#অদৃশ্য এক সত্তা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব – ৬
রাকি দেখানোর পর কিছু অদ্ভুত বিষয় পরিলক্ষিত হয়। রাকি কে ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে হাসপাতালে আনার ব্যবস্থা করা হয়। কারণ রোগী না দেখে রাকির পক্ষে চিকিৎসা করা সম্ভবপর ছিল না। দেখা যেত রাকি যখন কোরআন তেলোয়াত করতো তখন অদ্ভুত কিছু আওয়াজ আমার মুখ দিয়ে বের হতো। কখনো কখনো চোখ বড় হয়ে যেত। আবার কখনো কখনো দম বন্ধ হয়ে কাশির বিস্তার হত। আবার কখনো কখনো মনে হতো যে আমার বুকে কেউ পাথর দিয়ে চেপে ধরেছে। আমার দম নিতে কষ্ট হতো। প্রচন্ড রকমের খারাপ লাগতো এবং মাথায় ব্যথার সঞ্চার হতো।
সব মিলিয়ে রাকি প্রথম দিনে বুঝতে পারল আমার সাথে এমন কিছু আছে, যা আমাকে সুস্থ হতে দিচ্ছে না। হতে পারে আমার কিছু আপনজন আমাকে বান মেরেছে অথবা বদ নজর লেগেছে। রাকির নিকট প্রথম দিনেই আমার রোগের ধরন সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভবপর হয়নি। তবে আমার মধ্যে জ্বীন জাতীয় সমস্যা আছে এটা তিনি কনফার্ম করে গেছেন।
রাকি চলে যাওয়ার পর আমার অবস্থা আরো খারাপ হতে শুরু করে। হঠাৎ করে মাথার বাম পাশটা প্রচন্ড আকারে ব্যথা শুরু হতে থাকে। নাক মুখ দিয়ে আবারও রক্ত যেতে শুরু করে। আমার অবস্থার অবনতি দেখে আমাকে আবার অবজারবেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং ডাক্তার কঠোরভাবে বারণ করে দেয় রাকিকে না আসতে। উনি আসার ফলেই আমার শারিরীক অবনতি ঘটেছে। আমার বাবাও বিষয়টা জানতে পেরে মায়ের সাথে অনেক রাগারাগি করেন।
এদিকে আবারও দুদিনের জন্য আমি জ্ঞান হারাই। আমার অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। একে তো ওজন কমে গিয়েছে। তার উপর শরীরে ঘা। সে সাথে পুজরক্ত বমি তো আছেই। সব মিলিয়ে আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর সময় আমি পার করছিলাম মনে হচ্ছিল। এটা যে কতটা কষ্টদায়ক ছিল সেটা মনে হলে এখনও গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। টানা দুদিন পর আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখন মনে হলো কেউ আমার পাশে বসে হাসছে আর বলছে।
“আমাদের তাড়াতে চাস তাই না? আমাদের তোর থেকে কেউ তাড়াতে পারবে না। তাড়ানোর কোনো চেষ্টা করলে তোকে এভাবেই কষ্ট দিব।”
এ কথাগুলোই আমার কানে আসছিল। হতে পারে এটা আমার মনের ভুল অথবা এটা সত্যই। কথোপোকোথন আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হতে হতে থেমে যায়। আমার মাথা হালকা হতে থাকে। মনে হচ্ছিল কোনো বোঝা আমার মাথা থেকে নেমেছে। আস্তে আস্তে শরীরে একটু একটু শক্তি পাচ্ছিলাম। হাত পা পুরোপুরি নাড়াতে না পারলেও একটু একটু নাড়াতে পারছিলাম। এতদিনে পিঠের ক্ষতের জায়গায় কোনো