#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_০৭ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
লাবিব চিন্তাও করতে পারেনি এমন কিছু শুনবে। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। চোখজোড়া বিস্ফোরিত হয়ে স্থির হয়ে গেছে। কান থেকে ফোনটা আস্তে আস্তে নামিয়ে ধপ করে রকিং চেয়ারে বসে পড়ল। এবার সে পুরোপুরি নিশ্চিত, সাঈদ গুরুতর কোনো পরিকল্পনা করে বসে আছে। একটু আগে ফাহিমের নাম্বারে কল দিয়েছে লাবিব। কিন্তু কারণবশত ফোনটা বন্ধ ছিল। কলটা যায়নি। লাবিবের কাছে আরো একটি নাম্বার ছিল, যেটা দিয়ে কল করতেই ওপাশ থেকে কেয়ারটেকার ছেলেটা রিসিভ করে। নাম মাসুদ। ছেলেটা কল রিসিভ করেই প্রশ্নসূচকে বলে,
– হ্যালো, কে?
– আমি লাবিব খন্দকার বলছি। ফাহিমের কলিগ। ফাহিমকে একটু পাওয়া যাবে? আমি ওর পার্সনাল নাম্বারটায় ট্রায় করেছি, কিন্তু ওটা বন্ধ।
– ভাইয়ে তো হাসপাতালে। আপনে কিছু জানেন না?
লাবিব আশ্চর্য! কী বলছে এসব? হাসপাতালে মানে? লাবিব অস্থিরভাবে বলল,
– না তো। হাসপাতালে কেন? ওর কী হয়েছে?
– হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়া গেছে। ভাইয়ে তো ছয় মাসের জন্য পঙ্গু। কোনোরকম হাঁটা-চলা করতে পারব না।
পিঠের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা কিছু বয়ে গেল তার। লাবিব চোখ-মুখ কঠিন করে স্থিরচোখে থমকে গেছে। কেয়ারটেকার ছেলেটা আরো কিছু তথ্য জানিয়ে শেষমেশ কলটা দেয়। কিন্তু লাবিব তখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। ধপ করে রকিং চেয়ারে বসে পড়লে অবান্তর চিন্তাগুলো শূলের মতো বিঁধতে থাকে। সাঈদ কোনোভাবেই চাচ্ছে না ওর অতীতের ঘটনা বর্তমানে এসে প্রভাব ফেলুক। তার মানে এটুকু নিশ্চিত, ফাহিমের মাধ্যমে ফিহা শেখের ঘটনা সম্পূর্ণ গোপন রাখতে চাইছে। আর এই ঘটনা তখন থেকেই ঘটছে, যখন ওর মস্তিষ্কে ‘ নাবিলা হক ‘ ঢুকেছে। হয়তো আপাতদৃষ্টিতে সাঈদের কর্মকাণ্ড দেখলে যেকোনো মানুষ প্রচণ্ড খেপে যাবে, কিন্তু এর গূঢ় সত্যটা একবার ধরতে পারলে মানুষ সবকিছু খাপে খাপ বুঝতে পারবে। এটুকু বুঝার জন্য অবশ্যই ধৈর্য দরকার। এই ধৈর্যটাই ওর প্রতি কেউ দেখাতে পারল না। রাগী স্বভাব ও খিটখিটে মেজাজটার জন্য কেউ ওর অবস্থা দু’দণ্ড বুঝতে চায়নি। বুঝতেও চায়নি কী চাইছে সাঈদ। লাবিব ফোনটা নিয়ে ফাহাদের নাম্বারে কল বসাল। ফাহাদ কলটা রিসিভ করলে লাবিব ম্লান গলায় বলল,
– ফ্রি আছিস?
ফাহাদ পিসির সামনে বসে অফিসের ফাইল চেক করছিল। কলটা লাউডে দিয়ে বলল,
– হ্যাঁ, বল।
লাবিব রকিং চেয়ারে গা ছেড়ে বিমর্ষ গলায় বলল,
– ভালো লাগছে না বন্ধু। আমি বুঝতে পারছি না কী করলে ঝামেলাটা মিটমাট হবে। চর্তুদিক থেকে প্রবলেম ফেস করছি, বাট সলিউশন বলতে কিছুই পাচ্ছি না।
মাউস নাড়ানো হাতটা থামিয়ে ফেলল ফাহাদ। চট করে দৃষ্টি সরিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
– সব ঠিক আছে তো? তোর টোন এমন শোনাচ্ছে কেন? কী হয়েছে? ইজ এভ্রিথিং অলরাইট?
