#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_২১
#জান্নাতুল_নাঈমা
____________________
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষে ইমনদের বাড়ি থেকে আসা আত্মীয়-স্বজন সকলেই চলে গেলো। মুরাদ,দিহান সহ মুরাদের কাজিনরা মিলে সকলকে গাড়ি অবদি এগিয়ে দিলো। গায়ে হলুদের কিছু নিয়ম কানুন ছিলো যা রিমির মা মুসকানের চাচি বাথরুমে ঢুকে পালন করে বেরিয়ে এলেন। লম্বা এক শাওয়ার নিয়ে একঘন্টা পর মুসকানও বেরিয়ে এলো। চোখ, মুখ লাল হয়ে আছে তার। একদিকে সারাদিনের ধকলে শরীরটা দুর্বল লাগছে, অপরদিকে কাল থেকে ইমনের সঙ্গে তার বিন্দু যোগাযোগও হয়নি। যা থেকে স্পষ্ট ইমন তার ওপর ভয়ংকর রেগে আছে। এতোটাই রেগে আছে যে মানুষ’টা না একটা টেক্সট করছে, না একটা কল করছে। কিন্তু তার তো রেগে থাকলে চলবে না। তাই মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে দরজাটা ভিতর থেকে লাগিয়ে দিলো। তারপর বিছানার একপাশে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে দুরুদুরু বুকে কল করলো ইমনের ফোনে। দু’বার রিং হওয়ার পরও যখন ফোন রিসিভ হলো না তখন দুচোখ ভর্তি জল ছেড়ে দিলো মুসকান। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বেশ কয়েকবার কল করলো কিন্তু না একবারো রিসিভ হলো না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো মুসকানের। বুকের বা পাশে চিনচিনে এক ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। কেন এতো কষ্ট দিচ্ছে ইমন? তার দেওয়া ভালোবাসা যতোটা না সুখ দেয় তার দেওয়া কষ্ট গুলো তোতোটাই তীক্ষ্ণ হয় কেন? মরিয়ম আক্তার দরজায় ঠকঠক শব্দ করছেন আর মুসকান’কে ডাকছেন। মুসকান ত্বরিতগতি’তে দুচোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে দরজা খুলে দিলো। স্মিথ হেসে পিছন ঘুরে বিছানায় এসে বসলো। মরিয়ম আক্তার দু’হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে এসে বিছানায় রেখে বললো,
“কিরে মুখটা এমন লাগছে কেন? চোখ গুলো ডেবে গেছে কেমন আয় খাওয়িয়ে দেই তার পর মাথা টিপে দেবো ঘুমিয়ে যাবি। ”
মায়ের বলা বাক্যগুলো শেষ হতে না হতেই ডুকরে উঠলো মুসকান। মরিয়ম আক্তার মেয়ের কান্না দেখে নিজেও কেঁদে ফেললেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“কাঁদিস না মা এটাই তো নিয়ম প্রতিটি মেয়েকেই বিয়ের পর স্বামীর সংসারে যেতে হয়৷এ সময়টা অনেক কঠিন মা তবুও মেয়েদের এ সময়টা মানিয়ে নিতে হয়। শতকষ্ট হলেও যেতে হয় শ্বশুর ঘরে। ”
ব্যাথাটা এবার যেনো দ্বিগুণ ভাবে মুসকানের হৃদয়ে নাড়া দিলো। তার বিয়ে সত্যি সত্যি কাল তার ইমনের সঙ্গে বিয়ে। ভালোবাসার মানুষটিকে স্বামী রূপে পাবে সে। সারাজীবনের জন্য প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হবে মানুষটার সঙ্গীনী হওয়ার। সেই সাথে মা,ভাইয়া’কে ছেড়ে চলেও যাবে। এরপর হয়তো মা, ভাইয়ের কাছে আসবে কিন্তু সেই সময়টা আর এখনকার সময়টা হবে সম্পূর্ণ আলাদা। সব দুঃখ,কষ্ট একবারে চেপে ধরলো মেয়েটাকে। মা’কে জড়িয়ে ধরে অনেকটা সময় কেঁদেই চললো।
.
