তবু ভালো আছি পর্ব ৬

0
851

#তবু_ভালো_আছি
#রাজেশ্বরী_দাস_রাজী
#পর্ব_৬

কিছু সময় পর রুশা বাইরে মৃন্ময়ের কাছে এলো। ড্রয়িংরুমের সোফায় চুপচাপ বিরস মুখে মেঝের দিকে চেয়ে বসে ছিল মৃন্ময়, রুশা ঘরে আসতেই তার দিকে মুখ তুলে চাইলো সে। রুশা তাকে বলল ভেতরে যেতে, এখন শ্রুতি শান্ত হয়েছে, সে নিজেই মৃন্ময়ের সাথে দেখা করতে চেয়েছে। রুশার কথা শুনে উঠে রুশার সাথেই ঘরের দিকে এলো মৃন্ময়। সেইসময় শ্রুতি বিছানার একপাশে বসেছিলো, সেটা দরজার কাছে আসতেই দেখতে পেলো সে। তবে কোনো এক কারণে দরজা ডিঙিয়ে ভেতরে যাওয়ার সাহস যেন জোগাড় করে উঠতে পারছিল না সে এইমুহুর্তে। রুশা ঘরে এসে শ্রুতির পাশে বসে শ্রুতিকে বলল মৃন্ময় এসেছে। শ্রুতি দরজার দিকে একবার তাকালো মৃন্ময়ের দিকে। মৃন্ময় ভেতরে এলো, শ্রুতির সামনে এসে দুই হাঁটু ভাঁজ করে হাঁটুর ভরে বসে পড়লো সে। প্রথমে শ্রুতির হাত ধরার জন্য হাত বাড়াতে গেলেও পরে নিজেই তার মনে হলো এই অধিকার তার নেই, একদমই নেই, সত্যিই নেই। তাই নিজেই নিজের হাতটা আবারো গুটিয়ে ফেলল সে। শ্রুতির সামনে হাত জোড় করে ধরে আসা গলায় বলল সে,

“তোমার সাথে যা যা হয়েছে তার জন্য দায়ী আমিও। তোমার কাছে আমি অপরাধী। তবে কখনোই আমি তোমার ওপর দয়া করিনি, করতে চাইওনি, সেই ক্ষমতাও আমার নেই। রাগের মাথায় কোনো ডিসিশন নিয়ে, এই অবস্থায় এখান থেকে চলে গিয়ে আমার অপরাধের বোঝাটা আরো বাড়িয়ে দিও না শ্রুতি প্লীজ। আমি জানি তোমার পাশে থাকার অধিকার আমি হারিয়ে ফেলেছি, তবে আমাদের মাঝে কোনো ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার আগেও তো একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। আমাকে শুধুমাত্র একজন সাধারণ বন্ধু হিসেবেই না হয় পাশে থাকতে দিও। আর যায় হোক আমার দোষের জন্য এখন এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিও না যাতে তোমাদের কোনো ক্ষতি হয়। আমি জানি আমাকে ক্ষমা করা তোমার জন্য কঠিন, হয়তো সম্ভব নয়, তবুও বলছি পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। নাহলে আমি নিজেও যে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না, কখনো না। প্লীজ পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও।”

কথাগুলো বলতে বলতে মৃন্ময়ের গলা যেন ধরে এলো। শ্রুতি পুরো কথাটা শুনলো ঠিকই তবে মৃন্ময়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তেমন কোনো উত্তর দিলো না। সে রুশার দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলল,

“আমার খুব ক্লান্ত লাগছে রুশা দি, আমি একটু ঘুমোবো। আজকে আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দেবে?”

শ্রুতির এমন কথায় রুশা অবাক হলেও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। শ্রুতি কোনো উত্তর দেবে না অথবা তার সাথে কথা বলতে সে চাইনা এটা ভেবেই মৃন্ময় উঠে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে গেলেই শ্রুতি নরম স্বরে বলল,

“মৃন্ময়, আমার একটা আবদার রাখবে? আমাকে একটা গান গেয়ে শোনাবে?”

