নির্মোচন পর্ব ৬

0
880

#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_০৬ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

যাওয়ার খবর শুনে প্রচণ্ড খুশি হয়েছে ফিমা। ওর আনন্দ এখন দেখে কে! কিন্তু বিপত্তি হলো খালামনির মতো মানুষটা কঠিন বাগড়া দিয়ে আঁটকাবে। তাড়াতাড়ি আপদটা বাড়ি থেকে বিদায় হলে শান্তি। কিন্তু শেষ মূহুর্ত্তে কোনো অঘটনের শিকার হয়ে যাওয়াটা বানচাল হয় কিনা বুঝতে পারছে না। নাস্তার জন্য ডাইনিং টেবিলে বসে বসে এসব ভাবছে ফিমা। একটু পরপর দোতলার দিকে অপেক্ষারত চোখদুটো বুলিয়ে যাচ্ছে সে। আফসানা আড়চোখে সেটা দেখতে পেলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। তিনি পাউরুটিতে মাখন লাগাতে লাগাতে চিন্তা করছেন, কী করে উদ্ভট ঝামেলাটা ঠিকঠাক করা যায়। এভাবে তো মেয়েটাকে যেতে দেওয়া যায় না। ফিহা এখন লাগেজ গুছিয়ে তৈরি হয়ে নিচ্ছে। ঘড়িতে এখন আটটা বেজে দশ মিনিট চলছে। বাবাকে আরেকবার কল দিয়ে তাগাদা দিবে কিনা বুঝতে পারছে না। এই বাড়িতে এখন এক সেকেন্ডও থাকার মতো ইচ্ছাশক্তি নেই। অপমানের বাক্যগুলো দু’কানের কর্ণকুহরে জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গের মতো এখনো বেজে চলছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা চুলটা সযতনে আঁচড়ে নিল সে। ঠিক বাঁদিকে একটা খেজুর বেণী করতেই কানের কাছে কিছু আলগা চুল অবাধে ঝুলে রইল। সেগুলো আর ক্লিপের সাহায্যে লাগাতে পারল না ফিহা, তার আগেই আয়নার ভেতর তখন আরো একটি প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠল। পেছন থেকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন সুফিয়া। প্রৌঢ় মহিলার আঁটসাঁট গড়নের মুখটা দেখে ফিহা কিছু বলার আগেই সুফিয়া ভেতরে আসতে আসতে বললেন,

– তোমার সিদ্ধান্ত শুইনা আমি সন্তুষ্ট না। খালার বাড়িত আইছ এইহানে থাকবা কিছুদিন, তা না কইরা তুমি যাইতাছ গা? এইগুলি কোনো কথা?

ফিহা নিজের কথাগুলো বলার জন্য একটু স্বাভাবিক হয়ে নিল। সুফিয়ার দিকে ঘুরে সরল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শান্ত সুরে বলল,

– থাকার জন্য এসেছিলাম খালা। কিন্তু থাকার মতো যেটুকু মন-মানসিকতা আর ইচ্ছা ছিল, তা কিছু বেয়াদব মানুষের জন্য সম্ভব হচ্ছে না। আমি খুবই দুঃখিত খালা। কিছু করার নেই। আমি এখানে থাকতে পারব না।

সুফিয়া বুঝতে পারছেন পরিস্থিতি আস্তে আস্তে বিপদের দিকে যাচ্ছে। একবার অনুকূলের বাইরে চলে গেলে সেটা আগের মতো ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। তিনি চৌকশ বুদ্ধির বলে চালাকিটা শুরু করে দিলেন। সহসা চোখে-মুখে অসম্ভব রাগ ফুটিয়ে ক্রুদ্ধভাবে বললেন,

– তুমার বুদ্ধি দেইখা আমি হতাশ! কেউ তুমারে যাইতেগা কইলেই তুমি ফড়ফড়ায়া যাইবা গা? আজকা যদি তুমারে হারাম কথা কইয়া আমি অপমান কইরা দেই, তাইলে তুমি এমনেই তেজ দেহায়া যাইবা গা? এইটা কী তুমার খালার বাড়ি, না মাইনষ্যের বাড়ি? কোনডা? তুমি কার কথারে বেশি পাত্তা দিতাছ?

