#আঙুলে_আঙুল
#অন্তিম_পর্ব
সঞ্জয়ান ভেবেছিল শূভ্রাকে নিয়ে ঢাকার প্লটটিতে থাকবে। এতে তার কলেজে যাওয়া-আসা সহজ হবে। পরক্ষণেই মনে পড়ল, ব্যবসায়ের কাজে সে পুরো বাংলাদেশে ঘুরে বেড়ায়। রাত যাপন করে। সেই সময় শূভ্রা একা হয়ে যাবে। দিনটা এক রকমভাবে কাটিয়ে দিলেও রাতটা ভীষণ অসুবিধার হবে। এখান থেকে শূভ্রার বাসাটা কাছে। সেখানে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হবে। তাই তাকে গ্রামে মায়ের কাছে নিয়ে গেল। কলেজে কথা-বার্তা বলে বদলির ব্যবস্থাও করেছে। স্বর্ণলতা ছেলের এই পরিবর্তনে ভারি খুশি, সন্তুষ্ট। দুজনের সম্পর্ক ঠিক করার যে বাড়তি দুশ্চিন্তা ছিল সেটাও গায়েব হয়ে গেছে। হাসি বদনে দায়িত্বের সুরে ছেলেকে বললেন,
” নতুন কলেজ, নতুন জায়গা। বউমা কিছুই চিনে না। প্রথম কয়েক দিন তুই দিয়ে আসিস, নিয়ে আসিস। ”
সঞ্জয়ানের এই সময়টা কাজের চাপ কম। অবসর সময় কাটে। মায়ের কথা মেনে নিল নির্দ্বিধায়। শূভ্রাকে নিয়ে কলেজে দিয়ে আসা ও নিয়ে আসার কাজে লেগে পড়ে পরদিন থেকে। এমনই একদিন নিজের গাড়িতে করে তাকে নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল বেজে ওঠে। মোবাইলটা বের করার জন্য পকেটে হাত দিতে অন্য কিছুর উপস্থিতি টের পায়। সন্দেহ ও কৌতূহলী মনে সেটা বের করতে দেখে, শূভ্রার আইডি কার্ড। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যায়, তাদের মধ্যে প্রথম ঝগড়ার সৃষ্টি হয়েছিল এই কার্ডটির জন্যই। সে শূভ্রাকে কার্ডটি ফিরিয়ে দিল তখনই। সে কার্ডে চোখ বুলিয়ে তাকাল সঞ্জয়ানের দিকে। দৃষ্টি কড়া করে বলল,
” এবার প্রমাণ হলো তো আমি মিথ্যা বলিনি? দোষ করলেন আপনি আর বকা খেলাম আমি! শাস্তি হলো আমার। ছবিটাও পুরোটা দেখতে পারিনি। ”
শূভ্রার কণ্ঠস্বরের তেজটা বিকেলের আলোর মতো নিভে এলো শেষটায়। চোখ-মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে ফিরিয়ে নিতে সঞ্জয়ান বলল,
” কার্ডটা কোথায় রেখেছি মনে পড়ছিল না। সেজন্যই নতুন কার্ড বানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। আমার দোষ মেনে নিয়ে শোধরেও নিয়েছি। যেটা তুমি করোনি। ধরা খেয়েছ, বকা খেয়েছ, শাস্তি পেয়েছ তবুও ক্লাস ফাঁকি দেওয়া ছাড়নি। ”
শূভ্রার ফোলা মুখটা ঘুরে গেল সঞ্জয়ানের দিকে। অবাক স্বরে সুধাল,
” আপনি কী করে জানলেন? আমার পেছনে লোক লাগিয়েছিলেন? ”
” না। অনুমান করলাম। আর সেটা সত্যি বলে প্রমাণিত হলো। ”
শূভ্রা নিজের বোকামিটা ধরতে পেরে চোখদুটি বন্ধ করে ফেলল। নিজেকে মনে মনে বকা দিতে দিতে মুখ ফিরিয়ে নিল জানালার দিকে। শান্ত স্বরে বলল,
” ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অন্যকিছু করেছি, সিনেমা দেখতে যাইনি আর। ”
” খুব আফসোস হচ্ছে, তাই না? ”