এইমুহুর্তে শ্রুতির মুখে এমন কথা শুনে মৃন্ময় বিস্মিত চোখে তাকালো শ্রুতির দিকে, এখন এমন পরিস্থিতিতে সকল কথাকে উপেক্ষা করে শ্রুতির মুখে এমন কথা আর যায় হোক তারা আশা করেনি, এই কথার কারণও সে খুঁজে পেলো না। তবে শ্রুতির কথাটা উপেক্ষা করতেও তার মন সাই দিলো না। কী করবে বুঝতে না পেরে রুশার দিকে তাকালে সেও মাথা হেলিয়ে সাই দিলো। তবে মৃন্ময় দ্বিধামিশ্রিত কণ্ঠে বলতে গেলো,

“গান? কিন্তু আমি তো…”

শ্রুতি আবারো আগের ন্যায় শান্ত স্বরেই বলল,

“তুমি তো অনেক ভালো গান গাইতে পারতে। একটা গান গেয়ে শোনাও না প্লীজ।”

একটা দ্বন্দ্ব কাজ করলেও শ্রুতির আবদার কিছুতেই যেন ফেলতে ইচ্ছে করলো না আর মৃন্ময়ের। এতগুলো বছর ধরে গানের নামে অজুহাত দিয়ে আসলেও আজকে যেন কোনো অজুহাতই কার্যকর হলো বলে মনে হলো না তার। মৃন্ময় রাজি হলো। শ্রুতি সেই ভাবলেশহীন ভাব নিয়েই রুশার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো একপাশে মুখ ফিরিয়ে গুটি সুটি মেরে, রুশা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মৃন্ময় ঘরের একপাশে থাকা চেয়ারটা এনে তাদের সামনেই সামান্য দূরত্বে বসলো সে। নিজের অস্বস্তিভাবটা কাটিয়ে তুলে ঘরের জানালার দিকে চেয়েই একটা গান ধরলো সে।

“কিছু কিছু কথা,
বসে আছে ভিজে।
মিছি মিছি ব্যথা,
হয় নিজে নিজে।
ঝরে যাওয়া পাতা,
জুড়ে বসে ডালে।
মেঘে মেঘে কথা,
শোনে সে আড়ালে…..”

এতদিন গান না গাইলেও যে সুরের কোনো হেরফের হয়েছে সেটা মনে হলো না, গানের গলা তার আগের ন্যায়ই মধুর। বহুবছর পরে যেন এই মধুর সুর শুনতে পেলো আজ শ্রুতি। শ্রুতি চোখ বন্ধ করলো। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই গভীর ঘুম এসে ধরা দিলো শ্রুতির চোখে। মৃন্ময় গানটা যতটুকু পারলো ততটুকু গেয়ে চুপ করে বসে রইল সেখানেই। শ্রুতি ঘুমিয়ে গেছে সেটা টের পেয়ে রুশা অতি সাবধানে স্নেহের সহিত তার মাথাটা বালিশের ওপর রেখে ঠিকভাবে শুইয়ে দিলো তাকে। শ্রুতির ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে যেন সামান্য ছলছল করে উঠলো রুশার চোখদুটো। রুশা বলল,

“মেয়েটাকে দেখে প্রচন্ড খারাপ লাগে জানিস? কতকিছু না সহ্য করতে হয়েছে এটুকু বয়সে ওকে! পরবর্তীতেও যে আর কী কী সহ্য করতে হবে কী জানি! কতো যে লড়াই করে যেতে হবে ওকে!”

মৃন্ময় মৃদু দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলল, বলল,

“তবে আশা করবো দিনশেষে ঠিকই ওর লড়াইটা ও জিততে পারবে। সহজে হেরে যাওয়ার মেয়ে ও নয়, আর জিততে ওকে হবেই। যা হোক, আমি এখন আসি, ওর খেয়াল রাখিস।”

মৃন্ময় উঠে দাঁড়ালো। রুশাকে বলে শ্রুতির দিকে আর না চেয়েই সেই স্থান থেকে প্রস্থান করলো সে।

.
.

