#কুসুমিত_কামিনী ( ৬ )
#রেহানা_পুতুল
খবরদার বলছি। একদম চুপ। এই অমানুষের সাথে এখন আপনাকেও খু’ন করে ফেলব আমি। তারপর নিজেই ধরা দিব থানায়।
মাহতিম ও খালেদ অচেনার মতন জান্নাতের দিকে চেয়ে থাকে স্তম্ভিত চোখে। তারা দুজনেই চুপ হয়ে আছে। মাহতিম ফুফার সামনে লজ্জায় ছোট হয়ে গেল। কি ভাববে ফুফা। অথচ ফুফার কাছে কত প্রশংসা করল জান্নাতের। ফুফাও জান্নাতকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে গেল। আর যখন দেখল,
তখন জান্নাত তার কাছে পরিচিত হলো খারাপ, মেন্টাল হিসেবে।
জান্নাত খালেদের এক হাত টেনে ধরে বলল,
আপনার শরীর কেটে আমার দেওয়া সব রক্ত বের করে ফেলব। আপনি একটা খবিশ,ইতর,পশু,বর্বর। আপনার বেঁচে থাকার অধিকার নেই।
খালেদ তব্দা খেয়ে গেল আচম্বিতে। কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছেনা তার জান্নাতের এমন উদ্ভট আচরণ।
মাহতিম ঝট করেই জান্নাতের দুহাত পিছমোড়া করে ধরল। হাত থেকে ছুরিটি কেড়ে নিল।
জান্নাত কাঁপা কাঁপা উত্তেজিত কন্ঠে মাহতিমকে অনুনয় করে বলল,
আমাকে ছাড়ুন বলছি। প্লিজ। আমি কেন এমন করছি তার প্রমাণ নিয়ে আসি। আধঘন্টা সময় লাগবে মাত্র।
কিসের প্রমাণ আনবে? তুমি একটা সাইকো। তোমাকে মেন্টাল হসটপিটালে নিয়ে যাব এক্ষুনি।
মাহতিম। ওকে ছেড়ে দাও। যেতে দাও।
শীতল গলায় অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল খালেদ।
মাহতিম দূর্বার কৌতুহলমাখা চোখে খালেদের দিকে চাইল। ছেড়ে দিল জান্নাতকে। জান্নাত ব্যস্তপায়ে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে গেল।
কি ব্যাপার ফুফা? আপনি ওকে চিনেন? বিস্মিত চোখে জিজ্ঞেস করলো মাহতিম।
একদম না। আমি ওকে চিনি কেবল তোমার স্ত্রী হিসেবে। এবং এই এখন প্রথম দেখলাম ওকে। সেতো পাগল নয় মাহতিম। যেই মেয়েটা আমার জন্য রক্ত দিল স্বেচ্ছায়। এত আন্তরিক হয়ে দেখতেও এলো। তাহলে সে কি কারণে আমার মুখ দেখামাত্রই এমন হিংস্র হয়ে উঠল। এটা জানা জরুরী।
মাহতিম থমকালো কিছুক্ষণ। আপনি ঠিক বলছেন ফুফা। কিন্তু আপনার সাথে তার কিসের এত বিদ্বেষ। সেটাই আমার ব্রেনে ঢুকছেনা। সে ছুরিটা কোথায় পেল? আমাদের বাসায় এমন ছুরি নেই। দেখতে একদম নতুন মনে হচ্ছে।
তাহলে হয়তো আমাকে মারার জন্যই কিনেছে। কিন্তু তুমিতো বের হয়ে গেলে কি আনতে যেন। আবার ফিরে এলে কেন?