বুকের ভিতর কি যে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে মুসকানের তা সে কাউকে বোঝাতে পারবে না। বিয়ে নিয়ে কতোটা এক্সাইটেড ছিলো সে। তার সকল এক্সাইটমেন্ট ইমন এক নিমিষেই নিঃশ্বেষ করে দিল। পুরো দু’টো রাত একটি দিন মানুষ টা একটুর জন্যও তার সাথে দেখা তো দূরের কথা একটু কথাও বলেনি। চারদিকে ফজরের আজান ধ্বনি বাজছে। সারারাত একটুও ঘুম হয়নি মুসকানের। জাগ্রত ঘুমে বিভোর ছিলো সে। একটু পর পরই ফোন দেখেছে এই বুঝি ইমন একটা টেক্সট করলো,এই বুঝি ইমন একটা ম্যাসেজ করলো। বরাবরই ফলাফল শূন্য।মেঝেতে তাকিয়ে দেখলো মরিয়ম আক্তার নামাজরত অবস্থায় রয়েছে। আর তার পাশে সায়রী ঘুমাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওঠে বসলো মুসকান। শুকনো এক ঢোক গিলে ইমন’কে একটা টেক্সট দিলো। তারপর অজু করে এসে নামাজ শেষ করে ফোন হাতে নিয়ে আবারও কল করলো ইমন’কে। ঘুমের ঘোরে ফোন রিসিভ করে ‘হ্যালো বলতেই মুসকানের হৃৎস্পন্দন থেমে গেলো। মরিয়ম আক্তার কোরান শরীফ পড়ছেন মুসকান রুমের বাইরে গিয়ে একহাতে বুকের বামপাশে চেপে ধরে রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে বললো,
“নানাভাই সরি… ”
ইমন ঘুম জড়ানো কন্ঠে উত্তর দিলো,
“সরি দিয়ে আমি কি করবো আমার দরকার তোমাকে। আই নিড ইউ,আই নিড ইউর এভরিথিং। ফোন রাখো ঘুমাতে পারলে ঘুমিয়ে নাও। কারণ আজকের পর আবার কবে ঘুমানোর সুযোগ পাবে আই ডোন্ট নো। ”
বুকের ভিতরটা মারাত্মক পর্যায়ে কেঁপে ওঠলো মুসকানের। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া ছাড়ছে যেনো। হঠাৎ করেই ইমন কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। গতদিন কথা না বলে তাকে এতো কষ্ট দিয়ে আজ একটু খোঁজও নিলো না। নিজের মতো কথা বলতে শুরু করেছে। তবে কি ইমন পালটে যাচ্ছে? একদিনের ব্যবধানেই এমন পরিবর্তন কারো হয়? কেন করছে ইমন এমন সে কি বুঝতে পারছে না তার হৃৎপিণ্ডের কষ্ট হচ্ছে, তার মুগ্ধময়ী খুব কাঁদছে…
ফোন কেটে দিয়েছে ইমন। ব্যর্থ মুসকান ছোট্ট একটি শ্বাস ছেড়ে রুমে ঢুকলো। চেয়ার টেনে বসে চোখ বন্ধ করে রইলো দীর্ঘ সময়৷ বুকের ভিতর কেমন ধকধক করছে। চাপা এক কষ্ট হচ্ছে যেই কষ্টের সঠিক কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সে। আবার হয়তো খুঁজেও পাচ্ছে। দু’টো কারণ এক.ইমনের ইগনোর,দুই.আজ তার বিয়ে।