শূভ্রা কী একটা উত্তর দিতে চেয়েও থেমে গেল। চোখের চাহনি স্থির করল জানালার বাইরে। ব্যাপারটি সঞ্জয়ানের চোখেও পড়ল। গাড়ির গতি কমিয়ে তাকাল শূভ্রার দিকে। তার মনে হচ্ছে মেয়েটা বড্ড বেশি চুপচাপ হয়ে পড়ছে। আগের মতো ঝগড়া করে না। তর্কবিতর্কের একটা ভাব ফুটে উঠেও হারিয়ে যায় মুহূর্তে। এর কারণ কী হতে পারে তাই উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করছে। বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর মনে হলো, পরিবারকে মনে পড়ছে হয়তো। বন্ধু-বান্ধবও কম ছিল না! কলেজে একঝাঁক বন্ধুর মধ্যে দেখা যেত প্রায়শই। তার মধ্যে ছেলে বন্ধুই অধিক ছিল। পড়ালেখায় ফাঁকিবাজি, মাঠের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি, হুড়াহুড়ি, অভদ্রতা, চিৎকার করে কথা বলার মতো খারাপ গুণগুলো এদের থেকেই এসেছে। তার খারাপ গুণগুলো মনে করে সঞ্জয়ান যেমন বিরক্ত হলো তেমন সেগুলো হঠাৎ করে হারিয়ে যাওয়ায় মনখারাপও করল। মনে হলো, শূভ্রার বেড়ে উঠা, চলাফেরা যেমনই হোক না কেন তার মধ্যে স্বাধীনতা ছিল। যেটা সে ছিনিয়ে নিয়েছে। হতে পারে অনিচ্ছায় কিন্তু নিয়েছে তো! স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনার মধ্যে আকস্মিক অনুতাপের আলো পড়ল বুক জুড়ে। সেটা থেকে মুক্তি খোঁজার চেষ্টা থেকে বলল,
” আমাদের এখানেও সিনেমা হল আছে। যাবে? ”
প্রস্তাব শুনে প্রথম দফায় চমকাল সে। পর মুহূর্তে বিস্মিত সুরে প্রশ্ন করল,
” এখন? আমরা তো কলেজ যাচ্ছি। ”
শূভ্রা সরাসরি প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দেয়নি। সঞ্জয়ান বুঝে গেল, তার যাওয়ার ইচ্ছে আছে। সে তৎক্ষনাৎ রাস্তা বদলে ফেলে বলল,
” চলো, তোমার আফসোস দূর করে আসি। ”
” আমার ক্লাস? লেকচারগুলো মিস হবে। নোট করতে পারব না। ”
” কারও কাছ থেকে তুলে নিও। ”
” কার থেকে তুলব? আমার একটাও বন্ধু নেই। বছরের মাঝে নতুন কলেজে দিয়েছেন। সবাই যার যার মতো বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে। আমার সাথে কেউ কথা বলে না। ”
সঞ্জয়ান গাড়ি চালানোতে মনোযোগ রেখে সুধাল,
” নোট তুলতে না পারার চেয়েও বন্ধু বানাতে না পারার আফসোসটা বেশি মনে হচ্ছে। ”
শূভ্রা চুপ হয়ে গেলে সে পুনরায় বলল,
” এ কলেজে আমিও পড়েছি। কোন স্যার কী পড়ায় সব আমার জানা। বই আর খাতা নিয়ে এসো আমি নোট করে দেব। ”
সঞ্জয়ানের গাড়ি থেমে গেছে। শূভ্রাকে নামার জন্য ইশারা করে বলল,
” এখানটায় দাঁড়াও। আমি গাড়িটা পার্কিং-এ রেখে আসছি। ”
সে চলে যেতে শূভ্রা আশপাশে তাকাল। দৃষ্টিসীমায় সিনেমা হল ধরা পড়ছে না। সঞ্জয়ান কাছে আসতে জিজ্ঞেস করল,
” কোথায় সিনেমা হল? দেখতে পাচ্ছি না যে। ”
সে মৃদু হেসে বলল,