আমি নিচে নেমেই প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই দেখলাম মানিব্যাগ নেই। তখন টেবিলে রাখলাম যে নিতে ভুলে গিয়েছি। তাই মানিব্যাগ নিতেই এলাম আবার।
আল্লাহ সর্ব শক্তিমান। তিনি বড়ই দয়ালু। লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল খালেদ।
মাহতিম মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। মাকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত খুলে ফেলল। তার মা অকল্পনীয়ভাবে আশ্চর্য হলো ঘটনার আকস্মিকতা শুনে। তারা তিনজন হাসপাতালে চলে এলো কিছু সময়ের ভিতরেই।
কেবিনে ঢুকে বসল। জান্নাত এখনো আসেনি। তারা খই ফোটার মতো বিরতিহীনভাবে নানান প্রশ্নের ঝড় তুলল নিজেরাই। উত্তর ও হাতড়ে খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করল। খালেদকে মাহতিমের মা নানাভাবে বহু প্রশ্ন করেও কোন সদুত্তর বের করতে পারেনি।
কিছুক্ষণ পর জান্নাত ফিরে এলো। সাথে তার মা মধুলতা। রুমে ঢুকেই মধুলতা সালাম দিল মাহতিমের মা বাবাকে। তারা অবাক চোখে চাইলো জান্নাত ও মধুলতার দিকে। জান্নাত কারো সাথে কোন কথাই বললনা। দৃষ্টিতে তার এক সমুদ্র ক্রোধ ও কাঠিন্যতা। সে তার মায়ের হাত ধরে খালেদের বেডের কাছে নিয়ে দাঁড় করালো।
খালেদ শুকনো ঢোক গিলল। গোপনে জিভ ভিজিয়ে নিল। জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো,
মধুলতা তুমি!
বাকিরা হরর সিনেমার নিরব দর্শকের মতো হা হয়ে চেয়ে আছে খালেদের দিকে। তারা সবাই একে অপরের সাথে লুকানো দৃষ্টি বিনিময় করছে সংকেতময় ভাষায়।
এই মেয়েটা কে?
যাকে আপনি কন্যা সন্তান বলে ছুঁড়ে ফেলেছেন। সেই।
মানে?
মানে আমার গর্ভে আপনার জন্ম দেওয়া সন্তান কুসুমিত কামিনী।
খালেদ মৃগী রোগীর মতো থরথর করে কাঁপতে লাগল। বলল তার মানে আমার মেয়ে মাহতিমের স্ত্রী?
বাকিরা এখনো নিঃশ্চুপ হয়ে আছে। বহুকষ্টে নিজেদের ধৈর্যের পরিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে৷ ঘটনার সারমর্ম অনুধাবন করার জন্য অধীর আগ্রহান্বিত হয়ে ওদের বাক্যলাপ শুনছে।
আমার মেয়ে শব্দ দুটো শুনেই জান্নাত বাঘীনির মত গর্জন করে উঠল।
খবরদার বলছি! আপনার জিভ খসে পড়বে আমাকে মেয়ে বলে উচ্চারণ করলে। আপনার একজনের জন্য আমাদের তিন তিনটি জীবন বিপন্নের মুখোমুখি। আপনি আমার মাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে নিলে সে আর ওখানে থাকতোনা। আমার আশ্রয় হতোনা পিতৃহীনভাবে অন্যের বাসায়। আমি মাকে দেখার জন্য প্রতি সপ্তাহে যেতে হতনা সেখানে। আর সেটা উনি দেখে গিয়ে আমাকে চরমভাবে ভুল বুঝল। আপনার জন্য আমার জীবনে বাসর রাত আসেনি। আপনার জন্য উনিও উপভোগ করতে পারেনি বিয়ের প্রথম রাত। উনার চোখে আমি একজন খারাপ মেয়ে। দোষ উনার নয়। দোষ আপনার।
আমার জীবনে সমস্ত অবদান আমার মা আর পালিতা মা মিনারার। আপনি একটা নর্দমার কীট। ছিহ! কন্যা সন্তানের প্রতি আপনার এত অবজ্ঞা? পুত্র সন্তান জন্ম হয়নি বলে আপনি কথা দিয়েও আমার মাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেননি। কোনদিন কোন খোঁজ খবর নেননি। আপনি মানুষ নামের অমানুষ! আপনার ক্ষমা নেই। ফিরিয়ে দিতে পারবেন আমার জীবনের আনন্দগুলো? ফিরিয়ে দিতে পারবেন আমার মায়ের স্বপ্নের একটি সাজানো সংসার?