সাধারণ একটি সাজানো গোছানো ঘরের বিছানায় হালকা গোলাপী রঙের একটি ফ্রক পরে বসে আছে মিষ্টি একটি বাচ্চা মেয়ে, চুলগুলো তার দুদিকে ঝুঁটি বাঁধা। সে আঙুল উঁচিয়ে তার সামনে বিছানায় রাখা পুতুলগুলোকে মুখে রাগ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে কড়া শাসন করতে ব্যস্ত, কথা বলার তালে তালে তার মাথা সহ ঝুঁটিদুটোও দুলছে। শ্রুতি চেয়ারে বসে নিজের স্কুলের কিছু খাতা দেখছিল, খাতা থেকে মুখ তুলে মেয়ের এমন কান্ড দেখে আপনমনে হাসলো শ্রুতি। তার মেয়ে, শ্রেয়ার বয়স বর্তমানে প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল। মেয়ে জন্মানোর পর মোটামুটি চাকরির পাশাপশি বাকি পড়াশোনাটাও কোনমতে চালিয়ে গিয়েছিল শ্রুতি। যদিও তাতে রুশা আর মৃন্ময় তার জন্য যা যা করেছে সেটা ভুলে যাবে এমন অকৃতজ্ঞ সে নয়, তাদের অবদান কোনোমতেই অস্বীকার করতে পারবে না সে। শ্রুতি এখন একটি স্কুলের শিক্ষিকা, চাকরি ভালোই, সে এখন সাবলম্বি। এখন মেয়েকে নিয়ে সে একা এই ফ্ল্যাটে থাকে প্রায় দুই বছর হতে চলল প্রায়। বছর দেড়েক আগে রুশার বিয়ে হয়েছে আকাশের সাথে। রণজয়ের সাথে শ্রুতির ডিভোর্সের পালা শেষ হয়েছে প্রায় বছর চারেক আগেই। সিঙ্গেল মাদার হয়ে উঠতে গেলেও এখনো আমাদের সমাজে মেয়েদের খুব নাহলেও কিছু অসুবিধের মুখোমুখি হতে হয়, শ্রুতিকেও পড়তে হয়েছিল, তবে সবকিছুর মোকাবিলা করে এই জায়গায় এসে উপস্থিত হয়েছে সে এবং ভবিষ্যতেও যে যে লড়াই তাকে করে যেতে হবে সেগুলোকে ভয় পাইনা সে কখনোই।

শ্রেয়া খেলার মাঝে মায়ের দিকে তাকালো। চোখ পিটপিট করে কিছুসময় গভীর পর্যবেক্ষণ করে মুখে একরাশ হাসি টেনে বলল,

“মা তোমাকে আজ গোলাপী শাড়িতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে জানো, গোলাপ ফুলের থেকেও সুন্দর।”

শ্রুতি মেয়ের কথা শুনে “তাই?” বলে হাসলো, শ্রেয়া প্রায়ই এমন বলে, শ্রুতি সবসময়ই তার এমন কথা শুনে হাসে, বাচ্চা শ্রেয়া তখন ফ্যালফ্যাল চোখে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। এই ছোট্ট প্রাণটা জীবনে আসার পর থেকেই যেন পুরো জীবনটাই বদলে দিয়েছে শ্রুতির। এইসবের মাঝেই বাড়ির কলিংবেলের তীক্ষ্ণ আওয়াজ শোনা গেলো। শ্রেয়া যেন অধীর আগ্রহে এটারই অপেক্ষা করছিল এতটা সময়, কলিংবেলের শব্দ শোনামাত্রই সে একপ্রকার আনন্দে লাফিয়ে উঠে বিছানা থেকে নেমে “ভালো আঙ্কেল এসেছে।” বলে দৌড় দিলো দরজার দিকে। শ্রুতি উঠে “এই আস্তে শ্রেয়া।” বলে হাঁটা ধরলো মেয়ের পিছু পিছু। কিন্তু কে শোনে কার কথা! শ্রেয়া এক দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখেই যেন কোলে উঠার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লো। মৃন্ময়ও যেন এমন কিছুরই প্রস্তুতি নিয়ে ছিল, সে সাথে সাথে হাসি ভরপুর মুখে কোলে তুলে নিলো শ্রেয়াকে। শ্রেয়া মৃন্ময়ের গলা জড়িয়ে ধরে উৎফুল্লিত কণ্ঠে বলল,

“ভালো আঙ্কেল, সেই কখন থেকে তোমার জন্য ওয়েট করছিলাম আমি। আচ্ছা আমার চকলেট এনেছো তো?”

“এনেছি তো, আমি আমার প্রিন্সেসের জন্য চকলেট আনবো না সেটা কখনো হয়?”

শ্রুতি তাদের দুজনকে দেখে মৃদু হাসলো। মৃন্ময়ের সাথে শ্রুতির খুবই সাধারণ একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক বর্তমানে আছে। তবে শ্রেয়ার সাথে মৃন্ময়ের সম্পর্কটা আগাগোড়াই এমন গাঢ়। শ্রুতি তাতে কখনো কোনো বাঁধা দেয়নি, হয়তো সে তাদের জন্য যা যা করেছে সেইগুলোর কথা ভেবেই। ছুটি-ছাটার দিনগুলোতে মৃন্ময় আসে শ্রেয়ার সাথে সময় কাটানোর জন্য। শ্রেয়াও যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে তার। শ্রুতি শ্রেয়াকে ছোট থেকেই মা এবং বাবা উভয়ের ন্যায় আগলে রাখলেও, বাবার অংশের সামান্য কিছুটা ভালোবাসা এবং আস্কারা সে পেয়েছে মৃন্ময়ের থেকে, সেই জন্যই হয়তো এমন টান। জন্মের সময় থেকে শুরু করে মৃন্ময় শ্রেয়াকে যেন নিজের মেয়ের মতোই ভালোবেসে এসেছে। মৃন্ময় শ্রেয়াকে নামিয়ে পকেট থেকে চকলেট বের করে শ্রেয়ার হাতে দিলো, শ্রুতির দিকে চোখ যেতেই গলা ঝেড়ে মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে আবার শ্রেয়াকে বলল,

