#মায়াবতী_কাঞ্চনা
#সিমরান_মিমি
#পর্বসংখ্যা-০২
রাত সাড়ে এগারোটা।বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ভুগছে পুরো পিরোজপুর জেলার মানুষ। টেবিলের ওপর জ্বলন্ত মোমবাতির আলোয় পরিচিত মানুষটাকে দেখে বেশ চমকে যায় কাঞ্চনা।কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ করলো না।আজ প্রায় তেরো বছর পরে তাকে চিনতে সামান্য হিমশিম খায় সে।আগে দাড়ি না থাকলেও এখন সারা মুখ জুড়ে চাপ দাড়ি এবং গোফে ভর্তি।পেটানো শরীর টাও বুঝি আগের সেই পরিচিত মানুষ টাকে অচেনা করে তুলছে।নিজেকে সং*যত করে মাথা নিচু করলো কাঞ্চনা।সেলিম নয়,ইনস্পেকটর সেলিমের উদ্দেশ্যে কঠিন কন্ঠে বললো-
এই ভদ্রলোক(মাইক্রোর মালিক কে উদ্দেশ্য করে) দ্রুত যাওয়ার জন্য বেশ স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলো।সামনে ছোট্ট অটোটাকেও পরোয়া করে নি।নিজের বিলাসবহুল গাড়িটি দিয়ে ধাক্কা মেরে দেয়।ফলস্বরূপ ড্রাইভারের মাথা ফেটে যায় আর সি এনজির বেশ ক্ষতি হয়।আশা করি ইনস্পেকটর সাহেব ওনার ক্ষতি পুষিয়ে দিবেন।
থেমে,
কোথাও সাক্ষর লাগলে বলুন, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
গলার ভেতর সমস্ত কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে সেলিমের।চোখটাও কেমন জ্বলছে।নিজেকে সামলে নিয়ে কাঞ্চনার উদ্দেশ্যে বললো-
আমাকে পাচ মিনিট সময় দিন।
বলেই পাশ থেকে একটা ফাইল বের করে সেখানে কিছু লেখা শুরু করলো।লেখার ফাকেই মনযোগ কে বিচ্ছিন্ন করে উচ্চ শব্দে বেজে উঠে ফোনের রিংটোন।কাঞ্চনা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে কোনো বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পায় সাথে কোনো এক মহিলার কন্ঠ।বৃষ্টির কারনে নেটওয়ার্কের সমস্যার কারনে বাধ্য হয়েই স্পিকারটাকে লাউডে দেয়।সাথে সাথে ওপাশ থেকে ভেসে আসে_
কই তুই?প্রায় বারোটা বাজতে চললো।কখন আসবি বাড়িতে?এদিকে সুহা এখনো কিছু খাচ্ছে না।বারবার কাদছে।হয়তো তোকে দেখতে না পেয়েই।
কন্ঠকে বেশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কাঞ্চনা বললো-
তুমি ওকে আর কিছুক্ষণ সামলাও আমি আসছি।
___________
___________
ফোন কেটে দিলো কাঞ্চনা।সেলিমের লেখা শেষ হতেই ফাইলটাকে কাঞ্চনার সামনে দিয়ে নির্দিষ্ট এক জায়গায় সিগনেচার করতে বললো।কোনোরুপ বাক বিতন্ডা না করেই সেখানে একবার চোখ বোলালো।
শাস্তিস্বরূপ সকল ক্ষতিপূরণ মাইক্রোর মালিক দিবে এবং পরবর্তীতে এরকম ছন্নছাড়া হয়ে স্পিডে গাড়ি চালালে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হবে এমনটা পড়েই সেখানে সিগনেচার করলো কাঞ্চনা।
সময় ব্যয় না করেই ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে বাইরে চলে আসলো।
ম্যাডামকে বাড়ি পৌছে দিয়ে আসো।
কাঞ্চনা কক্ষ থেকে বের হতেই সেলিম নিচু কন্ঠে গম্ভীর ভাবে কনস্টেবল কে বলল।
দ্রুতপায়ে কাঞ্চনার সামনে গিয়ে বিরক্ত চোখে তাকালো কনস্টেবল। থমথমে কন্ঠে বললো-
স্যার আপনাকে বাড়ি পৌছে দিতে বলেছে।একা মেয়েমানুষ ক্ষতি হতে পারে তাই।চলুন।
অপমানে চিবুক শক্ত হয়ে এলো কাঞ্চনার।বজ্রকন্ঠে কন্সটেবল কে বললো-
আপনার স্যারকে গিয়ে বলবেন,কাঞ্চনা দুর্বল নয়।না আগে ছিল,আর না তো এখন।মেয়েদের সম্পর্কে এমন ভাবনাকে পরিবর্তন করতে বলবেন।আসি।
বলেই দ্রুতপায়ে সেখান থেকে চলে গেল।কথাগুলো বেশ উচ্চস্বরে বলায় সেলিম ও শুনতে পেল।না চাইতেই ঠোট এলিয়ে হেসে ফেললো সে।মনে মনে আওড়ালো”একটুও বদলাও নি তুমি”।
প্রতিদিন দশটার পরে বাড়ি পৌছালেও আজকে বৃষ্টির কারনে বেশ ঝামেলায় পড়েছিলো সেলিম।বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হতেই কনস্টেবল আবার ঝামেলা নিয়ে হাজির হলো।সব ঝামেলা চুকিয়ে কাঞ্চনা যাওয়ার পরপরই বের হয়ে গেল থানা থেকে।
_________
_________
বাজার পেরিয়ে গ্রামের মধ্যে ঢুকতেই হাত-পা শিরশির করে উঠলো কাঞ্চনার।বড় ভাইয়ের নাম্বারে ফোন দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বললো।প্রায় দশ মিনিটের মধ্যে মোটরবাইক নিয়ে হাজির হয় কাঞ্চনার বড় ভাই সুজন মির্জা।বোনকে নিয়ে সোজা চলে যায় বাড়িতে।বসার রুমে ঢুকতেই বড় ভাবী চেচিয়ে উঠে বললো-
এতটা দেরী কি করে হলো তোমার?সেই তিনটার সময় ঘর থেকে বেরিয়োছে।ছয় টার মধ্যেই তো বাসায় ফেরার কথা।তোমাকে নিয়ে কি আমাদের চিন্তা হয় না।তোমার এই খাম খেয়ালি পনা কবে ছাড়বে বলতো পারো কাঞ্চনা?