” দেখতে পাবে। আগে কলেজের ড্রেসটা বদলাও। নাহলে লোকে ভাববে, কলেজ থেকে মেয়ে চুরি করে এনেছি। ”
” কী! এখানে? ”
শূভ্রার কণ্ঠে ভয়, লজ্জা। চোখ-মুখে অসহায়ত্ব। সঞ্জয়ানের হাসি চওড়া হলো। তার পেছনের একটা পার্লার দেখিয়ে বলল,
” ওখানে। চলো। ”
তাকে অনুসরণ করতে করতে শূভ্রা বলল,
” এটা বদলে কী পরব? আমি ব্যাগে করে বই এনেছি, জামাকাপড় নয়। ”
তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। চুপচাপ কাচের দরজাটা ঠেলে ঢুকে পড়ল পার্লারে। সেখানকার মেয়েরা ব্যস্ত ও আগ্রহসহিত তাদের ঘিরে ধরলে সঞ্জয়ান বলল,
” ও কে সাজাতে হবে। এমনভাবে সাজাবে যেন কলেজের ছাত্রী বুঝা না যায়। ”
বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে সাবধানের সুরে বলল,
” আবার মাত্রাতিরিক্ত মেকাপ করে চেহারা পাল্টে দিবেন না। হালকা সাজের মধ্যে শুধু পোশাকটা পরিবদর্তন করলেই চলবে। ”
___________
সঞ্জয়ান আধ ঘণ্টার মতো আশপাশটা ঘুরে ফিরে এলো। কাচের দরজা ঠেলে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
” হয়েছে? ”
ভেতর থেকে একজন উত্তর করল,
” আর পাঁচ মিনিট, স্যার। ”
পাঁচ মিনিটের জায়গায় আরও দশ মিনিট পার হয়ে গেল। সঞ্জয়ান শুধু শুধু দাঁড়িয়ে না থেকে গাড়িটা নিয়ে এলো পার্কিং লট থেকে। তখনও শূভ্রা বাইরে আসেনি। সে হাত ঘড়িটা দেখল, দশটা পার হয়েছে। তার ইচ্ছে এগারোটার শো দেখার। এখান থেকে সিনেমা হলের দূরত্ব ত্রিশ-চল্লিশ মিনিটের মতো। বাসায় গিয়ে মায়ের প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে শূভ্রাকে পার্লার থেকে পোশাক বদলের ব্যবস্থা করেছে। এখন মনে হচ্ছে, বাসায় গেলেই ভালো হতো। এদের বেহিসেবী সময়ের মধ্যে পড়ে সিনেমা হলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হচ্ছে। সঞ্জয়ান ইঞ্জিন চালু রেখে গাড়ি থেকে নামার জন্য দরজা মেলল। একপা বাইরে ফেলতে দেখে, পার্লার থেকে একটা মেয়ে বেরুচ্ছে। পরনে সাদা শাড়ি, খোঁপায় বেলি ফুলের মালা, কানে মুক্তোর দুল। দুই হাত ভর্তি চুড়িগুলো মৃদু ছন্দ তুলছে হাঁটা ও বার বার কুঁচি ধরার জন্যে। চোখ-মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে মেয়েটা এই কাপড়টি পড়ায় অভ্যস্ত নয়। প্রচণ্ড বিরক্ত! সে সঞ্জয়ানের কাছে এসে অভিযোগের সুরে বলল,
” দেখেন তো কী পরিয়ে দিয়েছে! আমি একপা রেখে আরেকপা ফেলতে পারছি না। মনে হচ্ছে খুলে যাচ্ছে কোনোদিক দিয়ে। চুলকাচ্ছেও। ”
বলতে বলতে মেয়েটি তার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে পুনরায় বলল,
” পিঠটা চুলকে দিন তো। এখানে বেশি চুলকাচ্ছে। আমার হাতও পৌঁছাচ্ছে না, ধুর! ”
সঞ্জয়ান ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
” শূভ্রা, ভেতরে এসে বসো। ”
” বসছি। আগে চুলকে দিন। ”
