#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১৮
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
সন্ধ্যাবেলা, চারদিকে আবছা অন্ধকারে ছেঁয়ে গেছে। মেইন রাস্তা বাদ রেখে গ্রামের দিকের জনশূন্য রাস্তাটায় মনের সুখে ড্রাইভ করছে ইমন৷ তার পাশের সিটে বসে আছে মুসকান। একহাত উঁচিয়ে ইমনের কানে ফোন ধরে আছে৷ ইমন কথা বলছে তার বন্ধু রিক্তার সাথে পাশাপাশি ড্রাইভ করছে। মুসকান যে প্রশ্ন করবে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটুকুনিও করতে পারছে না। গাড়িতে ওঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ভিতরে আলো জ্বালিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে মুসকানের সিট বেল্ট লাগিয়ে দিলো। তারপর ফোন করলো রিক্তাকে আর মুসকানকে ইশারা করে বললো ফোনটা কানে ধরতে৷ অবাক চোখে তাকিয়ে ফোন কানে ধরলো মুসকান। কিন্তু এতেই ইমনের শান্তি হলো না। আবার তাকিয়ে ইশারায় বোঝালো তার দিকে তাকিয়ে থাকতে অর্থাৎ সে ড্রাইভ করবে আর ফোনে কথা বলবে আর মুসকান তার কানে ফোন ধরে থাকবে। পাশাপাশি তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে তার সুদর্শন চেহেরাখানা দেখবে। প্রায় পনেরো মিনিট এভাবে চলার পর হাত ব্যথায় মুসকান বিরক্ত হয়ে অন্যহাত দিয়ে ফোন ধরলো। এতে ইমনের দিকে একটু চেপেও বসতে হলো। ইমন মুচকি হেসে আবারো কথায় মনোযোগ দিলো। মুসকান যখন আবারো ফোন অন্যহাতে বদল করবে তৎক্ষণাৎ ইমন রিক্তার উদ্দেশ্যে বললো,
“এই এখন রাখি আমার বউয়ের হাত ব্যথা হয়ে গেছে রাতে কল দেবো। ”
ওপাশে কি বললো তেমন বোঝা গেলো না ইমন মুসকান’কে ফোন কাটতে বললো। মুসকান তাই করে নম্র গলায় প্রশ্ন করলো,
“আমরা কোথায় যাচ্ছি? ”
ইমন লম্বা এক শ্বাস ছেড়ে মাথা দুলিয়ে বললো,
“সারপ্রাইজ। ”
মুসকান এক পলক ইমনের দিকে উৎসুক দৃষ্টি’তে তাকিয়ে নতমুখে ইমনের ফোন চাপতে শুরু করলো। ফার্স্ট গ্যালারি’তে ঢুকলো সেখানে ইমন সহ তার বন্ধু-বান্ধবদের অগণিত ছবি চোখে পড়লো। অথচ তার একটা ছবিও নজরে পড়লো না। বেশ সময় নিয়ে গ্যালারির হাজার দুয়েক ছবি দেখে শেষ করলো। তবুও নিজের একটা পিকচারও পেলো না। রাগে,দুঃখে আড়চোখে একবার তাকালো ইমনের দিকে। সে মনের সুখে ড্রাইভ করছে। তার সে সুখ দেখে আরো গা জ্বলে গেলো মুসকানের তাই অভিমানে ছলছল দৃষ্টিতে ফোন ফেরত দিলো। ইমন তার দিকে না তাকিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো,
“শুধু গ্যালারি দেখলেই চলবে ম্যাম? প্রাইভেট মানুষ প্রাইভেট অ্যাপে ঢুকুন। আমার প্রাইভেট জিনিস কি আর পাবলিক প্লেসে পাওয়া যাবে নাকি? ”
কথাটি শেষ করেই মুসকানের দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপ মেরে ঠোঁট কামড়ে হাসলো ইমন৷ হৃৎপিণ্ড কেঁপে ওঠলো মুসকানের। লজ্জায় লাল হয়ে গেলো তার গাল দু’টো। মাথা নিচু করে নিজের নিঃশ্বাসের বেগ আঁটকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলো। যেনো ইমন শুনতে না পারে তার বিক্ষিপ্ত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ গুলো। তবুও সে ধরা পড়েই গেলো। ইমন ওষ্ঠকোণে তৃপ্তিময় হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। প্রায় দু’ঘন্টার জার্নি শেষে গাড়ির ব্রেক কষলো ইমন৷ মুসকান তখন ডুবে আছে ইমনের লোমহীন কখনো আবার লোমশভরা উন্মুক্ত