“চকলেট দিলাম কিন্তু বেশি খাবে না একদম, নাহলে কী হবে জানো তো?”

“জানি তো মা বলে দাঁতে পোকা হয়ে যাবে কিন্তু আমার দাঁত তো স্ট্রং, আমার কিছু হবে না।”

শ্রেয়া কথাটুকু বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। শ্রুতি “এই দুষ্টু!” বলতেই সে দৌড় দিলো ভেতরের দিকে। শ্রুতি মৃন্ময়ের দিকে চেয়ে সামান্য মজা করেই বলল,

“তুমি কিন্তু ভালোই আস্কারা দিচ্ছো মেয়েটাকে।”

প্রত্যুত্তরে মৃন্ময় মাথা নামিয়ে হাসলো। শ্রুতি প্রশ্ন করলো,

“আঙ্কেল, আন্টি, রুশা দি আর আকাশ দা, ওদেরও তো আসার কথা ছিল। তারা সবাই কোথায়?”

“ওরা আসছে।”

মৃন্ময় আর শ্রুতির কথোপকথনের মাঝেই মৃন্ময়ের মা-বাবা, রুশা, আকাশ সেখানে উপস্থিত হলো। মৃন্ময়ের মা-বাবা আগেও এসেছেন তাদের বাড়ি। এখন ছেলের সাথে দেখা করতেই মূলত শহরে এসেছিলেন তারা, তাই জন্যই ফিরে যাওয়ার আগে একবার শ্রেয়া আর শ্রুতির সাথে দেখা করতে আসা তাদের। এখান থেকে সরাসরি নিজেদের বাড়ি ফিরবেন মৃন্ময়ের মা-বাবা। তাদের সকলকে ভেতরে আসতে দেখেই শ্রেয়া রুশার কাছে গিয়ে “মিমি!” বলে কোলে উঠে পড়লো। সকলে মিলে গল্প-গুজব-হাসি-মজা আর দুপুরের একটু খাওয়া দাওয়ার মধ্যে দিয়ে কাটলো বেশ কিছুটা সময়। শ্রেয়া মৃন্ময়ের সাথে খেলছিল, বাকিরা বসে গল্প করছিল। সামান্য দূরেই শ্রুতি একপাশে দাঁড়িয়ে চেয়ারের ওপর রাখা শ্রেয়ার কিছু জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখছিল। কাপড় ভাঁজ করতে করতেই শ্রুতি একবার তাদের দিকে চাইলো। মৃন্ময়ের মা উঠে এসে তাকে সাহায্য করতে চাইলে শ্রুতি জানালো কয়েকটাই তো জামা-কাপড় সে ভাঁজ করে নিতে পারবে। তবে শ্রুতির বারণ তিনি শুনলেন না, তিনি ঠিকই সাহায্য করলেন। ভাঁজ করা কাপড়গুলো নিয়ে তারা শ্রুতির শোয়ার ঘরে আসলে ঘরের দরজার কাছ থেকে মৃন্ময় আর শ্রেয়ার দিকে একনজর চেয়ে তিনি বললেন,

“দুজনকে দেখে বড্ড ভালো লাগে না? মৃন্ময় তো শ্রেয়াকে বড্ড ভালোবাসে। আর শ্রেয়া! কী মিষ্টি বাচ্চাটা! বাচ্চাটার সাথে ছেলেটাকে এভাবে হাসতে দেখেও মনটা ভরে যায় আমার, মনে হয় আমার নাতনীর সাথেই যেন আমার ছেলেটা হাসছে-খেলছে।”

শ্রুতি জামাকাপড় আলমারিতে তুলে রাখতে রাখতে হাসিমুখে উত্তর দিল,

“শ্রেয়া তো আপনাদের নাতনীর মতোই আন্টি।”

মৃন্ময়ের মা “হ্যাঁ” বলে চুপ করলেন, আবার কী ভেবে যেন বললেন,

“এতটুকু বয়সেই কতকিছু ঘটে গেছে তোমার জীবনে! কিছুটা তো জানি আমরা, কতোকিছুই না সহ্য করেছো তুমি!”