ভাবী রেগে গেছে দেখে কাঞ্চনা আর কিছু বললো না।শান্ত স্বরে কোল থেকে দেড় বছরের ছোট্ট সুহাকে কোলে নেয় সে।এখনো ঘুমায় নি।কাঞ্চনার কোলে যেতেই ঢুকরে কেদে ওঠে সুহা।আদো আদো কন্ঠে বুলায়-মা*মু*নি*
বড় ভাইয়ের মেয়ে সুহা।এর আগে সাত বছরের একটা ছেলেও আছে।একসাথে থাকার ফলে মায়ের থেকেও ফুপিকে চেনে এই দুই ভাই বোন।মা না থাকলেও ফুপির কাছে থাকতে পারে কিন্তু ফুপিকে কিছুক্ষণ না দেখলেই ছোট্ট সুহা সারাক্ষণ কাদে।এমনকি ফুপির হাতেই খেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এই দুই ভাইবোন।
রাত দুইটা।খাটের উপর শুয়ে কপালের উপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করে আছে সেলিম।মাথায় শুধুমাত্র একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে”আর কিছুক্ষণ সামলাও আমি আসছি”।ফোনে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ও শুনতে পেয়েছে সেলিম।
বাচ্চাটা কি তাহলে কাঞ্চনার।তাহলে কি সে বিয়ে করেছে?
উফফ আর ভাবতে পারছে না।মাথা যন্ত্রনায় ছিড়ে যাচ্ছে।শেফালী চাচী খাবার দিয়ে গেছে সেই অনেক আগে।কিন্তু খাওয়ার কোনো রুচি নেই।এদিকে ওষুধ ও খেতে হবে।শেষে না খেয়েই ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো সেলিম।বিছানার পাশ থেকে ডায়েরিটা নিলো।পুনরায় পৃষ্ঠা গুলো উল্টাতে শুরু করলো।একসময় হারিয়ে গেল সেই সূদুর অতীতে।
____________
____________
তপ্ত দুপুর।ঘড়ির কাটা দেড়টায় ছুয়েছে।আধ মাঝারি এক টিনের ঘর।সামনের বারান্দা বাদে মোট দুটো রুম আর রান্নাঘর।মাঝের রুমের খাটে শোয়া ক্যান্সারে আক্রান্ত চারুলতা বেগমের শিউরে বসে পাতলা খিচুড়ি খাইয়ে দিচ্ছে কাঞ্চনা।চারুলতা বেগমের মাথা পুরো টাক হয়ে আছে।কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শরীরের সব লোম, ভ্রু,পিসি, চুল ঝরে গেছে।গরমের ঘেমে -নেয়ে দ্রুতপায়ে হাতে কিছু ঔষধ নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো সেলিম।তাকে দেখা মাত্রই চট করে উঠে বসলো কাঞ্চনা।দম বন্ধ লাগছে তার।দ্রুতবেগে পাশ কাটিয়ে বের হয়ে গেল তাদের বাড়ি থেকে।সেলিম একবার সেদিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে মায়ের ঔষধ খাওয়াতে মনযোগ দিলো।
বিশাল এক বাড়ি।দেখতে মনে হচ্ছে এ যেন কোনো রাজবাড়ির চেয়ে কম নয়।এই জেলার নামকরা ইঞ্জিনিয়ার শামসুল মির্জা। ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রতিচ্ছবি হিসেবে নিজের বাড়ি টাকেই একটা ভাস্কর্যে পরিণত করেছেন তিনি।দশ গ্রামের মধ্যে কোনো বাড়িতে এই মধ্যযুগে এতটা আধুনিকতা বা রুচিশীলতার প্রকাশ ঘটেনি।কিন্তু অত্যাধুনিক এই বাড়িতে মাত্র দুদিন বাস করতে পেরেছেন।এর মধ্যেই পরলোকগমন করেছেন।স্বামীর মৃত্যুর সাত দিনের মাথায় স্ত্রী ও চলে গিয়েছেন ওপারে।বেচে ছিলো একমাত্র ছেলে এবং ষোলো বছরের ছোট মেয়ে কাঞ্চনা।তাদের জন্য ব্যাংকে জমানো টাকা-পয়সার অভাব রেখে যাননি বাবা শামসুল মির্জা।আজ দু বছর পার হয়ে গেলেও এই বাড়িটা দেখে দীর্ঘ শাস ফেলে কাঞ্চনা।