লাবিব চোখদুটো বন্ধ করে নিস্তেজ সুরে বলল,
– নাথিং ইজ রাইট। ফাহিম হাসlপাতাlলে। একটু আগে ওর কেয়ারটেকারের সাথে কথা বললাম। ডান পায়ের লিগাlমেন্ট ছিঁlড়ে গেছে। কাজটা হlকিস্টিlক দিয়ে করা।
ফাহাদ ভ্রঁদুটো আরো কুঁচকে শেষমেশ পিসিটাই বন্ধ করে দিলো। লাউডে থাকা ফোনটা কানে চেপে অদ্ভুত স্বরে বলল,
– আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না লাবিব, আমাকে কাইন্ডলি বুঝিয়ে বল। ও কী নাবিলার প্রতি কোনোভাবে সিরিয়াস? যদি সিরিয়াস না-হয় তাহলে এরকম আচরণ করছে কেন? এরকম আচরণ তো ফিহার বেলায় করেনি।
– বলতে পারলাম না। ও আমার কাছে কিছুই খুলে বলে না। ইচ্ছে হলে দু-একটা প্রশ্নের জবাব দেবে, নাহলে চুপ করে থাকে। ফিহার কেস পুরোই আলাদা। ফিহা নিজ থেকে ছলচাতুরি করে ওর সাথে কানেক্ট হয়, কিন্তু নাবিলা তো একেবারেই অন্য ধাঁতের মানুষ। সেদিনের কথাবার্তা দ্বারা এইটুকু বুঝে গিয়েছি, ও ফিহার মতো শয়তাlনি চিন্তাভাবনা নিয়ে থাকে না। ওর মনটা স্বচ্ছ। ও সবাইকে বুঝতে জানে। কথায়-কথায় আরো একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি, ও সাঈদের প্রতি অ্যাট্রাক্টেড না।
– এটা তো অসম্ভব মার্কা কথা বলছিস। ফিমা যেখানে প্রথম দিন আসতে-না-আসতেই সাঈদের রুমে লুকোচুরি শুরু করে দিয়েছিল, সেখানে নাবিলার মধ্যে এতকিছু তুই আইডেন্টিফাই করলি?
– আমি একটু হলেও মানুষ চিনি। নাবিলা হয়তো বয়সে অল্প, কিন্তু ওর কথাবার্তা ম্যাচিউর্ড ব্যক্তির মতো লাগে। কিছু শিক্ষিত মেয়েরা লেখাপড়া শিখে নিজেদের বিরাট কিছু মনে করে, নিজেরে ইউনিক প্রমাণ করার জন্য মাঝে মাঝে দেখবি আলগা ঢঙ করে কথা বলে, ওটাকে বলে ন্যাকা। এই ন্যাকামো আমি ফিমার মধ্যে দেখেছি। কিন্তু নাবিলার মধ্যে কিছুই দেখিনি। মেয়েটা ওর বয়স অনুযায়ী যথেষ্ট ম্যাচিউর্ড। সামনে দেখিস আরো ম্যাচিউর্ড হবে।
– আজকেই ফার্স্ট শুনতেছি দোস্ত। কোনো মেয়ে যে সাঈদরে গুলুগুলু নজরে দেখে না এটাই প্রথম। এই পযর্ন্ত যা যা কেস দেখছি, সেই অনুপাতে বিবেচনা করলে নাবিলা সবকিছু পালটে দিলো।
– ফাহাদ, মেয়েদের ছোটো করবি না। তোর এটা মাথায় রাখা দরকার হাতের দশটা আঙুল এক সমান না। সব মেয়েরাই যে ড্যাবড্যাব করে তাকায়া থাকব এটা ভাবা ভুল। কেউ না কেউ অবশ্যই এমন হইব যে আমাদের চিন্তার বাইরে আচরণ করবে।