আমি এখন আমার মাকে এনেছি আপনার কোন করুণা ভিক্ষার জন্য নয়। কেবল আমার স্বামী যে আমাকে সন্দেহ করেছে ভুল বুঝেছে। তার প্রমাণ দিতে। আমি আমার মাকে নিয়ে সারাজীবন একাই বেঁচে থাকব। আমাদের দুজনের জীবনে কাউকেই প্রয়োজন নেই। না আপনাকে। না আপনার মাহতিমকে।
এই বলে জান্নাত তার মায়ের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। মা চলে আস৷ এখানে আর একমূহুর্ত নয়।
খালেদ এতক্ষণ জেলখানার পলাতক আসামীর মতো জান্নাতের করা অপমানগুলো নিরবে হজম করে গেল।
জান্নাতের দিকে চেয়ে আকুতি করে বলল,
মা আমার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার অন্তত সুযোগ দাও। তুমি স্থির হয়ে একটু বসো। মধু বসনা একটু আমার পাশে।
কোন বসাবসি নেই। এই মা চলো।
রবিউল এবার মুখ খুললেন। শাসনের সুরে বললেন,
বৌমা আশাকরি তুমি আমার কথার অবাধ্য হবেনা। কি করা যায় আমি দেখছি। তুমি শান্ত হও। মাহতিম তুমি বউকে নিয়ে বারান্দায় যাও। খালেদের সাথে আমাদের কিছু কথা আছে।
আমি যাব। নমনীয় স্বরে বলল মধুলতা।
না বোন। আপনি বসেন।
মাহতিম জান্নাতের হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে গেল। জান্নাতের মাথাকে টেনে যত্ন করে নিজের বুকে চেপে ধরল।
আজব। আমার মাথা ছাড়ুন বলছি।
অসীম বিরক্তি নিয়ে বলল জান্নাত।
মাথা বেশী গরম হয়ে গিয়েছে। ঠান্ডা করতে হলে এই হৃদয় নামক সমুদ্রে ডুবিয়ে রাখতে হবে। নয়তো বোমার মতো ফুটে উঠবে। পরে আমিসহ উড়ে যাব।
জান্নাত নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল। মাহতিম জান্নাতের আঁখিকোণ হতে নিজের আঙুলের ডগায় দুফোঁটা অশ্রু নিল।
দুহাত জোড় করে জান্নাতের নয়ন সম্মুখে ধরল। প্রেমিক সুলভ নিবেদিত কন্ঠে বলল,
সর্যি ফর অল। প্লিজ আর রাগ জেদ পুষে রেখনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি এক পৃথিবী।
জারা কি তাহলে?
গলায় একরাশ অভিমানের ঝাঁঝ ঢেলে বলল জান্নাত।
আই হেইট জারা। আই লাভ ইউ জান্নাত।
আমি বুঝলামনা খালেদ ভাই। আপনি বিয়ে করলেননা। অথচ উনার কাছে যেতেন। আবার কথা দিয়ে বিয়ে করেননি মেয়ে হলো। সবকিছু নিচু মানুষিকতার কাজ। আপনার দ্বারা এসব কিভাবে সম্ভব! আমিতো চিন্তা করতেই মাথা ভনভন করে উঠছে৷
আমাকে লজ্জা দিবেন না ভাবি। এই বলে খালেদ মধুলতার সাথের বিষয়গুলো তার মত করে সাজিয়ে বলল। এবং মধুলতাকে এই মুহুর্তে বিয়ে করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিলো।
কেবিনের ভিতর থেকে ডাক পড়ল মাহতিমের।
জান্নাত ও মাহতিম ভিতরে গেল।
রবিউল একটা কাজী অফিসের ঠিকানা দিয়ে বলল পুত্রকে,
কাজী সাহেবকে নিয়ে আয়। খালেদ আর উনার বিয়ে হবে এক্ষুনি।
নাহ! অসম্ভব! বলে বজ্রকন্ঠে বাধা দিল জান্নাত।
চলবেঃ ৬