#হিমাংশুর_জলপদ্ম [৬]
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
দ্বীপ বড় বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে চোখের চাহনি মুহুর্তেই বদলে ফেললো।চোখে এবার তার জড়ো হয়েছে হাজারো ক্ষোভ আর রাগ। কুমুদের কন্ঠ নালি শক্ত হয়েছে আরও আগে।তাই চাইলেও সে কন্ঠ নালি থেকে কোনো শব্দ বের করতে সক্সম হচ্ছে না।কুমুদ দ্বীপের দিকে ভয়াতুর চাহনি দিয়ে ডান হাতের তর্জনিতে মেঝেতে পড়ে থাকা সুপ্রিয়ার নিস্তেজ দেহটা ইশারা করলো।ঠোঁট নাড়িয়ে বলার চেষ্টা করলো,
– দিদি!
তবে তা সে নিজেও শুনতে পেল কওনা সন্দেহ। দ্বীপ দাঁতে দাঁত চেপে সুপ্রিয়ার পড়ে থাকা দেহের দিকে একবার দেখে হাতের দাঁ টি নিচে ফেলে কুমুদের দিকে তাকালে কুমুদের ভাব গতি জানার জন্য।কুমুদকে এমন মমের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে এক পা এক পা করে কুমুদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো।কুমুদের চোখ জোড়া আরও বড় হয়ে গেল।সে দ্বীপে গতি বিধি বুঝতে না পেরে জমাট বাঁধা পা টাকে প্রাণপণ চেষ্টায় তুলে দৌঁড়ানো প্রচেষ্টা করলো।শক্ত শিথিল পা জোড়া উঠিয়ে দু কদম যেতেই পিছন থেকে কুমুদের ঘাড় ধরে ফেললো দ্বীপ।টানতে টানতে ঘর থেকে বের করে উঠান পেরিয়ে বাড়ির পিছনে একটি গুদামঘরে ছুঁড়ে ফেললো কুমুদের দূর্বল দেহটাকে।কোনো কিছু বুঝি ওঠার আগেই ঘরের দরজাটি বন্ধ করে দিল দ্বীপ।ধপ করে কুমুদের মস্তিষ্কে প্রাণ এলো। সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আশে পাশে কয়েকটি চটের বস্তা পর পর স্তুপ করা।ঘরটা এতোটাই ছোট যে এখানে কয়েকটা বস্তা রাখতেই এটা বদ্ধ হয়ে গিয়েছে।নেই কোনো আলো বাতাস প্রবেশের উৎস।আশেপাশে তাকিয়ে কোনো জানালাও চোখে পড়লো না কুমুদের।শুধু ছোট একটু ফাঁকা তাও অনেক উপরে যা থেকে সামান্য আলো ভিতরে প্রবেশ করলেও সে আলো পুরো ঘর আলোকিত করতে সক্ষম নয়।বস্তার স্তুপে সে ফাঁকাটুকুও বন্ধ হয়ে আছে অর্ধেক।ঘরে বিরাজ করছে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কুমুদ এবার জোরে জোরে চিৎকার করা শুরু করলো।নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে প্রচন্ড জোরে দরজায় আঘাত করে লাগলো।চিৎকার করে দরজা খোলার জন্য মিনতি করতে থাকলো,
– জামাইবাবু…দরজা খুলুন। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।দরজাটা খুলুন দয়া করে।
কুমুদ কথাগুলো বলছে আর অনবরত দরজায় বারি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আফসোস!তার কথা শোনার মতো কেউ নেই এখানে।তবু সে দমে যায় না সে তার মতো দরজায় আঘাত করতে থাকে এবং বিভিন্ন কথা আওড়াতে থাকে,
– জামাইবাবু আমাকে ছেড়ে দেন।বিশ্বাস করুন আমি কাউকে বলবো না দিদির কথা কেউ কিছু জানতে পারবে না। জামাইবাবু দরজাটা খুলুন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।আমি শ্বাস নিতে পারছি না।
কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না অপর পাশ থেকে।কুমুদ গলা ফাটিয়ে কান্না করতে থাকলো।হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো ময়লা ধূলো মেঝেতে।তার গায়ের উপর থেকে দৌড়ে গেল একটি ছোট্ট কালো ইঁদুর যা স্পষ্ট দেখা না গেলেও প্রাণীটির অদ্ভুত ডাকে বোঝা গেল এটা ইঁদুর। কুমুদ ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো।দু’কদম সরে বসলো সে।
