আমি মায়াবতী পর্ব ১৪

0
1339

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_১৪
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

“মায়া, আমি আমার মা কে তোমার কথা বলেছি। মা তোমাকে দেখতে চেয়েছেন। তুমি কি যাবে আমার সাথে আমাদের বাসায়?”
“তোমার মা আমাকে যেতে বলেছে?”
“হুমম। তুমি না করো না প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ। মা তোমাকে দেখতে চেয়েছে। কবে যাবে তুমি বলো তো?”
“আমি জানিনা আসলে আমি কি বলবো। আমাকে আমার পরিবার থেকে পার্মিশন নিতে হবে। আম্মা রাজি হলেই যেতে পারবো। আমি কালকে এসে তোমাকে জানাই?”
“ওকে। আন্টি রাজি না হলে আমি আন্টিকে রাজি করাবো। প্রয়োজন হলে আমি নিজে তোমার মায়ের সাথে আমার মায়ের কথা বলিয়ে দিব। তবুও তোমাকে যেতেই হবে। আমার অনেক ইচ্ছে জানো তো, আমিও আমার বন্ধুর সাথে বাসায় বসে গ্রুপ স্টাডি করবো। ”
“মানে?পড়াশোনার জন্য যেতে বলছো?”ভীমড়ি খেয়ে বললাম আমি।
“হুমম। ছোট বেলায় ভাইয়াকে দেখতাম, ভাইয়ার ফ্রেন্ডরা আসতো ভাইয়ার সাথে। দরজা চাপিয়ে পড়তো আর লিখতো। আমি একটু উঁকিঝুঁকি দিলেই আমাকে ধরে মারতে আসতো। গম্ভীর স্বরে বলতো, কবিতা যাও এখন আমরা পড়ছি। জানো, আমার অনেক ইচ্ছে আমিও এইভাবে কাউকে বলবো। তোমাকে নিয়ে আমার রুমে বসবো। কেউ বিরক্ত করতে আসলে এইভাবেই বলবো। যাতে একটা ফিলিংস আসে যে আমি বড় হয়ে গেছি।” বলেই হাহা করে হাসতে লাগলো কবিতা।
আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার হুট করেই মনে হলো, আমি খুব সুখি একজন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করেছি। যে স্বভাবে আচরণে পাগলাটে টাইপ। প্রচুর বাঁচাল স্বভাবের। কিন্তু মনটা অনেক ভালো। ও হয়তো এমন একজন মানুষ যার সাথে দুটো কথা বললে খারাপ মুহুর্তেও মন ভালো হয়ে যাবে।
★★★
“আম্মা,কোথায় তুমি?আমার কলেজ তো ছুটি হয়ে গেছে। গাড়িও তো আসেনি তুমিও আসোনি।আমি যাব কিভাবে এখন?”
“মায়া,সাব্বির হুট করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি ওকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি।আজকে তো ড্রাইভারও আসেনি। আমিই হাসপাতালে এসেছি। তুমি কি একা একা আসতে পারবে?”
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম,”সাব্বির এর কি হয়েছে মা? ও ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ, ও এখন ঠিকই আছে। তুমি বরং রিকশা নিয়ে চলে এসো। আসতে পারবে তো ভালোমতো? আর বাসায় এসে আমাকে কল করে জানিয়ে দিও।”
“আচ্ছা,আম্মা।”
ফোন ভেতরে রেখে আমি একটা রিকশা খোঁজার চেষ্টা করলাম। কলেজ ছুটি হয়েছে। অনেক ভীর এখন। আমি রিকশায় উঠার চেষ্টা করেও পারলাম না। আমি এখনও এই শহরের মানিয়ে নিতে পারছি না নিজেকে। কিন্তু হুট করে একটা রিকশাওয়ালা এসে দাঁড়ায় আমার সামনে।
আমি কিছু না ভেবেই জিজ্ঞেস করি,”মামা, যাবেন?”
“হুমম, উডেন।”
আমি রিকশাওয়ালাকে আমার ঠিকানা দিলে সে চালাতে শুরু করে। উনাকে দেখে আমার কেন যেন রিকশাওয়ালা মনে হলো না। রিকশার সাথে যেন উনাকে একেবারেই মানাচ্ছে না। উনি বেশ শক্ত-সামর্থ্য চেহারার লোক। কিন্তু রিকশার সাথে কেন যেন উনাকে একেবারেই যাচ্ছে না।আমি হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, রিকশাটা অন্য রাস্তা ধরে চলছে। আমি উনাকে বললাম,”মামা, আপনি কোন দিক দিয়ে যাচ্ছেন? এইটা তো আমার বাসার রাস্তা না। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“মামায় মনে অয় ডাকার শহরে নতুন আইছুন।তাই চিনবার পারতেছুইন না। আমি শর্টকাট লইছি মামা। তাড়াতাড়িই যামুনে।”
“অহ। আচ্ছা।”
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমার সামনে খুব ভয়ানক কিছু অপেক্ষা করছে। কিন্তু সেটা কি আমি বুঝতে পারছি না। আমার মনের অস্থিরতা কমছে না। কেন এমন হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু যখন বুঝলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। রিকশাওয়ালা যখন রিকশাটা একটা অন্ধকার গলির মধ্যে নিয়ে গেলো,আমি চিৎকার করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,”আমাকে কই নিয়ে যাচ্ছেন মামা? আমি নামবো। এইখানেই থামান রিকশা। ”
কিন্তু সে থামলো না। সে তার পান খাওয়া মুখে বললো,”আপনেরে আনার জন্য মেলা টেকা পাইছি মামা। আরও টেকা পামু। আপনের ছোড ভাইয়ের এস্কিডেন্ট করাইছি। হাসপাতালে আছে হ্যা। আফনের আম্মায় ও আছে। তাইতো আফনেরে আনবার আসে নাই। আফনেরে ছাইড়া দিলে আমাগো কেমনে হইবো?”
