#মায়াবতী_কাঞ্চনা
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা_০৭
নিস্তব্ধ সরোবরের জলের মতোই কাঞ্চনার দুচোখ ভরে উঠেছে। তবে পার্থক্য হলো-সরোবর একদম নিরব আর কাঞ্চনার চোখ দুটো অবিরাম ধারায় বার বার ভরে আসছে আবার উপচে পড়ছে দুগাল গড়িয়ে।হাটু মুড়িয়ে আম গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়লো কাঞ্চনা।দুহাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হেচকি তুলে কাদতে লাগলো।
হ্যা,দোষ তো তার। সেটা সে মেনেও নিয়েছে । তাই বলে সেলিম কি তাকে ফেরাতে পারতো না।অবশ্যই পারতো।কিন্তু ফেরাই নি।তেজ কি শুধু কাঞ্চনাই দেখিয়েছে, সেলিম দেখায়নি।পুনরায় গুমড়ে কেদে উঠলো কাঞ্চনা।
____________________
____________________
কেটে কেছে আরো পনের দিন।চারুর মৃত্যুর আজ আড়াই মাসে পড়েছে।স্বাভাবিক ভাবে সেলিম কাঞ্চনার সংসার ভালো চললেও অশান্তি সৃষ্টি করলো প্রতিবেশীরা । নিত্য নতুন ভাবে চারপাশের সবাই কানপড়া দিতে লাগলো তিনজনকেই।কোনোদিন কাঞ্চনার কাছে এসে বলতো-
কালা ধলা তো আল্লায়ই বানাইছে এইডা নিয়া ওতো কষ্টের কি আছে?এমন ভাবে মুখ চোউখ কইরা রাখছে তোমার স্বামী/শশুর, যেন তোমার একটা হাতই নাই।শুকুর করা উচিত,মির্জা বাড়ির মাইয়া বিয়া করছে তারপরেও দেহ এমন একটা ভাব যেন তুমি জোর কইরা আইয়া বইয়া রইছো তাগো ঘাড়ের উপর ।
প্রথম প্রথম কাঞ্চনা নিশ্চুপ থাকলেও মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতো –
কেন কাকী,এসব বলছেন কেন?
বেশ সুযোগ পেয়ে যেতো তারা।আয়েশ করে বসে মুখে পান সাজিয়ে বলতো-
আর বইলো না মা৷ ওই তোমার শশুররে আমার আব্বায় জিগাইছিলো পোলা ডা তো বিয়া দিলা,একবার জানাইলাও না। কি দেমাগ হের জানো তুমি?মুখ চোউখ আন্ধার কইরা এমনভাবে তাকাইলো যেন তোমারে হের পোলার লইজ্ঞা বিয়া করাইয়া ভীষন অন্যায় করছে।সেলিমরেও কেউ জিগাইলে এইরম মুখ চোউখ আন্ধার কইরা ফালায়।আমার আর এইসব ভালো লাগে না রে মা।রাজার ঘরে জন্ম হইছে,হেই মাইয়ায় এহন সারাদিন কালি-পাতিল বাসন,রান্দা-বারার মধ্যে পইড়া থাহে হেরপরেও তাগো সুখ হয় না।
কাঞ্চনা নিশ্চুপ হয়ে সবকিছু শুনতো। কখনো হেসে উড়িয়ে দিতো আবার কখনো মন খারাপের বাসা বাধতো সারা মন জুড়ে।
কাঞ্চনার কাছে বেশী সুবিধা না পেয়ে যেত মজিদ হাওলাদারের কাছে।ইনিয়ে বিনিয়ে বেশ রেশ ধরে বলতো-
কি একটা বউ আনলেন ভাইজান।একটামাত্র পোলা আপনের আর আপনে কিনা টাকা বিয়া কইরা আনলেন।কয় টাকাই বা পাইছেন।এই যেই জেদি মাইয়া এর বাপের বাড়ি দিয়া এক কানাকড়িও পাইবেন না।আহারে,পোলাডার মুখের দিকে তাকোন যায় না।চান্দের নাহান পোলাডা,আর বউ আনছেন একটা পেত্নির মতো।সারাদিন শেষে কই বউডার মুখ দেইখা পরাণ ডা জুড়াইবো তা না আপনে তো এমন একখান কাম করলেন এহন পোলাডা না পারে সইতে আর নাতো পারে কইতে।
