধান্ত কেনো?”
আদ্রিশের প্রশ্নের জবাব দিতে মিম মাথা তুলে চাইলো। বা হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে চোখের চশমাটা নাকের উপরাংশে আঁটসাঁট ভাবে বসিয়ে নিলো। ভেতরে ভেতরে সে ভীষণ বিক্ষুব্ধ হয়ে আছে। দু হাত রীতিমতো ঘামছে তার। আদ্রিশের দৃষ্টির আড়ালে টেবিলের নিচে টিস্যু দিয়ে দু হাত মুছে নিলো সে। অতঃপর শুকনো একটা ঢোক গিলে বললো,
” সিদ্ধান্তটা সম্পূর্ণ আমার একার। এক্ষেত্রে আমার ফ্যামিলির কোনো হাত নেই। তারা এ ব্যাপারে জানে না। তাই বুঝতেই পারছেন গত পরশু বিয়ে ঠিক হওয়ার ব্যাপারে আমার ফ্যামিলির হাত থাকলেও সেখান থেকে আমি সম্পূর্ণ আলাদা ছিলাম। আমার কোনো ইচ্ছা ছিলো না বিয়ে করার। আমি ভেবেছিলাম আপনারা আমায় সরাসরি দেখতে এসে বোধহয় রি’জে’ক্ট করে দিবেন। কিন্তু চিন্তাও করিনি যে আপনারা এভাবে বিয়ে ঠিক করে যাবেন। ”
আদ্রিশ সন্দেহজনক চাহনিতে ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
” তোমার এমন কেনো মনে হলো যে তোমাকে আমরা রি’জে’ক্ট করে দিবো?”
স্বপক্ষের যুক্তির প্রত্যুত্তর স্বরূপ আদ্রিশের নিকট হতে এমন প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেলো মিম। এখন কি হবে! সে তো এ প্রশ্নের জবাব তৈরী করে রাখেনি! আদ্রিশকে কি জবাব দিবে সে? এজন্য সে তৎক্ষনাৎ খানিক আমতাআমতা করে বললো,
” মনে হয়েছে কিছু কারণে। সে কারণে না যাওয়াই ভালো।”
আদ্রিশ ভ্রু উঁচিয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য মিমকে পরখ করলো। অতঃপর চেয়ারটা টেবিলের দিকে আরোও এগিয়ে নিয়ে সে-ও এগিয়ে বসলো। মিমের পানে ভ্রুকুটি করে চেয়ে টেবিলের উপর দু কনুই রেখে একগুঁয়ে স্বরে বললো,
” অবশ্যই যাবো আমি। তুমি না গেলেও আমি যাবো। এবার বলো, কি কারণে এমন মনে হয়েছে তোমার?”
আদ্রিশের এরূপ একরোখা কথাবার্তা শুনে মিমের মনে সন্দেহের বীজ পূর্বের তুলনায় আরো শক্তপোক্তভাবে নিজের অবস্থান বানিয়ে নিলো। ঠিক যেসব কারণে সে বিয়ে করতে চাইছে না তার একটি কারণ ইতোমধ্যেই সে আদ্রিশের মাঝে পেয়ে বসেছে। তাহলে এখনও কি তার এ বিয়ে করা উচিত?
মিমও এবার খানিক নড়েচড়ে বসলো। গলার স্বরে ঈষৎ কঠোর ভাব এনে বললো,
” দেখুন, সব বিষয়ে আপনার জানার প্রয়োজন নেই বলে মনে হয় আমার। আর আপনি সোজাসাপ্টা কথাকে মেনে না নিয়ে শুধু শুধু পেঁচাচ্ছেন কেনো? আমি তো বললাম, আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না৷ ”
” সেটাই তো জানতে চাইছি, কি কারণে বিয়ে করতে পারবে না? স্পেসিফিক কোনো রিজন আছে? পাকাপাকি হয়ে যাওয়া বিয়ে এভাবে তুমি ভেঙে যাচ্ছো, আর পাত্র হয়ে এ বিয়ে ভাঙার কারণ জানবো না এমনটা তো হতে পারে না। বলো,শুনি তোমার কারণ।”
মহা ঝামেলায় পড়লো মিম! কি নাছোরবান্দা এই আদ্রিশ নামক বান্দাটা! কই, ওয়ার্ডে ক্লাস নেওয়ার সময় তো কখনও মনে হয়নি এই সুদর্শন পুরুষটা এরূপ একগুঁয়ে চরিত্রের অধিকারী হবে!
মিম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। নাহ, কিছু না কিছু কারণ বলতেই হবে আদ্রিশকে। সে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো,
” আমার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কারণের জন্য আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। আশা করি, একটা মেয়ের ব্যক্তিগত কিছু বিষয়ে সরাসরি তার কাছে জানতে চাইবেন না আপনি৷ ”
” যদি জানতে চাই? বা নিজ দায়িত্বে খুঁজে বের করি তবে?”