আমি অনেক চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলাম। যদিও বুঝেছিলাম আমার চিৎকার কেউই শুনবে না। আমি ভয়ে ভয়ে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন মামা?”
“আমার কাম এই পর্যন্তই মামা। আফনেরে নিয়া এটা ঘরে বাইন্ধা থুমু। তারপর তাগো কাম তারা করবো।”
“কাদের কাজ?”
“এই ছেমড়ি, এতো কতা কস কেন?তরে কিডনাপ করছি। তোর প্রশ্নের উত্তর দিমু নাকি?মাতাডা খাইলি আমার।”
আমাকে যখন একটা ছোট খুপরি ঘরের সামনে এনে দাঁড় করালো, তখন ভেতর থেকে একজন মহিলা আর একজন পুরুষ বের হয়ে আসলো।মহিলাটি এসেই আমার দু হাত বেঁধে দিল। মুখ বেঁধে দিল। ঘরের ভিতরে এনে আমাকে মাটির মধ্যেই বসালো। ওরা কি নিয়ে যেন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল।অনেকটা সময় আলোচনা করার পর মহিলাটি বললো,”এইবার মেলা টেকা লইমু। অনেক রিক্স নিয়ে আনছো তুমি। মেলা টেকা চাইবা।”
“হ। তা তো চামুই। আর এই ছেমড়ির বকবক হুনতে হুনতে আমার কান গেছেগা।”
“দুলাবাই, থামেন। বস কল দিছিলো। ইটু পরেই আইবো। তারপর মনে অয় এই ছেড়িরে পাড়ায় বেঁইচা দিয়া আইবো।”
“হেইডা হেগো কাম। এই ছেমড়িরে বেঁচলে মেলা টেকা পাইবো। আমাগো তো তার ছিঁটেফোঁটাও দিবো না। কিন্তু কাম তো আমরাই করলাম বেশি।”
হঠাৎ ঘরের দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। একজন বললো,”দুলাবাই, মনে অয় বস আইছে।”
“হ। যা দরজা খুইল্লা দে। আর হোন, কবি টেকা বেশি দিতে কবি। নাইলে এই ছেমড়িরে আমরাই বেঁচুম।কামডা ইটু রেক্সি অইবো। তয়, কাম হয়া গেলে লাভও অইবো।”

আমি ভয়ে আর আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। আমার নিজের জন্য ভয় হচ্ছে। সাব্বির এর জন্য ভয় হচ্ছে। ও কেমন আছে কে জানে। সাবিহাও মনে হচ্ছে ঠিক নেই। আম্মা নিশ্চয়ই পাগল পাগল হয়ে গেছে। ব্যাগে আমার ফোনটা আছে। কিন্তু সাইলেন্ট করা। ফোন দিলেও আমি বুঝতে পারবো না।এটা কোনো কাজেও আসবে না। আমার হাত বাঁধা।
“দুলাবাই,আমি দরজা খুইলা দিতাছি। আফনে প্রস্তুতি নেন। আফা, তুইও। ”
কাঁপাকাঁপা হাতে লোকটা দরজার খিল খুলতে গেল। আমি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি। আমি জানি, এখানে আমাকে যে আনতে বলেছে, সে নিশ্চয়ই আমার পরিচিত মানুষ। হয়তো খুব কাছের মানুষও। হয়তো তার সাথে আমার খুব বেশি ভালো কিংবা অনেক বেশি খারাপ সম্পর্ক।
লোকটা দরজা খুলে দিলে যে মানুষটা ভিতরে ঢুকলো, তাকে দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমি এই মানুষটাকে এখানে আশা করিনি মোটেও। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, আমার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক। আমার প্রিয় বান্ধবীর বড় ভাই কাব্য। সে আমাকে কিডন্যাপ কেন করাবে? কি লাভ তার?আর সেই বা কেন আমাকে বিক্রি করে দিবে?কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘরে থাকা মহিলাটি বললো,”এই আফনে কেডা? এইহানে কি চাই? যান এইহান থেকে।”
আমি বুঝলাম উনি আমাকে কিডন্যাপ করান নি। তাহলে কে?
