#অনূসুয়া
#পর্ব১৩
#রাউফুন
(অতীত)
তখন সুসমা দ্বিতীয়বার প্রেগন্যান্ট। প্রথম বাচ্চা নষ্ট হওয়ার এক বছর পর আবার সুসমা কন্সিভ করে। সেবার রাশেদের আচরণ ছিলো ভিন্ন। সুসমা ভেবেছিলো এই বুঝি তার সংসারে সুখ নেমে এলো। সুসমাকে রানীর মতো করে রাখছিলো৷ কোনো রকম কাজে হাত লাগাতে দিতো না রাশেদ। তার হয়ে মায়ের সঙ্গে সেকি রাগারাগি, চেঁচামেচি করতো! সুসমা রাশেদের পরিবর্তন দেখে কত কেঁদেছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছে নামাজে বসে।
তবে এবার বাচ্চার যদি আবার ক্ষতি হয় তবে সুসমার লাইফ রিস্ক হবে। সুসমা ভেবেছিলো হইতো তার জীবন আশংকায় শুনেছে, সেজন্য হইতো রাশেদের এতোটা পরিবর্তন। শাশুড়ী মা ও ছেলের রাগারাগি দেখে আগের মতো ব্যবহার করে না৷ সে ভাবে সে পেরেছে, ভালোবাসায় সবাইকে বাঁধতে পেরেছে। তার দুঃখের দিন শেষ। আর দুঃখ তাকে ছুঁতে পারবে না৷ কিন্তু কে জানতো এরপরই তার জীবনের মোর বদলে যাবে ভয়ংকর ভাবে।
একদিন হঠাৎই রিয়া ভার্সিটি থেকে ফিরতে দেরি করে। বাসার সবাই চিন্তিত হয়ে পুরো এলাকা খুঁজেও পেলো না। মিথুন তার ছোট দেবর রিয়ার ভার্সিটিতে গিয়ে খোঁজ নিলো। সেখানের লোকজনের থেকে শুনতে পায় কোনো একজন মেয়েকে জোর করে কিছু ছেলে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। মিথুন দৌঁড়ে এসে সবটা জানালে রাশেদের মুখ কালো হয়ে যায়৷ সে ঘামতে থাকে। এরপরই সে বেরিয়ে পরে বাড়ি থেকে। তাছাড়া বিগত কয়েকদিনের আচরণ সুসমার কাছে অদ্ভুত আর সন্দেহ জনক লেগেছে। হঠাৎই রাশেদের পরিবর্তন টা সে মানতে চেয়েও পারেনি। কেন যেনো তার মনে হতো রাশেদ অভিনয় করছে। ঐ যে কথায় আছে না, “অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ!” প্রথম দিকে সন্দেহ না করলেও পরবর্তীতে সুসমার মা ছেলের আচরণ সুবিধার ঠেকেনি। সুসমা নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। দৌড়াতে দৌড়াতে সুসমা বললো, ‘মা তোমাকে না পেয়ে অনেক কান্নাকাটি করছেন। আজকে ভার্সিটি থেকে ফিরতে দেরি কেন করেছো? দেরি না হলেই এতো বড় ঘটনা ঘটতো না।’
‘আমি দেরি করিনি ভাবি, আমি তো ভালো মনেই আসছিলাম, কিন্তু কোত্থেকে লোকগুলো এসে আমাকে তুলে নিলো সবার সামনে। লোকজন চেঁচালেও আটকাতে পারেনি ওঁদের গাড়িটা। আমি জানি না ওঁরা কেন আমাকে ধরেছিলো, তবে ওঁদের বসের নাম ফার্স্ট লেটার আর দিয়ে শুরু। আর,এস,কে নামে বার বার সম্বোধন করছিলো।’