মজিদ হাওলাদার এসব কথা শুনে বেশ ভেঙে পড়েন। কষ্টে /যন্ত্রনায় বুক ছিড়ে যায় তার।সত্যিই তো খুব ভালো ঘরের রুপসী মেয়ে আনতে পারতেন তিনি।আর সামান্য কটা টাকার জন্য ছেলেটার জীবন নষ্ট করে দিলেন।ছেলের মুখ সারাক্ষণ কালো হয়ে থাকে।হয়তো এই জন্যই।এসব ভাবতে ভাবতে তিনিও অশান্তির আগুনে দাউদাউ করে পুড়েন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকেই তিনি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
কাঞ্চনা কালো,অসুন্দর এসব কথা নিয়ে প্রতিবেশীরা তার কাছে খুব একটা ঘেষতে পারে না।সেলিম না শোনার ভান ধরে অন্য কাজে মগ্ন থাকে। তারপরেও হাল ছাড়েনি প্রতিবেশীরা।এরা যেন বিষধর সাপ।কোনো পরিবারকে শেষ করে দিতে এক অতৃপ্ত পৈশাচিক আনন্দ পায়।বন্ধুবান্ধব/পাড়া-প্রতিবেশী এমনকি নিজের বাবার মুখেও কাঞ্চনার কালো রঙ নয়ে অসন্তুষ্টি শুনে নিজেকে আর সামলাতে পাড়লো না।
সন্ধ্যাবেলা, আকাশে মেঘ জমেছে।বৃষ্টি পড়বে পড়বে ভাব।ঘরের কাজ শেষ করে পানি ভর্তি বালতি হাতে ঘরে ঢুকলো কাঞ্চনা।এরইমধ্যে হাতে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে রুমে ঢুকলো সেলিম।অসস্তিতে হাস-ফাস করতে করতে কাঞ্চনার হাতে দিল ব্যাগটি।নির্লিপ্ত কাঞ্চনা মাথা নাড়িয়ে বললো-
কি এটা?
খুলে দেখো।
হাসিমুখে ব্যাগ খুলে ভিতরের সামগ্রী গুলো দেখতেই স্তব্ধ হয়ে গেল কাঞ্চনা।এটা স্বাভাবিকের মধ্যেও অস্বাভাবিক ঘটনা।ব্যাগের মধ্যে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম,বডি লোশন এবং ফেসওয়াশ।অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে সেলিমের মুখের দিকে তাকালো কাঞ্চনা।তাহলে প্রতিবেশীদের কথাই সত্য। কাঞ্চনার রঙে অসন্তুষ্ট সে।চোখগুলো টলমল করে উঠলো।
আমার গায়ের রঙ নিয়ে যদি আপনার এতই সমস্যা, তাহলে বিয়ে কেন করেছিলেন?বিয়ের আগে কেন বলেননি?(চিৎকার করে কঠিন কন্ঠে)
সেলিম নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো-
বলি নি, ইচ্ছে করে নি তাই।এখন এগুলো এনে দিয়েছি,রেগুলার ব্যাবহার করবে ।কোনো কৈফিয়ত দিতে পারবো না।
সারা শরীর রাগে গজগজ করতে লাগলো কাঞ্চনার। হাতের ব্যাগটা ছুড়ে মারলো ঘরের কোনায়। কাঠের তক্তার বেড়ায় পড়ে কাচের বোতলটি চুরমার হয়ে গেল।ফুসে উঠে বললো-
আমি মরে গেলেও এইসব ব্যাবহার করবো না। আপনার আমাকে ভালো না লাগলে বলে দিবেন। ব্যাস চলে যাবো এখান থেকে।
মাথা গরম হয়ে গেল সেলিমের।টিউশনির টাকা হাতে পেয়েই ভালো ব্রান্ডের কসমেটিকস গুলো কিনেছে সে। রে*গে গিয়ে ঠাস করে থাপ্পড় মারলো কাঞ্চনাকে। দুগাল চেপে ধরে বললো-
তোর তেজ বেড়ে গেছে তাই না।এত্তো তেজ কাকে দেখাস তুই?এগুলো ভাঙলি কেন?এগুলো মাগনা পাওয়া যায়। তিনজন স্টুডেন্টের পুরো এক মাসের বেতন এখানে।এটা কি তোর বাপের বাড়ি পেয়েছিস।ইচ্ছে মতো,খেয়াল খুশিমতো যা ইচ্ছে তাই করবি।আমি এনে দিয়েছি মানে এগুলো সব তুইই ব্যাবহার করবি।
মুশলধারে বৃষ্টি।মজিদ হাওলাদার দোকানে।একা বাড়িতেই একের পর এক দুজনেই বিভিন্ন কথা বলে ঝগড়া করতে লাগলো।কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে সেলিম বেশ ভালোভাবেই মারলো কাঞ্চনাকে।সেদিন প্রথম কাঞ্চনা বেল্টের আঘাতের স্বাদ পেয়েছিলো।পুরো তিনদিন জ্বরে ভুগেছে।সেলিমই অসুধ এনে খাইয়েছে তাকে।বাবার বাড়িতে কখনো যাবে না এমন জেদ ধরেই বসে ছিলো কাঞ্চনা।সেলিম যে পাড়া-প্রতিবেশীর কু মন্ত্রনায় পড়েই তার জন্য কসমেটিকস গুলো এনেছিলো সেটাও বেশ বুজতে পেরেছিলো সে।নিজেকে বুঝিয়ে/সামলে থেকে গিয়েছিলো সেবার ও।
