#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৪।
রাত দুইটা পনেরোতে রিতার হঠাৎ ঘুম ভাঙে। খেয়াল করে সাদরাজ পাশে নেই। উঠে বসে রিতা। ওয়াশরুমে খেয়াল করে, সেখানেও নেই। রিতা আস্তে আস্তে বিছানা ছাড়ে। বারান্দার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। অন্ধকারে লাল ফুলকির মতো এক আলোর উঠা নামা দেখা যাচ্ছে। রিতা ছোট পায়ে এগিয়ে যায়। সাদরাজের পাশে দাঁড়ায়। মৃদু সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘ঘুমাচ্ছেন না কেন?’
সাদরাজ নিরব, নিস্তব্ধ। যেন কথা বলতেও আজ আর ইচ্ছে করছে না। সাদরাজের সামনে ফাঁকা জায়গাতে রিতা গিয়ে দাঁড়ায়। সাদরাজের মুখপানে চাওয়ার চেষ্টা করে। যদিও অন্ধকারে তার মুখ অস্পষ্ট। রিতা আলতো হাতে সাদরাজের গাল স্পর্শ করে। সাদরাজ এতে কপাল কুঁচকায়। সিগারেট’টা মুখ থেকে সরিয়ে রিতার মুখ বরাবর নিশ্বাস ছাড়ে। রিতা খুকখুক করে কেশে উঠে। সাদরাজ গম্ভীর স্বরে বলে,
‘আমাকে সহ্য করতে পারবে না, রিতা। তোমার কষ্ট হবে।’
রিতা মৃদু হেসে। বলে,
‘এতদিন তো কষ্ট পাচ্ছিলাম’ই। আরেকটু কষ্ট পেলে কিছু হবে না।’
সাদরাজ নিরব। রিতা কেন বুঝতে চাইছে না? সাদরাজ সিগারেট’টা নিচে ফেলে, পা মাড়িয়ে দেয়। হুট করেই রিতার কোমর জড়িয়ে ধরে। কাছে টেনে নেয়। রিতা নিমিষ চেয়ে থাকে। সাদরাজ রিতার কপালে কপাল ঠেকায়। তার কন্ঠস্বর কেন যেন কাঁপছে। কিছু বলতে গিয়েও বার বার জড়িয়ে যাচ্ছে। সাদরাজের উষ্ণ নিশ্বাসে রিতার বুক ঢিপঢিপ করছে। সাদরাজ জোরে শ্বাস টানে। থেমে যাওয়া কন্ঠে বলে,
‘আমার আর কেউ নেই, রিতা। আমার কাছ থেকে সবাই হারিয়ে গিয়েছে। মা, বাবা, রাবীর, সবাই। আমার কষ্ট হচ্ছে, রিতা। বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি এখন কীভাবে থাকব? আমার বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছে। কীভাবে এই ব্যথা যাবে বলতো? আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।’
রিতার গালে ভেজা স্পর্শ পেয়ে বুঝতে পারে, সাদরাজ কাঁদছে। রিতা দুহাত দিয়ে সাদরাজের মাথা তুলে। তারও কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে। যে মানুষটা কিছু সময় আগেও তার বড্ড অপছন্দের ছিল, তার প্রতি এখন হঠাৎ এত মায়া কেন জাগছে? কেন বুকের ভেতরে এমন খা খা করছে? রিতা কিছুক্ষণ সাদরাজের দিকে চেয়ে মৃদু সুরে বলে,
‘আমি কি আপনার কেউ না?’
সাদরাজ নির্বিকার। কী বলবে সে? রিতার কী পরিচয় দিবে? এত অন্যায় করার পরও এই মেয়েটাকে নিজের স্ত্রী বলে পরিচয় দেওয়ার অধিকার কি আদৌ তার আছে?
সাদরাজের নিরবতায় রিতা প্রশ্ন তুলে,
‘চুপ কেন? বলুন, আমি কি আপনার আপন না?’
‘তোমাকে আপন বলতেও বুক কাঁপছে আমার। আমি আমার নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। এই যন্ত্রণা থেকে নিজেকে কীভাবে মুক্ত করব? তুমি বলো, কীভাবে প্রায়শ্চিত্ত করব?’