– এটা একহিসেবে পজিটিভ সাইন। সাঈদরে সামলানো ইজি কাজ না। এটা দুর্বল, অধৈর্য আর ফাস্ট্রেটেড মানুষ দ্বারা কখনোই সম্ভব না। যেহেতু তোর ভাষ্যমতে নাবিলা ম্যাচিউর্ড, সেক্ষেত্রে আমি ধরে নিতে পারি, ও সাঈদকে ঠিকঠাক মতো বুঝতে পারবে। আমি-তুই যেখানে সবার সাথে মিলেমিশে নিজেদের প্রবলেম শেয়ার করতে পারি, এইটা কিন্তু সাঈদ পারে না। এই সামান্য কাজটাই আজ পযর্ন্ত করতে পারে নাই। ওর রাগের বাইরে যেই ডিসেন্ট চেহারা লুকায়া থাকে, ওটা যদি কেউ একবার বুঝতে পারে রে লাবিব! তাহলে আমি তোরে গ্যারান্টি দিলাম, ওই মেয়ে সবচাইতে লাকি পার্সন হবে। পাথরও ভাঙে, লোহাও গলে। একবার যদি সাঈদকে বুঝতে পারে, তাহলে ওর মতো মানুষটারে কোনোদিন ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথায় আনব না।
– তোর কী মনে হয় সাঈদ রোমান্টিক?
– আবার জিগায়! ওয় তোর চাইতেও রোমান্টিক দ্যাখ গে যেয়ে। গোমড়ামুখী খ্যানর খ্যানর পুরুষরা স্ত্রীর নিকট প্রেমময় হইয়া থাকে। তাহারা স্ত্রীর প্রেম-ভালোবাসা পাইবার জন্য যেকোনো কিছু করিবার জন্য সচেষ্ট। হিসাব বুঝছস?
ফাহাদ সাধুমিশ্রিত ভাষাটা এমন হাস্যকরভাবে বলল যে, তা শুনে সিরিয়াস মোমেন্টেও হেসে দিয়েছে লাবিব। ওপাশ থেকে তীব্র হাসির শব্দ শুনে ফাহাদও এখন মিচকি হাসি দিয়ে দুষ্টু দুষ্টু গলায় বলল,
– যা ব্যাটা, হাসিস ক্যান? সত্য কথাই তো বলতেছি। আমার আব্বারে দেখলাম আজীবন আম্মার সাথে ‘ দা-বটি তুইলা খুlনাiখুlনি ‘ টাইপ ঝগড়া করতে। অথচ, দ্যাখ আমরা পাঁচ ভাইবোন। এক সকালে আব্বার সাথে ঝগড়া করে পরদিন সকালে নাস্তা বানায়া খাওয়ায়।
লাবিব বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল,
– তুই কী জীবনে সিরিয়াস হবি রে পাlগlলা?
লাবিবের কথাকে সুন্দরভাবে অগ্রাহ্য করল ফাহাদ। ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি দিয়ে বলল,
– সাঈদ একটা পুংটা, ওর ঘরে কতগুলি হয় দেখিস।
আর নিজেকে থামাতে পারল না লাবিব। হো হো হাসিতে কথা বন্ধ হয়ে যায়। ফাহাদের কথায় হাসতে হাসতে সম্মতি জানিয়ে কলটা কেটে দেয় সে। ফাহিমকে একবার দেখে আসবে কিনা সেটাই এখন ভাবছে। হlকিস্টিlকের বাlরি খেয়ে কতটুকু টাইlট হয়েছে, সেটা দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে। একবার কী দেখে আসবে? স্বয়ং যে বান্দা জুনায়েদ সাঈদকে ব্ল্যাকমেইল করার দুঃসাহস দেখিয়েছে, তার অবস্থা কেমন হয়েছে সেটা কী এবার চাক্ষুষ দেখা উচিত না? অবশ্যই উচিত। কিছু জিনিস নিজ চোখে না দেখলে আত্মা শান্তি হয় না।
.