শূভ্রা আরেকটু পিছিয়ে দাঁড়াল। সঞ্জয়ান পিঠে নখের আঁচড় কাটতে চেয়েও থেমে গেল। হাত গুটিয়ে বলল,
” তোমার শাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে। ভেতরে এসো। সময় নষ্ট করো না। পরে শো শুরু হয়ে যাবে। আগেরবার প্রথম অর্ধেক দেখেছিলে এবার শেষের অর্ধেক দেখতে হবে। ”
এই কথাটায় কাজ হলো। সে দুই হাতে শাড়ি ধরে সঞ্জয়ানের পাশে গিয়ে বসল। গাড়ি ছুটতে জিজ্ঞেস করল,
” আমাকে কুৎসিত লাগছে? ”
সে এক ঝলক তাকিয়ে বলল,
” মুখটায় কী যেন নেই! ”
শূভ্রা দ্রুত প্রশ্ন করল,
” কী নেই? ”
সঞ্জয়ান আরও একবার তাকাল। ভালো করে মুখটা পর্যবেক্ষণ করার পর বুঝল, মুখে লজ্জা নেই। শাড়ি নারীর পোশাক হলেও প্রথমবার পরার পর তারা ভীষণ লজ্জা পায়। কিন্তু শূভ্রা পাচ্ছে না। উত্তর না পেয়ে শূভ্রা নিজ থেকেই বলল,
” লিপস্টিক, কাজল, টিপ সবই তো পরেছি! ”
” হ্যাঁ, চেহারা আগের মতো থাকলেও বয়সটা বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে, আমার পাশে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের কোনো যুবতী বসে আছে। মেকাপের যাদু এত মুখে শুনেছি, আজ প্রমাণ পেলাম। ”
এই মন্তব্যের বিপরীতে শূভ্রা কিছু বলল না। মনে মনে ভাবল, তাকে কুৎসিত বুড়ি লাগছে। সে মনখারাপ করবে তাই সরাসরি কথাটা বলতে পারছে না।
__________
সিনেমা হলে ছবি শুরু হতে শূভ্রার মনের ভাবটা মুছে গেল। উচ্ছ্বসিত চিত্তে ভীষণ মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে। একের পর এক দৃশ্য চলছে। বাংলা ছবি। প্রেম ও ভালোবাসার কাহিনি। অধিকাংশ দৃশ্যেই নায়ক ও নায়িকা। স্বাভাবিকভাবেই একটি চুমুর দৃশ্য চলে আসল। ঠিক এই সময়ে শূভ্রার মনে পড়ল সে বন্ধুদের সাথে নয়, সঞ্জয়ানের সাথে এসেছে। যে একসময় স্যার ও পরবর্তীতে তার স্বামী হয়েছে৷ সে লজ্জায় পড়ে গেল। বিব্রত হলো। অস্বস্থি ছড়িয়ে পড়ল সর্বাঙ্গে। বুঝতেই পাচ্ছে না, স্ক্রিনে চেয়ে থাকবে নাকি অন্য কোথাও। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে কয়েক সেকেন্ড। তারপরে আচমকা চেয়ার ছেড়ে উঠে বেরিয়ে আসে হল থেকে। সঞ্জয়ানও তার পেছনে পেছনে আসে। কোনোরূপ প্রশ্ন না করে গাড়িতে গিয়ে বসে। শূভ্রা পাশে বসতে ছুটে চলে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
এই ঘটনার পর শূভ্রা ও সঞ্জয়ান সামনাসামনি হয়নি আর। শূভ্রা বাসায় ফিরে দুটো প্রাইভেট শেষ করে শাশুড়ির রুমে বসে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারপরে এই রুমে আগমন ঘটে সঞ্জয়ানের। মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
” আমাকে ঢাকা যেতে হবে। দুদিন থাকব সেখানে। ব্যাগটা গুছিয়ে দাও। ”
স্বর্ণলতা সঙ্গে সঙ্গে বললেন,