কথার হেতুটা ঠিকঠাক মতো বুঝতে পারল না ফিহা। যার দরুন কপালে অসংখ্য ভাঁজ ফেলে সুফিয়ার দিকে প্রশ্নাতুর চোখে চাইল। সুফিয়া ওর মুখভঙ্গি দেখে মনে মনে খুশি হয়ে আবারও দ্বিতীয় দফায় বলে উঠলেন,

– কাপুরুষের মতো কাজ-কাম করতাছ ক্যা? কাপুরুষ কারে কয় জানো? যার কলিজায় ঠাস-ঠাস কইরা জবাব দেওনের মতো ক্ষমতা নাই। যারা অপমান শুইনাও মোক্ষম জবাব দিতে জানে না। তারাই একদিন গাধার মতো পলাইয়া যাওয়ার চিন্তা করে। এইহানে একটা মানুষ তুমারে কথা শুনাইল আর হেরে তুমি পাত্তা দিয়া মাথায় তুইলা ফেলবা? তাহলে তো ওই মানুষ তুমারে সামনে পাইলে সেকেন্ডে-সেকেন্ডে অপমান করতে থাকব! তুমি কী এইগুলাই নিজের লিগা চাইতাছ?

ফিহা ভাবনায় পড়ে গেল। অপমান শুনে চুপ থাকার কোনো মানেই হয় না। কেননা, চুপ থাকলে দেখা যায় পণ্ডিতিপনা মানুষগুলো আরো সাহস পেয়ে কথা শুনাতে থাকে। সুফিয়ার কথাকে সমর্থন করলেও আংশিক দ্বিধাগ্রস্তে বলে,

– সে যদি কুয়ায় ঝাঁপ দিয়ে নীচু আচরণ করতেই থাকে, তাহলে কী আমিও তার সাথে কুয়ায় ঝাঁপ দিয়ে ঝগড়া করতে যাব? তর্ক চালাচালি করলেই কী সে আমায় সম্মান করতে শিখবে? কী এমন ভুল করেছিলাম যার জন্য অতগুলো শুনিয়েছে? উত্তর আছে? জানেন কিছু? কেন আমার সাথেই খ্যাঁকশেয়ালের মতো খ্যাঁক খ্যাঁক করতে থাকে?

ফিহার রাগারুণ মুখটা দেখে সুফিয়ার খুব হাসি পাচ্ছিল। এইটুকুনি মেয়েটার ভেতর যেই ক্ষোভ, যেই রাগ, যেই আক্রোশ তিনি দেখতে পাচ্ছেন, ঠিক একই ধরণের ক্রুদ্ধ তেজ তিনি আরেকজনের মধ্যেও সময়ে-অসময়ে দেখতে পান। তবে কী নিয়তি তাদের অলক্ষ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে? যার একছত্র সূচনা এই তর্ক, এই বিবাদের মাধ্যমে হতে যাচ্ছে? সুফিয়া মিষ্টি হাসি দিয়ে ফিহার সরু চিকন হাতদুটো নিজের মুঠোয় টেনে বিছানায় এসে বসলেন। মুখোমুখি হয়ে একটু কাছে এসে মাথায় স্নেহাতুর হাত ছুঁয়ে বললেন,

– কেউ কুয়ায় ঝাঁপ দিলে তার মতো ঝাঁপাইতে হইব ক্যান? চালাক হইতে জানো না? তুমি চালাকের মতো বালতি ফালায়া দরকারি পানি তুইলা লাইবা। এরপর মাইনসে কী কইল না-কইল ওইদিকে ধ্যান দেওনের দরকার নাই। নিজেরে যোগ্য প্রমাণ করোনের লিগা অনেক কিছুই সহ্য করোন লাগে। সবকিছু সময়ের হালে ছাইড়া দেও। সবসময় এইটা মনে রাখবা তুমি নিজের আপন খালার বাইত আইছ, বাইরের মানুষের কাছে ধন্না দিতে যাও নাই।

