#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৩১|
ভালোবাসা ভালো কিন্তু ভালোবাসায় অন্ধত্ব বোকামি। সৌধর মতো শক্ত ব্যক্তিত্বের পুরুষটাও দিনশেষে হেরে গেল। সত্যিই কি হারল? খাঁটি প্রণয়ে কি হার শব্দটি জড়ায় কখনো? নাকি এই হারটাই একদিন বিস্ময়কর জয়ে পরিণত হবে? সৌধ কি সত্যি হেরে যাওয়ার মতো ছেলে? দিনশেষে আসলে হারল কে? যে গভীর প্রণয় আহ্বান করল সে নাকি যে নিষ্ঠুরভাবে প্রত্যাখ্যান করল সে? বনেদি পরিবারের ছেলে সৌধ। রূপ, গুণ, বংশপরিচয়, আত্মমর্যাদা সবকিছুতে শতভাগ এগুনো ছেলেটা নিঃস্বার্থ ভাবে কেবল নিধি নামক এক সাধারণ পরিবারের মেয়েকেই ভালোবেসেছিল। আর পাঁচটা ছেলের মতো অহরহ নারী লোভ ছিল না তার। এক নারীতেই আসক্ত ছিল পাঁচটা বছর। সেই নারীটার শত প্রত্যাখ্যান মেনে নিয়েও আশায় বেঁচেছিল। এক নারীকে বুকে পুষেই স্বপ্ন দেখেছিল। আজকের পর সব আশা, সব স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটবে। পুরুষের গভীর প্রেম যে নারীর হৃদয় ছুঁতে পারেনা। সে নারীর জীবনে প্রেম কি কেবলই মরীচিকা নয়?
বলিষ্ঠ লম্বা হাত, পা গুলো ছড়ানো সৌধর৷ গোল গোল রক্তিম চোখ দু’টো নিষ্পলক তাকিয়ে নিধির বিধ্বস্ত, অশ্রুসিক্ত মুখটায়৷ সকলের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ নীরবতা চলল। সুজা চৌধুরী বুড়ো আঙুল দ্বারা নিজের বাম ভ্রু চুলকাচ্ছে। গভীর চিন্তা করা কালীন ভ্রু চুলকায় তিনি৷ তানজিম চৌধুরী ছেলের পানে বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সৌধর ভেতরে কী ঝড় বইছে টের পাচ্ছেন তিনি। একসঙ্গে এত ধাক্কা সামলে ওঠতে বেগ পেতে হচ্ছে। তার ছেলে নিধিকে পছন্দ করে জানতেন না তিনি। আজ যখন জানতে পারলেন তখন আর কিছু করার রইল। আর যাইহোক কারো বউকে তো আর ছেলের জন্য নিয়ে আসতে পারবেন না তারা। যেখানে মেয়েটাও স্পষ্ট বলছে সে সৌধর সঙ্গে বন্ধু ব্যাতীত আর কোনো সম্পর্কে জড়াতে চায় না। সৌধর বুক ফাটা আর্তনাদ মা হয়ে যেন শুনতে পেলেন তিনি। স্বামীর দিকে তাকালেন করুণ চোখে৷ সুজা চৌধুরীও স্ত্রীর পানে তাকালেন একবার। এরপর তাকালেন পাশে বসা ভঙ্গুর ছেলেটার দিকে। মেয়ে হলে নিশ্চয়ই তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদত? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। ছেলের কাঁধে হাত রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
‘ আব্বা, আজ পর্যন্ত আমার দ্বারা কোনো অন্যায় হয়নাই। তুমি চাইলে আজ একটা অন্যায় আমি করতে পারি৷ কিন্তু কথা দিতে হবো তুমি এতে সুখ পাবা। ‘