” আমাকে বলছিস কেন? এখন না তোর বউ আছে? তাকে বল। ”
সঞ্জয়ান তাকাল শূভ্রার দিকে। সে এখনও শাড়ি পরে আছে। অথচ সকালের দিকে বলেছিল, হাঁটতে পারছে না, চুলকাচ্ছে। এরমধ্যে অভ্যস্ত হয়ে গেল? প্রশ্নটা মনে রেখে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
” ও ছোট মানুষ। এখনও নিজের জিনিস গুছাতে পারে না। আমারটা কী গুছাবে? ”
” নিজেরটা না পারলেও স্বামীরটা পারবে। প্রয়োজনে তুই শিখিয়ে দিবি। ”
কথার মাঝে ছেলের বউয়ের দিকে তাকালেন তিনি। বললেন,
” যাও, মা। ব্যাগটা গুছিয়ে দেও। ভয় পেও না। ও কিছু বললে আমাকে এসে জানাবে। ”
শূভ্রা উঠে দাঁড়াল। সঞ্জয়ানের রুমে ঢুকতে সে বলল,
” তুমি কি শাড়ি পরে প্রাইভেট পরেছ? ”
” হ্যাঁ। আপনি তো খুলতে বলেননি। ”
” আমাকে না বলে একা হল থেকে বেরিয়ে পড়লে আর শাড়ি খুলতে পারলে না? আশ্চর্য! ”
শূভ্রা জিজ্ঞেস করল,
” আপনি কি আমাকে বকা দিলেন? ”
” না। তোমার বোকামি চিনিয়ে দিলাম। ”
সঞ্জয়ান ট্রলি ব্যাগটা রাখল বিছানায়। চেইল খুলতে খুলতে বলল,
” ওখানে দাঁড়িয়ে না থেকে বিছানায় এসে বসো। দেখ, আমি দূরে কোথাও গেলে কী কী নিয়ে যাই। ”
সে বাধ্য মেয়ের মতো এসে বসলেও মুখটা গোমরা। আজ সে দুটো অন্যায় করেছে। এজন্য মানুষটা রেগেও আছে। ঠিক মতো প্রকাশ করছে না। হয়তো মনে মনে শাস্তি ঠিক করছে। কী শাস্তি হতে পারে? আরও একটি প্রাইভেট মাস্টার রাখা? তাহলে তো দশটার পর যে এক ঘণ্টা টিভি দেখে সেটাও আর দেখতে পারবে না!
” এগুলো ইকবাল মামাকে ফেরত দিয়েছিলে? ”
শূভ্রা সচেতন হলো। সঞ্জয়ানের হাতে আইফোন, কিছু গয়না, শাড়িসহ নানান জিনিস। সে উত্তর করল,
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
” মামা বলেছিলেন, এখানে থাকার জন্য যা চাইব তাই দিবে। তখন এগুলো চেয়েছিলাম। এখন তো আমি নিজের ইচ্ছায় থাকছি। তাই মামার জিনিস মামাকে ফেরত দিয়েছি। ”
” জিনিসগুলো মামা এনে দিলেও টাকা আমার থেকেই নিয়েছে। তাই ফেরত দেওয়া লাগবে না। রেখে দাও। ”
শূভ্রার পাশে জিনিসপত্রগুলো রেখে সঞ্জয়ান নিজের কাজে লেগে পড়ল আবার। শূভ্রার মনোযোগ শুরুতে ব্যাগের মধ্যে থাকলেও এখন গিয়ে পড়ল তার পরনের সাদা শার্টটিতে। ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল একটি সন্ধ্যা, কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়ানো শূভ্র আলো ছড়ানো পুরুষ ও পায়রাটির কথা। সেই সময়টাকে আরও একবার মনের মধ্যে লালন করতে করতে আকস্মিক বলল,
” আপনি কি এই শার্টটি পরেই যাবেন? ”
” হ্যাঁ। কেন? কোনো সমস্যা? ”
শূভ্রা মাথা দু’পাশে নেড়ে ‘ না ‘ বুঝিয়ে উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে হেঁটে গিয়ে থামল। সঞ্জয়ানের দিকে না চেয়ে বলল,
” অন্য রঙের কিছু পরুন। ”
” কেন? সাদা রঙ তোমার পছন্দ নয়? ”
