১|
ছেঁড়া ফাটা ওরনা নিয়ে একজোড়া বলিষ্ঠ শক্ত পা ধরে কান্না করছে রিধিমা। কান্না কম চিৎকার করে অনুনয় বিনয় করেছে। পাশের মানুষটি চোয়াল শক্ত করে বসে আছে মৃদু রাগে শরীরটা শক্ত হয়ে আছে। রিধিমা ব্যাকুল চোখে চেয়ে দেখলো মানুষটির কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ওরদিকে সমস্ত কনসেন্ট্রেশন যেন ফোনের ওপর। রিধিমার কান্নাকে প্রশয় না দিয়ে দৃঢ় পায়ে হেটে বের হতে গেলেই মৃদু চিৎকার করে ওঠে রিধিমা,
_ সম্রাট ভাইয়া প্লীজ!
প্রচন্ড কাতর শোনাল মিহি সোনালী কন্ঠস্বরটা। সম্রাট যেন শুনেও না শোনার ভান করে চলে গেলো। সাদা ধবধবে পরিপাটি বিছানার পাশে ঠাঁই বসে রইলো রিধিমা। এতোটা পাষণ্ড কিভাবে হতে পারে সম্রাট এটাই ভেবে পাচ্ছে না। বেশিই এক্সপেক্ট করে ফেলেছিল লোকটির কাছে। সবাইকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরালেও সম্রাটকে যে অসম্ভব বুঝে গেছে রিধিমা। নিজের আত্মসম্মান বলি দিয়ে সম্রাটের কাছে বান্ধবীর সুপ্ত ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল যা শুনেই সম্রাটের মাথা বিগড়ে যায়। রাগে বলিষ্ঠ পুরুষালী শরীরটা শক্ত হয়ে যায়। রিধিমা সম্রাটের পরির্বতিত রুপটা খুব ভালো মতো চিনে। মিনমিনে স্বরে ভয় পেয়ে থেমে থেমে অনুরোধ করতে থাকে সম্রাটকে। এদিকে সম্রাটের শরীর জ্বলে যাচ্ছিলো ইচ্ছে করছিলো রিধিমার ফর্সা টুকটুকে গালটা থ্রাপড়িয়ে লাল করে দিতে। এতটুকু মেয়ে বয়স কতো এসব সিলি বিষয় নিয়ে কথা বলার সাহস কিভাবে পেল রিধিমা তার বোধে আসেনা, নিজেকে দমিয়ে ঘর থেকে বের হতে যাচ্ছিলো সেই সময় রিধিমা সিফ্ররনের সাদা সুতোই কাজ করা প্রিয় শুভ্র ওরনাটা সম্রাটের হাতে দিয়ে বলল,
_ এই নিন আমার সবচেয়ে প্রিয় ওরনা ইচ্ছে মতো ছিড়ুঁন কিন্তু প্লীজ রাজি হয়ে যান সম্রাট ভাইয়া! আর কোনোদিন জ্বালাবো না আপনাকে প্লীজ।
এতো আবেগী কন্ঠস্বর ছলছলে চোখ মন টলাতে পারলো না সম্রাটের। পারবে কিভাবে ওপর পাশের মেয়েটি যদি একটু বুঝতো ওকে তাহলে তো ল্যাটা চুকে যেতো কবেই। পাথরের মতো দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ওরনাটা রিধিমার হাতে দিয়েই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল কিন্তু রিধিমা বড়সড় কান্ড করে বসল। হাতে থাকা প্রিয় ওরনাটার কোণা ছিড়েঁ ফেললো তারপর হাউমাউ করে কেদেঁ কেদেঁ বলল,
_ এটা ছাড়া আমার অত্যন্ত পছন্দের ৪৭ টা ওরনা ছিড়েঁছেন সেগুলোর জামা নতুন অবস্থায় অ অযত্নের সঙ্গে পড়ে আছে আ আলমারিতে। ওরনা ছাড়া পড়তে পারিনা সেগুলো….
