প্রেমোত্তাপ পর্ব ২০

0
992

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

২০.

ধরায় তখন প্রহর চলছে অপরাহ্নের সমাপ্তির প্রহর। ব্যস্ত শহরে ঝুপ করে নেমে এসেছে ক্লান্তি। কেউ রিকশার টুংটাং শব্দে খুঁজে নিচ্ছে অবকাশের ভাবনা। আঁধার আকাশে আধো আধো কুয়াশারা হামাগুড়ি দিচ্ছে। হিমেল সমীর জনজীবনে দিয়েছে প্রশান্তি। কেবল শান্তি নেই চিত্রার দেহে, মনে। কেবিনের এক কোণায় বসে সে এই অশান্তির জীবনের হিসেব মেলাচ্ছে। মেলাতে মেলাতে ফলাফল বের হলো, অদ্ভুত জীবন, অচেনা দুঃখ। চিত্রার চোখের কার্নিশ ঘেঁষে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। চোখের পাতায় ভেসে উঠল সেই অপ্রত্যাশিত, নিষ্ঠুর, অপ্রিয় দৃশ্যটি। বাহার ভাই কারো ভরসার কাঁধ হয়েছে, এটা চিত্রা মানতে পারছে না। অবশ্য মানতে না পারারই কথা। যে মানুষ সর্বদা ছিল ছন্নছাড়া, বেখেয়ালি— সে মানুষ হুট করে কারো খেয়াল রাখার কারণ হয়ে যাবে সেটা চিত্রা কীভাবেই বা মানবে? উন্মাদ হলো সে, দ্রুত গতিতে মায়ের ফোন থেকে কল লাগাল কাঙ্খিত সেই নাম্বারটিতে। রিং হলো, চিত্রা তৃষ্ণার্ত পাখির ন্যায় ছটফট করতে লাগল। তার তৃষ্ণাকে চির যৌবনা রেখে অপর পাশের মানুষটি ফোন রিসিভ করল না। অবহেলায় মূর্ছা গেলো ফুলের ন্যায় চিত্রা। চোখ তার ঘোলাটে হয়ে এলো। দৃষ্টি এলোমেলো। চারপাশে হাতড়ে একটি ভরসার কাঁধ খুঁজল কিন্তু পেল না। পাবেই বা কীভাবে? তার ভরসার কাঁধ আজ অন্যের আশ্রয় হয়েছে যে! এই চরম সত্যি মানতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মেয়েটি। চোখের সামনে বখাটে, ভবঘুরে এক পাগলাটে পুরুষের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ভেসে উঠল। যাকে ভালোবেসে অষ্টাদশী বিনা লাভে কষ্ট ধার করেছে।

_

একটি সুন্দর সকাল। চোখে-মুখে নতুন উদ্যম নিয়ে তার আগমন। তার আগমনে নাচছে মেঘ। প্রকৃতি আনন্দঘন। সওদাগর বাড়িতেও আনন্দ উপচে পড়ছে। আজ বাড়ির চঞ্চল প্রাণ বাড়িতেই ফিরে আসবে। অবনী বেগম ব্যস্ত হাতে রান্নাঘর সামলাচ্ছেন। তার সাথে সাহায্য করছেন রোজা সওদাগর। ব্যস্ত রান্নাঘরে হুট করে আগমন ঘটল ছোট্টো চেরির। এসেই মায়ের আঁচল টানল, শুধাল,
“কী রাঁধো, আম্মু?”

অবনী বেগমের ব্যস্ত হাত থামল না। কাজ করতে করতে মেয়ের উত্তর দিলেন,
“ইলিশ মাছ রান্না করছি, সোনা। তোমার চিত্রা আপা’র না অনেক পছন্দ? তাই।”

“চিত্রা আপা কী আজ আসবে, আম্মু? কতদিন আপার সাথে খেলি না। আপা না থাকলে মোটেও ভালো লাগেনা, আম্মু।”

অবনী বেগম এবার ব্যস্ত হাত থামালেন, মেয়ের দিকে চাইলেন স্নেহের দৃষ্টিতে। আর কেউ না জানুক, সে-তো জানে, তার মেয়েটা চিত্রা আপা বলতে পাগল। মায়ের বুকের স্নেহ ঢেলে দিল মিষ্টি চেরির পানে চেয়ে। কপালে আদর মাখা মিষ্টি চুমু এঁকে মেয়ের গাল টানলেন,
“তোমার ভালো লাগে না বলেই তো আপা চলে আসছে। আর মন খারাপ করে রেখ না। কেমন?”