সে মাথা নত করে ফেলল। সাদা রঙ তার খুব পছন্দ। সেজন্যই পার্লারে শাড়ি পছন্দ করার সময় সাদা রঙটা পছন্দ করেছে। শূভ্রা সত্য স্বীকার করল,
” পছন্দ। ”
” তাহলে? আমাকে এই রঙে মানায় না? ”
সে উত্তর দিতে পারল না। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে চলে গেল শাশুড়ি মায়ের রুমে।
___________
সঞ্জয়ান মা ও বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দরজার দিকে এগুল। স্বর্ণলতা শূভ্রার দিকে চেয়ে বলল,
” যাও, মা। গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসো। কিছু লাগলে বলে দিও, লজ্জা পেও না। আসার সময় ঢাকা থেকে নিয়ে আসবে। ”
শূভ্রা মাঝে কিছুটা দূরত্ব রেখে সঞ্জয়ানের পেছন পেছন যাচ্ছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে উঠোনের মধ্য স্থানে আসতে সঞ্জয়ান পেছন ঘুরল। বলল,
” যেখানে লজ্জা আশা করেছি সেখানে লজ্জা নেই, যেখানে আশা করিনি সেখানে লজ্জার ঢেউ বয়ছে! তুমি না কলেজের ছাত্রী? আজকাল তো প্রেমিক-প্রেমিকারা চুমুর চেয়েও বেশি কিছু করে। আমি তোমার প্রেমিকও না, স্বামী। ”
শূভ্রা চোখ তুলে বিস্ময়ের সাথে সুধাল,
” এর মানে আপনি চুমুর চেয়েও বেশি কিছু করবেন? ”
” কী বলি আর কী বুঝে! ”
সঞ্জয়ানের চোখে, মুখে ও কণ্ঠে বিরক্তের আভা। আর কথা না বাড়িয়ে বলল,
” আর আসতে হবে না। ভেতরে যাও। ”
তার আদেশমতো ভেতরে এলেও মনের মধ্যে একটা খচখচ ভাব চলে এলো। সেটা দূর করতে ফোন দিল অরুণিমাকে। সে ধরতে বলল,
” আপু, মিথ্যা বললেই তো ভালো। সত্য বললে শুধু রেগে যাচ্ছে। আমার সংসারটা আর টিকবে না মনে হয়। নিয়াজকে বলো দাও, আমার টেবিল, বিছানা যেন নষ্ট না করে। শীঘ্রই আসছি। ”
” রেগে যাচ্ছে মানে? তোকে ধমকাচ্ছে? মারছে? ”
” না। ”
” তাহলে? ”
শূভ্রা ধীরে-সুস্থে সব জানাল। অরুণিমা শুনার পর বলল,
” শুধু কথা শুনলে আর সত্য কথা বললে হবে না। ভালোবাসাও দেখাতে হবে। এক কাজ কর, এখনই স্যারকে কল দিয়ে বল, ‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি। ‘
____________
মাইমূন কাজ শেষ করে বাসায় ফিরেছে সন্ধ্যার দিকে। রুমে ঢুকতে অরুণিমার কথাটা শুনতে পায়। জিজ্ঞেস করতে সেও সরলমনে স্বামীকে শূভ্রা ও সঞ্জয়ানের ব্যাপারটি বলল। শোনার পর মাইমূন কৌতূক করে বলল,
” শুধু কথা শুনলে আর সত্য কথা বললে হবে না। ভালোবাসাও দেখাতে হবে। এক কাজ করো মাইমূনকে কল করে বলো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ”
অরুণিমা কৃত্রিম রাগ নিয়ে বলল,
” মজা করছ? ”
” উহু, উপদেশ দিচ্ছি। শূধু শূভ্রা না তোমারও এই উপদেশটা প্রয়োজন। কারণ, তুমি আমাকে ভালোবাসি বলো না। ”
মাইমূন পরনের কাপড় পাল্টাচ্ছে। অরুণিমা ধোয়া লুঙ্গি ও তোয়ালে এনে দিয়ে বলল,
