#কোন_কাননে_ফুটিবে_ফুল🌸
#Part_25
#Writer_NOVA
খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে শুভ। ভরদুপুরে ওকে শুয়ে থাকতে দেখলে যে কেউ অবাক হবে। হওয়ারই কথা! যে ছেলেকে ভোর সকালে আর মধ্য রাত ছাড়া বাড়িতে পাওয়া যায় না তাকে দুপুর বেলা দেখা যেনো আমাবস্যার চাঁদ দেখতে পাওয়া। কারণ তো অবশেষ আছে। সকালে তার উড়োজাহাজ নিয়ে বেরিয়ে ছিলো। ঠান্ডায় অবস্থা খারাপ। হাঁচি দিতে দিতে নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানি তার সয় না। সেদিন বৃষ্টিতে গোসল করে বাড়ি ফেরার ফল এটা। দুপুর থেকে শরীরটা জ্বর জ্বর লাগছে। তাই বাড়ি ফিরে এসেছে। এসেই চুপচাপ খাটে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।
ফুল খাবারের প্লেট নিয়ে উপরে চলে এলো। অনেক বার ডেকেও শুভর কোন সাড়া না পেয়ে বাধ্য হয়ে চলে এসেছে। শুভর লাল চোখ দেখেই ফুলের মন খচ করে উঠেছিলো। কিছু একটা তো গন্ডগোল আছে। তাছাড়া যেই শুভ কইতরির মা বলে ডাকতে ডাকতে হয়রান হয়ে যায়। আজ সে একটা বার ডাকেওনি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছোট করে ডাকলো ফুল।
‘শুভ ভাই!’
শুভর দিক থেকে কোন উত্তর এলো না। তবে চাপা স্বরে গোঙানির আওয়াজ ফুলের কানে ঠিকই এলো। হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে এসে ছোট টেবিলের ওপর খাবারের প্লেটটা রেখেই শুভর শিউরে বসলো।
‘তোমার কি খারাপ লাগছে?’
‘হু!’
‘জ্বর এসেছে?’
‘হু!’
‘মাথায় পানি দিয়ে দেই?’
‘নাহ!’
‘কেনো?’
শুভ জ্বরের ঘোরে চোখ তুলে তাকালো। ফুল আৎকে উঠলো। মুখ, চোখ ফুলে গেছে। আগের থেকে চোখ দুটো আরো লাল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় চোখের পুত্তলী ফেটে যাবে। ফুল কপালে হাত রেখে সাথে সাথে সরিয়ে ফেললো। গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কপালে হাত রাখা যাচ্ছে না। ফুল ব্যস্ত হয়ে পরলো।
‘তোমার শরীরে তো অনেক জ্বর। মাথায় পানি যখন দিতে দিবে না, জলপট্টি দিয়ে দেই?’
‘লাগবো না।’
‘তাহলে চাচীকে ডাকি?’
‘না।’
‘কি ছোট বাচ্চাদের মতো জেদ শুরু করছো? মাথায় পানি দিতে দিবে না, জলপট্টি দিতে দিবে না, চাচীকে ডাকতে চাইলাম তাও না করছো। তাহলে করবোটা কি? হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো? আর তোমার জ্বর বাড়তে থাকবে।’
শুভ পলক ফেলে তার মাথাটা ফুলের কোলে তুলে দিলো৷ এহেন কান্ড ফুল অবাক বা বিরক্ত কিছুই হলো না। ফ্যালফ্যাল করে শুভর মুখপানে তাকিয়ে রইলো। শুভ তার দূর্বল হাত দিয়ে ফুলের হাত টেনে কপালে দিয়ে শুকনো গলায় বললো,
‘তোর হাতটা এমনেই রাখ। আমার ভালো লাগতাছে। পারলে মাথার চুলগুলি একটু টাইনা দিস। আমি একটু ঘুমামু।’
‘ঘুমাবে বললেই হলো নাকি? সকালে না খেয়ে বেরিয়েছো। আমি খাবার নিয়ে এসেছি। খেয়ে ঔষধ খেয়ো। জ্বর ছেড়ে দিবে।’
শুভ এই অবস্থায়ও ফুলকে ধমকে উঠলো,
‘বেশি কথা কইস না। চুপচাপ মাথার চুলগুলি টাইনা দে। আমার অনেক ঘুম পাইতাছে।’
বিকেলে অভি, আনোয়ার সর্দারের কামরায় এসে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চেয়ারম্যান তখন আছরের নামায পরছিলেন। ছেলের শরীর খারাপ শুনে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দ্রুত ফিরে এসেছেন। আজ আর যাবেন না। শুভর জ্বর এখন একটু কমেছে। সালাম ফিরাতেই বড় ছেলেকে দেখলেন। কিছু না বলে মোনাজাত ধরলেন। অনেক সময় পর্যন্ত মোনাজাতে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন। মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ ভাজ করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কিছু কবি?’
