অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী দ্বিতীয়_অধ্যায় পর্ব_৩৪

0
412

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_৩৪
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

রামি ছুটি মঞ্জুরের জন্য মেইল করলো। তার ছুটি মঞ্জুর হলো না। মাত্র দুদিন হলো ছুটি কাটিয়ে ডিউটিতে এসেছে। ঠোঁট গোল করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রামি। জেনেশুনেই এই প্রফেশনে এসেছে সে, তবুও মনে হচ্ছে বিয়ের পর হলে সে কখনোই এই প্রফেশনে আসতো না। অরুর স্নিগ্ধ মুখটা চোখের সামনে বারবার ভেসে ওঠে। একহাতে কপালের দু-পাশ চেপে ধরে রাখলো। চোখমুখ শক্ত। সময় দেখে ডিউটির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো।

★★★

ইলেকশনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, রাজপথ ততই গরম হয়ে উঠছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঝে তুমুল সং*ঘ*র্ষ। আজ পার্লামেন্টে ছোটোখাটো একটা ব্যাপার নিয়ে তর্ক হলো। সেখান থেকে বেরিয়েই হাতাহাতি শুরু। তারপরই মা*রা*মা*রি*র সূত্রপাত। চা*পা*তি, রা*ম*দা, ক্ষুর বের করলো মিঠু আর এমদাদুল হক দুজনের ছেলেরা। কো*পা*কু*পি*র মাঝে এমদাদুল হকের শরীরে আ*ঘা*ত পড়ে। ক্ষিপ্ত হয়ে তার দলের ছেলেরা মিঠুর উপর পাল্টা আক্রমণ করে বসে। হাত আর পিঠে গভীর ক্ষ*ত সৃষ্টি হয়। এখানেই শেষ নয়। এরপর মা*রা*মা*রি আরো মহামারী আকার ধারণ করে। দুদলেরই কয়েকজন নিহত হয়। তৎক্ষনাৎ মিঠু আর এমদাদুল হক দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। মিঠুর বাবা আজ একটা কাজে শহরের বাইরে আছেন। উনার কাছেও খবর পৌঁছে গিয়েছে। তিনি ছুটে আসছেন ছেলের কাছে। বাড়ি থেকে অরু, তরী কান্নাকাটি করে মাহমুদের সাথে হাসপাতালে এসে জড়ো হয়েছে। মিঠুর জ্ঞান নেই। মাহমুদ বলল,“তোমরা দুজন বাসায় চলে যাও। এদিকটায় আমি আছি।”

তরী হেঁচকি তুলে কাঁদছে। বলল,
“আমি যাবো না। কত করে করি বলি এসব ছেড়ে দে, আমার কথাই শোনে না।”

মাহমুদ নরম স্বরে বলল,“এখানে থেকে কান্নাকাটি করে কী করবে? যদি তোমাদের প্রয়োজন পড়ে তখন আসতে পারবে।”

অরু কান্না থামিয়ে তরীকে বলল,“আমি থাকছি, তুমি যাও। অমি রাতে কান্নাকাটি করবে।”

মাহমুদ বলল,“তোমাদের কাউকেই থাকতে হবে না। ওঁর জ্ঞান ফিরতে দেরি আছে। শুধু শুধু বসে থেকে কী করবে? কোন কাজ নেই। কাল আসতে পারবে।”

তরীর বাবা ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছেন হাসপাতালে। হন্তদন্ত হয়ে রিসিপশন থেকে কেবিন নাম্বার জেনে ছুটলেন ছেলের কেবিনের দিকে। অরু, তরী বাবাকে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরে আবারও হাউমাউ কান্নায় ভেঙে পড়লো। দুহাতে দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন বাবা। অথচ উনার চোখেরও পানি। ভেতরটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। মাহমুদ শান্ত স্বরে বলল,“এভাবে কান্নাকাটি করো না। এটা হাসপাতাল, খারাপ দেখা যায়।”