কথা তো ঠিকই বলল। সে কেন মুখ লুকিয়ে ক্ষোভের সাথে চলে যেতে চাইছে? সম্পূর্ণ বিনা দোষে যেহেতু কথাগুলো শুনিয়েছে এবং তিরিক্ষি গলায় ফিহাকে চলেও যেতে বলেছে, তাহলে ফিহা কোন অধিকারে তার কথা ও আদেশ পালন করতে যাবে? কে সে? কী হয় ওর? এই বাড়িটা নিশ্চয়ই খালামনির, তাহলে তার কথা শুনে লাভ কী? ফিহা ফ্লোরের দিকে শূন্য দৃষ্টি রেখে চরম মূহুর্ত্তে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল। সে ঘাড় নীচু করে মিনমিনে স্বভাবের মতো পালিয়ে যাবে না, বরন্ঞ্চ নাক উঁচু করে সরাসরি তার দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি মিলিয়ে মুখোমুখি হবে সে। ভেতরে ভেতরে চাপা আক্রোশের অবস্থা হতেই সুফিয়ার উদ্দেশ্যে বলে,

– আমাকে আজ পযর্ন্ত বাবাও একটা ধমক দেয়নি। সেখানে যেই আচরণটুকু আমি পেলাম সেটার হিসাব অবশ্যই চুকাতে হবে। ছোটো বলে অনেক সম্মান দিয়েছি খালা। এরপর থেকে কোনোপ্রকার উগ্র আচরণ দেখলেই দু’চারটা কথা শুনিয়ে ছাড়ব। শুধু শুধু নিজের উপর ফালতু কথা শুনব না। আমি যেখানে ভাইয়াদের সামনে যেয়ে আহামরি কিছু করিনি, তাহলে তারও উচিত আমার বিষয়টা ভালোভাবে বুঝে স্যরি বলা। সুফি খালা, আপনি একটু বাইরে যান। আমি জামাটা চেন্ঞ্জ করে নীচে আসছি। খালামনিকে বলুন আমি যাব না।

লাগেজ থেকে সাদামাটা জামাটা বের করে কাউকে কল লাগাল ফিহা। বাবাকে কল করে না আসার জন্য ভালোবাসা বারণ করে দিলো। এদিকে সুফিয়া নিজের উদ্দেশ্যে সফল হয়ে গেলে রুম থেকে সন্তপর্ণে বেরিয়ে গেলেন। লম্বা বারান্দা অতিক্রম করে আরেকটি রুমের সামনে আসতেই মুখটা ঠিক ডানদিকে ফেরালেন। সেখানে দরজায় আলতো হেলান দিয়ে কফি খাচ্ছিল সাঈদ। সামনে দাঁড়ানো সুফিয়ার দিকে ভ্রুঁ’দুটো একবার কপালে তুলে ক্ষুদ্র ইশারা করল সে। সুক্ষ্ম ইশারাটা ধরতে পেরে সুফিয়া মিচকি হাসি দিয়ে তাকালেন। ছোট্ট ভাবার্থটা বুঝতে পেরে ঠোঁটের ডানদিকে একপেশে হাসিটা ফুটে উঠল সাঈদের। কফিতে চুমুক দিতে দিতেই বাঁ’হাতের দু’আঙুল কপালের কাছে তুলে স্যালুট ভঙ্গিতে ইশারা করল। তা দেখে প্রৌঢ় সুফিয়া প্রসন্ন মুখে ফিক করে হেসে দিলেন। কাজ শেষে চলে গেলেন নীচে।

.

ফিহা নাস্তার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামতে নিলে ডাইনিং টেবিল থেকে হুলস্থুল কাশির শব্দ শোনা গেল। যক্ষ্মা রোগির মতো কেশেই যাচ্ছে ফিমা। গ্লাসভর্তি পানিটা এক চুমুকে খেতে খেতেই সাধারণ পোশাকে হাজির হলো ফিহা। বড়ো বোনের নাজুক অবস্থা দেখে বিস্ময়সূচকে বলল,

– তোমার কী হল আপু? আপু তুমি ঠিক আছ?

