#হৃদয়ের_কথা
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
|১০|
১৬.
আকাশটা ঝকঝকে পরিস্কার। সূর্য সরাসরি মাথার উপরে অবস্থান করছে। রোদের তীব্রতা মৃদু। মর্তুজা ফেমেলীর সবাই রেডি চৌধুরী বাড়িতে যাওয়ার জন্য। রিধিমা লাল রঙের শিফন গজির্য়াস সুন্দর একটা লেহেঙ্গা পড়েছে। সোজা চুল গুলো পিঠে ছড়িয়ে ওরনাটা আচলের মতো পিন আপ করেছে। কানে ডাইমন্ডের ছোট কানের দুল,গোলায় ডাইমন্ডের চেন। চুলগুলো একসাইডে সিথি করে সেট করা। চুলে ছোট ছোট পাথর মৌ ক্লিপ আর গরজিয়াস মেকআপ,পারফিউম। রিধিমা এতো কিছু করেছে সবটা সম্রাটের জন্য।সম্রাট আসবে খুশিতেই তার নাচতে ইচ্ছে করছে। আজ অনেক মেয়েই থাকবে বিয়েতে যারা সম্রাটের জন্য পাগল। সম্রাটের চোখে সবার চেয়ে স্পেশাল লাগতে হবে বলেই এতো তোড়জোড় ।রেডি হয়ে রিধিমা মেধার রুমে যায়। মেধাও সুন্দর মেরুন লেহেঙ্গা পড়েছে। শুধু চুলটা ক্লিপ দিয়ে খোপা করা। রাহুল, সাহিল একিরকম পাজামা,পান্জাবি উপর দিয়ে কোট। বাকি বয়জেষ্ঠরাও সেম। রিধিমার আম্মু,বড় আম্মু, ছোট আম্মু সবাই একিরকম শাড়ি,জুয়েলারি পড়ে রেডি!
সবাই যখন রেডি সবার শেষে সম্রাট আসে। ফ্লাট থেকে সরাসরি এসেছে সে। রাহুল,সাহিলের মত
একি ডিজাইনের পাজামা পান্জাবি কিন্তু লাল। সঙ্গে কোট আর সানগ্লাস। সম্রাটের এন্ট্রিতে রিধিমা হা করে তাকিয়েছিল। উজ্জ্বল ফর্সা শরীরে লাল কালার সুন্দর মানিয়েছিল। সম্রাট আসতেই বাবার সঙ্গে টুকটাক কথা বলে। শাখাওয়াত সাহেব ইমোশনাল হয়ে আগে আগে গাড়িতে উঠে যায়। ছেলেকে ইমোশনাল দেখাতে চান না তিনি। বাকিদের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে নেয়।বয়জেষ্ঠরা আলাদা গাড়িতে আর সম্রাট, রাহুল,সাহিল,রিধিমা,মেধা এক গাড়িতে। পুরোটা সময় রিধিমা আড়চোখে সম্রাটকে দেখেছে। রিধিমা যখনই তাকিয়েছে সম্রাটের সঙ্গে চোখাচখি হয়েছে। প্রতিবার সম্রাট কিলার একটা স্মাইল দিয়েছে। আর রিধিমা বারবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। বিয়ে বাড়িতে পৌঁছে সবাই একসঙ্গে গাড়ি থেকে নামে। দুর থেকে রিধিমাকে দেখে নীলি,জারিফা ছুটে আসে। নীলি,জারিফা দুজনেই লেহেঙ্গা পড়েছে। নীলি পারপেল রঙের জারিফা মিষ্টি গোলাপি। মর্তুজা ফেমেলীর বয়জেষ্ঠরা চৌধুরী বাড়ির সবার সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্যস্ত। রিধিমা ব্যস্ত বান্ধবীদের সঙ্গে এটা ওটা গল্প করায়। এদিকে সম্রাট,রাহুল,সাহিল, মেধা আলাদা টেবিলে আড্ডা দিচ্ছে। অন্যদিকে একজোড়া চোখ মুগ্ধ দৃষ্টিতে রিধিমাকে দেখে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে বেশ কয়েকজন মেয়ে এসে সম্রাটের সঙ্গে কথা বার্তা বলতে আসে। তাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে সম্রাটের উপর ক্রাশড্। সম্রাট বারবার হাসি মুখে ইগনোর করার চেষ্টা করছে। সবটা নোটিশ করেছে রিধিমা। নীলি,জারিফাকে নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। নীলি সম্রাটকে দেখে রিধিমাকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
_’সম্রাট ভাই ইজ সো হট ইজেন’ট হি? দেখ ঐ মেয়ে গুলো এজন্যই আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।’
জারিফা নীলিকে সায় দিয়ে বলে,
_’আই কম্পিলিটলি এগরি উইথ দ্যাট,,,সম্রাট ভাই এক পিসই ভাই। এতো কিউট কেনো আমাদের জিজু?’