সুসমার মাথায় তখন অন্য কিছু খেলা করছিলো। সেই কুঁজো বুড়োটা হঠাৎই সোজা কিভাবে হলো? সে লক্ষ্য করেছিলো, কুঠুরিতে বুড়ো যখন তার হাতে স্প্রে দিয়েছিলো তার হাতে কোনো দাগ ছিলো না কিন্তু পরবর্তীতে যে বুড়ো ছু’রি ধরেছিলো তার হাতের উপরি ভাগে দাগ আছে। টর্চের আলোয় সে স্পষ্ট দেখেছে। বেশ ভুষা এক হলেও দুজনকে আলাদা আলাদা মনে হচ্ছে তার কাছে। ভুল এখানেই ছিলো। তারা যখন বাড়ি ফিরলো রাত বারোটা। রাতের আঁধারে একদম বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরলো। এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলেও বাড়ি প্রবেশের পরই সুসমা জ্ঞান হারালো। এমনিতেই সে পাঁচ মাসের গর্ভবতী তারপর সারা বিকেল থেকে রাত বারোটা অব্দি এতো ধকল। শরীর নিস্তেজ হয়ে পরলো তার। সবাই তাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেলো।
মিথুনের বড় ভাইকে কেন যেনো সন্দেহ হতে লাগলো। এখনো বড় ভাই বাড়ি ফিরে আসেনি৷ অথচ সে ভাবির আগে বেরিয়েছে।
সবাই সুসমাকে নিয়ে ব্যস্ত তখন মিথুন অন্য ভাবনায় পরেছে। রিয়া তার মাকে জাপ্টে ধরে সবটা খুলে বলতেই তড়তড় করে অপরাধ বোধ বাড়তে থাকে প্রজা বেগমের। সুসমার প্রতি এতো দিন করা সব গুলো অত্যাচার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। কিভাবে দিনের পর দিন একটা মেয়ের উপর শারিরীক মানসিক নির্যাতন চালিয়েছেন তিনি। আর সেই মেয়েই কিনা নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তার সন্তানকে বাঁচালো। সে এই মুখ নিয়ে কি করে দাঁড়াবে মেয়েটির সামনে। সারা রাত সেই ঘরেই প্রজা, সুসমার শ্বশুর মশাই, রিয়া, মিথুন বসে বসে কাটিয়ে দিলো।
সুসমার ঘুম ভাঙলো সকাল পাঁচটার আগে প্রচন্ড প্র’স্রা’বে’র বেগে। সবাইকে তার ঘরের আনাচে কানাচে ঘুমাতে দেখে বুঝলো কারোরই গতকাল রাতে ঘুমানো হয়নি। কালকের বিমূর্ত, বিমর্ষ দিনের কথা মনে হতেই লাফিয়ে বিছানা থেকে নামলো। আবার ঐ লোকের র’ক্ত পান করার কথা মনে হলো। সে দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে হড়বড়িয়ে বমি করে দিলো। শরীরে জোর পাচ্ছে না বিন্দু পরিমাণ। এতো কিছুর মধ্যে সে রাশেদকে একবারও দেখলো না। সবাই তখন বিভোর ঘুমে। কাউকে ডাকা ঠিক হবে ভেবে সুসমা খাওয়ার জন্য রান্না ঘরের দিকে গেলো। খিদেতে পেটে মোচড় দিয়ে উঠছে তার। সুসমা সবে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়েছে, রাশেদ ফিরলো তখনই।
সুসমা ভালো করে লক্ষ্য করতে দেখলো, রাশেদের হাতে কি যেনো। র’ক্ত? সে ভয়ে শিউরে উঠলো। বললো, ‘আপনার হাতে র’ক্ত কেন রাশেদ?’
রাশেদ কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললো, ‘কই না তো। ও তেমন কিছু না।’
‘আপনি জানেন আপনার গালে এখনো বুড়ো লোকের দাড়ি লেগে আছে?’ চালাকি করে বললো সুসমা। কারণ রাশেদকে তার সন্দেহ হচ্ছে। ঐযে বলে না, কলা চোরের মাথায় কলার পাতা!
সঙ্গে সঙ্গে রাশেদ মুখে হাত দিলো। বললো, ‘কি সব আবোল তাবোল বকছো? কোথায় দাড়ি?’