__________________
গাঢ় খয়েরী রঙের বেনারসি’টা মনে হয় পৃথিবীর অন্য কোন রমণীর জন্য নয় কেবল মুসকান নামক এই রমণীর জন্যই তৈরি করা হয়েছে। বাঙালি আকারে বেনারসি পড়ানোয় অদ্ভুত রকমের সৌন্দর্য ঘিরে ধরেছে ওকে। সে যে বাঙালি বউ এটা নিঃসন্দেহে বুঝে ফেলা যাবে। তার সাজেও বাঙালিয়ানার কমতি রাখেনি রিক্তা। মাথার মাঝবরাবর দোপাট্টা’টি অতি সন্তর্পণে গেঁথে আছে। চুল থেকে কপালের আগ বরাবর জড়োয়াটিই যেনো ছোট্ট মুখশ্রী’তে রাজস্বী ভাব স্পষ্ট ফুটিয়ে তুলেছে। নাকের নোলকটা যেনো তার বধুবেশের স্পষ্ট এক উদাহরণ। গলা থেকে পেট অবদি ভারী ভারী গহনায় ভরা। হাত,পা,কান, গলা, নাক সর্বাঙ্গেই স্বর্ণের অলংকারে সজ্জিত আজ সে। আর এ সাজ শুধুই ইমনের জন্য।
কনে সাজে বোন’কে দেখে চোখটা জুড়িয়ে গেল মুরাদের। সম্মুখে পুতুলের ন্যায় এক রাজরানীই যেনো দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দু’টো টলমল করছিলো মুরাদের। বোনের দুগালে আলতো ছুঁয়ে কপালে চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বললো,
“আমার মুসু যে অনেক বড়ো হয়ে গেছেগো রিমি। দেখ আমার মুসু’কে একদম রাজরানীর মতো লাগছে। ”
আবেগে আপ্লুত হয়ে মুসকান কেঁদেই ফেললো। চোখে জল রিমিরও। মুরাদ বোনকে তৃপ্তি সহকারে দেখে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“আরে পাগলী কাঁদার কি আছে সন্ধ্যায় যাবি সকাল সকালই এসে পড়বি। একটুও কাঁদবি না দাদাভাই আছে তো…”
দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো সায়রী। বললো,
“হুম তাই তো দাদাভাই আছে নানাভাইও আছে মুসুরানীর কান্না কেন হুম? ”
মুরাদ সায়রীর দিকে তাকিয়ে কুটিল হেসে বললো,
“ওমা সায়ু তোকে তো শাড়িতে বুড়ি বুড়ি লাগছে আর আমার মুসুকে দেখ পুরোই রাজরানী। ”
সায়রী ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,
“এই মুসু বলতো কেমন লাগছে আমি বাবা এই শাড়ি টারি একদম পছন্দ করিনা। তোর কাজিন সিস্টার্সদের জ্বালাতনে পড়তে বাধ্য হলাম। ”
মুসকান ক্রন্দনরত অবস্থায় মৃদু হেসে দিলো। রিমি বললো,
“আপু তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে এ প্রথম তোমাকে শাড়িতে দেখছি। দিহান ভাইয়া তো চোখের পলকই ফেলছিলো না আজ। লুকিয়ে লুকিয়ে খুব দেখছে তোমায়। ”
সায়রীর মুখটা ছোট হয়ে গেলো। মুরাদ রিমির দিকে চোখ রাঙিয়ে সায়রী’কে তাগাদা দিয়ে বললো,
“এই সায়ু তুই মুসুর সঙ্গে থাক আর কোন কাজ নেই তোর আমি ওদিকটা সামলাই ওদের আসার সময় হয়ে গেছে। ”
সায়রী সম্মতি দিতেই মুরাদ বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে রিমিকে শাসনী স্বরে বললো,
“আক্কেল জীবনে হবেনা তাইনা? কোথায় কি বলতে হয় আজো শেখাতে পারলাম না। আল্লাহ জানে বাচ্চা টা মায়ের মতো মাথামোটা হয় কিনা! ”
.