হঠাৎই দপ দপ শব্দে কান খাঁড়া করে দিলো কুমুদ।মনে হচ্ছে ঘরটির পিছনেই কেউ শব্দ করছে।শব্দটি খুব সম্ভবত কোদাল দিয়ে মাটি কাটার শব্দ। কুমুদ উঠে দাঁড়ালো শাড়ির আঁচলটি কোমরে বেঁধে বস্তার স্তুপ থেকে কয়েকটি বস্তা নিচে ফেলার চেষ্টা করলো।আস্তে আস্তে একটি তারপর দুইটি এবং সর্বশেষ তিন বস্তা নিচে ফেলতেই লোহায় আটকানো ফাঁকা জায়গাটি উন্মুক্ত হলো।কুমুদ বাকি থাকা বস্তাগুলোর উপরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো শব্দের উৎস জানার জন্য।প্রথমবার ব্যর্থ হলো সে বস্তার উপর দাঁড়াতে। দ্বিতীয় বার আবারও ব্যর্থ হলো।তৃতীয় বার সে সফল হলো কাঁপা পায়ে উঁচু বস্তার স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে ফাঁকা জায়গাটিতে জমে থাকা মাকড়সার জালগুলো হাত দিয়ে ছিঁড়ে ফেললো সে।বাইরে চোখ যেতেই বুকের মধ্যে হাহাকার করে উঠলো তার।দ্বীপ সুপ্রিয়া রক্তাক্ত নিস্তেজ দেহটি পাশে রেখে কোদাল দিয়ে প্রচন্ড গতিতে মাটি কাটছে।যেন সে অদ্ভুত এক তাড়ার মধ্যে আছে।মাঝে মাঝে আশেপাশে তাকিয়েও দেখছে।কোনো মতে একটি গর্ত করে সুপ্রিয়াকে সেখানে ঠেসেঠুসে ঢুকিয়ে দিলো দ্বীপ।যে দৃশ্য কুমুদের ছোট্ট হৃদয়টাকে কাঁপিয়ে দিলো।ব্যস্ত হাতে পাশে স্তুপ করে রাখা মাটিগুলো কোদাল ভরে সুপ্রিয়ার গায়ে ঢেলে দিতে থাকলো একে একে।সম্পূর্ণ মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়ে গেলে কোদাল দিয়ে জোরে জোরে বারি দিয়ে মাটিটা সমান করে দিলো।কখনো আবার নিজের পায়ের সাহায্যেও চেপে মাটি সমান করে দিলো।হতবাক কুমুদ চিৎকার করে কেঁদে উঠলো দ্বীপকে আকুল কন্ঠে বলতে লাগলো,
– দিদিকে কেন মেরে ফেললেন জামাইবাবু দিদি তো আপনার কোনো ক্ষতি করেনি।আমাকে বের করুন এখান থেকে আমি যে এখানে থাকতে পারছি না।
কুমুদের কথায় রক্ত চক্ষু নিয়ে দ্বীপ কুমুদের দিকে তাকায়।এগিয়ে এসে লোহার রডের ভিতর থেকে হাত ঢুকিয়ে কুমুদকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়।পায়ে ব্যাথা পায় কুমুদ।দ্বীপ সেখান থেকে চলে যায়।আবারও ফিরে আসে এবং সাথে করে নিয়ে আসে চওড়া একটি কাঠের তক্তা যা দিয়ে ফাঁকা জায়গাটি আটকে দেয়।যাওয়ার আগে গলা উঁচিয়ে বললে যায়,
– এখানে পঁচে গলে মর।
অসহায় কুমুদের কাঁদতে কাঁদতে চোখের পাতা এক হয়ে যায়।হারাতে থাকে তার জ্ঞান শক্তি আর তাজা হতে থাকে স্মৃতির পাতা।চোখের পাতা এক হতেই খুলে যায় তার জীবনের কঠিন সময়ের সূচনার দৃশ্য।জ্ঞানহীন কুমুদ ঢুব দেয় অতীতের কালো অন্ধকারে।
—————
সবে তেরো বছরের অন্তিম আর চৌদ্দ বছরের সূচনা হয়েছে কুমুদের।শারিরীক বিভিন্ন পরিবর্তন বেশ আগেই হয়েছে তার।তবে সে যেন এখন তার শৈশব থেকে বের হতে পারেনি।উঠানে দাড়িয়ে হাতের চাঁড়াটা দূরে ছুঁড়ে মেরে একপা উঠিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে কুমুদ।গায়ে তার আড় পাড়ে পরা একটি হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি। যার আঁচলটি কুমুদের কোমরে শক্ত করে বাঁধা। ঘন কালো চুলগুলো দিয়ে দুপাশে দুটো মোটা মোটা বিনুনি করা।কামিনী এক কেজি আলু হাতে বাড়িতে ঢুকলো।কুমুদকে এই কাট ফাটা রোদে উঠানে খেলতে দেখে রাগি কন্ঠে বললো,
– কিরে কুমুদ তোর কি জীবনেও বোধ বুদ্ধি হবে না?এই কাট ফাটা রোদে কেউ এভাবে খেলে?