‘বলতেই এতখন ধরে দাঁড়িয়ে আছি।’
‘যা কওনের কইয়া ফালা।’
‘তুমি কি আমার বিষয়টা একবারো ভাবছো না?’
আনোয়ার সর্দার জায়নামাজ খাটের এক কোণায় রেখে চোখ সরু করে ছেলের দিকে তাকালো। গলা ঝেড়ে বললো,
‘পেচাইস না। যা কওনের সরাসরি ক।’
‘আমি ফুলকে বিয়ে করতে চাই আব্বা।’
‘তা এহন আর সম্ভব না।’
বাবার কথা বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো অভির মাথায়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কেনো?’
‘আমি ঠিক করছি শুভর লগে ফুলের বিয়া দিমু।’
‘আব্বা!’
আহত গলায় চাপা আর্তনাদ করে উঠলো অভি। চোখ মুখে ফুটে উঠলো গভীর অসহায়ত্ব।
‘তুমি এতবড় সিদ্ধান্ত আমাকে না জানিয়ে কি করে নিতে পারো আব্বা?’
‘আমি যতদিন বাইচা আছি ততদিন আমার কথাই শেষ কথা। আমি এমন কোন সিদ্ধান্ত নিমু না যাতে তোগো অমঙ্গল হয়। অনেক ভাইবা চিন্তা কইরাই নিছি। আমি আমার মত পাল্ডামু না।’
‘এমন করতাছো কেন?’
‘এইডা তোর শাস্তি। আমার ফুল মারে কান্দানোর শাস্তি। তুই হেই দিন রাজী হইয়া গেলে আজ এত কিছু ঘটতো না। তাছাড়া আমি সবসময় শুভর লগে দুই নাম্বারি করছি। ওর চাওয়া-পাওয়ার কোন গুরত্ব দেই নাই। পোলায় আমার কাছে এতবছর পর কিছু চাইলো ওরে আমি খালি হাতে ফিরাই কেমনে?’
অভি করুন গলায় বললো,
‘আমার কথাডা ভাবলেন না?’
‘তোর কথা ভাইবাই এই সিদ্ধান্ত নিলাম। শুভর চোখে আমি ফুলরে হারানোর ডর দেখছি। তোর চোখে তা যে আমি খুইজা পাই না বাজান।’
বাবার নরম গলা শুনে চমকে উঠলো অভি। তবে বেশি সময় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। আহত শাবকের ন্যায় গুটি গুটি পায়ে কামরা থেকে বেরিয়ে গেলো। অভি যেতেই আনোয়ার সর্দার হাঁক ছাড়লেন,
‘ফুল মা, এক কাপ চা দিয়া যাইস।’
আমিন, মারুফ আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের দেখেই গলা শুকিয়ে এলো মনোয়ার সর্দারের। কলি বেগম ওদের গাড়ির শব্দ পেয়েই বৃন্ত, পাপড়িকে নিয়ে পাশের বাড়ি ছুটেছে। ছেলেমেয়ে দুটোকে কারো ঘরে লুকিয়ে রেখে সেও ফিরবে স্বামীর কাছে। আমিন চেয়ারে লাথি মারতেই মনোয়ার সর্দার চমকে উঠলো।
‘শ্বশুর আব্বা, কত সুন্দর কইরা ঐদিন বুঝায় গেলাম। তাও আপনে একেবারে চুপচাপ বইয়া রইছেন। এইডা তো ভালো কথা না। আমি এমনি ভীষণ শান্তশিষ্ট পোলা। কিন্তু রাইগা গেলে শ্বশুর, বাপ দেহি না। ধর থিকা কল্লা আলাদা কইরা হালাই। এহন আপনেরে কি কমু তাই কন।’
মারুফ আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে সিগারেটে শেষ ফুক দিলো। এরপর নিজেই মোড়া টেনে পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে বসলো। ছোট ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘বইয়া রইছোত কেন? হালায় দে। বাপের এই অবস্থার কথা হুনলে এমনি মাইয়া দৌড়ায় আইবোনি। তহন তোর পাখিরে তুই খাঁচায় পুরিস। আমার এতে খেচাখেচি ভাল্লাগে না। যা মুখে কবি তা হাতে কলমে দেহায় দিবি। তাইলে না মানুষ ডরাইবো।’
‘শ্বশুর দেইখা সম্মান করতাছি।’