ইমনদের বাড়ি থেকে ইমনের কাজিন’রা প্রায় সকলেই এসে উপস্থিত হয়েছে। এরা এসেই বউ দেখার জন্য বেশ তাগাদা দেওয়া শুরু করেছিলো। কিন্তু কনে পক্ষের কেউই হুটহাট বরপক্ষ’কে কনে দেখাতে রাজি নয়৷ এই নিয়ে বরপক্ষ কনেপক্ষের মাঝে বেশ ঝগড়াই বেজে গেলো। ঝগড়ার মূলে রয়েছে দু’পক্ষেরই মহিলা পার্টি। এক পর্যায়ে ইমনের ফুপাতো বোন আলিয়া সিরিয়াস রেগে গেলো। রেগে গিয়ে সরাসরি ইমনকেই কল করলো সে। এদিকের খবর পেয়ে ইমন মুরাদ আর দিহান’কে ফোন দিয়ে গালি দিলো কয়টা তারপর বললো,
” এসব ঝামেলা যদি দশমিনিটের মধ্যে না মেটাতে পারিস সোজা গিয়ে বউ নিয়ে চলে আসবো। এতো প্যারা আর ভাল্লাগছে না। ”
ইমনের এহেন কথা শুনে মুরাদ হন্তদন্ত হয়ে মুসকানের রুমের সামনে যায় তারপর রিমি,সায়রী আর মামাতো বোনদের বেশ জোরেসোরে এক ধমক দেয়। আর আলিয়াদের বলে ভিতরে যেতে। মুরাদের ধমকে রিমি কেঁদেই দিলো সায়রী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি’তে তাকিয়ে শুধু বললো,
“এইসবের ভিতর নাক গলিয়ে ভালো করলিনা মুরাদ। ”
সায়রীর কথা শেষ হতেই দিহান বললো,
“সায়ু…ইমন ফোন করেছিলো। ”
দিহানের কথা শুনে সায়রী আরো দ্বিগুণ রেগে গেলো। কিন্তু আলিয়ারা খুশিতে গদগদ হয়ে হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়লো।
সকলে ভিতরে গিয়ে এমন হট্টগোল শুরু করলো যে পাঁচমিনিটেই মাথা ধরে গেলো মুসকানের। আলিয়া,অভ্র বাদে চারদিকে শুধু অপরিচিত মুখ। সে অপরিচিত ব্যাক্তিরা এসে গা ঘেঁষে ঘেঁষে ছবি তুলছে। শুধু মেয়েরাই নয় ইমনের ভাই,ব্রাদার অপরিচিত যারা আছে তাঁরাও এসে ছবি তুলছে। একজন যখন মুসকানের কাঁধ জড়িয়ে সেলফি নেওয়ার চেষ্টা করলো মুসকান বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। তারপর চোখে,মুখে বিরক্তি প্রকাশ করে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো নিজেদের কেউ আছে কিনা৷ কিন্তু না কেউ নেই। এরই মধ্যে দু’পাশ থেকে ছেলেরা এসে ওকে ঘিরে ধরে ছবি ওঠাতে শুরু করলো। কান্না পেয়ে গেলো মুসকানের। এ কোন বিপদের সম্মুখে পড়লো সে!
আলিয়াকে যে কিছু বলবে তারও উপায় নেই। সে সবার সঙ্গে সেলফি নিতে ব্যাস্ত। এক পর্যায়ে মাথা ঘুরাতে শুরু করলো মুসকানের। গিজগিজে মানুষের ভীরে এমন অস্বাভাবিক আচরণে ফাপর হয়ে গেলো মেয়েটা। অভ্র তখন ভ্রু কুঁচকে মুসকানের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মুসকান তা লক্ষ করে অভ্রকে ইশারা করলো। অভ্র হয়তো কিছু টা বুঝতে পেরেছিলো। তাই মুসকানের পাশে থাকা ছেলেগুলোকে টেনে টুনে কিসব বুঝিয়ে দুরে সরিয়ে নিলো। মুসকান একটু স্বস্তি নিয়ে আবারো বিছানায় বসলো। তারপর ফোন খুঁজে বের করে ইমন, সায়রী,রিমি তিনজনকে একই ম্যাসেজ সেন্ট করলো। সঙ্গে সঙ্গে সায়রী,রিমি ছুটে এলো ইমনও কল করলো তাকে। ইমনের ফোন পেয়ে কেঁদেই ফেললো মুসকান। ইমন ক্ষুব্ধ স্বরে বললো,
“অভ্র’কে ফোন দাও। ”