তারপর থেমে থেমে ছেড়া সুন্দর সাদা সাফ্ররনের ওরনাটা দিয়ে নাক মুছে হুহু করে কেদেঁ বলল,
_ আপনার হয়ে এইটা আমি ছিড়ঁলাম। আপনার সমস্ত রাগ তো সবসময় আমার ওরনার উপর আছড়ে পড়ে তাই আপনাকে হেল্প করলাম স..সম্রাট ভাইয়া।
সম্রাট ভ্রুকুচকে হতভম্ব বিহ্বল তাকিয়ে রইলো কান্নারত আকুতি মিনুতি করা অজস্র মায়ায় ভরা মুখস্রীতে। সে হাসবে নাকি কাদঁবে বুঝতে পারছেনা সে রিয়েকশন দিতে ভুলে গেছে।রিধিমার বাচ্চামো দেখে সে যাস্ট থ য ব ল !
হ্যাঁ যখন যখন রিধিমা অত্যন্ত বিরক্ত করত তখন সম্রাট ওকে থামানোর জন্য বেশকিছু ওরনা ছিড়েঁছে।যখনই রাগের মাথায় বা ইচ্ছেকৃত দুষ্টুমি করে ওরনা ছিঁড়েছে আবার রিধিমার কান্নাকাটির কথাশুনে তারপরেরই দিন নতুন জামা এনে গিফট কে দিতো এই পাগলটাকে সম্রাট কিভাবে বোঝাবে। অবিশ্বাস্য নয়নে চেয়ে আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলল সম্রাট।
_ ভাইয়া নীলি আপনাকে ওর সঙ্গে একবার দেখা করতে বলেছে যাস্ট ও কিছু বলবে শুনে নিবা প্লীজ না করোনা।কাপাঁকাঁপা কন্ঠে আওড়ালো রিধিমা।
নীলি কেনো তাকে কলেজের পাশে পার্কটাই ডেকেছে তা আর অজানা নয় সম্রাটের। মেয়েটা যে ওর প্রতি দুর্বল হয়ে আছে সেটা সে ভালো মতো জানে। নিত্যদিন ফোন দিয়ে টুকটাক টেক্সট করে সবটা দেখেও পাত্তা দেয় না সম্রাট। এমনকি এ বাড়িতেও এসেছে বহুবার। সবসময় পিছু লেগে থাকে দেখা হলেই। তবে মেয়েটা ভালো। রিধিমার সব বান্ধুবীদের ছোট বোন ভাবে সম্রাট। বান্ধুবী হিসাবে রিধিমার সবচেয়ে ক্লোজ। এজন্য এখনো কিছু বলেনি নীলিকে। অবশ্য বয়সের ও একটা ব্যাপার আছে এট্রাকশন জিনিসটা এই বয়সের সবার মাঝেই থাকে। তাই আরোই পাত্তা দেয়না। সবার কাছে পরিচিত সে কঠিন হৃদয়ের ‘মর্তুজা মাহিরাদ সম্রাট’ নামে।
_ থাপ্পড় চিনিস? আমার হাতে মার খাওয়ার আগেই কেটে পড় রিধিমা! তোর সাহস কিভাবে হয় আমাকে এগুলো বলার ছোট আব্বুকে বলতে হবে?