বিকেলের আঁচটা কমে গিয়ে সন্ধ্যের ছায়ায় ডুবে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে নিভে যাওয়া আকাশটা এখন সন্ধ্যের ছাঁচে বেগুনি আভায় ছেয়েছে। পাখিদের উল্লাসিত দল এখন নীড়ে ফেরার জন্য মগ্ন। সহসা প্রকৃতির ব্যস্ত অবস্থা নীরবতার চিত্রে ছাপিয়ে যাচ্ছিল। থাইগ্লাসটা সরিয়ে গ্লিলহীন জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে ফিহা। নীচের খালি লনটা এখন এনার্জী বাল্বের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিশাল বড়ো গেটটা দিয়ে এখনো খালামনির গাড়িটা ঢোকেনি। পাশের রুমে ফিমা আপু কলেজ থেকে ফিরে এখন রেস্ট নিচ্ছে। দরজাটা ভেতর থেকে আঁটকে রেখেছে বিধায় টুকটাক কথা বলারও সুযোগ নেই। এখানে এসে খুবই ফাপর লাগছে ফিহার। বাড়িটা এত নীরব যে বাইরে থেকে কোনো মানুষ এলে বিশ্বাসই করতে চাইবে না এখানে কোনো মানুষ থাকে। এতটা নিরিবিলি নিস্তেজ পরিবেশে থাকলে মানুষ ধীরে ধীরে চরম বিষণ্ণতার দিকে ধাবিত হবে। গ্যারেজটার ভেতর কী আছে তা জানার জন্য মনটা খুব আঁকুপাঁকু করছে। আচ্ছা বদখত লোকটা ওই গ্যারেজটার ভেতর কীভাবে সময়গুলো কাটায়? বই পড়ে? ঘুমিয়ে? নাকি অফিসের কোনো কাজ-টাজ নিয়ে নিরিবিলি ভাবার জন্য বসে থাকে? এই লোকটা নিজের রুমটা পযর্ন্ত লক করে রেখে গেছে। আচ্ছা কথায় কথায় ‘ এই লোকটা ‘ বলে সম্বোধন করছে কেন? ওর তো ভাই হয়। মানুষটাকে ‘ ভাই ‘ ডাকলে ক্ষতি কী? ছোটো থাকতে তো ‘ ভাই, ভাইয়া ‘ বলেই ডাকত, তবে বড়ো হয়ে সম্বোধনটা ভুলে যাওয়ার পাশাপাশি ‘ তুমি ‘ থেকে ‘ আপনিতে ‘ চলে এসেছে। তাছাড়া ‘ ভাই ‘ একটা সম্মানবোধক শব্দ, যা এই বদমেজাজী অভদ্র লোকটার জন্য কোনোভাবেই খাটছে না। তাকে সে সম্বোধন ছাড়াই ‘ বlদখlত, বেlয়াদlব, খ্যাঁlকশেlয়াlল ‘ যতপ্রকার ভয়ংকর ভয়ংকর সম্বোধন আছে তা দ্বারাই অভিহিত করবে। হঠাৎ দাপুটে দুটো হর্ণ বাজিয়ে গুম গুম শব্দে রোলস রয়েস গাড়িটা প্রবেশ করল। কালো কালিনান মডেলের গাড়িটা যেন অদ্ভুত দাম্ভিকতার জাহির করছে। প্রকাশ পাচ্ছে এর আভিজাত্যে ঘেরা শৌখিনতার পরিচয়। এই লোকটার রুচি ও শখ অন্য সবার থেকে পুরোপুরি ব্যতিক্রমই বলা চলে। নাহলে কেউ নিজের রুম ও গ্যারেজ শুধু শুধু লক করে? ড্রাইভিং সিটের দরজাটা খুলে বাইরে পা রাখল। ধড়াম করে দরজাটা বন্ধ করতেই দূর থেকে ফিহা কপাল কুঁচকে ফেলে। কী আশ্চর্য! হাতে ব্যান্ডেজ কেন? কপালটা আরো কুঁচকে দেখল, ঠিক ডানহাতে ব্যান্ডেজটা করা। টানটান স্লিভের নীচে বলপূর্ণ হাতটা লাল টকটকে হয়ে আছে। ওই হাতটা একদমই নাড়াচ্ছে না সে। সকালে যে হাতটা ঠিকঠাকই ছিল, এখন ওই হাতটার এই অবস্থা কেন? কী হয়েছে হাতে?