সুজা চৌধুরীর কথা শুনে সৌধ বাদে উপস্থিত সবাই কেঁপে ওঠল। থমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিধিও। সে আঁচ করতে পারল কী ভয়ানক একটি কথা সুজা আংকেল বলেছেন। ভয়ে তটস্থ হয়ে ওঠল সে। হাত, পা কাঁপতে শুরু করল মৃদুভাবে। সৌধর দৃষ্টিজোড়া তখনো তার দিকে অনড়। বাবার কথায় নিধির হাত, পায়ের কাঁপন, মুখে ভীতিগ্রস্ত ভাব। স্পষ্টই দেখতে পেল। সহসা চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলল সৌধ। তানজিম চৌধুরী দেখলেন দু’গাল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়াল। মুহুর্তেই আঁচলে মুখ ঢেকে ডুকরে ওঠলেন তিনি৷ সুহাস, আইয়াজ আচমকা সৌধর দিকে তাকাতেই দেখতে পেল বিস্ময়কর দৃশ্যটি। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না সুহাস। ছুটে গিয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল। ছুটে এলো আইয়াজও। কাঁধে হাত রেখে তীব্র ক্রোধে তাকাল নিধির পানে। নিধি জড়োসড়ো হয়ে ঠাঁই বসে। সৌধ যেভাবে ছিল ওভাবেই রইল৷ না বন্ধুদের ধরল আর না চোখ তুলে তাকাল। কিয়ৎক্ষণ পর হঠাৎ দৃঢ়স্বর ভেসে এলো সৌধর,
‘ ছাড় আমাকে। ‘
সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিল সুহাস। সরে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে উদ্যত হতেই সৌধ ঘাড় বাঁকিয়ে বাবার পানে তাকাল। বাবার চোখে চোখ রেখে দৃঢ় স্বরে বলল,
‘ আপনাকে কোনো অন্যায় করতে দিব না আমি। ‘
সুজা চৌধুরী প্রচণ্ড দুঃশ্চিন্তায় ছিলেন। আকস্মিক ছেলের কথা শুনে রুদ্ধশ্বাস ছাড়লেন। যা বোঝার বুঝে গেছেন৷ তাই স্ত্রী তানজিমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ ড্রাইভারকে ফোন দেও। নিধিকে হসপিটালে পৌঁছে দিতে বলো। ‘
স্ত্রীকে কথাটা বলেই ফের ছেলের দিকে তাকালেন। সৌধ চুপচাপ আগের জায়গায় বসে পড়ল। আগের ন্যায় তাকিয়ে রইল নিধির পানে। পরিস্থিতি বুঝেশুনে ওঠে দাঁড়াল নিধি। কিন্তু আর একবারো সৌধর দিকে তাকানোর সাহস পেল না। সুজা চৌধুরী নিধিকে বললেন,
‘ যা কিছু হইছে এরজন্য আমার ছেলেকে যদি ক্ষমা করতে পারো করো নয়তো অনুমতি দিলাম ওর বিরুদ্ধে যা যা পদক্ষেপ নেওয়ার আইনিভাবে নেও। ‘
সুজা চৌধুরী চৌকশ চরিত্রের মানুষ। সে ঠিক জানে নিধি কোনো পদক্ষেপই নেবে না। আর নিলেও তা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা তার আছে। তবু নিজের দাম্ভিকতা দেখিয়ে কথাটা বললেন। এরপরই ওখান থেকে প্রস্থান করলেন তিনি৷ সঙ্গে করে নিজের মাকেও নিয়ে গেলেন। ছেলেকে সামলাতে রেখে গেলেন স্ত্রী আর ছেলের বন্ধুদের। স্বামী প্রস্থান করতেই মুখ খুললেন তানজিম চৌধুরী। বললেন,
‘ আজকালকার মেয়ে মানুষ হয়ে তুমি কী কাজ করলা বুঝলাম না। আমার ছেলে কোন দিক দিয়ে কম? তোমরা না লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াইতেছ? শুনছি তোমার নাকি মুখের ওপর উচিত কথা বলার স্বভাব আছে? বাপের বিরুদ্ধে যাইয়া ডাক্তারি পড়ছ? এমন মেয়ে হইয়া পরিবার চাপ দিল আর বিয়ে করে নিলা! মেয়েতো আমারো আছে। ‘
তানজিম চৌধুরীর কথায় স্পষ্ট রাগ। নিধি অবাক হলো না। সৌধর মা হিসেবে এটুকু স্বাভাবিক তাই ঈষৎ হেসে বলল,