গম্ভীর পুরুষালী ঠান্ডা কন্ঠস্বরের হুমকি শীতল চাহনি। ব্যাস এতটুকুই যথেষ্ট ছিল। রিধিমার মনে ক্রমাগত ভয় ঢুকে গেছে। সে তৎক্ষণাৎ মাথা বারবার এপাশওপাশ করলো তারপর আরো আকুতি মিশিয়ে বিধ্বস্ত ভাবে ইশারায় সম্রাটকে বোঝানোর চেষ্টা করছে এমনটা না করতে।
_ তাহলে কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরে যা।আর শোন রাহুলকে একটু উপরে পাঠাবি।
রাহুল হচ্ছে রিধিমার একমাত্র নিজের ভাই বয়সে রিধিমার চেয়ে গুনে গুনে তিনবছরের বড়। সামান্য মাথা ঝাকিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হলো।
বড় বড় পায়ের ধাপ ফেলে ব্যথিত হৃদয়ে দরজার কাছে যায় রিধিমা। মনে মনে সে ব্যার্থ। তার ভিতরে একটু আশা ছিল এই নিষ্ঠুর পুরুষটিকে মানিয়ে নিবে। বান্ধুবীকে দেওয়া কথা রয়েছে রাখবে। নীলি,রিধিমা আর জারিফা ছোট থেকে এক সঙ্গে একি স্কুল থেকে একই কলেজে উঠেছে,তিনজনই আন্ডারএইটটিন। কতো স্মৃতি ওদের বেড়ে ওঠার। বন্ধুত্বের পূরত্ব অনেক গভীর। এইযে জারিফার ১৭ তম জন্মদিন ছিলো আগামীকাল। ওদের বাসায় পুরো রাত ছিল রিধিমা আর নীলি। এতে অবশ্য সম্রাট ঘোর আপত্তি করেছিল শুধু জন্মদিন এটেন্ড করতে বলেছিল। কিন্তু রিধিমা কেদেঁ কেটে পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছিলো। আর বাসাও কাছে হওয়াই পরে কেউ আপত্তি করেনি।
জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষে নীলির জেদাজেদিতে তারা একটা গেম খেলে গেমে শর্তই ছিল যে হারবে তাকে বাকি দুজনের একটি করে শর্ত পূরণ করতে হবে। বেচারা রিধিমা হেরে গিয়ে মুখ লুকিয়ে ফেলেছিল অজানা আশঙ্কাই হার্টবিট থেমে গেছিলো মনে হয়। কি কি করতে হবে ভেবে। শেষে জারিফা ওকে হালকার ওপর ছেড়ে দিলেও নীলি ঠিক বিড়াট কিছু আবদার করল। যে করে হোক সম্রাটের সঙ্গে আলাদা সময় করে দেওয়ার রিকুয়েস্ট করলো। বিধ্বস্ত দেখালো রিধিমাকে সম্রাটকে সে চেনে ওকে মেরে মাটি চাপা দিয়ে দিবে এমন রিকুয়েস্ট করলে। প্রাণের ভয় কার না আছে? সে সাফসাফ মানা করে দিয়েছিল কিন্তু নীলি কেদেঁ কেটে কসম দিয়ে রাজি করায় রিধিমাকে। আর কি বান্ধুবীতো শুধু একান্ত সময় করে দিতে বলেছে প্রপোজ করবে তাই। এদিকে রিধিমার বিশ্বাস সম্রাট রাজি হবে না। তাই সবটা মেনে নিতে বাধ্য হয় কিন্তু ভেতরে ভেতরে অনুভূতিরা ঠিকই জানান দিচ্ছিলো একে অপরের সঙ্গে কলহ। নিউরন গুলো যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করছে।মনটা হঠাৎ বিষণ্নতায় ছেয়ে গেছিলো সেদিন। কিন্তু কারণটা অজানা ধোয়াঁশার মতো আড়ালেই রয়ে গেলো রিধিমার কাছে।
তার সেই হার আর নিজের কাজে ব্যার্থতা সব মিলিয়ে নাকের জলে চোখের জলে। বিষণ্নতা ঠেলে দরজার কাছে ফিরে সবমিলিয়ে হুরমুর করে ঘরে ঢুকে গেলো রিধিমা। তাকে এভাবেই হন্তদন্ত আসতে দেখে বিছানায় বসে ফোনে চোখ বুলালো সম্রাট নিজেকে যথাসম্ভব ব্যাস্ত দেখানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু রিধিমা কোন গ্রাহ্য করলো না এসে সরাসরি সম্রাটের পা ধরে বসে পরল। হতভম্ব হয়ে সম্রাট রিয়েশকশন দিতে ভুলে গেলো রিধিমা যে আবার ফিরে এসে ওর পায়ে পড়ে যাবে কল্পনাতেও আসেনি ওর।