.
রুমে ফিরতেই খুব কষ্টে শার্টের বাটনগুলো খুলে ফেলল সাঈদ। প্রচণ্ড ব্যথায় ডানপাশটা টনটন করছে তার। বাঁ-কাধ থেকে শার্টটা খুলতেই আস্তে আস্তে ওটা ডানহাত দিয়ে নামিয়ে নিল। স্লিভের কাছে ছোপ ছোপ রক্ত দেখে সেটা বাথরুমে যেয়ে রেখে আসলো। কোমরের বেল্টটা বাঁ-হাতে একটান দিয়ে খুলতেই বিছানায় বসল সে। কাটা হাতের দিকে তাকিয়ে উদাসী চোখে নীরব হয়ে গেছে। একটা পুরোনো দিনের স্মৃতি মানসপটে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠল। সেদিন মাকে খুব আবদার করে বলেছিল,
– মা, তুমি খাইয়ে দাও।
সেদিন মায়ের মেজাজটা কোনো কারণে প্রচণ্ড খারাপ ছিল। বাবার সাথে কথা কাটাকাটির পর খুব রুক্ষ মেজাজে টিভি দেখছিল। সাঈদের কথা শুনতেই যখন ওর দিকে ক্রুদ্ধভাবে তাকায়, ভেতরের সমস্ত জ্বালা যেন ওর উপর দিয়ে ঝেড়ে দেয় সে। প্রচণ্ড ধমকের সুরে চ্যাঁচিয়ে উঠে,
– সামনে থেকে যা! চলে যা বলছি। আমাকে একদম বিরক্ত করবি না! তোর বাপের সংসারে এসে আমার কপাল পুlড়lল। তোদের পেছনে কামলার মতো শুধু খেটেই গেলাম, খেটেই গেলাম, কোনো লাভ হলো না। নিজের হাতে টুকে টুকে সংসারটা সাজালাম, আর এখন তোর চাচারা ভাগ বসাতে এসেছে! এতদিন কোনো খোঁজখবর ছিল না? বেঁlচে আছি না মiরে গেছি সেই খবর নিতে পারেনি? যেই শুনেছে সম্পত্তির পুরো ভাগ বড়ো ছেলেকে লিখে দিবে, ওমনেই বুড়ো বাপের প্রতি ন্যাকা কান্না শুরু। শlয়তাlনের দল! ধাlন্দাবাlজ কোlথাlকার! আমিও দেখে ছাড়ব তোর চাচারা কীভাবে আমার সংসারে আlগুlন লাগায়। একেকটাকে ধরে ধরে শিক্ষা দেব!
মায়ের রণমূর্তি দেখে সেদিন ভাতই খায়নি সাঈদ। খেলতে গিয়ে ডানহাতের বৃদ্ধাঙুলটা কেটে গিয়েছিল, যার জন্য মায়ের কাছে খাইয়ে দেওয়ার আবদার করে সে। কিন্তু মা যে তখন সাংসারিক ঝামেলায় ব্যস্ত হয়ে অতগুলো কঠিন কথা শুনিয়ে দেয়, সেগুলো ছোট্ট সাঈদ মানতে পারেনি। ওই ঘটনার পর থেকে আর কোনোদিনই মায়ের কাছে খাইয়ে দেওয়ার আবদার করেনি। কখনো নিষ্পাপ সুরে বলেনি, ‘ মা, খাইয়ে দাও ‘। আজ ব্যান্ডেজে মোড়া হাতটা দেখে বীভৎস স্মৃতিগুলো খুব বাজেভাবে তাড়া করল। এভাবেই তো জীবন তাকে রাগী, মেজাজী, গম্ভীর পুরুষ বানিয়ে দিলো। সেটা কী আশপাশের মানুষগুলো বুঝবে? হঠাৎ রুমের দরজা ঠেলে প্রবেশ করলেন সুফিয়া। কাছে এসে হাসিমুখে বললেন,
– আহো, নীচে আহো। সকালে যেই কামডা করছ, এহনো তুমার উপর খেইপ্পা আছে। রাগ ইট্টুও কমে নাই। সামনে গিয়া আর চেতাইয়ো না, রাগলে এহন তুস তুস কইরা কথা শুনাইব।
খুব সাবধানে হাতটা আড়াল করল সাঈদ। বিছানায় যে শুকনো টাওয়েলটা রেখেছিল, সেটা দিয়ে হাতটা এমনভাবে ঢেকে নিল যেন সুফিয়ার চোখে না পড়ে। সে হালকা মেজাজে মিথ্যা করে বলল,
– নীচে যাব না খালা। আপনি যান। আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।
সুফিয়া অবাক হন। বিস্ময়সূচকে বলেন,
– কী কও এগুলি? তুমি বাইরের খাওন খাইছ? আমার তো তুমার কথা বিশ্বাস হইতাছে না। তুমার না বাইরের খাওন খাইলে শরীর খারাপ করে? বমি হয়? আইচ্ছা ঠিক আছে, খাওন লাগব না। তুমি নীচে আহো। টুকটাক কথা না কইলে সহজ হইতে পারবা না। কালকা মাইডারে যেইভাবে কথা শুনাইছ, কাজটা একদমই করো নাই। ওর কী দোষ আছিল কও তো দেহি? হুদাই ওরে বকছ ক্যা?
