ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব ৩৩

0
1141

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩৩|
ঘুম পাগলী মেয়েটা হঠাৎ ঘুম বিমুখ হয়ে পড়েছে৷ রাত যত বাড়ে বুকের বা’পাশের চিনচিনে ব্যথাটুকু ততই তীব্র হয়৷ বক্ষঃস্থল জুড়ে আশ্চর্যজনক এক অশান্তি বইতে থাকে সর্বক্ষণ। যে অশান্তি তাকে না ঘুমোতে দেয় আর না প্রত্যাহিক জীবনের কোনো কাজে মন বসাতে দেয়। মন কেবল ক্ষণে ক্ষণে ডুকরে ওঠে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটি আফসোসে। কিশোরী বয়স থেকে যে মানুষটিতে সে মত্ত ওই মানুষটি গত পাঁচ বছর যাবৎ মত্ত ছিল অন্য নারীতে। বুকটা হাহাকার করে ওঠে একটি কথাই ভেবে সে ওই মানুষটির প্রথম ভালোবাসা, প্রথম স্পর্শ হতে পারল না৷ প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসার গভীরতা সে খুব ভালো করেই অনুভব করতে পারে৷ কারণ ওই মানুষটির প্রতি তার যে প্রেম, ভালোবাসার অনুভূতি সবটাই প্রথম। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে ওঠে বসে সিমরান৷ বিছানা থেকে ধীরেসুস্থে নেমে দাঁড়ায়। ঠিকঠাক ঘুম না হওয়াতে শরীরটা কেমন নুইয়ে পড়ছে৷ মাথা ঝিমঝিম করে খুব। হঠাৎ হৃদয় গভীরে একটি কথা ছলকে ওঠে সিমরানের। কোথায় যেন সে পড়েছিল, কারো প্রথম প্রেম হওয়াটা গর্বের না হলেও শেষ প্রেম হওয়া গর্বের। এছাড়া সেদিন রাতে নিধি আপুও তাকে কত কী বোঝাল। সৌধ ভাইয়ের আগে তো সেই জানতে পেরেছিল নিধি আপু বিবাহিত। তার হাজব্যান্ড ডক্টর অর্পণ শিকদার। নিধি তাকে তার বিয়ের সব কাহিনি বলেছিল সেদিন। জানিয়েছিল সৌধর অনেক কথাও। অনুরোধ করেছিল,

‘ সিনু, তুই আমাকে কথা দে কোনো পরিস্থিতিতেই সৌধর থেকে মুখ ফিরাবি না৷ ও এখন আবেগে ভাসছে ঠিক৷ কিন্তু যেদিন বাস্তবতা বুঝবে আর তোর ভালোবাসার গভীরতা টের পাবে সেদিন ঠিক তোকে আপন করে নেবে। ‘

সিমরান ভয় পায় সে কথা শুনে। বিষয়টা অসম্ভব লাগে। নিধি তার দু গালে হাত রেখে তখন বলে,

‘ শোন, আমরা যদি মোনাজাতে চেয়েও কাউকে না পাই তাহলে বুঝতে হবে আমাদেরও কেউ মোনাজাতে চাচ্ছে। যার প্রার্থনা আরো বেশি গভীর আর বেশি জোরালো। দেখ না সৌধ আমাকে কত চাইল পেল কি? পেল না। কেন পেল না এর সঠিক উত্তরটাই আমি খুঁজছিলাম। আজ পেয়েও গেলাম। কারণ সৌধ আমাকে যেভাবে চায় তার চেয়েও বেশি গভীরভাবে তুই সৌধকে চাস। আই বিলিভ দ্যাট অবুঝ বয়সের প্রেমে বেশি গভীরতা থাকে। তুই যে বয়স থেকে সৌধকে ভালোবাসিস ও বয়সে ভালোবাসা ছাড়া, মুগ্ধতা ছাড়া আর কোনো স্বার্থ নেই। ‘

নিধি আপুর সে কথা শুনে চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায় সিমরান। অবাক কণ্ঠে বলে,

‘ সৌধ ভাই যে তোমাকে ভালোবাসে এটায় কী স্বার্থ আপু? ‘

জোর পূর্বক হাসে নিধি। উত্তর দেয়,

‘ বোকা মেয়ে ওর ভালোবাসায় স্বার্থ আছে বলছিনা৷ কিন্তু তোর ভালোবাসায়ও স্বার্থ নেই। ‘