মুসকান তাই করলো অভ্রকে ইমন কি বললো বোঝা গেলো না কিন্তু তার মিনিট কয়েক পরেই পুরো রুম ছেলে বিহীন হয়ে গেলো। তার পরপরই ইমন আলিয়াকে ফোন করলো চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
” একজন্য তোদের ভিতরে ঢোকার ব্যবস্থা করেছি আমি? তোদের সাথে অতোগুলো ছেলেরা কেন গেলো আন্সার মি! সার্কাস দেখতে গেছিস ওখানে কোন সার্কাস হচ্ছে না। ক’জন ছিলি ভিতরে কেকে ছিলি পাই টু পাই ম্যাসেজ করে পাঠাবি তারপর বাকি হিসাব নিবো। ”
চারদিকে থমথমে এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে গেলো। আলিয়ার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সে প্যান্ডেলের ভিতরের একটি চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। কিছু সময়ের ব্যবধানেই বরের গাড়িও চলে এলো। গেটের এপারে মেয়ে পক্ষ ওপারে ছেলে পক্ষ দাঁড়িয়ে আছে। মেয়ে পক্ষের সাথে সায়রী’কে দেখে দিহান তৎক্ষনাৎ ছেলে পক্ষে চলে গেলো। ইমনকে মিষ্টি সরবত খাওয়িয়ে যখন মুসকানের মামাতো বোন লম্বা হাঁক ছেড়ে দুলাভাই ডাক দিলো, ডান হাত চুলকাতে চুলকাতে মিষ্টি করে হাসলো দিহান তখন টিটকারি মেরে বললো,
“কি বেয়াইনসাহেবা আপনার চুলকানি বাড়ছে নাকি?”
“আরে আরে ওল্ড দুলাভাই যে কন কি ধপাধপ বিশ হাজার ছাড়েন তারপর দেখাইতাছি চুলকানি বাড়ছে না কি বাড়ছে। ”
“ওল্ড ইজ গোল্ড শালিসাহেবা তা বিশ হাজার দিলেই চলবে তো? ”
“আরে আরে বলেন কি সবে তো সূচনা পর্ব উপসংহার অবদি পৌঁছাতে হবে তো। ”
দিহান আর মুসকানের মামাতো বোনের কান্ড দেখে জোর পূর্বক হাসি থামিয়ে রাখলো সায়রী। ইমনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“ইমন কনেপক্ষের চাহিদা মিটাও। ”
দিহান তৎক্ষনাৎ বললো,
“এসব কি কথা ছিঃ আমার বন্ধু কনে ছাড়া কারো চাহিদা মিটাবে না, আমার বন্ধু ক্যারেক্টারলেস না। ”
এমন একটা কথা দিহান বলে ফেলবে যা ভাবার বাইরে ছিলো। বিষয়টা ইমনেরও পছন্দ হলো না। কিন্তু বর হওয়ার দুরুণ কিছু বলতেও পারলো না। কিন্তু সায়রী চুপ করে রইলো না। মুখ্যম জবাব সে দিলোই,
“ওওও আচ্ছা তো আপনি বুঝি ক্যারেক্টারলেস? ”
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি করলো দিহান তারপর নিজের পকেট থেকে একটি এক হাজার টাকার নোট আরেকটি বিশ টাকার নোট বের করে সায়রীর হাতে প্রথম বিশ টাকা দিয়ে বললো,
“এই যে বিশ। ”
তারপর হাজার টাকা দিয়ে বললো,
“এই যে হাজার ইজ ইকোয়াল বিশ হাজার ডান। ”
বরপক্ষের সকলেই হোহো করে হেসে ওঠলো। কনে পক্ষরা তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠলো। সায়রী হাতে থাকা টাকাটা মুচড়ে দিহানের মুখের ওপর ঢিল দিয়ে চলে গেলো। ইমন বুঝলো সায়রী সিরিয়াস রেগে গেছে। তাই তার পাশে থাকা অপর বন্ধু টিকে চাহিদা অনুযায়ী পাঁচ হাজার বেশি টাকাই দেওয়া হলো। পরিবেশ শান্ত শিষ্ট করে মুরাদ আর মরিয়ম আক্তার এসে ইমনকে হাতে আংটি, ঘড়ি পড়িয়ে দিয়ে বরের বসার জায়গায় নিয়ে বসিয়ে দিলো।
.