ফ্লোর থেকে দৃষ্টি তুলে কড়া চোখে তাকাল। মুখের ভাবমূর্তি হিংস্র তেজের মতো পরিবর্তন করে বলল,
– আমার মাথাটা কন্ট্রোলে নেই খালা। এই মূহুর্তে কোনোপ্রকার কথা বলতে চাচ্ছি না। আমাকে একা ছাড়ুন।
টাওয়েল দিয়ে উন্মুক্ত দেহের ডানপাশটা ঢেকে নিয়েছে সে। সাঈদ কোনোভাবেই চাচ্ছে না সুফিয়া হাতের ব্যাপারটা দেখে ছোটোখাটো হল্লা করুক। ওর অবস্থা দেখলে ভদ্রমহিলা একদমই স্থির থাকবেন না, উলটো বিপিটা বাড়বে। সুফিয়া মনটা খারাপ করে বাইরে চলে গেলেন। বাথরুমে ঢুকে ক্লথ হ্যাঙ্কারে টাওয়েলটা ঝুলিয়ে আস্তে আস্তে ব্যান্ডেজটা খুলে ফেলল সাঈদ। অসহ্যকর ব্যথায় ভেতরটা কুড়ে কুড়ে ছিঁlড়ে যাচ্ছে, অথচ বাইরে থেকে তার সুশ্রী মুখটা দেখলে কেউ নূন্যতম অবস্থাও আন্দাজ করতে পারবে না। অবশেষে ব্যান্ডেজটা উন্মুক্ত হয়ে হাতের তালুতে গভীর ক্ষতটা ফুটে উঠল। তিন ইন্ঞ্চির মতো ডেবে কেটেছে তালুটা, হালকা চাপ দিলে এখনই বুঝি তরতাজা রlক্ত বেরোবে। হাতে কী এখন স্টিচ করাবে?
.