” আমাদের এখন ভালোবাসা মুখে বলার প্রয়োজন নেই। তাই বলি না। ”
সে লুঙ্গিতে গিট দিচ্ছিল। কথাটা শোনামাত্র থেমে গেল। অরুণিমার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
” তাহলে কিভাবে বলব? শরীরের স্পর্শে? ভালোবাসা, বিয়ের পর তো তুমি বেশ আবেগি আর স্বামী পাগল হয়েছ। আগে জানলে, শুরুতেই বিয়ে করে নিতাম। ইশ, কতগুলো দিন নষ্ট হলো! ”
রাতে খেতে বসে মাইমূন দেখল, টেবিলে ভাতের সাথে ভাজি আর ডাল। মুহূর্তেই তার মনটা ভার হয়ে গেল। মলিন মুখে বলল,
” একসাথে খাওয়ার জোরটা না করলে হতো না? আমি জন্মের পর এই টেবিলে মাংসের বাটিটা খালি দেখিনি! ”
পেছন থেকে দিদারুল করিমের গলা পাওয়া গেল। খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
” ঠিক বলেছ। কিন্তু তোমার জন্মের পর না দেখলেও আমার জন্মের পর দেখেছি। এর মানে এসব খেয়ে আমি অভ্যস্ত। ”
অরুণিমাকে বেড়ে দিতে হলো না। নিজ আগ্রহে প্লেটে ভাত আর ভাজি নিয়ে একসঙ্গে মাখলেন। মুখে তুলে আয়েশ ভঙ্গিতে খেতে খেতে বললেন,
” অমৃত! সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। ”
আরেক লোকমা মুখে তুলে বললেন,
” আমি উপার্জন করে বাবাকে খাওয়াতে পারিনি৷ তুমি পেরেছ। এবার বলো তো, কে ভাগ্যবান? ছেলে হিসেবে তুমি নাকি বাবা হিসেবে আমি? ”
মাইমূন উত্তর করল,
” আমরা দুজনেই। ”
___________
সঞ্জয়ানের ঢাকা পৌঁছাতে বেশ রাত হয়। খুব ভোরে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে বের হতে হবে। একদম দেরি করা যাবে না। তাই পৌঁছে কাপড়টা বদলে নেয়। হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় শুয়ে মোবাইলটা হাতে নিতে একটা মেসেজ ঢুকল। নাম্বারটা কন্টাক্টের তালিকায় না থাকলেও অচেনা নয়। কী লিখেছে পড়ার জন্য আগ্রহবোধ করল। বার্তা বাক্সে ঢুকে দেখল তাতে লেখা,
‘ সাদা রঙে আপনাকে জোসনার মতো সুন্দর লাগে। জোসনাকে সবাই ভালোবাসে। সেও সবার ভালোবাসা গ্রহণ করে গলে গলে পড়ে। কিন্তু আপনি তো জোসনা না। মানুষ। তারপর পুরুষ। একজন পুরুষের কি উচিত সব মেয়ের ভালোবাসা গ্রহণ করা? ‘
সঞ্জয়ান উত্তরে লিখল,
‘ জোসনাকে সবাই ভালোবাসে। এই সবার মধ্যে কি শুধু মেয়ে পড়ে? ছেলেরা জোসনা পছন্দ করে না? ‘
সেকেন্ড কয়েক পরে উত্তর এলো,
‘ জানি না। জোসনা পছন্দ করা ছেলের সাথে আমার পরিচয় হয়নি। ‘
সঞ্জয়ান লিখল,
‘ পরিচয় ছাড়াই জোসনা পাগল ছেলের নাম্বারে মেসেজ দিচ্ছ? ‘
‘ আপনি জোসনা পছন্দ করেন? ‘
‘ অবশ্যই। নাহলে আমার ঘরে জোসনা রঙের কাপড়ে ভর্তি হয়? যা বার বার তোমার চোখে পড়ে? ‘
এবার উত্তর আসতে একটু দেরি হলো। এই সময়ের মধ্যে সঞ্জয়ানের স্মরণ হলো, শূভ্রারও সাদা রঙ পছন্দ। দুজনের মধ্যে হাজারটা অমিলের মধ্যে এই একটা মিল। ঠিক যেন হাজারটা তারার মধ্যে একটা চাঁদ! তার এই ভাবনার মধ্যে মেসেজের উত্তর এলো,