বুকখানায়। জার্মানি’তে থাকাকালীন তার যতো রূপ সবই দেখতে পেলো মুসকান। কয়েকটা পিকে সুইমিংপুলে পা ডুবানো অবস্থায় ছিলো ইমন তার পাশে ছিলো বেশ কিছু বিকিনি পরিহিত বিদেশি নারী। যা দেখে কান্না পেয়ে যাচ্ছে মুসকানের। মনে ভিতর শুধু কয়েকটি প্রশ্ন খুঁত খুঁত করছে ঐ মেয়েগুলো ইমনের পাশে কেন ছিলো? ইমন কি ঐ মেয়ে গুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলো? অমন অবস্থায় ইমন সাদা চামড়ার ঐ মহিলাদের দেখেছে ভাবতেই মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। দুচোখ ভর্তি অশ্রুকণা গুলো কেবল পড়ার অপেক্ষা।
গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে নজর বুলিয়ে মুসকানের পাশে চলে গেলো ইমন৷ ডোর খুলে মুসকানকে নামতে বললো। অভিমানে মুসকান ফোনটা ইমনের দিকে এগিয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে নেমে দাঁড়ালো। ইমন তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে জানেনা। শহর থেকে দূরের কোন জায়গায় তা বেশ নিশ্চিত করতে পারলো। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি ভাবে যেমন অসংখ্য গাছপালা রয়েছে, তেমনি দুধারে বিস্তর জায়গা জুরে রয়েছে অথৈজল। দু’একটা গাড়ি চলাচলের ফলে রাস্তাটা ঠিকভাবে পরোখ করে নিলো মুসকান। তারপর তাকালো পশ্চিম পাশের বিস্ময়কর এক দৃশ্যের দিকে। রাস্তার পাড়ের পরেই বিস্তর জায়গায় পানি আর পানি। দেখে বোঝায় যাচ্ছে আবাদি কিছু জমি এবং খালবিল ভরে পানি এসেছে। সে পানির ওপরই ছাতার মতো সিস্টেম করে ছাউনি ঘর তোলা হয়েছে। সে ঘরে যাওয়ার জন্য বাঁশ এবং কাঠ দিয়ে সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে গ্রাম্য ভাষায় এটাকে শাকুও বলা যেতে পারে। তবে সরলরেখার থেকে কিছুটা ভিন্ন শাকু যা মুসকান সিঁড়ি হিসেবেই চিহ্নিত করলো। সিঁড়ির দুপাশে ল্যামপোস্টের মতোন থেকে থেকে দূরে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছাউনির চারপাশে দেয়াল নেই। মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালে চারপাশের শুধু পানি আর পানি দেখা যাবে। এমন মনোরম পরিবেশে মুগ্ধ না হয়ে পারলো না মুসকান।
অক্টোবর মাস চলছে, ঋতুতে শরৎকাল। অথচ আবহাওয়ায় এখনো বর্ষাকালের ভাব রয়েছে। যার ফলস্বরূপ চারদিকে থৈথৈ পানি বাড়ছে বই কমছে না। প্রকৃতির এমন আবহাওয়াতেই মুসকানকে নিয়ে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের ব্যবস্থা করেছে ইমন। শহরে পরিবেশে নয় বরং গ্রাম্য পরিবেশে। আজ সে মুসকানকে থৈথৈ জলের মধ্যেখানে প্রকৃতি’কে নব্যরূপে উপভোগ করাবে। গাড়ি লক করে মুসকানের পাশে এসে ওর হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে এগোতে থাকলো ইমন৷ যখন সিঁড়ি দিয়ে যাচ্ছিলো কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে ইমনের হাত শক্ত করে চেপে ধরলো মুসকান। ইমনও আস্থার সাথে তাকে ধরে একদম ভিতরে নিয়ে গিয়ে মাঝবরাবর থাকা গোল টেবিলের সামনের চেয়ারটায় বসতে বললো। মুসকান বসে নিচের দিকে তাকিয়ে লক্ষ করলো মেঝে পুরোটাই কাঠ দ্বারা তৈরি। চারদিক থেকে শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিতে থাকলো ওকে। কি স্নিগ্ধ অনুভূতি! ইমন ততোক্ষণে ছাউনির একপাশে দু’জন অল্প বয়সী ছেলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ফিরে এলো। কিছু সময়ের মাঝেই ছেলে গুলো সমস্ত লাইট অফ করে ফোনের ফ্ল্যায় অন করে বেরিয়ে গেলো। মুসকান ধড়ফড়িয়ে ওঠে অন্ধকারেই ইমনের পিঠ খামচে ধরলো। চমকে ওঠে ইমন দ্রুত ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে মুসকানের দিকে ধরলো। বললো,