সকাল সকাল উঠেই ফিহা থম মেরে আছে। আজ নাকি প্রাইভেট টিউটর এখানে এসে পড়াবে। নিয়াজ মেয়ের পড়াশোনার দেখভাল করতে গিয়ে আফসানার ইচ্ছায় কাজটা করেছেন। ফিহা নিজেও বুঝতে পারছে না স্যার কীভাবে এখানে আসার জন্য রাজি হল। যদিও স্যার ঢাকা থেকে জার্নি করে নারায়ণগঞ্জমুখো হয়, তবু ব্যাপারটা স্বাভাবিক কিছু লাগছে না। এগারোটার দিকে আসার কথা, কিন্তু এখন বাজে আটটা। আফসানা অফিসে চলে গেছে, ফিমাও কলেজের জন্য বেরিয়ে গেছে। ফিহা বাড়ির বাইরে সকালের মিঠে রোদটা মাথায় নিয়ে ঘুরে ঘুরে চারপাশটা দেখছিল। এটা বাড়ির ডানদিকের অংশ। যেখানে খালামনির গাড়িটা রাখবার জন্য আরো একটি গ্যারেজ করা হয়েছে। পায়ের নীচে নরম ঘাসের আস্তরণ, মাথার উপর সুনীল আকাশের ছাদ। গ্যারেজের কাছে পৌঁছে যেতেই হঠাৎ পায়ের নীচে কাঁটার মতো কী যেন বিঁধল! সাথে সাথে গ্যারেজের দরজাটায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল ফিহা। সেখানে হাতের সাহায্যে ভর দিয়ে দাঁড়ালে পা-টা উপরে তুলছিল সে। কিন্তু ফিহা জানত না ওই দরজাটা আলগা ভাবে লাগানো ছিল। ওতে ভর দেওয়া নিষেধ। যখন মাথা ঝুঁকিয়ে পায়ের তলা থেকে ছোট্ট কাঁটাটা বের করছিল, তখন ধড়াস করে দরজাটা ওর উপর পড়ে যেতে নিল। ফিহা এই অবস্থা দেখে ভয়ে দু’হাত বাড়িয়ে দরজাটা ঠেকিয়ে ফেলে, কিন্তু দরজাটা এত ভারী ছিল যে সবটুকু শক্তি দিয়েও ঠেকাতে পারছিল না ফিহা। বাইরে থেকে জগিং করতে করতে ভেতরে ঢুকছিল সাঈদ, হাঁপিয়ে উঠা শরীরটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য জিরোতে নিলে হঠাৎ তার দৃষ্টি গ্যারেজের দিকে পড়ল। ফিহা চিৎকার করে ‘ খালা, খালা ‘ বলে ডেকেই যাচ্ছে। অবস্থা বিপন্ন দেখে এক নিশ্বাসে দৌঁড় লাগাল সাঈদ, পেছন থেকে এক ধাক্কা দিয়ে ফিহার হাত থেকে দরজাটা উঁচু করে ফেলল। ফিহা আকস্মিক এই কাণ্ড দেখে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিতেই কয়েক পা পিছিয়ে গেল। ওই ব্যান্ডেজ করা হাতটা দিয়েই সজোড়ে ধাক্কা মারল সাঈদ। ধপাস করে দরজাটা গ্যারেজের ভেতর পড়ে গেলে বুকভরা দম ছাড়ল সে। ফিহা ভয়কাতুরে ভঙ্গিতে চুপ হয়ে গেলে হঠাৎ চোখদুটো সাঈদের দিকে পড়ল। ডানহাতটা খুব ঝাঁকাচ্ছে সে। প্রতিটি ঝাঁকানির তালে তালে তরতাজা রক্ত ঝরছে। ফিহা চরম বিস্ময় নিয়ে সাঈদের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেল। নিঃসংকোচে হাতটা টেনে নিতেই চোয়াল ঝুলাল সে, তালুর মধ্যখানে ক্ষতটা দেখে নির্বাক চোখে সাঈদের দিকে তাকায়। ঢোক গিলে মূঢ় ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,
– আপনি ডাক্তার দেখাননি?
নির্বিকার মুখে হরিণী চোখদুটোয় তাকিয়ে রইল সাঈদ। কোনো জবাব দিলো না সে। ফিহা তার নীরবতা দেখে আবারও ক্ষতটার দিকে দৃষ্টি রাখে। সাঈদ হাতটা সরাতে চাইলে খপ করে কবজিটা ধরে ফেলল ফিহা। চিকন চিকন ভ্রুঁদুটো সহসা খিঁচিয়ে তেজালো স্বরে বলল,
– খ্যাঁক খ্যাঁক স্বভাবটা সাইডে রাখুন। আমি আপনার অ্যাটিটিউড দেখার জন্য মোটেও রাজি নই। একটু আগে আমার জন্য হাতটা আরো বেশি জখম করেছেন, তাই মানবতার খাতিরে এখন হিসাব চুকাতে চাচ্ছি। আমার সঙ্গে আসুন। আমি ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।
মুখটা গোমড়া করে হাঁটা দিলো ফিহা। বাঁ-হাতের মুঠোয় সাঈদের ডান কবজিটা ধরে আছে ও। যদিও ফিহার ছোট্ট মুঠোর ভেতর বলবন্ত হাতটা কোনোভাবেই আঁটছে না, তবু প্রভুত্বের মতো ভঙ্গি করে ধরে আছে কবজিটা। পিছু পিছু আসা সাঈদ ওর অবস্থা দেখে কী প্রতিক্রিয়া দেবে বুঝতে পারছে না। কাধের নীচে পড়ে থাকা এইটুকু একটা মেয়েটা তার উপর চটাশ চটাশ হুকুম চালাচ্ছে। ঠাস করে একটা চlড় মাlরlলে এখনই দু’রাত জ্বরে পড়বে, আর তাকেই এখন চমৎকার করে বলল, ‘ খ্যাঁক খ্যাঁক, অ্যাটিটিউড ‘। আচ্ছা, এই খ্যাঁক খ্যাঁক কথাটার মানে কী? কী বুঝাল এটা দিয়ে?