সুসমা অন্ধকারে তীর ছোড়ার মতো আন্দাজে রাশেদকে প্রশ্নটা করতেই তার ধারণা সত্যি হলো। বললো, ‘তার মানে আপনার হঠাৎই গায়েব হওয়ার কারণ টা বুড়োর ছদ্মবেশ তাই না? আর ফার্স্ট লেটার আর মানে আর তে রাশেদ। এস কে লাগানোটা যেনো আপনাকে না চেনা যায়!’
রাশেদ হাউমাউ করে কাঁদলো। বললো, ‘প্লিজ সুসমা বিশ্বাস করো, আমি এতো বছর থেকে এই কাজ করছি এমন ভুল হয়নি। ওঁরা যে আমার বোনকে তুলে নেবে ভাবতেও পারিনি। যেহেতু ওঁরা ভুল করেই ফেলেছিলো তাই ওঁদেরকে বলেছি মেয়েটাকে স্পেশালি আমার ডেরায় আন। যেনো ওঁকে আমি সেখান থেকে ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু ওখানে সরাসরি গেলে আমাকে চিনে ফেলতো রিয়া। বোনের কাছে এই রূপ প্রকাশ করতে চাইনি বলেই বুড়োর ছদ্মবেশ নিলাম। কিন্তু দেখি তুমি এই পর্যন্ত পৌঁছে গেছো। তাই তোমাকে বিশ্বাস করাতে বানিয়ে আজে বাজে সব গল্প বলি, বলি স্প্রে আমি নিজেই বানিয়েছি।’
সুসমা বিস্মিত হয়ে বললো, ‘এতো দিন মেয়েদের গায়েব হওয়ার কারণ তার মানে আপনি। এতো খারাপ আপনি? ছিঃ নিজের বোনকেও ছাড়লেন না? আর আপনি আপনার ভাড়ার লোক গুলোকেও মে’রে দিয়েছেন? কেন? ওহ বুঝেছি, আপনি মে’রে দিতেন বলেই খুনি অব্দি পৌঁছাতে পারেনি পুলিশ। কারণ ঐ বুড়োটাই মানে আপনিই সবাইকে মে’রে ফেলন!’
‘আমি মা’রিনি! আমি মা’র’তে গিয়ে দেখি কেউ-ই আমার লোক গুলোকে মে’রে কু’চি কু’চি করে ফেলেছে। আমার বোনকে তুলে নেওয়াই আমার চরম রাগ হয় তাই ওঁদের মৃ’ত দেহকেই কু’পি’য়েছি।’
সুসমা হাটু ভেঙে পরে গেলো। কান্নায় ভেঙে পরে বললো,’এতো দিন তবে আমি একটা খু’নি, মেয়ে বাজ লোকের সঙ্গে সংসার করেছি? এতো দিন জানতাম আপনি ব’র্ব’র, জা’নো’য়া’র, কিন্তু এখন দেখছি আপনি তার থেকেও নিকৃষ্ট! নিজের বোন, বোন, অন্যের বোন বুঝি ফেলনা? আমি এক্ষুনি পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সব বলে দিবো।’
‘কোথাও যাবে না তুমি। আর যদি তুমি বলে দাও তবে তোমার বাবা মায়ের আশা ছাড়তে হবে! নিশ্চয়ই তুমি বুঝে গেছো আমি ঠিক কি?’
সুসমার পিলে চমকে উঠে। সে অশ্রুসিক্ত লোচনে দেখলো মানুষ নামক জা’নো’য়া’র টাকে। এই দিনটাও দেখার ছিলো? রাশেদ এগিয়ে এসে সুসমাকে বললো, ‘ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিও। ডিভোর্স পেপার রেডি আছে!’