“আরে আরে আছি আমি এতো ভয় কিসের? ”
মুসকান কোন কথা না বলে ইমনের বাহু চেপে ধরলো। ইমন অমনি তাকে বসালো চেয়ারে। কিন্তু মুসকান তাকে ছাড়লো না ইমন বলার পরও ছাড়লো না। বাধ্য হয়ে ইমন ফোন টেবিলের এক কোণায় রেখে একহাতে চেয়ার টেনে একদম মুসকানের পাশে বসলো। একহাতে অতি সন্তর্পণে মুসকানকে জড়িয়ে ধরে অপর হাতে ফ্ল্যাশ অফ করে দিলো। সাথে সাথে ভয়ে মুসকান ‘নানাভাই ‘ বলে ইমনকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে দিলো। ভয়ে ভয়ে ধমকে বললো,
“এমন করছো কেন অন্ধকারে ভয় লাগে আমার জানোনা ”
এ যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির আগমণ ঘটলো ইমনের বক্ষঃস্থলে। কিন্তু সারপ্রাইজ তো এখনো বাকিই রইলো। এতো কাঠখড় পোহিয়ে এমন একটি সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করলো আর তা কিনা নষ্ট হবে! ইমন মুসকানকে আরেকটু গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
“এমন করলে সারপ্রাইজ দেবো কি করে আমি আছিতো এখানেই এতো ভয় কিসের? ”
মুসকান আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইমনকে। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো,
“তুমি ওদের সব লাইট অন করতে বলো নয়তো আমি ছাড়বোনা। ”
“তাহলে তো লাইট অন করার প্রশ্নই ওঠে না। ”
“না তুমি এমন করবেনা আমার ভয় লাগছে। ”
“আমি এটাই করবো ”
কথাটি বলেই আচমকাই মুসকানের কানের নিচে গভীরভাবে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো ইমন। শিউরে ওঠে ইমনের শার্ট খামচে ধরলো মুসকান। নিঃশ্বাস ভারী করে অস্ফুট স্বরে বললো,
“প্লিজ এমন করোনা। ”
মৃদু হেসে ইমন মুসকানের মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে খানিকটা উঁচিয়ে ধরে ওঠে দাঁড়ালো। মুসকান তার দুপা ফেললো ইমনের পায়ের ওপরে। দুহাতে বুক জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। নিঃশ্বাসে তার তীব্র অস্থিরতা। ইমন একহাতে মুসকানকে সামলে অপরহাতে পকেট থেকে লাইটার বের করলো। তারপর টেবিলের ওপর থাকা সাদা পাতলা আস্তরণ টা ওঠিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে মাঝ বরাবর রাখা মোমগুলো জ্বালালো। তারপর মুসকানকে বললো চোখ খুলে তাকাতে। মুসকান সেভাবেই চোখ খুলে তাকালো। তারপর আচমকাই বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেলো তার তারপর অন্যমনস্ক হয়ে ইমনকে ছেড়েও দিলো। ইমন মুচকি হেসে চেয়ারগুলো ঠিক করে বসলো তারপর মুসকানকে ইশারা করলো বসতে। এক ঢোক গিলে মুসকান আবারো ইমনকে ঘেষে বসলো তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এসব আমার জন্য!”
“না আমার বন্ধুর একমাত্র বোন কলিজার টুকরা আমার একমাত্র বউ এণ্ড হৃৎপিণ্ডের জন্য কাস্টমাইজড চকলোট উইথ হার্ট শেপ। ”
দু’হাত গালে লাগিয়ে অবাক হয়ে বললো,
“হায় আল্লাহ এতোগুলা আমি খাবো কি করে সব আমার জন্য! ”
“আমার কি আরো দু’চারটা বউ আছে নাকি? ”
চলবে…
রিচেক দেওয়ার সময়ও পাইনি আমি নেক্সট পার্ট আগামিকালই দিব ইনশাআল্লাহ।