রিধিমা ওদের কথায় বলে উঠে,
_’দেখতে হবে না কার ভাই। যাইহোক আগে ওই পেতনি গুলোকে সরায়। দেখ কেমন মৌমাছির মতো পিছনে পরে আছে। সম্রাট ভাইয়াকে কি মধু পেয়েছে?’
নীলি জারিফা মজা করে বলে উঠে,
_’ভাইয়া না সাইয়া রিধি?’
বলেই হিহি করে হাসতে শুরু করে। এদিকে রিধিমা চোখ রাঙায় নীলি জারিফাকে। এই তিনজন মিলে মেয়ে গুলোকে সম্রাট সম্পর্কে উল্টাপাল্টা বলে দুরে পাঠিয়ে দেয়।মূলত এই দুষ্টু আইডিয়াটা নীলির। রিধিমা বলতে চায়নি সম্রাট সম্পর্কে বাজে কথা। তাদের কথা গুলো ছিল এমন যে,
‘সম্রাট মেয়েবাজ। ক্যরেক্টার খারাপ। মেয়েদের সঙ্গে রিলেশন করে খেয়ে ছেড়ে দেয়। হাজারটা মেয়ের ভিডিও রয়েছে সম্রাটের কাছে। এখন সেগুলো কেমন ভিডিও এটা জানার মতো বয়স তো সবার হয়ে গেছে। এছাড়া সম্রাটের সম্পর্কে আরো বাজে কথা।’
এই টাইপ আজগুবি কথা গুলো বলেছে নীলি,জারিফা। রিধিমা তো এগুলো স্বপ্নেও বলতে পারবে না। সে শুধু বোকার মতো হ্যাতে হ্যা মিলিয়েছে। অন্য দিকে মেয়ে গুলো বিশ্বাস করতে চায়নি কিন্তু নীলি জারিফার বনোয়াট রসের কথায় তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়।
সম্রাট বুঝতেও পারেনা মেয়ে গুলোকে কি উল্টাপাল্টা বলল ওর সম্পর্কে। কিন্তু সে তো খুশি মেয়ে গুলো পিছু ছাড়লো নাহলে সেলফি, নাম্বার করে মাথা খাচ্ছিলো। সাহিল আর রাহুল চেয়েও হেল্প করতে পারেনি কারণ তাদের পিছনেও দু’চারজন এসেছিল।
রাহুল, সাহিল আর মেধা, নীলি,জারিফা, রিধিমা একই টেবিলে বসেছিল। সম্রাট উঠে যায় ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য। সম্রাটের কিছুক্ষণ পর রিধিমাও উঠে যায় সম্রাটকে খুজতে। আশেপাশে কোথাও না দেখে গেটের কাছে যায়। রিধিমাকে দেখে একটা ছেলে ক্যামেরা হাতে এগিয়ে আসে।
_’কাউকে খুজছেন মিস?’
রিধিমা বিরক্তবোধ করে জিগ্যেস করে,
_’তাতে আপনার কি?’
_’না মানে এমন ভাবে এদিকে ওদিকে দেখছেন মনে হলো কোন স্পেশাল মানুষকে খুজছেন।’
_’আমার রিলেটিভস ও হতে পারে আপনার এটা বোঝার কারণ?’