বাবাও অরু আর তরীকে বাসায় চলে যাওয়ার জন্য বোঝালেন। তরী কান্না মাখা গলায় বলল,“আমি যাবো না। মায়ের সময় আমি থাকতে পারিনি। আমি আর আমার মাকে জীবিত ফিরে পাইনি। আমার ভাইকে আমি হারাতে পারবো না।”

মাহমুদ খানিক বিরক্তির সুরে বলল,“কেন অযথা নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করছো।” অতঃপর ঠান্ডা গলায় বোঝালো,“ রাজনীতি করতে গেলে এসব হবেই। তোমাদের আরো শক্ত হতে হবে। এরচেয়েও কঠিন পরিস্থিতিতে শক্ত থাকতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না তরী।”

শেষমেষ দু-বোনকে বোঝাতে সক্ষম হলো শশুর-জামাই। তরীর বাবা মাহমুদকে বললেন,“তুমি বরং ওঁদের দিয়ে এসো। আমি থাকছি এখানে।”

মাহমুদ দ্বিরুক্তি করলো না। অরু আর তরীকে বাসায় পৌঁছে দিয়েই সে আবার আসবে। বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসার সময় ইরা রাতের জন্য দুজনের খাবার দিয়ে দিল। আগে থেকেই সে সব রেডি করে রেখেছিল। মাহমুদ খাবার নিয়ে আবারও বের হলো।

অসহনীয় যন্ত্রণায় শরীর টনটন করে উঠছে। দাঁতে দাঁত পিষে হজম করে চলেছে সমস্ত ব্যথা। ছটফটিয়ে উঠছে যন্ত্রণায়। বিছানায় পিঠ লাগিয়ে শোয়া যাচ্ছে না। প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় শরীর অনেকটাই দুর্বল। নিস্তেজ হয়ে আছে দেহ। চোখমুখ কুঁচকে আছে। বাবা মিঠুর এই যন্ত্রণা দেখে নিজেই অস্থির হয়ে উঠলেন। কিছুতেই সন্তানের এমন করুণ পরিণতি তিনি মেনে নিতে পারছেন না। এজন্যই সবসময় একটু গো*লা*গু*লি*র শব্দ পেলে দিশেহারা হয়ে ছেলেকে খুঁজতে বেরিয়ে যেতেন। তিনি অস্থির গলায় মাহমুদকে বললেন,“ডাক্তার ডাকো বাবা। আমার ছেলে ব্যথা সহ্য করতে পারছে না।”

মাহমুদ চেয়ার টে*নে শশুরকে বসিয়ে দিল। গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে ধরলো মুখের সামনে। ধীরস্থির ভাবে বলল,“পানি পান করুন। ডাক্তার ঔষধ দিয়ে গিয়েছেন। উনারা বলেই দিয়েছেন জ্ঞান ফিরলে ব্যথা বাড়বে।”

তারপর হাতঘড়িতে সময় দেখলো। রাত্রি বারোটার চেয়ে একটু বেশি সময়। মাহমুদ বলল,“আপনি বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করুন বাবা। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি আপনাকে বাসায় দিয়ে আসবে।”

তরীর বাবা জেদ ধরলেন তিনি কিছুতেই যাবেন না। মাহমুদ বলল,“আপনি বাচ্চাদের মতো জেদ করবেন না বাবা। আপনার তিন সন্তানের আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা-মা বেঁচে থাকলে সন্তানের জন্য সবাই থাকে, সবার মায়া-মমতা থাকে। বাবা-মা পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেলে সবদিক থেকে অবহেলা বেড়ে যায়। আপনার বিশ্রাম দরকার। আগে নিজেকে ঠিক রাখুন। তবেই না আপনার সন্তানদের আগলে রাখতে পারবেন। আমি ড্রাইভারকে কল দিচ্ছি, জেদ করবেন না।”