বাড়িতে প্রবেশ করতেই রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন কহিনুর বেগম।ছেলেমেয়ে দুটোকে লালন-পালন এবং রান্নাবান্না করে খাওয়ানোর জন্যই এ বাড়িতে তাকে রাখা হয়েছে।
তোমারে কত্তবার বারন করছি ছোড আম্মা,এই ভাবে ভর দুপুরে কোথাও যাইয়ো না,তাও কথা শোনো না কেন?এমনিতেই তোমার গায়ের রঙ চাপা তার উপর রোদে পুড়লে আরো কালা হইয়া যাবা তো।
শাসনের সুরে বললো কহিনুর।
ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ঝাঝালো কন্ঠে কাঞ্চনা বললো-
তোমাকে কতদিন বলবো কাকি,এইসব কালা-ধলা নিয়ে আমার সামনে কথা বলবে না।আমি কালো হলে তোমার যদি এতই সমস্যা হয় তাহলে চোখ বন্ধ করে রাখবা।
বলে হনহন করে দোতলায় উঠে গেল।সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো সুজন মির্জা।হেসে দিয়ে বললো-
কাকি,তুমি তো জানোই ও একটু জেদি।তারপরেও এতো কথা বলো কেন?
আমি তো খালি খালি কিচ্ছু কই না আব্বা।আম্মায় তো ওই চারুগো বাড়ি যাইয়া প্রায়ই বইসা থাহে।চারুর ক্যান্সার, হের সেবা যত্ন করে বইসা বইসা।আল্লাহ না করুক ওই রকম রোগীর ছোয়া লাগলে যদি খারাপ কিছু হয়।
দোতলায় বসেই চিৎকার করে কাঞ্চনা বললো-
কি হবে?আমার ও ক্যান্সার হবে।হলে হোক,তাতে তোমাদের কি?কি সব স্বার্থপরের মতো কথা বলো তোমরা?মজিদ চাচা সারাদিন দোকানে থাকে।নইলে সংসার চলে না।তাদের ছেলে যায় টিউশনি করাতে।চারু কাকি একা অসুস্থ মানুষ বাড়িতে থাকে।আমি গেলে তাতে তোমাদের কি সমস্যা?
কহিনুর বেগম উপর তলায় চেয়ে কাঞ্চনা কে বললো-
আমি তো আর এমনি এমনি বলি না আম্মা।পাড়ার সবাই কওয়া কওয়ি করে –
জোয়ান একটা পোলা আছে চারুর।আর তুমি জোয়ান মাইয়া সারাক্ষণ ওই বাড়ি গিয়া বইয়া থাহো। মানষে কি ভালভাবে এই সব নেয়। তুমিই কও আব্বা(সুজনকে উদ্দেশ্য করে)
পুনরায় তেতে উঠলো কাঞ্চনা।বললো-
মানুষ কি ভাবে, আমি প্রেম করি ওই বাড়ির ছেলের সাথে, নাকি বিয়ে করবো।কোনটা?যার যা ইচ্ছা সে সেটাই ভাববে।আমি কিছুর ধার ধারি না।তুমি পরের বার এই ধরনের পাড়া-প্রতিবেশীর কথা নিয়ে ঘরে বসে আমাকে জ্বালালে সারা রাত দিন ওই চারু কাকিদের বাড়ি বসে থাকবো।তখন দেখবো কি করো?
কথাগুলো বলেই হনহন করতে করতে রুমে ঢুকে গেল কাঞ্চনা।নিচে সোফায় বসে সুজন মির্জা বোনের রুমের দিকে তাকিয়ে আছে।বোনটা তার একটু স্বাধীনচেতা হলেও খুব নরম মনের। কারো কষ্ট সহ্য করতে পারে না।কিন্তু তার পরেও চারু কাকিদের বাসায় যাওয়ার অন্যতম কারন হলো সেলিম।প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে সেলিমকে দেখতে দেখেছে সুজন।অষ্টাদশী বোন যে সেলিমের প্রতি দুর্বল সেটা বুজতে তার একটুও অসুবিধা হয় না।বোন তার শ্যামকালো।কালকেই প্রস্তাব রাখবে মজিদ চাচার কাছে।সব দেখেশুনে যদি তারা রাজি হয় তাহলে আর দ্বিমত করবে না সে।খুব তাড়াতাড়ি পাড়ার মানুষের মুখ বন্ধ করা উচিত।
চলবে?