‘ যার পরিস্থিতি সেই বুঝে। তাছাড়া আমিত বলেছি ওর প্রতি আমার উইকনেস ছিল কিন্তু ভালোবাসা না। ‘
তানজিম চৌধুরী মুখ ঝামটা দিলেন। সুহাস এসে নিধির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘আই কান্ট বিলিভ তুই এভাবে বিয়ে করতে পারিস।’
নিধির মাথা ধরে গেল। কোনোরকমে সোজা হয়ে সুহাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উত্তর দিল,
‘ মি ঠু সুহাস। ‘
চোখ, মুখ শক্ত হয়ে ওঠল সুহাসের। নিধি আর কথা বাড়াতে চাইল না। তার এবার যাওয়া উচিত। অর্পণ স্যার কেমন আছে জানা উচিত। বিনা দোষে, নিরপরাধ হয়ে মানুষটা যা কিছুর মুখোমুখি হলো। সবটার জন্য একমাত্র সে দায়ী। আকস্মিক পেছনে তাকাল নিধি৷ রোবটের মতো তাকিয়ে থাকা সৌধর দিকে কয়েক পল চেয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল৷ চোয়াল শক্ত করে লম্বা একটি শ্বাস নিয়ে পা বাড়াল দরজার দিকে। সৌধর ঘোর কাটল ঠিক তক্ষুনি। বসা থেকে তড়াক করে ওঠে এলো সে। বন্ধু, মাকে অতিক্রম করে নিধির সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। চমকে ওঠল নিধি। ঢোল গিলে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সৌধর পাগলপ্রায় মুখটায়। তানজিম চৌধুরী ত্বরিত এসে ছেলেকে ধরতে চাইল তার আগেই হাত ওঠিয়ে মাকে নিষেধাজ্ঞা দিল সৌধ। বলল,
‘ আমি ঠিক আছি আম্মা। তুমি অস্থিরতা কমাও। ‘
চুপসে গেলেন তানজিম চৌধুরী। সুহাস, আইয়াজ দু’জনই এগিয়ে এলো। নিধি সুহাসের দিকে করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। যেন সে খুবই অসহনীয় এখন। সৌধ বুঝতে পারল, নিধির বুকে এখন কেবলই অর্পণ স্যারকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা। তার হৃদয় যে চুরমার হয়ে যাচ্ছে এতে বিন্দুমাত্র হুঁশ নেই বেইমানটার। আকস্মিক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠল সে। উন্মাদ গ্রস্ত কণ্ঠে বলল,
‘ তিন কবুল পড়ে বিয়ে করেছিস? ‘
দৃষ্টি নত করে মাথা নাড়াল নিধি। সৌধ বলল,
‘ আমার দিকে তাকিয়ে বল। ‘
নিধি তাকাল না৷ কয়েক পল অপেক্ষা করে ফের সৌধ বলল,
‘ তুই অন্যকারো বউ? ‘
নিধি হ্যাঁ বোধকে মাথা নাড়াল। হঠাৎ মায়ের দিকে তাকাল সৌধ। বলল,
‘ আম্মা একটু সরে দাঁড়াও ব্যক্তিগত কোশ্চেন করব। ‘
তানজিম চৌধুরী একবার নিধির দিকে তাকিয়ে সরে গেলেন কিছুটা। বুকের ভেতর অস্থিরতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে তার। সৌধকে স্বাভাবিক ঠেকছে না। ছেলেটা নিজের মধ্যে নেই। মা সরে যেতেই নিধির খুব কাছাকাছি হয়ে দাঁড়াল সৌধ। একদম মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে শুধাল,
‘ বাসর করেছিস? ‘
