#কে!!
#৩য়_পর্ব
চোখ বুজতেই বেশ গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় নীতি। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন দেখতে পায় তার পায়ের কাছে কেউ বসে আছে। এবং কেনো যেনো মনে হচ্ছে গভীর নয়নে তাকে দেখছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের গাঢ় কালো অবয়বটা ঠিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এতো রাতে কে হতে পারে!! অস্পষ্ট স্বরে মুখ থেকে বেরিয়ে যায়,
– কে!!
কোনো রেসপন্স দিচ্ছে না মানুষটি, মূর্তির ন্যায় বসে আছে। শালুক নিজের রুমে ঘুমোচ্ছে। ঘরে সে এবং শালুক ব্যাতীত কেউ নেই। তবে কি আবার স্বপ্ন দেখছে, হ্যা এটা স্বপ্ন, খুব বাজে একটি স্বপ্ন দেখছে। এখনই স্বপ্ন থেকে উঠতে হবে নয়তো স্বপ্নের বেড়াজালে নিজেই জড়িয়ে যাবে নীতি। কিন্তু ঘুম ভাঙ্গবে কিভাবে? ভয়ের গলা জড়িয়ে আসছে। হাত রীতিমতো কাঁপছে। মাথা কাজ করছে না। রাত গভীর হয়েছে সেটা রাতের নিস্তব্ধতা প্রমাণ দিচ্ছে। এবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো নীতি। ভূতে বিঃশ্বাস সে কখনোই করে না। একাবিংশ শতাব্দীতে এসে কোনো মেয়ে যদি ভূতে বিঃশ্বাস করে তাহলে তাকে নিতান্ত ভীতুর ক্যাটাগরিতে ফেলা হয় নয়তো নিতান্ত অন্ধবিশ্বাসে জর্জরিত ভাবা হয়। নীতি তেমন মেয়ে নয়, সে যথেষ্ট মডার্ণ এবং তার যথেষ্ট সাহস আছে। এটা ভূত হতেই পারে না। সে স্বপ্ন দেখছে নয়তো একটা চোর তার ঘরে ঢুকে৷ পড়েছে। হ্যা, হ্যা এটাই। চোখ বন্ধ করে জড়সড় হয়ে বসে নিজের মনের ভয় দূর করতে যখন ব্যাস্ত নীতি তখন কানের কাছে মৃদু কন্ঠে শুনতে পায়,
– বাবুইপাখি, আমি আবার আসবো। এখন ঘুমাও
কন্ঠটা খুব হিনহিনে, বুকের মধ্যে ধক করে উঠলো কন্ঠটা শুনে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসলো। নীতির ভয় করছে, প্রচুর ভয় করছে। মাঝে মাঝে স্বপ্নের ভয় পেলেও মানুষ আৎকে উঠে, নীতির কাছে সবকিছু কেমন অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। যেনো সে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। বাস্তব অবাস্তবের মাঝে সে আটকে গেছে। তার সাথে কি হচ্ছে, এটা কি অবচেতন মনের কোনো খেলা!! নীতি আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। যেনো অন্ধকারে অতল গহব্বরে তলিয়ে গিয়েছে, যার তল পাওয়া সত্যি দুষ্কর________
সকাল ৯টা,
সূর্যের তীর্যক রশ্নি চোখে পড়তে চোখ মুখ খিচে আসলো। পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখতে পেলো সূর্যিমামা বেশ চড়াও হয়ে বলছে,
” উঠ ব্যাটা, আমি উঠে বসে আছি”
মাথাটা ঝিম মেরে আছে, কাল রাতের ঘটনাটা এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। নীতি তো ড্রাগ-ট্রাগ ও নেয় না তাহলে এমন হ্যালুসেনেশন কেনো হবে। লোকের হিনহিনে ভয়েজটার কথা মনে হলে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এখনো মাথায় ভাসছে
” বাবুইপাখি, আমি আবার আসবো। তুমি ঘুমাও”
উফফফ, মাথাটা টনটন করছে। দু হাত দিয়ে চুল টেনে ধরেছে নীতি। একটা অস্থিরতা ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।
– আফার কি মাথায় বেদনা করতাছে?
শালুকের প্রশ্নে মাথা তুলে তাকায় নীতি। মেয়েটাকে বেশ অবাক হলো নীতি। একদম পায়ের আওয়াজ পায় নি সে। এতো নিস্তব্ধে তো নীতি কখনোই তাকে চলতে দেখে নি। ঠিক যেনো বিড়ালের মতো চলাফেরা। ভ্রু উচিয়ে সন্দেহের চোখে জিজ্ঞেস করে,
– তুই কখন আসলি??