চেরি গাল ভোরে হাসল। গোলগাল স্থুল আকার চেহারাটির ডাগর ডাগর অক্ষি যুগল হাসির দাপটে পিটপিট করল। সেই পিটপিট নেত্র মেলে সে বড়ো আম্মুর দিকে চাইল। বড়ো আম্মুকে কাজে ব্যস্ত দেখতেই সাবধানী ভঙ্গিতে মায়ের আঁচল টেনে নত হওয়ার ইশারা করল সে। মেয়ের সাবধানী হাবভাব এড়ায় না মায়ের দৃষ্টি। তাই সেও সাথে সাথে মাথা নামায়। শুধায়,
“সিক্রেট কিছু বলবে?”

চেরি সম্মতিতে মাথা নাড়ে উপর-নীচ। প্রায় ফিসফিস করে বলে,
“আম্মু, তরকারিতে ইলিশ মাছের দু’টো টুকরো বেশি দিও। বাহার ভাই আর বনফুল বুবুও তো ইলিশ মাছ অনেক পছন্দ করে।”

মেয়ের কথায় তাজ্জব বনে যায় অবনী বেগম। ও বাড়ির মানুষ গুলোর সাথে তাদের আজকাল দেখা সাক্ষাৎ নেই বললেই চলে। না আছে সম্পর্ক। তবুও বাচ্চা মেয়েটা ভালোবাসা ভুলেনি। অথচ বড়োরা অনায়াসে তা ভুলে ভালো আছে!

“দিবে তো, আম্মু? দিও প্লিজ। আর না থাকলে, আমারটা দিয়ে দিব। তুমি কাউকে বলো না কেমন?”

অবনী বেগমের চোখ ঝাপসা হয় মেয়ের এমন মায়া ভোরা বায়নায়। সে ঝাপসা চোখে মেয়েকে আদর দিতে দিতে বলে,
“ওদের জন্য দু’টো টুকরো বাড়িয়ে দিব। তুমি চিন্তা করো না।”

মায়ের আশ্বাসে আনন্দ হারা হয় চেরি। ছুটে যায় রান্নাঘর ছেড়ে। মনে মনে ফন্দি আঁটে বাহার ভাইদের বাড়ি যাওয়ার। এখন একবার গিয়ে বুবুকে বলে আসবে যেন দুপুরে ভাত তাড়াতাড়ি না খায়। চেরি মাছ নিয়ে আসবে।

সকাল হতেই চিত্রা হাঁসফাঁস শুরু করে। সে আর হসপিটাল থাকবে না। কোনো ভাবেই না। তাকে বাড়ি নিয়ে গেলেই সে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। মেয়ের নাছোড়বান্দা আবদারে মুনিয়া বেগম হার মানেন। সকাল সকালই তাকে ছেড়ে দেওয়ার আর্জি পেশ করেন ডাক্তারদের কাছে। তুহিন মা’কে আগেই পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে। চাঁদনী ও অহি চিত্রাকে নিয়ে আসতে যায়।

চিত্রার চঞ্চল চিত্ত। বাড়ি আসলে সে সুস্থ হয়ে যাবে এই কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। ঠিক কথা হলো— বাড়ির পাশে বসবাসকারী প্রেমিকের সান্নিধ্যে থাকলে সে সুস্থ হবে। ছন্নছাড়া বাহার ভাইয়ের গিটারের শব্দ শুনলে সে সুস্থ হবে। সে সুস্থ হবে আধ্যাত্মিক এক ওষুধের মাধ্যমে। যে ওষুধের কথা কেউ জানেনা, কেবল রোগ জানে আর রোগী জানে।

চিত্রাদের গাড়ি শব্দ তুলে সওদাগর বাড়ির সামনে এসে থামল। খানিক জার্নিতেই মেয়েটার শরীর ক্লান্ত। তুহিন দ্রুত গাড়ি ছেড়ে বের হলো। বোনের নিকট বাড়িয়ে দিল সাহায্যের হাত। চিত্রা এক পলক সেই হাতের দিকে চাইল, নির্লিপ্ত দৃষ্টি জোড়া সরিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,
“আমি পারব।”

তুহিনের আশা ভরা হাতটা অগোচরে নিজেকে গুটিয়ে নিল। চাঁদনী ভাই-বোনের এই মান-অভিমানের পালা দেখে হতাশার শ্বাস ফেলল খুব গোপনে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই কিছুটা মিছে ধমক দিয়ে বলল,
“কী তুই পারবি হ্যাঁ? শরীর যা দুর্বল হয়ে আছে, নড়তেই তো পারিস না ভালো করে। আয়, আমার হাত ধর দেখি, আমি ধরছি।”