রিতা তপ্ত শ্বাস ছাড়ে। বলে,
‘আমাকে আপন করে নিন। একটা সুন্দর জীবন দিন। অন্যায় করছেন, কষ্ট পাচ্ছেন। নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়েছেন। ব্যস, এইটুকুই। এবার অল্প অল্প করে জীবন গুছিয়ে নিন। ভালো কাজ করুন। নতুন করে ভালোবাসতে শিখুন। তারপর দেখুন, জীবন কীভাবে পাল্টে যায়।’
সাদরাজ ঠোঁট কামড়ে নিজেকে শক্ত করে। তারপর জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?’
রিতা মাথা নাড়ায়। বলে,
‘না, যাব না।’
সঙ্গে সঙ্গেই খুব শক্ত করে সে রিতাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। খুব করে কাঁদে। রিতাও জড়িয়ে ধরে। কাঁদলে মন হালকা হবে। রিতা তাই সাড়া শব্দ করে না। সাদরাজ নিশব্দে কেঁদে যায়। মনের কষ্ট সব এভাবেই ঝরে যাক। সুখ আসুক, প্রচন্ড সুখে তাদের জীবন ভরে উঠুক।
রিতাকে অনেকক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখে। রিতাও যেন এই প্রশস্ত বক্ষে তার সুখ খুঁজে ফিরছে। কী হবে এত ঝামেলা করে। সুখ তো আর নিজে এসে ধরা দেয় না। তাকে খুঁজে আনতে হয়। সম্পর্কের শুরুটা যেমনই হোক। একটা তো পরিচয় আছে তার। এই পরিচয় নিয়ে বাঁচতে এখন আর তার মাঝে কোনো দ্বিধা নেই, নেই কোনো সংকোচ। আজ থেকে সেও সুখী, প্রচন্ড সুখী। আর অতীত নিয়ে ভাববে না। এবার বর্তমান আর ভবিষ্যতটাই গুছাবে দুজন।
_________________
পরদিন এক মিটিং শেষে বের হতেই রাবীরের পি.এ জানাল, সাদরাজ তার মনোনয়নপত্র বাতিলের জন্য আবেদন করেছে। সে নাকি এই নির্বাচনে দাঁড়াবে না। রাবীর কথাটা শুনে বিস্মিত হয়। পি.এ কে বলে এক্ষুনি সাদরাজের অফিসে যেতে।
সাদরাজের অফিসে গিয়ে রাবীর আরেক দফা অবাক হয়। চারদিক থেকে তার সব পোস্টার সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অফিসের বাইরে কোনো কোলাহল নেই। নির্বাচনের কোনো কর্মী নেই। রাবীর ভেতরে যায়। সাদরাজের অফিস রুমের দরজায় নক করে। ভেতর থেকে সাদরাজ বলে,
‘ভেতরে আসুন।’
রাবীর ভেতরে আসতেই সাদরাজ মৃদু হাসে। বলে,
‘তুই?’
রাবীর চেয়ার টেনে বসে। কপাল কুঁচকে বলে,
‘এসব আমি কী শুনছি?’
সাদরাজ সহজ স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেয়,
‘কেন, কী শুনছিস?’
‘তুই নাকি মনোনয়নপত্র বাতিলের জন্য আবেদন করছিস?’
‘করছি না। অলরেডি করে ফেলেছি।’
‘আশ্চর্য! এমন কেন করছিস তুই? তুই নির্বাচনে দাঁড়াবি না?’
‘না।’
সাদরাজের সহজ স্বীকারোক্তি। যেন এসবে তার কিছুই যায় আসছে না। রাবীর রেগে বলল,
‘মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তোর? শেষ মুহূর্তে এসে তুই এই সিদ্ধান্ত কেন নিলি?’