আঁতকে ওঠল নিধি। হতভম্ব হয়ে একবার সৌধ আর একবার পাশে সুহাস, আইয়াজের দিকে তাকাল। তীব্র অস্বস্তি ঘিরে ধরল ওকে। তাদের বিয়ের অনেক গুলো দিন কেটে গেছে। স্বামী হিসেবে যখন অর্পণ স্যারকে গ্রহণ করেছে। তখন সব ধরনের অধিকারও দিয়েছে। ব্যক্তিগত এই প্রশ্নটিতে বিব্রত হলো খুব। ঢোক গিলল ঘনঘন৷ সৌধ যেন মরিয়া হয়ে ওঠল জানার জন্য। সহসা চিৎকার করে বলল,
‘ কী হলো বল সে ক্স করেছিস তোর অর্পণ স্যারের সাথে? ‘
কাঁধ ঝাকিয়ে কেঁপে ওঠল নিধি। চোখে পানি ছেড়ে দিয়ে স্বীকার করল। হয়েছে বাসর। মুহুর্তেই বীভৎস এক চিৎকার দিয়ে ছিটকে দূরে সরে গেল সৌধ। সুহাসকে বলল,
‘ বিশ্বাসঘাতক, বেইমানটাকে চোখের সামনে থেকে নিয়ে যা। আর এক মুহুর্তও যদি ও আমার সামনে থাকে প্রাণ নিয়ে বেরুতে পারবে না। ‘
কথাটা বলেই মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সৌধ। দৃষ্টি মেঝেতে স্থির। নিধিও আর এক মুহুর্ত দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে চলে গেল। তার পেছনে গেল সুহাস। কিয়ৎক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর সৌধর কাছে তানজিম চৌধুরী এলেন। ছেলের কাঁধে হাত রেখে কিছু বলতে উদ্যত হতেই সৌধ মায়ের হাত ছাড়িয়ে হঠাৎ দৌড় দিল। সিঁড়ি বেয়ে, ড্রয়িং রুম পেরিয়ে সদর দরজার বাইরে চলে গেল ছেলেটা। তানজিম চৌধুরী চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ছেলের পেছনে ছুটলেন। ছুটল আইয়াজও। ভেতর ঘর থেকে নামী, সিমরান সহ সবাই বেরিয়ে এলো। সদর দরজার বাইরে বেরুতেই দেখতে পেল নিধি গাড়িতে ওঠতে নিচ্ছিল এমন সময় সৌধ গাড়ির ডোর টেনে ধরল। বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিতে নিতে বলল,
‘ আল্লাহর কসম তোকে আমি ক্ষমা করব না। ‘
নিধি স্তব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে। সুহাস সৌধকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। আইয়াজ পিছন থেকে টেনে ধরেছে। তবু সৌধ টলছে না। নিধি ফের গাড়িতে ওঠতে নিলে সৌধ ওর আঁচল টেনে ধরল। বলল,
‘ তুই আমার গভীর ভালোবাসা দেখেছিস, ঘৃণা দেখিসনি। ‘
এ পর্যায়ে হুহু করে কেঁদে ফেলল নিধি। বলল,
‘ সৌধ আমাকে ক্ষমা কর তুই। ‘
নিধির কান্নায় আরো ক্ষেপে গেল সৌধ। বুকের বা’পাশে চেপে ধরে বলল,
‘ আমার ভালোবাসায় অন্যকারো অধিকার। আমার অধিকারে অন্যকারো আধিপত্য। কসমরে, মরে গেলেও ক্ষমা পাবি না। তোর মতো ছলনাময়ীর জায়গা এই বুকেও আর হবে না। ‘
কথাগুলো বলে সরে আসতে নিয়েও আসল না। নিধির একদম পেছন ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে গা থমথমে কণ্ঠে বলল,
‘ তোর স্বামীকে যেন আমার ত্রিসীমানায়ও কখনো না দেখি। যদি ভুলেও কোনোদিন দেখিরে…জীবন বাজি রেখে বলছি, ও আর প্রাণ নিয়ে তোর কাছে ফিরবে না! যে অধিকারে ও তোর কাছে যায় আজন্মের মতো শেষ করে দিব সেই অধিকার। যে পরিচয়ে আজ তুই আমাকে খু ন করে গেলি চিরতরে খু ন হয়ে যাবে সেই পরিচয়! ‘
|চলবে|
®জান্নাতুল নাঈমা
রিচেক দিইনি। ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।