চিত্রা বাক্যব্যয় না করেই নিরবে চাঁদনীর হাতটি ধরল। তুহিন হতাশার শ্বাস ফেলল। চিত্রা গাড়ি থেকে নামতেই তার দৃষ্টি গেল একতলা বিশিষ্ট রঙ চটা দালানটির দিকে। যেই দালানের আধ-খষা ছাঁদের কোণে বসে ঝিমুচ্ছে শালিক। কয়েকটি মেটে রঙের নিত্য পরিহিত জামাকাপড় উড়ছে ছাঁদের কার্ণিশে। চিত্রা তীর্থের কাকের ন্যায় তাকিয়ে রইল মিনিট দুই। হয়তে পরিচিত মানুষটাকে দেখতে পাওয়ার লোভে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। গাঢ় বিষাদ এসে জমল তার বুকে। কিন্তু হুট করেই সকলের দৃষ্টি আটকে গেল সেই রঙচটা বাড়ির মেইন গেইটের সামনে। একটি ক্রন্দনরত বাচ্চার নিষ্পাপ মুখমন্ডল দৃষ্টিগোচর হতেই সকলের মন মুহূর্তেই হাপিত্যেশ করে উঠল। চিত্রা তো এই অসুস্থ, ব্যাথা যুক্ত শরীরটা নিয়ে ছুটে গেল নিষ্পাপ বাচ্চাটির দিকে। স্নেহের হাতে আগলে নিল মুহুর্তে। চিত্রার পেছনে পেছনে চাঁদনী, অহি এবং তুহিনও উপস্থিত হলো। চেরির মুখমন্ডল লাল হয়ে এসেছে, ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে বাচ্চাটা। চিত্রা উত্তেজিত হলো, চঞ্চল কণ্ঠে শুধাল,
“কী হয়েছে আমার চেরি সোনার? কাঁদছে কেন আমাদের প্রিন্সেস?”

চেরির কান্নার স্রোত উত্তাল হলো। ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলল,
“আ আপা, বুবু ভালো না। বনফুল বুবু পচা হয়ে গিয়েছে। সে মোটেও ভালো না।”

সকলের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। চিত্রা আহত চোখে চাইল বন্ধ দরজার দিকে। মনের মাঝে মানতে না চাওয়ার এক ঝড় উথাল-পাতাল ধ্বংস তুলল। বনফুল নামক মিষ্টি মেয়েটা এমন পাষাণ হয়ে গিয়েছে, তা সে মানতে পারল না।

অহি নিজের ছোটো বোনকে বুকে চেপে ধরল। দাঁত কিড়মিড় করে জিজ্ঞেস করল,
“কী করেছে বনফুল তোমার সাথে?”

চেরির ঠোঁট ভেঙে কান্নারা ততক্ষণে আরও প্রসস্থ হলো। তারা জানল না বনফুলের দোষ কি ছিলো। ততক্ষণে সওদাগর বাড়ির ভেতর পৌছে গেল এই সংবাদ। তাদের সামনের বাড়ির মানুষ গুলোর প্রতি এবার রাগ প্রগাঢ় হলো তাদের।

#চলবে

[প্রিয় পাঠক, আপনারা অনেকে বনফুলকে নিয়ে অসন্তুষ্ট। আচ্ছা, বনফুল মেয়েটা কী অযৌক্তিক কিছু করছে? একটা আঠারো বছরের মেয়ে যাকে ভালোবাসতো, হুট করে একদিন শুনে তার ভালোবাসার মানুষ অন্যকারোতে আসক্ত, সেই মেয়েটার কাছে কি এসব মেনে নেওয়া এতই সোজা? একসময় সে জানত ছেলেটা তাকে ভালোবাসে, অথচ তার ধারণা ভুল হয়ে গেল নিমিষেই, তার এই ব্যাথার ভার কেমন বলেন তো? যাকে পাবে না বলে আত্ম হ ত্যাও করতে গেল, সে ছেলেটা তার খোঁজ অব্দি নিল না। এই কষ্টের দাম কে দিবে? অথচ নিজের বোনের কথা ভেবে, ভাঙা মেয়েটাকে আবার ভাঙল, কিন্তু মেয়েটাকে একবার জিজ্ঞেস করল না ভালো আছে কি-না, এমন পরিস্থিতিতে বনফুল কি ভুল করছে খুব?

আর তুহিনকেও দোষ দেওয়া যায় না। সে যাকে কখনো ভালোবাসেনি, তাকে নিয়ে ভাববে না সেটাই স্বাভাবিক। তবুও মানুষ তো আশা করে!

প্রতিটা চরিত্র তাদের জায়গায় সঠিক, আপনারা কেবল উপলব্ধি করলে বুঝবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here