পানিটা খেয়ে একটু নিস্তার পেল ফিমা। চোখের পাতা বন্ধ করে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে বুঝাল সে এখন ঠিক আছে। আফসানা সরু চোখে ফিমার দিকে তাকিয়ে কাপের হ্যান্ডেলটা তর্জনীতে প্যাঁচিয়ে নিলেন। চা-টা ঠোঁটের কাছে আনতে আনতে বললেন,

– এতক্ষণ তো ঠিকই ছিলি। হঠাৎ ফিহাকে দেখে যক্ষ্মার জীবানু কোত্থেকে উদয় হলো?

ফিমা চট করে দু’চোখের পাতা খুলে অপ্রস্তুত চোখে তাকাল। নিজেকে পরিস্কার করবার জন্য সাথে সাথে দাবড় দেখিয়ে বলল,

– আরে না, কী বলছ এসব! আমি ওকে দেখে কাশতে যাব কেন? আমার গলায় রুটি আঁটকে যাওয়ায় কাশি শুরু হয়েছে, সেদিকে তুমি যক্ষ্মার কথা বলছ? তুমি শুধু শুধু আমার উপর কারণ চাপাচ্ছ খালামনি। এগুলো কেন করছ?

আফসানা ভালো করেই জানেন অকপটে মিথ্যা বলছে এখন। তার চেয়ে বড়ো কথা, যেই মেয়ে নিজের সহোদর বোনকে একদমই দেখতে পারে না, আজীবন হিংসুটে স্বভাবের জন্য ছোটো বোনকে অপদস্থ করতে করতে এসেছে, তার এই আকস্মিক কাশির অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে স্বভাবটা এখনো বদলায়নি। ফিহা কোনোদিকে ধ্যান না দিয়ে আপন মনে নাস্তা করছে তখন। এখনো নাস্তার টেবিলে বেয়াদব লোকটার সাথে মুখোমুখি হয়নি ওর। ফিহাকে দেখে নিশ্চয়ই সে বড়ো বড়ো চক্ষু মেলে হা করে তাকিয়ে থাকবে, কিন্তু তাতে ফিহা পাত্তাই দিবে না একদম। উলটাপালটা কিছু বললে তাকে তুলোধুনা করে ছাড়বে ফিহা। ওর চিন্তাশীল ভাবনাকে ধূলিসাৎ করে দোতলা থেকে ফোনে কথা বলতে বলতে নেমে এলো সাঈদ। ডাইনিং টেবিলের দিকে ভ্রুঁক্ষেপ না করে চুপচাপ অফিস পোশাকে বেরিয়ে গেল সে। মুখে কোনো দানাপানি নিলো না আজ। ফিহা নাস্তার দিকে গভীর মনোযোগ দিলেও ভেতরে ভেতরে কুণ্ঠিত প্রশ্ন এখন কিলবিল করছে। এই লোক এখন না খেয়ে চলে গেল কেন? ওর প্রতি জেদটা দেখিয়ে কাজটা করল না? ফিহা মুখটা আস্তে আস্তে বাঁয়ে ঘুরিয়ে সদর দরজার ঠিক বাইরে দিকে দৃষ্টি দিলো। অফ হোয়াইট শার্ট পড়ুয়া, চুলগুলো সুনিপুণ করে আঁচড়ানো। সুদীর্ঘ উচ্চতাটা একটু বেশি লাগছে ওর কাছে। মানুষটা ডানহাতের কাফড্ স্লিভটার বাটন কবজির কাছে লাগাতে বুঁদ ছিল। ফিহা শান্ত অথচ রোষের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে সেটা বাঁকা চোখে খেয়াল করল সাঈদ। পাউরুটির চর্তুদিকে হালকা বাদামী রঙের সাইডগুলো টুকে টুকে ছিঁড়ে চলেছে ও। ও কী পাউরুটি এভাবেই খায়? সাইডগুলো আলাদা করে শুধু নরম পাউরুটিটুকু? তা দেখে খুব সাবধানে ঠোঁটের বক্র হাসিটা আড়াল করল সাঈদ। পকেট থেকে ছোট্ট ডিভাইসটা ক্লিক করতেই অদূরে থামানো গাড়িটা ‘ টুট টুট ‘ শব্দ করে উঠল।
.