তরীর বাবা চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখের পাতা বন্ধ করে নিলেন। উপরে জেদ ধরলেও সত্যিই শরীরটা আর কুলচ্ছে না। বুকের ভেতর হারিয়ে ফেলার ত্রাস। তরীর মা মা*রা যাওয়ার পূর্বে মাহমুদ একজন বড়ো ছেলের অভাব দূর করেছে। তরীর বাবা আজ আবার উপলব্ধি করলেন মাহমুদ সেদিনের মতো আজও বড়ো ছেলের দায়িত্বে অব্যহত আছে। মেয়ের জন্য সুপাত্র পেয়েছেন ভেবেই বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। মাহমুদ লক্ষ করছে তরীর বাবার শরীর মৃদু কাঁপছে। সে দ্রুত ড্রাইভারকে কল দিয়ে উনাকে বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিলেন।

★★★

মিঠুর খবর সুহার কানে যখন পৌঁছায়, তখন রাত। বাড়ি থেকে মামা বের হতে দিলেন না। তাই সকালের আলো ফুটতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো মিঠুকে দেখতে যাওয়ার জন্য। তার ভেতরটা বিষ ব্যথায় মুচড়ে উঠছে। রাতটা কীভাবে কেটেছে, একমাত্র সে আর আল্লাহ জানেন। মামা মন থেকে বিয়েতে মত দেন নি। মিঠুর অবস্থার কথা শুনে বেশ হম্বিতম্বি করলেন তিনি। সুহা ঠিক করলো এবার সে লড়ে যাবে সব পরিস্থিতিতে। মামা উল্টে যেতে চাইলেও সে বোঝাবে। প্রয়োজনে পায়ে পড়ে থাকবে মামার। তবুও মিঠুকে সে হারাতে দেবে না। মামিকে বলেই বাসা থেকে বের হলো সে। হাসপাতালে এখন ভীড় নেই বললেই চলে। সুহার পা চলছে না। তবুও টে*নে নিয়ে ছুটে চলেছে। কেবিনে ঢুকতেই রামির পাশে অরুকে নজরে পড়লো। অরু একটু আগেই এসেছে। মিঠু মলিন চোখে তাকিয়ে আছে। কান্নারা দলা পাকিয়ে আসছে সুহার। ঢোক গিলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেও যেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে। চেয়েও অনুভূতি লুকাতে পারছে না। সুহাকে দেখে অরু ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে বেরিয়ে গেল। ধীর পায়ে রামির পাশে এসে চেয়ার টে*নে বসলো সুহা। কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলো। মিঠু ক্ষীণ স্বরে শুধালো,“কেমন আছেন?”

এই পর্যায়ে সুহা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেললো। বিচলিত হলো না মিঠু। তার ঠোঁটে নিস্তব্ধ গাঢ় হাসি। হাসি থামিয়ে চোখমুখ সরল করলো। সুহার নতমুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলো,“কাঁদছেন কেন সুহা?”

সুহা চোখ মুছে নিলো ঝটপট। কাতর স্বরে অনুরোধ করলো,“এসব ছেড়ে দিন না!”

মিঠু শান্ত হয়ে বলল,“ছেড়ে দেব।”

সুহা যেন আশার আলো দেখতে পেল। দু-চোখ জুড়ে রঙধনুর মেলা। মিঠু আবারও বলল,
“মৃ*ত্যু*র পর। তিনটে জিনিস আমি মৃ*ত্যু*র আগ পর্যন্ত ছাড়বো না। এক – আমার পরিবার, দুই – আপনি, তিন- রাজনীতি।”

সুহা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। একটু আগের আশারা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে নিরাশায় পরিণত হলো। চোখমুখ শক্ত করে বলল,“বেশ, আপনি যদি রাজনীতি না ছাড়েন তবে আমি দূরে কোথাও চলে যাবো।”

মিঠু অল্প হেসে বলল,“তার আগেই আপনাকে বন্দি করার বন্দোবস্ত করবো।”

সুহা হাল ছেড়ে দিল। এখন আর কঠিন হয়েও থাকতে পারে না। চোখদুটো জলে টইটম্বুর হয়ে এলো। ঠোঁট ভেঙে কান্না আসছে তার। মিঠুর হাতের ক্ষতস্থানে আলতোভাবে হাত ছুঁয়ে দিল। প্রথম নিজ থেকে মিঠুকে স্পর্শ করেছে। সুহার চমক কাটলো মিঠুর মুখে ব্যথা সূচক ‘আহ্!’ শব্দ শুনে। ঝট করে হাত সরিয়ে অপরাধী স্বরে বারবার ক্ষমা চাইলো।
“সরি, সরি, সরি! আমি ইচ্ছে করে ব্যথা দেইনি।”