সাদরাজ এখনো অত্যন্ত স্বাভাবিক। সে স্পষ্ট সুরে বলে,
‘দেখ রাবীর, শাহাদাত আহমেদ আমাকে এই রাজনীতিতে এনেছিলেন, তোর সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্য। উনি সবসময়ই চাইতেন, অন্যায় ভাবে সব দখল করে নিতে। কিন্তু, তোর জন্য পারতেন না। এই জন্য ভেবেছেন, যেভাবেই হোক আমাকে নির্বাচনে জেতাবেন। তারপর নিজের মর্জি মতো সমস্ত অন্যায় করে যাবেন, কেউ তার কিছু করতে পারবে না। এই নির্বাচনেও তাই অনেক কিছু ভেবে রেখেছিলেন উনি। তোকে যেভাবেই হোক হারিয়ে ছাড়তেন। তারপর তোর ক্ষমতা আমার হাতে তুলে দিয়ে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতেন। কিন্তু, তা আর হয়ে উঠল না। এর আগেই সব অন্যায় ধরা পড়ল। শাহাদাত আহমেদের কথায় আমি এতদিন এসব করেছি। এই রাজনীতিতে কোনো কালেই কোনো আগ্রহ আমার ছিল না। আজ থেকে তো আরো নেই। আমি এই নির্বাচনে দাঁড়াতে চাই না। বরং তোর হয়ে প্রচরনা করতে চাই। তাই আর এই নিয়ে আমাকে কিছু বলিস না, প্লিজ। আমি আমার মতো ভালো আছি। রাজনীতি একেবারে ছেড়ে দিব। একটা ছোট্ট ব্যবসা আছে। এখন থেকে সেখানেই মনোনিবেশ করার কথা ভাবছি।’
‘তুই আরেকবার ভেবে দেখ, সাদরাজ। শাহাদাত আহমেদ এখন আর নেই। অন্যায় করে না, ন্যায়ের পথে থেকে এবার চিতবি তুই। একবার ভেবে দেখ।’
‘ভেবে ফেলেছি। আর নতুন করে কিছু ভাবতে চাই না। ন্যায়, অন্যায় কোনোভাবেই আর চিততে চাই না। আমি আমার এই হার নিয়েই সন্তুষ্ট।’
রাবীর বিমূর্ত চেয়ে থাকে। সত্যিই, সাদরাজের এই রাজনীতির প্রতি কোনো কালেই কোনো আগ্রহ ছিল না। রাবীর তো ভার্সিটি লাইফ থেকেই রাজনীতিতে যুক্ত। কিন্তু, সাদরাজ এসব বরাবরই উপেক্ষা করত। কেবল মাত্র এই শাহাদাত আহমেদের প্ররোচনায় পড়ে সে এতদিন এতকিছু করেছে। আজ সে মুক্ত। সেই জন্যই হয়তো আর এসবে জড়াতে চাইছে না।
রাবীর নিরবতা ভেঙে বলল,
‘চল, আজকে বিকেলে একটু কফি খেতে যাই। ঐ ক্যাফেতে, যেখানে আমরা ভার্সিটি লাইফে রোজ যেতাম।’
পুরোনো স্মৃতি চোখের সামনে চকচক করে উঠল। সাদরাজের ঠোঁটের কোণে হাসি। ঐ ক্যাফেতেই একসময় তাদের কত আড্ডা, কত গানের আসর ছিল। আজ হয়তো সব শূন্য পড়ে আছে। হ্যাঁ, আজ সে একবার যাবে। রাবীরের কাঁধে হাত রেখে হেঁটে চলবে। যেভাবে ভার্সিটি লাইফে হাঁটত। ক্যাফেতে বসে খুব আড্ডা দিবে। একের পর এক কফির গ্লাস শেষ করবে। তারপর বিল দেওয়ার বেলায়, দুই বন্ধু তুমুল ঝগড়া করবে।
ভেবেই ঠোঁট ছড়িয়ে হাসে সাদরাজ। তার হাসি দেখে রাবীর বলে,
‘কিরে, পুরোনো কথা ভেবে হাসছিস? আজ কিন্তু বিল তুই দিবি। সেই লাস্ট বিলটা কিন্তু আমিই দিয়েছিলাম, মনে করে দেখ। আজ কিন্তু তবে তোর পালা।’
রাবীরের অমন কথায় সাদরাজ শব্দ করে হেসে ফেলে। তার হাসি দেখে রাবীরও হাসতে আরম্ভ করে। বাইরে থেকে তাদের এই হাসির শব্দে পি.এ উঁকি দেয়। দুজন শত্রুকে এত সখ্যতা সহিত হাসতে দেখে অবাক হয় সে। ভাবে, এভাবেও কি বন্ধুত্ব ফিরে আসে?
চলবে….