বাড়িটা খালি। একমাত্র সুফিয়া ছাড়া কেউ নেই। আফসানা মরহুম শ্বশুরের রেখে যাওয়া ব্যবসাটা এখন নিজ আয়ত্তে সামলাচ্ছেন। মরহুম শ্বশুর যদি বিরাট বড়ো দায়িত্বটা আফসানার হাতে না দিতেন তাহলে আজ ব্যবসায়িক মহলে যুক্ত হতেন না আফসানা। অন্যদিকে এ বাড়ির একমাত্র হর্তাকর্তা সোয়াদ আহমেদ জাকির সেনাবাহিনির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। চাকরির সুবাদে তিনি কর্মস্থলের কোয়ার্টারে আছেন এখন। ছুটির মৌসুম এলে এখানে এসে ঘুরে যান তিনি। রান্নাঘরে দুপুরের রান্না নিয়ে ব্যস্ত আছেন সুফিয়া। পুরো বাড়িটা নিরিবিলি পায়ে একটু একটু করে দেখে চলছে ফিহা। বাড়ির বাইরে ঠিক ডানদিকটায় বিশাল বড়ো গ্যারেজ। গ্যারেজের বিশাল বিশাল দরজাদুটো বন্ধ হয়ে একটি পেটমোটা তালা ঝুলছে। তালাটা দেখে মনে হলো সদ্য ব্যবহার করা কোনো তালা, যেটা মাঝে মাঝে খুলে ভেতরে প্রবেশ করা হয়। গ্যারেজটা দেখে কোনো অর্থেই বোঝা সম্ভব না এটা কোনো গাড়ি রাখার স্থান। বরং, বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় ছোটোখাটো প্রাসাদতুল্য একতলা বাড়ি। সিঁড়িটা বোধহয় ভেতরের দিকে, তাই দোতলায় উঠে মনোরম দৃশ্যটুকু দেখার সৌভাগ্য হলো না। হঠাৎ ডান কাধে কে যেন হাত রাখলে পলকেই শিউরে উঠল ফিহা। পেছন ফিরে তাকাতেই সুফিয়াকে দেখতে পেল। সুফিয়া প্রসন্ন মুখে হাসতে হাসতে বলল,

– ডরাইছ?

ফিহা নাকোচ করে ‘ না ‘ ভঙ্গিতে মাথা নাড়াল। একবার সুফিয়ার দিকে তাকাল, আরেকবার কৌতুহলী চোখ দিয়ে গ্যারেজটার মায়াময় নিস্তব্ধতা পরোখ করতে লাগল। সুনশান-নীরব-শান্ত জায়গাটা সুউচ্চ গাছপালায় ঢেকে আছে, যেন লোকারণ্য থেকে সন্তপর্ণে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে ওটা। ফিহা সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পায়ের তলায় নরম ঘাসগুলো দেখতে দেখতে বলল,

– জায়গাটা খুব সুন্দর। এখানে এত শান্তি যে মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আমি একটু ভেতরে ঢুকতে চাই খালা। এটা কী সম্ভব?

সুফিয়া হাসিমাখা মুখটা উপরে তুলে বদ্ধ গ্যারেজটার পানে চাইল। ফিহার উদ্দেশ্যে পরিশ্রান্ত সুরে বলল,

– আমার কাছে তো চাবি নাই মা। এই গ্যারেজের চাবি শুধু সাঈদের কাছে থাহে। ওয় এইহানে কাউরে ঢুকতে দেয় না। এইহানে যত গাছগাছালি দেখতাছ না? এগুলা সব ওর নিজের হাতে লাগান। জায়গাটা ওর খুব পছন্দের।