– আপনি দশ মিনিট ধইরে আপনেরে ডাকতেছি। আপনি তো কোনো কথা কন নি। চুল ধইরে টানতেছেন। তাই জিগাইলাম
নীতি কথা বাড়ালো না, কাল রাতের ঘটনা এখনো মাথায় ঘুরছে। হয়তো একারণেই শালুকের আসাটা বুঝতে পারে নি। একবার ভাবলো শালুককে কালকের ঘটনা বলবে। কিন্তু পর মূহুর্তেই কি ভেবে না বলার সিদ্ধান্ত নেয়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শালুককে বলে,
– আমি ভার্সিটি যাবো, নাস্তা দে।
বলেই বিছানা ছাড়ে নীতি। এখন মন ভালো করতে হবে, কালকের কথা আর ভাববে না নীতি। অহেতুক মাথাটাকে নষ্ট করবে না আর নীতি। নতুন সকাল, নতুন আলোয় আবার প্রাণোচ্ছল নীতি হয়ে যাবে সে।
সকাল ১০.৫০,
ক্যাম্পাসের পকেট গেটে দাঁড়িয়ে আছে নীতি। পরণে লাল একটা লং কুর্তি, নীল জিন্স। ওড়নাটা গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে। মাঝা অবধি দোল খেলানো চুলগুলো হাফ পাঞ্চ করে রাখা। বাতাসের উত্তালতায় উড়ছে চুলগুলো। সিনিয়র থেকে জুনিয়র সবাই একবার না একবার তাকাচ্ছেই তার দিকে। নীতি দেখতে খুব সুন্দরী, রুপের অমৃত পান করা একটি মেয়ে। গোলগাল পুতুলের মতো মুখটি, যে কারোর নজর কাড়ে। হরিণটানা চোখ, সরু নাক সাথে গোলাপের পাঁপড়ির মতো ঠোঁটজোড়া, খুব নিখুঁত একটি মেয়ে। যেন ভাস্কর্যের কোনো নিপুন হাতের শিল্পকর্ম। ঠোঁটের উপরের কালো তিলটি নজর টিকার মতো কাজ করে। তার উপরে আজ বেশ পরিপাটি করে সেজেছে সে। মন ভালো করার একটা উপায় ও বলা যেতে পারে এটাকে। চোখে মোটা কাজল, ঠোঁটে নুড লিপস্টিক; আরো সুন্দর লাগছে তাকে। মূলত আফরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু মেয়েটা এখনো আসে নি। বিরক্ত লাগছে নীতির, দুটো বাইক নিয়ে কিছু ছেলে শুধু সামনে ঘুরঘুর করছে। ছেলেগুলো কলেজের না, তাই হয়তো নীতিকে জুনিয়র ভেবে ঘুরঘুর করছে। তাদের চাহনী আরো বিরক্ত ধরিয়ে দিচ্ছে। আফরাকে সামনে পেলে একটা গাট্টা মারতো নীতি। মেয়েটার এতো দেরি হচ্ছে কেনো। কি এমন রাজকাজ করছে। নীতি ঠিক করলো আর এখানে দাঁড়াবে না। এখনই ভেতরে যাবে, দরকার হলে ক্যান্টিনে যেয়ে অপেক্ষা করবে। নীতি যখন ভেতরের দিকে যেতে থাকে তখনই পেছন থেকে একটি ছেলে বলে উঠে,
– ইশশ, কি আইটেম বস। যদি পাইতাম কাছে
নীতির রাগে গা রি রি করছে, একটা থাপ্পড় মারতে পারলে হয়তো ভালোই হতো। তাও নিজেকে ভেতরের দিকে যেতে নিলে হাত টান অনুভব হয়। পেছনে তাকাতেই দেখে ওই ছেলেগুলোই তার হাত টেনে ধরেছে। অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে কড়া কন্ঠে বলে উঠে,
– কি অসভ্যতামি এটা?