ফিহা তাকে বিছানায় এনে বসাল। আলমারি খুলে ছোট্ট প্ল্যাস্টিকের বক্সটা এনে মুখোমুখি হয়ে বসল। হাতটা নিজের কোলে টেনে তুলো দিয়ে জায়গাটা পরিস্কার করতেই একবার মুখ তুলে তার চেহারাটা দেখার জন্য তাকায়, কিন্তু আফসোস এই লোকের মুখে কোনো যন্ত্রণার ছাপ নেই। এই প্রথম কোনো মেয়ের স্পর্শ অনুভব করছে সাঈদ। যতবার তুলো দিয়ে ক্ষতর মুখে বুলিয়ে যাচ্ছে, চিনচিনে ব্যথাটা খুব গাঢ় করে হচ্ছে। মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝবার উপায় নেই কতটা ব্যথার মধ্যে ঝুঁকে আছে সে। আঙুলের মাথায় মলম নিয়ে জায়গাটা সন্তপর্ণে ছুঁয়ে দিলো ফিহা। দাঁতে দাঁত খিঁচে এমনভাবে বুলাচ্ছে, যেন নিজের আঘাতে মলম লাগাচ্ছে ও। ফিহা নরমভাবে শুধাল,
– হাতটা কীভাবে কেটেছেন?
প্রশ্নের গলাটা শুনে একটু ভাবনায় পড়ল সাঈদ। জবাবটা কী দেবে? কিছুক্ষণ আপন মনে চিন্তা করে কিছুটা গমগম সুরে বলে,
– টিন ঢুকেছিল।
অপ্রত্যাশিত কায়দায় চোখ তুলে তাকাল ফিহা। মলম দেওয়ার হাতটা আচানক থামিয়ে হাসিহীন মুখটার পানে হতবাক চোখে তাকিয়ে রইল। সত্যিই কী জবাবটা দিলো? এই লোকটা কী সত্যিই মুখ খুলেছে? ফিহার ফ্যালফ্যাল চোখের চাহনি দেখে সাঈদ নার্ভাস ফিল করছে। বুকের বাঁদিকে দুম করে হার্টবিটটা বেড়ে গেছে তার। ওই চোখ, ওই মুখ, ওই ঠোঁটদুটোর মৃদু মৃদু কম্পন যেন খুব আকর্ষণ করছে। এই অবস্থা তো ফিহার বেলার হয়নি। না, কোনোদিনই কারো প্রতি হয়নি। ওর লাবণ্যময় গালটা আঙুলে আঙুলে ছুঁয়ে দিলে চোখদুটো বন্ধ করবে না? না, এভাবে থাকা যাচ্ছে না। এখনই উঠতে হবে। এক্ষুণি উঠা দরকার। ভাবতে ভাবতেই হাতটা সরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সাঈদ। কোনোদিকে না তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল সে, হঠাৎ কী যেন ভেবে দরজার কাছে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। মাথাটা পিছু ঘুরিয়ে কাlটা হাতটা ইঙ্গিত করে বলে,
– থ্যাঙ্কস ফর দ্যা হিউম্যানিটি। মানবতা যদি আরেকটু বেঁচে থাকে, দ্যান আমাকে খাইয়ে দিতে পারিস। আমি নাস্তা করিনি।
.
#FABIYAH_MOMO .