সিমরান থমকানো কণ্ঠে বলল,

‘ সৌধ ভাই কেন পেল না তোমাকে? ‘

স্মিত হেসে নিধি জবাব দিল,

‘ তুই পাবি বলে। যার জন্য যেটা মঙ্গলদায়ক সৃষ্টিকর্তা তাকে সেটাই দেয় রে সিনু বুড়ি। ‘
.
.
বেলা করে ঘুমানো মেয়েটা যে ইদানীং সাতসকালে ওঠে পড়ে খেয়াল করেছে উদয়িনী। আজও ভোরবেলা ওঠে সিমরান৷ হাসফাস চিত্তে পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের পাতা উল্টায়৷ দু’টো কফি করে এনে দরজার সামনে উপস্থিত হয় উদয়িনী৷ মিষ্টি হেসে এগুতে এগুতে বলে,

‘ আম্মুজান আজো জলদি ওঠেছে দেখি। ‘

ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকায় সিমরান৷ ঈষৎ হেসে মুখ ফিরিয়ে বইয়ের পাতায় চোখ রাখে। ইদানীং আম্মুকে ভীষণ শান্ত আর স্নিগ্ধ লাগে সিমরানের কাছে। অদ্ভুত একটা পরিবর্তন হয়েছে তার আম্মুর৷ আব্বুর মাঝেও পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটি হচ্ছে তার আব্বু, আম্মুকে এখন একসঙ্গে বসে থাকতে দেখা যায়, গল্প করতে দেখা যায় এবং রাতে তারা এক ঘরে একই বিছানাতে ঘুমায়। ঠিক আগের মতোন স্বাভাবিক। ভালোবাসা না থাকলেও তাদের মধ্যে যে স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল সেটি যেন ফিরে এসেছে আবার। সিমরানের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক ঠিক বুঝতে পারে এটি সম্ভব হয়েছে আম্মুর কারণেই। একটা মেয়ে চাইলে আসলে সবই সম্ভব। বিশেষ করে একজন সভ্য পুরুষকে সঠিক পথে আনা কঠিন কিছু নয়৷ একটু সম্মান, যত্ন, ভালোবাসা এবং সততা পেলে পুরুষ মানুষ বশ মানতে বাধ্য। সোহান খন্দকার ভীষণ ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। আগ বাড়িয়ে গরম হওয়ার ব্যাপারটা তার ব্যক্তিত্বে নেই। তার মধ্যেকার বিশেষ গুণটি হলো, সে মানুষকে ক্ষমা করতে পারে। বিশেষ করে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া, নিজের ভুল বুঝতে পারা মানুষ গুলোকে সে পছন্দ করে। এরা প্রকৃত অর্থেই ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য৷ জীবন থেকে যা কিছু হারিয়ে গেছে তা হয়তো ফিরে পাওয়া সম্ভব না৷ কিন্তু যা কিছু রয়ে গেছে তা ধরে রাখা সম্ভব। সোহান খন্দকার হয়তো এ কারণেই ঘরে মন দিয়েছে। তার মন নরম করেছে উদয়িনীর মাঝেকার আমূল-পরিবর্তন। নানারকম ভাবনা, কল্পনা, জল্পনা করে গোপনে হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ে সিমরান। উদয়িনী তার পাশে চেয়ার টেনে বসে কফি এগিয়ে দেয়। বলে,

‘ শরীর তো ভীষণ দুর্বল। ঠিকঠাক খাবার না খেলে, ঘুম না হলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তো। ‘

মেয়ের শরীরের দিকে তাকিয়ে, চোখ লক্ষ্য করে কথাগুলো বলল উদয়িনী। সিমরান ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে কফির মগ হাতে নিল। এক চুমুক দিয়ে বলল,

‘ কিছু হবে না। আব্বু ওঠেছে? ‘

‘ হ্যাঁ, তুমি অন্য প্রসঙ্গ টেনো না। কী নিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগছ সেটা শেয়ার করো। ‘

আকস্মিক স্তব্ধ হয়ে গেল সিমরান৷ তার ব্যস্ত আম্মু মেয়ের দিকে খেয়াল করেছে তাহলে? একটুখানি হাসে সিমরান। বলে,