– অসভ্যতামি তো করলামি না ম্যাডাম
পেছনের ছেলেটা চোখ টিপ্পনী দিয়ে বলে উঠলো। এবার রাগে গজগজ করতে লাগলো নীতি। বেশ জোরে এবং ধমকের সাথেই বলে উঠলো,
– হাতটা ছাড়ুন, আমি কিন্তু লোকজড় করবো।
– যদি না ছাড়ি।
এবার আর না পেরে ঠাস করে থাপ্পড় লাগিয়ে দেয়। পকেট গেটে লোকাল পোলাপান একটু বেশি থাকে, মানুষের আনাগোনা খুব কম। এখানে নীতির বন্ধুদের দল ও নেই। নিজের উপর মেজাজ খারাপ লাগছে তার। কেনো এখানেই দাঁড়াতে হলো। ভেতরে দাঁড়ালে তো এই ঝামেলাতে পড়তো না। ছেলেগুলো এখনো নীতির হাত ধরে আছে। মেজাজ খারাপ হচ্ছে কিন্তু কি করবে বুঝতে পারছে না। থাপ্পড় পড়তেই ছেলেগুলো আরো চট্র গেলো। আরো শক্ত করে হাত ধরে। নীতি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকলে, ছেলেটি বেশ উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে,
– লাভ নেই গো, এতো সহজে ছাড় পাচ্ছো না।
– আর দু সেকেন্ডে হাত না ছাড়লে ভাঙা হাত নিয়ে যেতে হবে।
চোখ কুচকে পাশে ফিরতেই দেখে নির্ভীক এবং নীতির। সব বন্ধুদের টিম দাঁড়িয়ে আছে। এতোজনকে একসাথে দেখে ছেলেগুলো হাত ছেড়ে দেয়। নীতি এক রকম হাফ ছেড়ে বাঁচে যেন। নির্ভীকের রাগ খুব ভয়ংকর, তার উপরে নীতির হাত ধরে অসভ্যতামি যেনো একেবারেই সহ্য হয় নি তার। ব্যাস একচোট মারামারি বেধে যায়। মারামারির এক পর্যায়ে সিরিয়াস অবস্থায় চলে গেলে ক্যাম্পাসের অনেক মানুষ জড়ো হয়ে যায়। কিছু স্যাররা এসে মারপিট থামায় এর মাঝে স্নিগ্ধ ও আছে। ছেলেগুলো এক প্রকার পালিয়ে যায়। নির্ভীকের ঠোঁট ফেটে গেছে। কি একটা ঝামেলা হলো। নীতির বুকটা ছ্যাতছ্যাত করছে। হয়তো তার জন্যই এমন হয়েছে।
ডিপার্টমেন্টের হেডের ঝার খেয়ে বের হলো নীতি এবং নির্ভীক। সাথে স্নিগ্ধ ও রয়েছে। হেডের ঝাড় অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে স্নিগ্ধ। রুম থেকে বের হতেই স্নিগ্ধ মুচকি হেসে বললো,
– রাগটা একটু কাবু রাখতে হয়। নয়তো হিতে বিপরীত হয়।
– আমি ওই ছেলেটা মেরেই ফেলতাম। নীতির হাত ধরে অসভ্যতামি করছিলো।
বেশ চড়া গলায় নির্ভীক বললো। স্নিগ্ধ আবারো হেসে বললো,
– তবুও এতো রাগ ঠিক নয়। মারামারি কিছুর সল্যুশন নয়। লাভ কি হলো বলো? থাকো তাহলে। আমি যাই, তোমাদের গ্যারান্টার আমি। আর এমন করবে না।
নীতি অবাক স্নিগ্ধ এর দিকের তাকিয়ে রইলো। সে না থাকলে সত্যি বেশ বিপদে পড়তো। নির্ভীকের ক্যারিয়ার এর ব্যাপার। লোকটার প্রতি সত্যি বেশ কৃতজ্ঞ নীতি। নির্ভীকের এই রাগটাই সব কাল। ইচ্ছে মতো বকতে লাগলো তাকে নীতি। কি দরকার ছিলো এতো মারপিটের। আর নির্ভীক সে নির্বিকার ভাব নিয়ে আল্লু আর্জুন পোজে সব কথা উড়িয়ে দিলো। কি করবে এই ছেলেটাকে দিয়ে!!!
দুদিন পর,
সকাল ১০টা,
নীতি তখন ক্লাস করতে ব্যাস্ত। তখন পিয়ন ক্লাসে এসে জানায় নীতি এবং নির্ভীককে স্যার ডেকেছে। বেশ অবাক হয় তারা। ডিপার্টমেন্টাল হেডের রুমে গিয়ে দেখতে পায় একজন সিভিল ড্রেসে লোক বসা। তাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে লোকটি হাসি মুখে বলেন,
– হ্যালো, আই এম আহসান হাবীব। আমার সাথে তোমাদের দুজনকে একটু থানায় যেতে হবে।
– থানায় কেনো?
অবাক হয়ে নির্ভীক জিজ্ঞেস করলে লোকটি বলে,
– খুন হয়েছে, তার প্রাইম সাসপেক্ট তোমরা। তাই
– মানে?
এরপর যা বললো তাতে মাথা ঘুরে যাবার জোগাড় নীতি এবং নির্ভীকের। লোকটি মুখে হাসি রেখেই বললো………
চলব
মুশফিকা রহমান মৈথি