সেন্স ছিল না তাই তেমন একটা ব্যথা অনুভব করিনি। এখন একটু একটু সেন্স আসায় পিঠটায় প্রচুর ব্যথা শুরু হয় আর সে সাথে জ্বলুনি। সেদিন আবার অবজারবেশন থেকে আমাকে কেবিনে দেওয়া হয়। সে সময়ে পরিবারের অবস্থা কতটা সূচণীয় ছিল এখন সেটা আমি একটু হলেও টের পাই। না পারছিল পরিবার সঠিক কোনো চিকিৎসা করতে না হচ্ছিল আমার উন্নতি। একের পর এক টেস্ট করেই যাচ্ছিল তবে মূল রোগটা ধরা পড়ছিল না। সবমিলিয়ে আমার মা বাবা শেষ পর্যায়ে এসে হতাশ হয়ে পড়ে। একে তো টাকার উপর টাকা যাচ্ছে। এত টাকার জোগান দিতেও হিমশিম খাচ্ছে পরিবার। সব মিলিয়ে হাহাকার করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
মা, বাবা চিন্তায় ঘুমাতে পারত না। আর এদিকে যতই আমার শারীরে সাড় পেতে শুরু করলাম ততই আমার ব্যথা তীব্র হতে লাগত। সারা শরীর ব্যথা করত। পিঠের ক্ষতটা মরিচের মতো জ্বলত। মাথার পেছন দিকটা অসম্ভব হারে ব্যথা করত। আমি একটুও ঘুমাতে পারতাম না। যেদিকে নড়তাম সেদিকে কেবল ব্যথা। শরীরে অসাড়তা কমলেও ব্যথার তীব্রতা বেড়ে গিয়েছিল। যার দরুণ এবার শারিরীক যন্ত্রণা শুরু হয়। সারাদিন রাত শারিরীক যন্ত্রণায় চিৎকার পারতাম। মাথার ব্যথায় মনে হত দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। বারবার মনে হত আমি কেন বেঁচে আছি। এত অসহ্য যন্ত্রণা কেন সহ্য করছি। এর থেকে আমি মরে গেলেই ভালো হত। চিন্তারা সব হানা দিয়ে আমাকে পরপারে যাবার অনুপ্রেরণা দিত।
ডায়বেটিস নেই অথচ পিঠের ঘা টা কোনোক্রমেই শুকাচ্ছিল না। সব মিলিয়ে আমার অবস্থা আরও খারাপ। চিল্লায়ে চিল্লায়ে কাঁদতাম। ব্যথায় কাঁতরাতাম। বারবার মনে হত আমাকে কেউ মারার চেষ্টা করছে। যন্ত্রণা গুলো কেউ ইচ্ছা করে দিচ্ছে। লোমশ কিছু বস্তুর স্পর্শ অনুভব করতাম। সবমিলিয়ে এ সূচণীয় অবস্থার শেষ পরিণতির জন্য দিন গুনতেছিলাম। কিন্তু শেষ যেন আর হচ্ছিল না।
সেদিন রাতে ব্যথার হাই ডোজ ইনজেকশন দেওয়ার পর আমার ব্যথা একটু কমলে আমি ঘুমানোর চেষ্টা করি। একটা পর্যায়ে হালকা ঘুমও হয় আমার। তবে সেটা আসার সাথে সাথে মনে হলো একটা বিভৎস লাশ, আমার উপর শুয়ে আছে। যার সারা শরীরে কাফনের কাপড় মুড়ানো। আমি দম নিতে পারছিলাম না, চোখও খুলতে পারছিলাম না, সে সাথে জিহ্বা নাড়িয়ে কথাও বলতে পারছিলাম না। অনেকক্ষণ এ পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি। মৃত্যু যন্ত্রণা কী? হয়তো একটু হলেও টের পেয়েছিলাম সেদিন। একটু হলেও বুঝতে পেরেছিলাম জাহান্নামের কষ্ট কত করুণ হতে পারে।
সে কাফন পরা লাশটা যেন হুট করেই সবল হলো আর আমার বুকে এসে চেপে বসল। হাত দুটো দিয়ে আমার গলা চেপে ধরল। যার দরুণ আমার গলা দিয়ে আমার দুর্গন্ধ যুক্ত রক্ত বের হতে শুরু করল। আর তার পর থেকে কাহিনি আবার নতুন মোড় নিল।
চলবে?