‘ ছুটিত শেষ। যাচ্ছ না কেন? ‘

‘ ছুটি বাড়িয়েছি। ‘

‘ কেন? ‘

‘ ভালো লাগে না আর। হাঁপিয়ে ওঠেছি খুব৷ ভাবছি রিটায়ার্ড করে নিব। ‘

‘ সে কী! আর তো ক’টা বছর সময়ের আগে রিটায়ার নিতে পারবে? ‘

‘ উপযুক্ত কারণ দেখালে পারব। ‘

‘ কী দেখাবে? ‘

‘ আমি অসুস্থ। ‘

আঁতকে ওঠল সিমরান। বলল,

‘ মিথ্যা বলবে? ‘

‘ জীবনে প্রচুর মিথ্যা বলেছি। এবার সত্যি বলেই নিব। ‘

মন খারাপ হয়ে গেল সিমরানের। বলল,

‘ সামান্য অসুখে রিটায়ার নেয়া যায়? ‘

সিমরান জানে বয়সের কারণে বেশকিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে উদয়িনীর। তাই বলল কথাটা। উদয়িনী মৃদু হেসে বলল,

‘ যায়। ‘

মেয়ের সাথে কথোপকথনের এ পর্যায়ে সুহাসের কল পেল উদয়িনী। রিসিভ করতেই জানতে পারল, আজ তারা তিন বন্ধু কক্সবাজার যাচ্ছে। সঙ্গে নামীও যাবে। আইয়াজের যে মেয়েটার সাথে রিলেশন চলছে সে মেয়েটার সাথে আজই বিয়ে করার পরিকল্পনা করছে আইয়াজ৷ পরিকল্পনা অনুযায়ী সব হলে আইয়াজের বউও যাবে৷ এ পর্যন্ত কথা বলেই ফোন কেটে দিল সুহাস। গোপনে হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল উদয়িনী। ছেলের সাথে তার দূরত্ব দূরত্বই রয়ে গেল৷ আর কমল না। যতটুকু সম্পর্ক ততটুকু বোধহয় দায়ে পড়ে। প্রয়োজন ব্যাতীত কথা বলে না ছেলেটা। মায়ের প্রতি ছেলের ভালোবাসা কতটুকু ক্ষীণ হয়েছে চার বছরে ভাবলেই বুক কাঁপে উদয়িনীর। সিমরান বেশকিছু ক্ষণ উশখুশ করে হঠাৎ বলল,

‘ ভাইয়া কক্সবাজার যাবে? সৌধ ভাইও? ‘

উদয়িনী মাথা নাড়াল৷ সিমরান হঠাৎ আকুল স্বরে বলে ওঠল,

‘ আমিও যাব আম্মু। ‘

উদয়িনী ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বলল,

‘ কী সব বলো? ভাই ভাবি আর তার বন্ধুরা যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে তুমি কী করবে? ‘

মন খারাপ হয়ে গেল সিমরানের। সব আকুলতা নিভিয়ে কফির মগে চুমুক দিল। বুঝতে পারল সত্যি ঝোঁকের বশে আম্মুর কাছে এমন একটি আবদার করা উচিত হয়নি।
.
.
সকাল হতে না হতেই নজরুল মিঞার বাসায় সুজা এমপির ছোটো ছেলের আগমন। নজরুল মিঞা সম্পর্কে ফারাহর দুলাভাই। প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার। লোকটাকে প্রথম দেখাতে পছন্দ হয়নি সৌধর। চোখ দু’টো দেখে মনে হচ্ছে কঠিন কামাসক্ত মানুষ। এই মনে হওয়া নিয়ে একটুও বিব্রত নয় সৌধ। পুরুষ হয়ে নারীর চোখের ভাষা বুঝতে সে অক্ষম হলেও পুরুষের চোখের ভাষা বুঝতে অক্ষম নয়। সৌধর সঙ্গে তার ছোটো চাচা আর সুহাস এসেছে। তারা এসেছে আইয়াজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। নজরুল মিঞার শুধু চোখ দু’টিই সন্দেহ জনক নয়। তার ব্যবহারেও প্রকাশ পাচ্ছে অতিভক্তি। যা চোরের লক্ষণ। সে যাইহোক এসবে যায়-আসে না সৌধ বা সুহাসের৷ তারা মূল কথা বলল। প্রথমে নজরুল মিঞা বুঝতে পারছিলেন না এত বড়ো ঘরের লোক তার বাসায় কেন? কিছুটা ভয় আর কৌতূহল থেকে সম্মান দেয়ার পাশাপাশি অতিরিক্ত কথাও বলে ফেলেছে। পাঁচ মাসের গর্ভবতী স্ত্রী আর শালিকাকে খাঁটিয়ে আপ্যায়নও করেছে। কিন্তু তাদের আসার কারণ জানতে পেরে হঠাৎ দমে গেলেন যেন৷ আমতা আমতা করে বললেন,