আদ্রিশের এরূপ দুটো প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো মিম। নিকাবের আড়ালে ঢাকা পড়া তার চেহারার প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেলেও তার চাহনি দেখে এটি স্পষ্ট বুঝতে পেলো আদ্রিশ৷ গুরুগম্ভীর এ পরিস্থিতি হাসার জন্য উপযুক্ত না হলেও মুখে হাত চেপে আড়ালে হেসে নিলো সে। মিমের এরূপ চাহনি দেখে তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় আদৌ হাসি থামানো সম্ভব কি!
আদ্রিশ আড়ালে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হেসে নিয়ে অকস্মাৎ জিজ্ঞেস করলো,
” বাই এনি চান্স, তোমার কি কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে? আই মিন রিলেশন?”
বয়ফ্রেন্ড না থাকা সত্ত্বেও যখন কেউ এরূপ প্রশ্ন করে তখন মিমের ভীষণ রাগ হয়। আশ্চর্য! সবার কি বয়ফ্রেন্ড থাকতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আছে নাকি! সে তড়িতে জবাব দেয়,
” না। আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই এবং রিলেশনও নেই। ”
আদ্রিশ মুচকি হাসলো। অনেকটা কটাক্ষের সুরেই বললো,
” আমিও তাই বলি। তোমাকে তো কখনো কোনো ছেলের সাথে ওভাবে ঘুরতে বা কথা বলতে দেখিনি। তাহলে তোমার বয়ফ্রেন্ড আসে কি করে তাই না?”
না চাইতেও তীব্র অপমানবোধে মিমের মুখখানা থমথমে হয়ে এলো। মেজাজের পারদ এ পর্যায়ে ধীরেধীরে বৃদ্ধি পেতে লাগলো। কখন যেনো সর্বোচ্চ পর্যায়ে মেজাজের পারদ বিন্দু পৌঁছে গিয়ে সে তার ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলে!
মিম নিকাবের আড়ালে দাঁত কিড়মিড় করে শক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি আমায় অপমান করলেন?”
আদ্রিশ কিছুই করেনি এমন ভাব ধরে বললো,
” কই? আমি কি এমন কিছু বলেছি যাতে তুমি অপমানিত হও?”
মিমের আর কথা বলার মনমানসিকতায় রইলো না। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এক্ষুণি তাকে এ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে হবে। না হলে কখন যেনো এই সামনের মানুষটিকে যাচ্ছেতাই কথা শুনিয়ে দেয় সে!
মিম চেয়ার ছেড়ে উঠে ব্যাগপ্যাক কাঁধে নিলো। আদ্রিশকে বললো,
” অযথা কথা বাড়ানো আমার পছন্দ না। বিশেষ করে অপরিচিত মানুষের সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলতেও ভালো লাগে না। আপনাকে বলে দিয়েছি, আমি বিয়ে করবো না মানে করবো না। এটা আমার ফাইনাল ডিসিশন। ”
আদ্রিশ কথা না বাড়িয়ে থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে চুপচাপ মিমের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করলো। মিমের প্রতি তার ভাব এমন যে, ‘আচ্ছা, যত নাটক করতে পারো করো। যতবার নিষেধ করতে পারো করো। আমি বসে আছি তোমার নাটক দেখার জন্য। ‘
মিম ব্যাগ নিয়ে উল্টোপথে পা বাড়ালো। আদ্রিশ ছোট্ট করে হাঁক ছেড়ে ডেকে জিজ্ঞেস করলো,
” কোথায় যাও এখন?”
চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে মিম জবাব দিলো,
” ইভিনিং ওয়ার্ড আছে। কলেজে যাচ্ছি।”
বলেই সে চোখ বুজে জিব কাটলো! ধ্যা’ত, সে তো আর কথাই বলতে চেয়েছিলো না। কিন্তু তারপরও আদ্রিশের প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়ে গেলো!