‘আমি তোকে ডিভোর্স দিলে তুই অন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করবি তা-তো হবে না। আমার জীবন যেভাবে নষ্ট করেছিস সেভাবে অন্য নারীকেও আঘাতে আঘাতে শেষ করবি ভেবেছিস? তোকে ডিভোর্স দিবো না আমি। যা করার করে নে।’
‘ভালোই তো, বুলি ফুটেছে মুখে। “পিপিলিকার পাখা গজায় ম’রি’বার তরে!” তোরও তাই হয়েছে। তুই কি ভেবেছিস আমি বিয়ে করিনি? এই দেখ এই মেয়েটা আমার মামাতো বোন। ওঁকে আমি বিয়ে করেছি। যদি-ও ওঁদের সঙ্গে আমাদের অনেক দিন সম্পর্কে ছিলো না। তবে এখন আমি ওঁকে বিয়ে করে সম্পর্ক ঠিক করে নিয়েছি।’ রাশেদ একটা মেয়ের ছবি দেখিয়ে এই চরম সত্যিটা বললো।
সুসমা রাগে কাঁপতে থাকে। সর্বাঙ্গে আগুন ধরে যাচ্ছিলো। একটা মেয়েকে দিনের পর দিন টেনে টর্চার করার ফলে এমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্ষোভ জমা হতে থাকে। একবার বহির্ভূত হলে বার বার সেটা বহির্ভূত হতে থাকে। রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে সে প্রথম বারের মতো রাশেদকে আঘাত করতে থাকে।
পর পর থাপ্পড়ে জোর ছিলো অনেক। সুসমা রাগে কোমড়ের কাছ থেকে ছু’ড়ি নিয়ে আ’ঘা’ত করে। রাশেদের ডান হাতে লাগে। রাশেদ রেগে গিয়ে সুসমার কাছ থেকে ছুড়িটা কে’ড়ে নিলো। সুসমা আওয়াজ করতে গিয়েও পারলো না। সুযোগ পাওয়ার আগেই শাড়ীর আঁচলে তার মুখ বেঁধে দিলো রাশেদ। শ্বাস রোধ করে অজ্ঞান করে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিলো। শব্দ হচ্ছিলো বলে কোলে তুলে নিয়ে গেলো ছাদে। বাড়ির কেউ-ই তখন জেগে উঠেনি। ভোর পাঁচটাই শহরের কেউ-ই জেগে উঠে না। হাত বেঁধে, মুখও বেঁধে দিলো রাশেদ। ছাদের ট্যাংকে ফেলে ট্যাংকির ঢাকনা লাগিয়ে দিলো। তখন জলের ট্যাংক খালি। পানি শেষ হয়ে গেছে। রাশেদ সুসমাকে ফেলে নিচে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
এদিকে সুসমা হাত পা বাঁধা অবস্থায় পরে রইলো ট্যাংকে। পানি যখন পরতে লাগলো সুসমার মুখে তখন তার জ্ঞান ফিরলো। সে অনেক কষ্টে দাঁড়িয়ে পরলো। তার বুঝতে সময় লেগেছিলো সে কোথায় আছে। জল পরতে দেখে সে বুঝলো জলের ট্যাংক এ আছে সে। তার হাইটের চেয়ে ট্যাংক বড়। জল নাক বরাবর উঠলেই সে শ্বাস রোধ করে মা’রা যাবে। দু চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পরছিলো তার। দম বন্ধ অবস্থা সে পরে রইলো। আর দু পা দিয়ে অক্লান্ত ভাবে শব্দ করতে লাগলো। থপথপ শব্দের সঙ্গে ছাদ ভরে গেলেও এখানে কেউ-ই ছিলো। এদিকে জল পরতে পরতে ভরে উঠতে শুরু করেছে ট্যাংক। নিশ্চয়ই রাশেদ যাওয়ার পথে মটরস অন করে গেছিলো। দশ মিনিটে প্রায় অনেক জল ভর্তি হয়েছে। দেখতে দেখতে গলা অব্দি জল আসলো। সে প্রাণপনে লাফিয়ে লাফিয়ে মাথা দিয়ে দিয়ে ঢাকনায় আওয়াজ করতে লাগলো। মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পরলো তার। সেই রক্তে রঞ্জিত হলো ট্যাংকের পানি। সে শেষবার চোখ বন্ধ করার ক্ষনকাল পর মনে হলো ট্যাংকের ঢাকনা খুলে গেলো।
#চলবে