‘রাখ তোর সরমান। এই বেডায় সরমানের যোগ্যই না। এহনো মাইয়াডারে তোর হাতে তুইল্লা দিলো না। এতে বুঝোস না ভালো কথার মানুষ না।’
মনোয়ার সর্দার একদম নিশ্চুপ। মনে হচ্ছে মারুফ, আমিন কোন পাথরের মূর্তির সাথে কথা বলছে। কোন নাড়াচাড়া, টুঁশব্দ কিছু নেই। মাঝে মধ্যে শুধু ঘন পল্লব বিশিষ্ট নেত্র জোড়া কেঁপে উঠছে। কলি বেগম দুরুদুরু বুকে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখেই আমিন ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত করে বললো,
‘এই তো শাশুড়ী মা আইয়া পরছে। আপনে ভালোয় ভালোয় কইয়া দেন তো আমার পরাণ পাখিডা কই আছে। কতদিন ধইরা ওরে দেহি না। মনডা বড় আনচান করে। কতদিন ধইরা আমি ওরে ভালোবাসি। কত পরীক্ষা দিলাম। তারপর কিল্লিগা যে আপনেরা আমারে জামাই হিসেবে নির্বাচন করতাছেন না আমি বুঝতেই পারতাছি না। আমার মতো পোলা একটাও পাইবেন না। হাজারে একখান আমি। আপনের মাইয়া অনেক সুখে থাকবো। কেন ওর সুখটারে পায়ে ঠেইল্লা দিতাছেন?’
কলি বেগম নিজেকে গুটিয়ে নিলো। তার হাত-পা অনবরত কাঁপছে। আমিন, মারুফের সামনে কথা বলতে ভয় পায় না তা এই গ্রামের কেউ নেই। বিশেষ করে মারুফের নীরবতা কলি বেগমকে আরো বেশি ঘাবড়ে দিচ্ছে। মারুফ চুপ থাকা মানে ঝড় আসার পূর্বাভাস। কলি বেগম হাত জোর করে বললেন,
‘বাবা, আমার মাইয়াডার পিছু ছাইড়া দাও। গত এক বছর কম ঝড় যায় নাই ওর ওপর দিয়া। ওরে এবার একটু শান্তি দেও। ও যেনে আছে হেনেই ভালো থাকবার দাও।’
আমিনের আগেই হুংকার দিয়ে উঠলো মারুফ।
‘আবার মুখে মুখে কথা কন। আমিইন্না, তুই এহনো খাড়ায় রইছোত কেন? যা গিয়া হের ছোড মাইয়াডারে তুইল্লা লইয়া আয়। এক মাইয়া হারাইলে আরেক মাইয়া নিজেই সুড়সুড় কইরা বাইর কইরা দিবোনে।’
আমিন চোখ রাঙিয়ে তার এক সাঙ্গকে কঠিন গলায় বললো,
‘যা গিয়া পাপড়িরে লইয়া আয়।’
ছেলেটা আদেশ পেয়ে মাথা নাড়িয়ে ছুটলো ভেতরের দিকে। এবার মুখ খুললেন মনোয়ার সর্দার। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
‘দোহাই লাগি তোমাদের, আমাদের পিছু ছেড়ে দাও। আমাদের একটু শান্তিতে বাঁচতে দাও।’
সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে পিষতে পিষতে মারুফ বললো,
‘আমরাও অশান্তি চাই নাই। কিন্তু আপনেরা তো ভালো কথা হুনলেন না।’
ততক্ষণে আমিনের সাঙ্গপাঙ্গরা পাপড়িকে খুঁজে না পেয়ে চলে এসেছে। এসেই একজন উৎকন্ঠা নিয়ে বললো,
‘ভাইজান, ঘরে কেউ নাই।’
আমিন চিৎকার করে হুকুম দিলো,
‘সারা ঘর তছনছ কইরা ফেল। পাপড়িরে না নিয়া আমি আইজকে যামু না।’
আমিনের হুকুম দিতে দেরী পালন করতে দেরী নয়। হাতে থাকা লাঠি দিয়ে বারি দিয়ে ঘরের প্রত্যেকটা জিনিস ভাঙতে লাগলো। মনোয়ার সর্দার বাঁধা দিতে গেলে এক ছোকড়া জোরে তার মাথায় আঘাত করে বসলো। প্রচন্ড জোরে আর্তনাদ করে মনোয়ার সর্দার মেঝেতে পরে গেলেন।
[সারাদিন রোজা রেখে একটা অক্ষরও লিখতে মন চায় না। আপনাদের অপেক্ষা করিয়ে রাখতে আমারও ভালো লাগে না। খুব শীঘ্রই গল্প শেষ করে দিবো।]
#চলবে