মজিদ হাওলাদারের সৎ ভাই ওরফে সেলিমের বড় চাচা-চাচীরা হায়নার মতো পড়েছিলো তাদের পিছনে। সামান্য জায়গাটুকু ভোগ-দখলের জন্য মেতে ছিলো নানা কু-মন্ত্রনা দিতে।চারু মারা গেছে,কাঞ্চনাকে তাড়াতে পারলেই দুই বাপ-ছেলে ছন্নছাড়া হয়ে যাবে এমনটা ভেবেই পড়েছিল তাদের পিছনে।মির্জা বাড়ির মেয়ের সাথে ততোটা পেরে ওঠা যাবে না দেখেই পুনরায় তাকে তাড়ানোর জন্য নতুন চাল চালে। সেলিম,মজিদ হাওলাদের যাকেই পায় তাদের কাছে কাঞ্চনার দুর্নাম রটতে থাকে।
কাঞ্চনা বড়দেরকে সম্মান করতে জানে না,সবার সাথে ঝগড়া করে,অসম্মান করে,অবহেলা করে ইত্যাদি ইত্যাদি।
চোখ বুঝেই বিশ্বাস করে নেয় সেলিম।কেননা কাঞ্চনাকে কেউ কিছু বললে যে কাঞ্চনা তাকে ছাড় দেবে না সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত।নিশ্চয়ই এমন কিছু কথাবার্তা বলে যার কারনে কাঞ্চনা তাদের অপমান করতে বাধ্য হয়।
তারপরেও সেলিম কাঞ্চনাকে বোঝায়,কেউ কিছু বললে না শোনার ভান করে থাকতে।সবার কথার দাম দিতে হবে এমনটা নয়।কিন্তু অষ্টাদশীর তেজী মন তাতে সায় দিতে নারাজ।কাউকে ছাড় দেবে না সে।এরকমভাবে প্রায়ই টুকটাক কথা নিয়ে ঝগড়া লেগে যেতো তাদের মাঝে।নিজেকে সংযত করতে না পেরে সেলিম ও গায়ে হাত তুলতো।
তৎক্ষণাৎ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও পরবর্তীতে বুদ্ধিমতী কাঞ্চনার মন তাতে সায় দেয় না।সে চলে গেলে যে সবার উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাবে।রাত হলে সেলিমের ওই ঘুমন্ত মুখ দেখে সবকিছু ভুলে যেত কাঞ্চনা।হামলে পড়তো সেলিমের লোমশ বুকের উপর।লোকটা তো তাকে অপমান করে না।এমনকি নিজস্ব কোনো বিষয়েও তাদের মধ্যে ঝগড়া হয় না।শুধুমাত্র বাইরের বিষয় নিয়ে কথা-কাটাকাটি হয়। বোকা লোকটা যে বোঝে না এই যুগে কাউকে ছাড় দিতে নেই তাহলেই সে ধারালো থাবা নিয়ে পরবর্তীতে আক্রমন করার জন্য প্রস্তুত থাকবে।অষ্টাদশী নিজের মনকে বোঝায় হয়তো ধীরে ধীরে সেলিম সব বুজতে পারবে।
হয়েছেও তাই।সেলিম বুঝেছে, কিন্তু ভাগ্য বুঝলো না।ধেয়ে এলো নিষ্ঠুর ভাগ্য যা কাঞ্চনার ভাবনার ও অতীত ছিলো।
বাপের বাড়ি যাবে না যাবে না করেও ঠেকাতে পারলো না কাঞ্চনা।ভাই সুজন মির্জার ভয়াবহ জ্বরে ছুটে গিয়েছিলো একদিন।একরাত থেকেছিলো সেখানে। কিন্তু পরের দিন সকালেই প্রতিবেশীর মুখের কথা তার পুরো পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিলো।
সেলিম দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, চাদের মতো সুন্দর সেই বউ।গত রাতেই তাকে ঘরে তুলেছে।সকাল হতেই সারা গ্রামময় ছড়িয়ে পড়লো সেই কথা।অষ্টাদশী, নরম চিত্তের কাঞ্চনা নিতে পারলো না এমন ধারালো সত্য। অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লো সেখানেই।
চলবে?
বাড়ি ফিরেই বড় করে দিব ইনশাআল্লাহ