‘ ফারাহকে চেনেন আপনারা? ওর কারণেই আসছেন? ‘

সৌধ মাথা নাড়ায়। ওর চাচা সুলল চৌধুরী বলে,

‘ আমরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি৷ আপনাদের অনুমতি পেলে আজই বিয়ে পড়ানো হবে। পরে ধীরেসুস্থে মেয়ে ওঠিয়ে দেবেন। ‘

ফারাহর বর্তমান গার্জেন বলতেই নজরুল মিঞা আর তার স্ত্রী। সবাই এ সম্পর্কে জানে। এতিম মেয়েটা বোন আর দুলাভাইয়ের দায়িত্বে আছে। ভালো পাত্র পেলে খুশি মনে বিয়ে দেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নজরুল মিঞা খুশি হলেন না। স্বস্তিও পেলেন না৷ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকলেন। তার এহেন আচরণের মাথা মুণ্ডু খুঁজে পেল না কেউই। আগের মতো আর ধৈর্য নেই সৌধর৷ বর্তমানে তার মাথা খারাপই বলা যায়। তাই নজরুল মিঞার ইনিনো বিনানো, আমতা আমতা ভাবে প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। আকস্মিক চোয়াল শক্ত করে, কঠিন চোখে তাকাল নজরুল মিঞার দিকে৷ নজরুল মিঞা হকচকিয়ে গেলেন। এমপির ছেলে সৌধ। ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। এরা ক্ষেপে গেলে তার চাকরি যেতে সময় লাগবে না। এ শহরে থাকাও স্বস্তি দায়ক হবে না৷ জীবনেরও গ্যারান্টি থাকবে না৷ রাজনীতির সাথে জড়িত মানুষ গুলো কতখানি ভয়ংকর হয় জানে সে৷ তাই ঢোক গিলল। সৌধ তার ভয় পাওয়া বুঝতে পেরে ভয়কে দ্বিগুণ করতে বলল,

‘ ফারাহর বাবা,মা নেই৷ অর্থাৎ এ পৃথিবীতে ওর কোনো অরিজিনাল গার্জেনই নেই। তাই আমরা ফারাহর অনুমতির পর বড়োজোর আপনার স্ত্রীর অনুমতি নিতে পারি৷ এরপরও আপনাকে বলছি জাস্ট ভদ্রতার খাতিরে৷ এবার আপনিও ভদ্রতার পরিচয় দিন। নয়তো আমরা অভদ্রতার পরিচয় দেব।’

সুহাস তখন সৌধর গা ঘেঁষে বসে ফিসফিস করল,

‘ দোস্ত দুলাভাইকে সুবিধার লাগছে না৷ নিশ্চিত ভেজাল আছে। ‘

‘ ভেজাল আছে তা তো প্রথম পলকেই টের পেয়েছি। জাস্ট ওয়েট, বেশি বুঝলে দুলাভাইয়ের পশ্চাৎদেশে ব্যান্ড বাজিয়ে আইয়াজ, ফারাহর বিয়ে দিব। ‘

সুহাস মাথা দুলাল একটু। বুঝতে পারল তার প্রিয় বন্ধুটি নিজের ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে বন্ধুদের নিয়েও চিন্তায় আছে। সে যে আঘাত পেয়েছে এ আঘাতের সম্মুখীন যেন তার আর কোনো ঘনিষ্ঠ মানুষ না হয় সেই প্রচেষ্টা করছে। সত্যি এই ছেলেটার মনে যেমন খাঁটি প্রেম রয়েছে ঠিক তেমনি রয়েছে বন্ধুত্ব। এমন একজন মানুষকে সৃষ্টিকর্তা এভাবে নিঃস্ব করে দিতে পারে না৷ যদি করে দেয় তাহলে এর চারগুণ নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেবে?

|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here