আদ্রিশ মিমের এ কান্ডে হেসেই কুটিকুটি হয়ে গেলো৷ ওয়ার্ডে গত এক বছর হতে সে মিমকে দেখছে। কখনো মেয়েটিকে ওভাবে পর্যবেক্ষণ করেনি সে৷ কিন্তু পারিবারিকভাবে যখন ছবি দেখাদেখি, বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হলো তখন থেকে সে মিমকে একটু একটু করে জানার চেষ্টা করলো, বুঝার চেষ্টা করলো। আর এই এক সপ্তাহেই সে মিমকে অনেকটা চিনে ফেলেছে। তার মতে এই মেয়েটি ভীষণ ভুলোমনা ও পদে পদে ছোটখাটো ভুল করে পরে আফসোস করার মতো একজন মানুষ। আর সে খুব সহজেই বিরক্ত বোধ করা একজন মেয়ে। আপাতত এটুকুই সে ধারণা করেছে। সে জানে, এখনও আরো বহু কিছু জানার বাকি আছে এই মেয়েটিকে নিয়ে। আচ্ছা, এই মেয়েটা কি সত্যিই তাকে বিয়ে করবে না? তার এ বিয়েতে নাকচ করার কারণটা কি? তবে যে কারণই হয়ে থাকুক না কেনো, সে এই মিম নামক মেয়েটির সিদ্ধান্তের সাথে কিছুতেই একমত নয়। কারণ সে এ বিয়েতে রাজি হয়েছে। আর তার নাকচ করারও কোনো কারণ নেই। তাই এ বিয়ে হবেই হবে। অন্তত আদ্রিশ এমনটা চায়। আর আদ্রিশ জানে, সে কতোটা একগুঁয়ে প্রকৃতির লোক। এ কারণে এখন তার সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান কাজ হবে মিমকে বিয়েতে রাজি করানো। যা কিছু হয়ে যাক না কেনো।
মিম তখন ঘাড় ফিরিয়েই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো। আদ্রিশ তার যাওয়ার পানে একাধারে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। অতঃপর স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় এসে বরফের ন্যায় ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া অবশিষ্ট কফিটুকু মুখে নিলো। সাথে সাথে বিস্বাদে চোখমুখ কুঁচকে এলো তার। গরম গরম কফি ঠাণ্ডা হওয়ার পর তার স্বাদের যে পরিবর্তন হয় তা নিতান্তই অপছন্দের হয়ে ঠেকে আদ্রিশের নিকট। তবুও সে কফিটুকু পান করে ওষ্ঠজোড়া জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিলো। অতঃপর পকেট হতে মানিব্যাগ বের করতে করতে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
” যাও মিস মিম। আবারও দেখা হচ্ছে ওয়ার্ডে। আজ তোমাকে একটু শায়েস্তা করার প্রয়োজন বোধ করছি আমি। সো বি প্রিপেয়ার্ড। ”
এই বলে সে ওয়েটারকে ডেকে রেস্টুরেন্টের বিল চুকিয়ে বেরিয়ে পড়লো। এখন হসপিটালে যেতে হবে। আজ আবার নাইট ডিউটি পড়েছে তার। ইশ শান্তির ঘুমটুকুই শেষ হয়ে গেলো। এখন তিন চারদিন তার রাতের সেই আরামের ঘুমটুকু হবে না। এই হলো ডাক্তারদের জীবন। আফসোস, ডাক্তার হতে গেলে আরাম আয়েশ সব জলে ডুবিয়ে আসতে হয়। এই ভেবে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লো সে।
পথিমধ্যে মিমকে নিয়ে নানারূপ ভাবনায় মগ্ন হলো সে। কোনো সন্দেহ নেই, মিমকে প্রথম দেখায় সে পছন্দ করে ফেলেছে। গত এক বছর ওয়ার্ডে থাকাকালীন কখনো মিমের চেহারা দেখেনি সে। দেখেছে শুধু চোখজোড়া যা সবসময় চশমার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। তবে বিয়ের কথাবার্তা এগুনোর জন্য যখন সে মিমের ছবি দেখে তখন ভীষণ অবাক হয়ে যায়। সে ভাবেনি, নিকাবের আড়ালের চেহারাখানা এমন হবে! সে যে কল্পনায় রঙ তুলি দিয়ে অন্য আদলের এক মুখশ্রী এঁকেছিলো। তবে সে এ ভেবে পুলকিত বোধ করলো, মিম তার কল্পনার তুলনায় অধিক সুশ্রী। যদিও তার গায়ের রঙ শ্যামলা। তবুও তার দৃষ্টিতে রূপবতী। বিশেষত মিমের ঐ প্রশস্ত আঁখিজুগল তার ভীষণ প্রিয়।
আদ্রিশের মতে মিমের শ্যামলা বর্ণের চেহারার সাথে ঘন ভ্রু ও বৃহৎ আঁখিজুগল মানিয়েছে দারুণ। যদিও এটা সম্পূর্ণ আদ্রিশের একার অভিমত।
মিমকে নিয়ে কল্পনায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনের পাতায় একদিনের স্মৃতি ভেসে উঠলো। ফোর্থ ইয়ারে থাকাকালীন একদিন মিমকে সে কি কারণে যেনো চাশমিশ বলে সম্বোধন করেছিলো। অবাক করার ব্যাপার, মিম সে নামে প্রত্যুত্তরও করেছিলো, যদিও আদ্রিশ তা মোটেও আশা করেনি। সেই থেকে মাঝেমধ্যেই সে মিমকে চাশমিশ বলে সম্বোধন করে। আর এ ধারা বজায় রেখেই সে গোপনে মিমকে সম্বোধন করার জন্য দারুণ একটা নামও দিয়ে বসলো, মিশমিশ!
#চলবে কি?
#ফাগুন_ছোঁয়া
#পর্ব_১
#লেখিকা_সারা মেহেক