_ রিধি ওঠ আমার পা ছাড়! ধর্য্যের সীমা পার হয়ে গেলেকিন্তু খবর আছে তোর ছাড় আমার পা।
কন্ঠে রুঢতা মিশিয়ে বলে যাচ্ছে সম্রাট আর বিছানা থেকে উঠে দাড়িয়ে পা ছাড়ার চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ তারপর ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো সম্রাট। রাগ তরতর করে বাড়ছে। অযথা কান্না করার বা এতো অনুনয় কেনো করছে রিধিমা বুঝতে পারছেনা। সম্রাটের মতিষ্ক তাকে বলছে রিধিমা খুব করে চাইছে ওর আর নীলির রিলেশনটা যাতে হয়। ক্রমশ তার হাত পা শরীর শক্ত হয়ে যাচ্ছে রাগটা আকাশচুম্বি।
এদিকে রিধিমা ভাবছে একটুর জন্য হলেও নীলির সঙ্গে দেখা করে সম্রাট সবটা শুনুক। সম্রাটের পা জরিয়ে সেদিন জারিফার জন্মদিনের সমস্ত কথা খুলে বলল রিধিমা বরং বানিয়ে বানিয়ে আবেগ দিয়ে নীলির হয়ে সাফাই গাইলো। আর খুব সন্তপনে গেমে হেরে এমনটা করার বিষয়টি লুকিয়ে ফেলল।সে জানে ওটা বললে সম্রাট তাকে আস্ত খেয়ে ফেলবে!
এসব শুনে রেগেমেগে বের হয়ে যায় সম্রাট। রিধিমা ওভাবেই বসে থেকে হুহু করে কেদেঁ উঠলো কিন্তু বুঝতে পারছে না ও কেনো কাদঁছে। এই কান্নাটা তো পুরোটাই দেখানো তবে?
২.
চিরপরিচিত আড্ডায় বসে সিগারেট খাচ্ছে সম্রাট। চোখদুটো লাল টকটকে হয়ে আছে। একটু আগে কম্পানি দিতে বন্ধুদের ফোন দিয়ে ডেকে পাঠায় সে। জলন্ত অগ্নিপিন্ডের মতো লেলিহান শিখা তার কঠিন আবরনে ঢাকা হৃদয়টাকে জ্বালিয়ে ছাড়খার করছে। হৃদ,সৌভিক,সাম্য,মুরাদ হন্তদন্ত হয়ে বাইক থেকে নেমে সম্রাটের সামনে বসে ওর বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে জিগ্যেস করলো,
_ সম্রাট এনিথিং হ্যাপেন্ড তোকে এমন লাগছে কেনো?~ হৃদ
বাকি সবাই হৃদের স্বরে সাই দিয়ে জিগ্যেস করলো। কাউকেই উত্তর না দিয়ে হাতে থাকা অষ্টম সিগারেটা ফেলে দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে সবটা বলল
_ আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা রিধিমা তোকে নীলির সঙ্গে সম্পর্ক করিয়ে দিতে উঠেপরে লেগেছে। মেয়েটা কি বুঝবে না কোনদিন তোকে? ~ সৌভিক
_ যেখানে নিজের ভালোবাসা নিয়ে আগানোর সময় সেখানে এতোবড় ঝটকা?ভাই সম্রাট তুই তোর প্রিসিয়াস হার্টটা দেওয়ার মতো ম্যাচিউর মেয়ে পেলিনা?চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল হৃদ।
সম্রাট নিজেও দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকালো মনটা হঠাৎ তার কঠিন আবরণে ফিরে আসছে। তাকে তৈরি হতে হবে আসন্ন দিনগুলোর জন্য নিজেকে ভেঙে পরতে দিতে পারে না সে।
~চলবে
#হৃদয়ের_কথা
প্রজ্ঞা জামান তৃণ
|গল্পটা কি চলবে?কমেন্ট করে বলবেন কেমন হয়েছে |