ছেলেটা হেসে হাত বাড়িয়ে বলল,
_’ওহহ ভালোই হলো তবে। যাইহোক আমি আবির। আমি LLB স্টুডেন্ট লাস্ট সেমিনার। একজন ভবিষ্যৎ লয়ার বা জাজ।আজ যার বিয়ে মানে তিশান চৌধুরীর বন্ধু আমি ।’
রিধিমার কাছে ছেলেটা এনোয়িং মনে হলো। সে হাত না মিলিয়ে বলল,
_’ওয়েল মিস্টার আবির আমি অপরিচিত কারো সঙ্গে হাত মেলায় না। আমার নামা রিধিমা ওয়াসিফা। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার আপনার চেয়ে বয়সে ছোট।’
এতটুকু বলেই রিধিমা চলে আসতে চায় কিন্তু আবির তাকে ডেকে বলে,
_’আমার আপনাকে দেখে মনে হচ্ছিলো আপনি ছোট। যাইহোক আপনাকে ভিষণ সুন্দর লাগছে রিধিমা।কিছু মনে না করলে আমরা কি পরিচিত হতে পারি,?’
_’এক্সকিউজমি?’
_’i mean well wisher. Pls be comfortable mis Ridhima!’
_’দেখুন আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল। আপনাকে দেখেও ভদ্র মনে হচ্ছে। আনকম্ফিটিবল ফিল করবো এমন কাজ করবেন না বাই।’
১৭.
এতটুকু বলেই রিধিমা ফিরে যাচ্ছিলো তাড়াহুড়োয় হঠাৎ একজন ওয়েটারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে জুস পরে যায় রিধিমার লেহেঙ্গায়। লোকটি ভয় পেয়ে বারবার ক্ষমা চাইতে থাকে। রিধিমা উনাকে ইনশিয়র করে স্বাভাবিক এক্সিডেন্ট বলে। লেহেঙ্গা পরিস্কার করতে ওয়াশরুমের কাছে গিয়ে আবির নামের ছেলেটিকে গালি দিতে গিয়েও দেয়না। আবির পিছনে না পরলে এতো তাড়াহুড়ো করতো না রিধিমা। ওয়াশরুমের আয়নায় নিজের সাজটা দেখে নেয় একবার। তারপর একটা কাচের গ্লাসে পানি নিয়ে জূস পরা সাইডে পরিস্কার করে। যাওয়ার পথে কাউকে সম্রাট ভেবে ভুল করেছে বলে আবারো ফিরে তাকিয়ে দেখে,
মেহনাজ মেয়েটা সম্রাটকে জরিয়ে ধরে আছে। সম্রাটকে ছাড়তেই মেহনাজ টুপ করে ঠোঁটে শুকনো চুমু খেয়ে হেসে ফেলে।রিধিমা এতটাই শকড্ ওর পুরো দুনিয়া ঘুরে উঠে। হাতে থাকা কাচের গ্লাসটা শব্দ করে ফ্লোরে পড়ে। হাতটা কেটে গেছে রক্ত ঝরছে। গ্লাস পড়ার শব্দ পেয়ে সম্রাট সামনে তাকায়। সে আর মেহনাজকে কিছু বলতে পারে না দুঃসাহস দেখানোর জন্য। সামনে রিধিমাকে কাদঁতে দেখে কিছু বলবে সেই সুযোগ পায়না। রিধিমা কাদঁতে কাদঁতে বেরিয়ে আসে। সম্রাট কপালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকায় রিধিমার চলে যাওয়ার দিকে। কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছু বুঝতে পারেনা। মেহনাজ সম্রাটকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কিছু বলবে সঙ্গে সঙ্গে শব্দ করে দাবাং মার্কা চড় পরে ওর গালে। মুহুর্তেই মেহনাজের গাল লাল হয়ে যায়। মেহনাজের গালটা জ্বলে যাচ্ছে। কান্না করে ফেলবে এমন অবস্থা। সে সম্রাটকে কিছু বলবে এমন সময় সম্রাট আরেকটি চড় দিয়ে বসে মেহনাজের গালে। মেহনাজের মনে হয় চামড়া ফেটে রক্ত ঝরবে এখন। রাগে সম্রাটের কপালের রগ ফুলে উঠেছে। শরীর শক্ত হয়েছে। নিজেকে সামলে বলে উঠে,
_’স্টে ইয়র লিমিট। হাউ ডেয়ার টু কিস মি ইউ bitch? যাস্ট পরিচিত ছিলি। আমাকে জরিয়ে ধরা প্লাস কিস করার দুঃসাহস কোথায় পেয়েছিস?’