কাব্য স্যার এর পিছনে আরও একজন মানুষ আসলো। তাকে আমি চিনি। সেও আমার শিক্ষক। আমি বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছি তাদের দিকে। কিছু বলার জন্য আপ্রান চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। মহিলাটি এসে আমার মাথার পিছনে একটা লাঠি দিয়ে আঘাত করলো।আর তার ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,”ভাই, এই ছেমড়িরে নিয়া পিছের দরজা দিয়া পালা।”
আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। মাথায় প্রচন্ড ব্যথা করছে। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। তার মধ্যে থেকেই শব্দ পেলাম, কাব্য স্যার কাউকে উদ্দেশ্য করে বলছে,”তোদের সাহস হয় কি করে আমার ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দেওয়ার।”
আচ্ছা, আমি কি ভুল শুনলাম?আমি ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাচ্ছি।হয়তো মারা যাচ্ছি। তাই হয়তো, এই লোকের থেকে যেটা শুনতে চেয়েছি এতোদিন, আমার অবচেতন মন সেটা ভেবে নিয়েছে।
★★★
বাসার কলিংবেল বেজেই চলছে। কবিতা নিজের রুম থেকে চিল্লিয়ে তার মাকে ডেকে বললো,”মা, দরজা খুলে দাও। মনে হয় তোমার ছেলে এসেছে। এতো রাতে এসেছে। মনে হচ্ছে, প্রেম করছে তোমার ছেলে। না হলে নেশা করছে ইদানীং। নয়তো মায়ের আচল ধরে ঘোরা ছেলে কেন এতো রাতে বাড়ি ফিরবে।”
“কবিতা, আমি কাজ করছি মা। আগে দরজা টা খুলে দিয়ে আয়। আর এইসব কথা আমার ছেলের সামনেই না হয় বলিস। আমাকে কেন বলছিস।”
“আমি পারছি না মা।তুমি যাও।”
“সোনা মা, আমার। আজকের মতো যাও। কালকে থেকে আমি যাব। এখন আমার হাতের কাজ অনেক।”
একরাশ বিরক্তি নিয়ে কবিতা গিয়ে দরজা খুলে দিল। কিন্তু সে যা দেখলো, সেটা সে তার স্বপ্নে কতবার দেখেছে, তার হিসাব নেই। সে তো চেয়েছে কোনো একদিন তার ভাই একটা মেয়েকে বিয়ে করে বাসায় নিয়ে আসবে। আর বাবার কাছে অনেক বকা খাবে।কিন্তু এতো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। তার ভাই কোলে করে একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু মেয়েটাকে দেখে সে যারপরনাই অবাক হলো। তার ভাইয়ের কোলে তার প্রিয় বান্ধবী মায়া। তার চোখদুটো বন্ধ। ও কি ঘুমুচ্ছে নাকি?নাকি অজ্ঞান? ব্যাপার কি? ভালোই হলো, মায়া তার ভাবী হবে। ব্যাপারটা তার কাছে ভারী মজার মনে হচ্ছে।
“দরজার সামনে থেকে সরবি নাকি এইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবি?”
“তুই বিয়ে করেছিস ওকে? ভালোই হয়েছে। এইবার আমি আর ও একসাথে কলেজে যাব। একসাথে ঘুরতে যাব। একসাথে শপিং এ যাব আর একসাথে… ”
“মা, তোমার মেয়েকে থামতে বলো। না হলে আমি ওকে মেরেই ফেলবো কিন্তু। ” বলেই সে গটগট করে হেটে মায়াকে নিয়ে তার নিজের রুমে গিয়ে শুইয়ে দিল।
কবিতার মা আর কবিতাও পিছনে পিছনে গেল। কবিতার মা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো জিজ্ঞেস করতে চাইছে মেয়েটা কে। মায়ার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মেয়েটা মাশাল্লাহ সুন্দরী। তার কোনো আপত্তি নেই। কাব্যর বাবাকে সহজেই ম্যানেজ করা যাবে।
“কাব্য,আমাকে বলতে পারতি। আমিই তোদের বিয়ে দিতাম। তোর বাবাকে না হয় আমিই ম্যানেজ করতাম। আমার কত শখ ছিল ছেলের বিয়ে ধুমধাম করে দিব। আর তুই এইটা কি করলি?একবার তো আমাকে বলতে পারতি।”
“মা, এইটা আমার বান্ধবী মায়া। তোমাকে ওর কথাই বলেছিলাম।”
কবিতা ঘুমন্ত মায়ার কাছে গিয়ে বললো,”হ্যাঁ গো মায়া, তুমি তো বলেছিলে আমার বাসায় বেড়াতে আসতে তোমার বাবা-মায়ের পার্মিশন লাগবে। এখন তো কারো পার্মিশন না নিয়েই বিনা নোটিশ এ আমাদের বাড়িতে সারাজীবনের জন্য চলে আসলি।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here