“আপনাদের আশীর্বাদে সবকিছু সামলে উঠেও তো তবু ভালো আছি।”

“সত্যিই কি ভালো আছো?”

শ্রুতি এমন প্রশ্ন শুনে তার কারণ প্রথমটায় ঠিক বুঝে উঠতে না পেরে মৃন্ময়ের মায়ের দিকে তাকালো।

“সেই কতো বছর আগে তোমার আর মৃন্ময়ের দেখা হয়েছিল। মৃন্ময় আমার কাছে খুব কম কথা লুকোতো, তোমাদের প্রেমের কথা পরে তাই মৃন্ময় ঠিকই আমায় একটু আধটু জানিয়েছিল। কলেজে ভর্তির পর থেকে তো ও মেসেই থাকতো, একদিন হঠাৎ ও আমাকে ফোন করে জানালো ‘মা আমি বিয়ে করছি। বাকিসব কী হবে আমি জানি না কিন্তু আমি পালিয়ে বিয়েটা করছি, তুমি ওদিকটা সামলে নিও।’ ছেলে তো ওটুকু বলেই খালাস। আর এদিকে আমার চিন্তার শেষ নেই যে কী বলছে এইসব ও? ওকে কী বলবো? কীভাবে হুট করে এইসব সম্ভব? কীভাবে কী হবে? কীভাবে সামলাবো সব? ওর বাবাকে কীভাবে বোঝাবো? কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তারপর মৃন্ময় পরের দিন একা বাড়ি ফিরে এলো। ছেলে একদম শান্ত, চুপচাপ। তার সেই শান্ত ভাবটাও যেন প্রচন্ডরকম অস্বাভাবিক লাগছিল। আমি অনেক জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে, এমন কেন দেখাচ্ছে ওকে? ও শেষে আমাকে কাঁদতে কাঁদতে এটাই বলেছিল, ‘পারলাম না মা ধরে রাখতে, নিজের ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেললাম আমি পুরো জীবনের জন্য। আমি হেরে গেলাম, ওকেও হারিয়ে দিলাম আমি। নিজের এই অপরাধবোধ কীভাবে কমাবো আমি মা?’ সেইদিনই বুঝেছিলাম তুমি ওর কাছে কতটা দামী ছিলে। সেই দিনের পর ছেলেটাকে আর আগের মতো ফিরে পাইনি। হাসি-মজা করে দিন কাটানো ছেলেটার প্রাণোচ্ছলতাও কোথায় যেন হারিয়ে গেলো, তারপর তো সবাই যে যার জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।”

শ্রুতি চুপ করে শুনলো ওনার সকল কথা, এইসব কথা ওঠায় বেশ অস্বস্তির মাঝেই পড়লো সে। মৃন্ময়ের মা আবারো বললেন,

“একটা কথা বলছি, জোর করার বিষয় এটা যদিও নয়, জোর করবোও না। তবে নতুন করে জীবন শুরু করার কথা ভাবো কি কখনো?”

তার এরূপ প্রশ্নে শ্রুতির অস্বস্তির মাত্রা যেন বেড়ে গেলো প্রচন্ড পরিমাণে। উত্তর নিজের কাছে স্পষ্ট হলেও মুখের ওপর বলতে হয়তো বাঁধলো। তখনই শ্রেয়া ডাক দিলো তাকে “মা, মা” বলে, শ্রুতি সাথে সাথেই “আসছি, আমাকে ডাকছে।” বলে প্রসঙ্গটা সম্পূর্ন উপেক্ষা করে চলে গেলো সেই স্থান থেকে। শ্রুতি মুখে কোনো উত্তর না বললেও তার ভাবভঙ্গিতে উত্তরটা ঠিকই যেন পরিষ্কারভাবে ধরা দিলো মৃন্ময়ের মায়ের কাছে, তিনি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বাইরে এলেন। এই বিষয়ে আর কথা উঠলো না। আরো কিছুটা সময় পর হাসপাতালে কাজ থাকায় আকাশ রওনা দিলো সেখানে, মৃন্ময়ের মা-বাবার বাড়ি ফেরার সময় এলে বাকি সকলে মিলেই তাদের দুজনকে স্টেশন অবধি পৌঁছে দিয়ে আবার শ্রুতিদের বাড়িতে ফিরলো।

চলবে,…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here