ফিহা পলকের ভেতর দৃষ্টি তুলে সুফিয়ার দেখানো জায়গাটা দেখতে পেল। অসংখ্য ছোটো ছোটো চারাগাছ লাগান জায়গাটা দেখে ফিহার কেন জানি বিশ্বাস হলো না, এসব কাজ সত্যিই ওই লোকটা করেছে। ফিহাকে নীরব থাকতে দেখে সুফিয়া আবার বলে উঠলেন,

– গ্যারেজে এহন পযর্ন্ত কেউ ঢুকে নাই। তোমার খালাও না। সাঈদ এইহানে একলা আহে, একলা সময় কাটায়া যায়। এই লিগা কিছু করতে পারলাম না। আহো, খাইবা এহন।

বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো দু’জন। দুপুরের কড়া রোদটা মরে গিয়ে কিছুটা তেজহীন হয়েছে। ফিহা কথাটুকু শোনার পর চাপা উদ্বেগে প্রশ্ন করে,

– খালা, এটা কী নিষিদ্ধ জায়গা?

আফসানা মাথায় ঘোমটা টেনে বললেন,

– হ, কইতে পারো। এইটা লইয়া আপার লগেও একচোট ঝগড়া হইয়া গেছে। আপায় এইহানে গাড়ি রাখতে চাইছিল, পরে সাঈদ বাবায় এমন রাগারাগী শুরু করছে হেরপর থিকা এইহানে রাখে না। আপায় এহন ওই মাথায় একটা গ্যারেজ বানায়া নিছে। ওইহানেই গাড়ি-ফাড়ি রাইখা দেয়।

নরম ঘাস মাড়িয়ে দু’জনই বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল। ফিহা হাতদুটো ধোয়ার জন্য সুফিয়ার পিছু পিছু রান্নাঘরে গেল। এখনো বুঝতে পারছে না ওই গ্যারেজটায় এমন কী আছে যেটার জন্য খালামনি পযর্ন্ত ঢুকতে পারে না। এই লোক নিজেকে আলাদা করে রাখে কেন? কী কারণে এমন উদ্ভট উদ্ভট কর্মকাণ্ড করে? সুফিয়া খাবার লাগাতে ব্যস্ত হলে ফিহা উজবুক দৃষ্টিতে বলে,

– একটা প্রশ্ন করি খালা? আপনার বাবা এমন অদ্ভুত কেন? ওই গ্যারেজে এমন কী লুকিয়ে রেখেছে যেটার জন্য তিনি কাউকেই যেতে দেন না? আপনি কী আসলেই কিছু জানেন না?

অবান্তর প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হওয়ার কথা, কিন্তু সুফিয়া তার বদলে যেন এক চিলতে হাসি দিয়ে ফেললেন। পানির জগ নিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে যেতে যেতে বললেন,

– ওইহানে এমন কিছুই আছে যেইটা দেখার লিগা এহনো উচিত সময় আহে নাই।

কথাটায় ‘ কিন্তু ‘ রেখে শেষ করল সুফিয়া। ফিহা বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের কাছে জবুথবু হয়ে চুপটি মেরে গেল। সুফিয়া খাবার বাড়তে বাড়তে সরল গলায় বলল,

– ও ভালো কথা, আমার তো জিগাইতেই মনে আছিল না। তুমার আব্বা জানালার কাহিনি কিছু ধরতে পারছে?

ফিহা খাওয়া শুরু করতেই শঙ্কিত চোখে বলল,

– না, খালা। উলটো এলাকার মুরুব্বিরা বলছে, খুব দ্রুত আমাদের বাড়িটা বন্ধক করতে। আমাদের বাসায় নাকি খারাপ জ্বিlনের আসর পড়েছে। কিন্তু আমি জানি ওগুলো জ্বিlন ছিল না। পরপর দু’দিন দুটো ভিন্ন কিছু জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রথমদিন অন্য কেউ ছিল, দ্বিতীয়দিন অন্য কেউ। ওগুলো জ্বিlন বা অন্যকিছু হতেই পারে না। জ্বিlন হলে আমি বাঁlচতাম না খালা। আমাকে মেlরে ফেলার মতো ভালো সুযোগ ছিল। আমি মlরিlনি।

#FABIYAH_MOMO .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here