মিঠু চোখমুখ কুঁচকে নিলো ব্যথায়। ব্যথা হজম করে সুহার কথায় কপাল শিথিল করলো। গম্ভীর স্বরে বলল,“ইচ্ছে করে দিয়েছেন ব্যথা, তাইনা? এর শোধ আমি হিসেব করে নেব। তবে আমার শা*স্তি দেওয়ার ধরণ কিন্তু ভিন্ন। নিজেকে প্রস্তুত করুন।”

বলেই মিটিমিটি হাসলো মিঠু। সাথে যেন চোখদুটোও হাসছে। সুহা ঢোক গিলে আরেকটু জড়োসড়ো হয়ে বসলো৷ প্রথমে অপরাধবোধ থাকলেও পরক্ষণে লজ্জা পেল বেশ। মিঠু বেশ উপভোগ করছে সুহার এমন পরিণতি। করুণ চোখে মিঠুর দিকে তাকালো সুহা।
দরজায় দুবার নক করলো অরু।
“আসবো?”

মিঠু বলার পূর্বেই সুহা তড়িঘড়ি করে বলল,“এসো, এসো।”

তাকে অস্বস্তি থেকে বাঁচানোর জন্য মনে মনে কয়েকবার কৃতজ্ঞতা জানানো শেষ অরুকে। মিঠু ইশারায় বোঝালো,“পরে দেখে নেব।”

সুহা আপাতত ভাবলেশহীন রইলো। অরু এসে ফোন বাড়িয়ে দিল মিঠুর দিকে। রামি কথা বলতে চাচ্ছে। সে সকালেই খবর পেয়েছে। ডিউটি থেকে ফিরে অরুর মেসেজ চেক করতেই এমন একটা দু*র্ঘ*না*র খবর জানতে পারলো। সুহা অরুকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। রামি আর মিঠুর মাঝে অনেকক্ষণ আলাপ চললো। অরু আসার পর মাহমুদ বাড়ি গিয়েছে। কথা শেষ করে মিঠু ডাকলো অরুকে। ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলল,“নে কথা বল।”

অরু ফোন হাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। সকালের মিষ্টি রোদ শরীরে এসে পড়ছে। খানিকটা উষ্ণতা পেয়ে মন চনমনে হয়ে উঠেছে অরুর। রামি নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে বলল,“চোখমুখের কী অবস্থা করেছিস! মিঠুটাকে ধরে বুড়িগঙ্গায় চুবানো উচিত। ওঁর জন্যই আমার বউ কেঁদেকেটে পুকুর বানিয়েছে। বোধহয় আমি সহ আমার চৌদ্দগোষ্ঠী সাঁতার কাটতে পারবে। বাড়ি এসেই ওঁকে একটা গণধোলাই দিতে হবে দেখছি।”

অরু ক্ষেপে গেল।
“আমার ভাইকে নিয়ে আর একটাও কথা বলবে না। তুমি আমার ভাইকে ধোলাই দেবে আর আমি বসে বসে দেখবো?”

রামি বলল, “হয়েছে, আমাকেও মে*রে হাসপাতালে শুইয়ে রাখিস। এখন চুপচাপ ভালো মেয়ের মতো খেয়ে নিবি। ভাইয়া খাবার নিয়ে আসছে।”

অরুও বাধ্য মেয়ের মতো বলল,“আচ্ছা। তুমি খেয়েছো?”

“না, একটু পর খাবো। তুই খেয়ে নে। বেশি চিন্তা করিস না। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। মিঠু দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। কোন কিছু প্রয়োজন হলে তোর বের হওয়ার দরকার নেই। ভাইয়াকে বললেই এনে দেবে।”

অরু ছোটো করে বলল,“ডিউটি থেকে এসেছো। তুমি খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও। পরে কথা বলবো।”

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here