কুমুদ তার সৌভ্যগের চাঁড়াটি হাতে তুলে নিলো কোমর থেকে শাড়ির আঁচলটা খুলে চাঁড়াটি স্বযত্নে আঁচলে বেঁধে ফেললো।দিদির উদ্দেশ্যে বললো,
– খেলার কি আবার সময় অসময় আছে নাকি রে দিদি?
কামিনী কুমুদের হাত ধরে মাস্টারমশাইয়ের মাটি দিয়ে উঁচু করে বানানো বারান্দায় বসলো।এ বারান্দা-ই তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল।কামিনী শাড়ির আঁচল দিয়ে কুমুদের কপালে,ঠোঁটের উপরে আর নাকে জমা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছে দিলো।এক হাতে কুমুদের ডানগালটি ধরে বললো,
– দেখেছিস মুখটার কি অবস্থা করেছিস?এভাবে গায়ের রং কালো হয়ে গেলে তোকে তো আর কেউ বিয়ে করবে নারে বোন।তখন তোকে আমার মতো আইবুড়ো থাকতে হবে।দেখলি না আমি কালো বলে আমাকে গাঁয়ের কেউ বিয়ে করলো না।
– আমি তো বিয়ে করতেই চাই না রে দিদি।গায়ের রং কালো হলে তো ভালো তোকে ছেড়ে আমাকে আর কোথাও যেতে হবে না।
– তা বললে কি হবে?মাস্টারমশাই কি আজীবন আমাদের তার এ বারান্দায় রাখবে?আমাদের তো নিজেদের পথ দেখতে হবে রে বোন।
– তাহলে চলো আমরা নদীর পাড়ে একটা ঘর বানায়।সেখানে দু’জনে খুব আয়েশ করে থাকবো।
– ধূর!তুইও না।শোন পাল বাড়ির বড় ছেলের তোকে মনে ধরেছে তোকে বিয়ে করতে চায়।মাস্টারমশাইয়ের সাথে নাকি কথা বলেছে।যাক তোর কপাল আমার মতো না। বাঁচলাম এবার আমি মরেও শান্তি পাবো।
– মনে ধরেছে তা আমি কি করবো?দিদি আমি কিন্তু বলে দিচ্ছি ওসব বিয়ে টিয়ে আমি করতে পারবো না কিন্তু।
– বোকা মেয়ে তা বললে কি হয়?বিয়ে না করলে যে পাঁচ গাঁয়ের মানুষ পাঁচ কথা বলবে তা শুনতে পারবি তুই?ছেলের বাপের এক বিঘা জমি আছে আর আটচালার একটা ঘর তুই আর না করিস না বোন। এমনিতেই অনেক সমস্যার মধ্যে আছি।
কুমুদ কোনো কথা বললো না।উঠে হাঁটা ধরলো নদীর পাড়ের উদ্দেশ্যে।যেতে যেতে রাস্তায় দেখা হলো পাল বাড়ি বড় ছেলে ইন্দ্র পালের সাথে সে খালি গায়ে ধুতি পরে দাঁড়িয়ে আছে মাটির রাস্তায়।কুমুদকে আসতে দেখে বেশ ত্যাড়া গলায় বললো,
– কিরে তুই রাস্তায় রাস্তায় কি করস?
কুমুদ তার কথার কোনো উত্তর দিলো না।পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে ইন্দ্র তার হাতের কব্জি খাঁমচে ধরলো।কুমুদ মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো।নাক মুখ কুঁচকে বললো,
– হাত ছাড়ুন।
ইন্দ্র দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
– খুব বেশি দেমাগ দেখি তোর।সব দেমাগ এক্কেবারে ঘুচাই দিমু।খাঁড়া কাইল তোর মাস্টারমশাইয়ের লগে কথা কমু।
কথাটা বলেই কুমুদের হাত ঝাড়া দিয়ে ছেড়ে দিল।কুমুদ চোখ ভরা পানি নিয়ে টলমল পায়ে এগিয়ে গিয়ে নদীর পাড়ে বসলো।নদীর প্রচন্ড বাতাসে কুমুদের চোখে জমা পানিগুলো গড়িয়ে পড়লো।
চলবে…