বলেই মেহনাজের গলা টিপে ধরে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে গলা টিপে ধরায় মেহনাজের মনে হচ্ছে প্রাণটা এখুনি বেরিয়ে যাবে। সম্রাটের রাগ সম্পর্কে মেহনাজের ধারণা ছিল। কিন্তু এতটা ডেন্জারাস মেহনাজ কল্পনা করতে পারেনি।মেহনাজের চোখে রক্ত জমে যায়। চোখ বেরিয়ে আসবে এমন ভাব। সম্রাট নিজেকে সামলে ছেড়ে দেয় মেহনাজকে। ধাক্কা দিয়ে বলে,
_’তোর মতো প্রস্টিটিউটকে আমার সামনে আরেকবার দেখলে মেরেই ফেলবো আই সোয়ার। আমার সামনে আসবিনা কোনদিন।’
মেহনাজ কাশতে থাকে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে সে। নিজের গলায় হাত বুলাতে থাকে ক্রমাগত। মনে হচ্ছে এবারের মতো আল্লাহ্ তাকে সম্রাটের হাত থেকে বাচিয়ে দিয়েছে।
সম্রাট দৌড়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রিধিমাকে ডাকতে থাকে। রিধিমা বাইরে কোথাও নেই। সম্রাট সাহিলকে ফোন দিয়ে বলে রিধিমা তাদের সঙ্গে নাকি। পরে জানতে পারে রিধিমা গেটের বাইরে চলে গেছে। প্রচুর কান্না করছিলো সে। সম্রাট ফোনটা রেখে চুল গুলো টেনে জোরে চিৎকার করে ওঠে। সবকিছু তার জন্য হয়েছে। যদি সে মেহনাজের কথা না শুনতো এতোকিছু কখনো হতো না।
ওয়াশরুমের সামনে মেহনাজ সম্রাটকে থামিয়ে এটা সেটা করে আবারো প্রপোজ করে। তার পরিবার যে শাখাওয়াত সাহেবের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলেছে এসব বলতে থাকে। সম্রাট চেয়েও ইগনোর করতে পারেনি। পরে সুযোগ মতো সম্রাটকে জরিয়ে ধরে মেহনাজ। আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঠোঁটে শুকনো চুমু বসিয়ে দেয়। ব্যস রিধিমা দেখে ফেলে। সম্রাট জানে রিধিমা ভুল বুঝছে তাকে। সে পাগলের মতো দৌড়ে আসে গেটের কাছে। চারিদিকে রিধি বলে ডাকতে থাকে।
এদিকে রিধিমা যখন কান্না করতে করতে যাচ্ছিলো দুর থেকে আবির লক্ষ্য করে এগিয়ে যায়। রিধিমা আবিরকে পাত্তা না দিয়ে গেটের কাছে চলে যায়। আবির রিধিমা রিধিমা করে ডাকতে ডাকতে পেছন পেছন চলে আসে। রিধিমা চোখের পানি মুছতে মুছতে গেট থেকে বের হয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে। বেহায়া চোখের পানি তারপরও বাধা মানে না। কোন গাড়ি না পেয়ে দৌড়াতে থাকে রিধিমা। উদ্দেশ্যে দৌড়ে বাড়ি পৌঁছনো। তার পেছন পেছন আবির ও দৌড়ায়। রিধিমা থামুন প্লীজ বলে ডাকতে থাকে। হঠাৎ সামনে থেকে একটা গাড়ির হেড লাইটের আলোতে রিধিমা চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে পরে ব্যাস গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে রাস্তার পাশে পরে অজ্ঞান হয়ে যায়। দুর থেকে আবির রিধিমা বলে চিৎকার করে উঠে। রিধিমার কাছে গিয়ে মাথাটা কোলে নিয়ে মৃদু ডাকতে থাকে। রিধিমা একবার মিটমিট করে তাকিয়ে আবারো জ্ঞান হারায়। কপালে আর হাতে একটু আঘাত পেয়েছে রক্ত পরছে। গাড়িটা ব্রেক না করলে উপর দিয়ে ছিটকে পড়তো। গাড়িটা ব্রেক করেছিল ঠিক সময়ে।এদিকে আলোর কারণে রিধিমা থেমে ছিল বলে বড় সড় এক্সিডেন্ট হয়নি। গাড়ি থেকে একজন আধো বয়স্ক লোক বেরিয়ে আসে তাড়াতাড়ি করে আবিরকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। আবির রিধিমার পরিবারকে জানাতে চাইছিল কিন্তু সময় নায় হাতে এজন্য লোকটার গাড়িতে করে হসপিটালে নিয়ে আসে।
~চলবে