চলে এলো কাঙ্ক্ষিত সেই সময়টি। যে সময়টি সাক্ষী হবে দু’জন নরনারীর প্রণয় থেকে পরিণয় নিশ্চিত করার। কিন্তু কে জানতো এই সময়টিতে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরী হবে! যাকে পাওয়ার জন্য এতো মরিয়া হয়ে ওঠেছিলো মেয়েটি, যার দূরত্ব এতো পুড়িয়ে ছিলো মেয়েটাকে তার বউ হওয়ার জন্য তিন কবুল কেন বলছে না সে। কেন কান্নাকাটি করছে? সকলেই বলে প্রতিটি মেয়েই নাকি বিয়ের সময় তিন কবুল বলা কানীন কান্নাকাটি করে। সে হিসেবে মুসকানের কান্নাটার জন্যও তারা কেউ বিচলিত হচ্ছে না৷ কিন্তু ইমন যে সকলের মতো নয়। সে ঠিক বিচলিত হচ্ছে। তাঁদের দুজনের মাঝখানে যে লাল পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছিলো তা এক হাতে উঁচিয়ে মুসকানের দিকে চেপে বসলো ইমন। সকলের সম্মুখে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“এই কান্নার অর্থ কি মুসকান? এভাবে কান্না করোনা তাহলে হয়তো সকলে ভেবে নিবে এই বিয়েতে তুমি নারাজ। বিয়েটা সারাজীবনের ব্যাপার সকলকে শুনিয়ে কবুল বলতে হবে না। তুমি কেবল আমায় নিশ্চিত করো, তুমি কি কবুল বলেছো?”
মুসকান কাঁদতে কাঁদতেই মাথা ঝাঁকালো। ইমনের দাদি ঘোর বিরোধিতা করে বললো,
“এই মেয়ে মুখে কুলু পাতছো কেন? বিয়ে করতে মন চায় কবুল বলতে মন চায় না কেন? কবুল বলো। ”
ইমন শান্ত দৃষ্টি মেলে বললো,
“প্রয়োজন নেই দাদি ও বলে দিয়েছে। ওর যে বিয়েতে মত আছে তা সকলেই জানি। এতোগুলো মানুষের ভীরে মুখে স্পষ্ট নাই বা বললো মনে মন বললেই হবে বিয়েতে কবুল যে সকলকে শুনিয়েই বলতে হবে এমন কোন বিধান আমাদের ধর্মে নেই,এটা আমাদের সমাজেরই প্রচলিত নিয়ম। ”
মুরাদ তখন বললো,
“ইমন এতো ঝামেলার দরকার নেই, মুসু তুই সকলকে শুনিয়েই বল। ”
ইমন শান্ত গলায় বললো,
“আমার কোন অসুবিধা নেই। ”
ওদের সম্মুখে থাকা হুজুরটি আবারো নিয়ম অনুযায়ী বাণী আওড়িয়ে মুসকান’কে কবুল বলতে বললো। হয়তো অনেক সময় লাগলো তবে সকলের তাগাদায় তিন কবুল স্পষ্ট ভাবে বলেই দিলো মুসকান। সকলের মুখেই ফুটে ওঠলো তৃপ্তির হাসি। চোখ বুজে ফেললো ইমন লম্বা এক শ্বাস ছেড়ে তার স্থানে গিয়ে বসলো সে। কিন্তু মুসকান? সে তো ঘোরে আছে। তার অনুভূতি যে ব্যক্ত করে বোঝানো সম্ভব নয়। একহাত দুরে বসে থাকা ইমন মুসকানের দিকে দৃঢ় দৃষ্টি তে তাকালো। অদ্ভুত সুখের আবেশে ছেয়ে গেলো তার মনটা। দৃষ্টি দিয়ে কেবল ব্যক্ত করলো কিছু লাইন –
মনে কি পড়ে আমায়..
দেখা হয়েছিল কোন সূদুর নিলীমায়;
হয়েছিল কথা কিছুক্ষণ, আবেগে
বেসেছিলে ভালো ততোক্ষণ, সবেগে
তোমারই পরশে হয়েছিলাম আমি রিক্ত;
তা দেখে আজকে সবে অনুরক্ত।
কত শত প্রেম উজার করে দিয়েছিলে তুমি আমায়,
সর্বশেষ পরিনতিতে আজ তোমার আমার পরিণয়। (বিশ্বজিৎ মালাকার)
চলবে…