‘ আমি যদি একটু সুন্দর হতাম, তাহলে একটা আবদার করতাম। শুনেছি, সুন্দরী বউয়ের কথা জামাইরা ফেলতে পারে না৷ ‘
সঞ্জয়ান এই উত্তরটা মুখে বলতে চাইল। তাই কল দিল। শূভ্রা ধরল না। মেসেজ পাঠাল,
‘ এখানে বলুন না। ‘
সে জবাবে লিখল,
‘ কল ধরো। ‘
মেসেজটা পাঠিয়ে আবার কল দিল। শূভ্রা ধরল না। তৃতীয় বারে বন্ধ পেল। সঞ্জয়ান থামল না। মায়ের নাম্বারে কল করে শূভ্রাকে চাইল। মিনিটের মাথায় সে ধরলে সঞ্জয়ান বলল,
” সুন্দরী বউদের আবদার জামাইরা যেমন ফেলতে পারে না৷ তেমন কুৎসিত বউদের আবদার করার পূর্বে জামাই বুঝে যায় ও পূরণ করে দেয়। ”
কথাটা বলে সে কল কেটে দিল। গোছানো ব্যাগ থেকে অন্য একটা সাদা শার্ট পরে বেরিয়ে পড়ল বাসার উদ্দেশ্যে। মাঝ রাস্তায় অরুণিমাকে একটা মেসেজ লিখে পাঠাল, ‘ সবসময় তোমার বোনের নামে অভিযোগ করেছি, বদনাম করেছি। আজ প্রশংসা করব। শূভ্রার অনেকগুলো খারাপ গুণের মধ্যে একটা ভালো গুণ আছে। সেটা হলো ওর সরলতা। এই একটা গুণই হয়তো আমাদের বিয়েটাকে আজীবন বাঁচিয়ে রাখবে। খোদাকে অশেষ ধন্যবাদ যে, তুমি আমার ভালো লাগা পর্যন্তই ছিলে। দোয়া করো, শূভ্রা আমার সেই ভালো লাগার গণ্ডি পেরিয়ে যেন ভালোবাসাতে পৌঁছায়। ‘
সঞ্জয়ান যখন বাসায় পৌঁছাল তখন ভোরের আলো ফুটছে। শূভ্রা গভীর ঘুমে অচেতন। তার ঘুম ভাঙাল না। খুব সাবধানে পাশে শুয়ে কানের কাছে ফিসফিসে বলল,
‘ শূভ্রা নামের অর্থ শ্বেত। শ্বেত অর্থ সাদা রঙ। আর সাদা রঙ আমার ভীষণ পছন্দ। এরপরও তোমাকে অসুন্দর বলা যায়? বাবা ঠিকই বলেছিলেন, যেদিন তোমার সৌন্দর্য আমার চোখে পড়বে সেদিন অন্য কোনো সৌন্দর্য আমাকে আকর্ষণ করবে না। ঠিক যেমন তোমার পাশে ভোরের আলোটাও ফিকে লাগছে। ‘
সমাপ্ত
[ গল্পটি আরও বড় হতো, আরও গভীর হতো। হয়তো সমাপ্তিটাও একটু ভিন্ন হতো। কিন্তু গল্পটা লেখায় এত অনিয়মিত ও দীর্ঘ গ্যাপ পড়ে যাচ্ছিল যে আমি নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হয়েছি, রাগ করেছি। তার মধ্যে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা তো আছেই। তাই আর বড় করে আপনাদের অপেক্ষায় রাখলাম না। আশা করছি, পরবর্তী গল্পটা নিয়মিত লিখতে পারব এমন অবসর সময় বের করতে পারলেই আপনাদের পড়ার সুযোগ করে দিব। ততদিন আপনারা ভালো থাকেন, সুস্থ থাকেন। আমার জন্য দোয়া করেন। পরিশেষে, সমাপ্তি কেমন হলো, ভুল-ত্রুটি কোথায় ছিল, এসব সম্ভব হলে কমেন্টবক্সে জানাবেন। আমি আপনাদের জন্য যেমন লিখি তেমন আপনাদের থেকে শিখিও। ]
#নোটিশ: যারা আমার #বিবি উপন্যাসটা ফেসবুকে পড়েছেন তারা এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড পড়তে পারবেন #বইটই-অ্যাপ থেকে। ই-বুক দুটির লিংক কমেন্টবক্সে দেওয়া হলো। যারা পড়েননি তারা ফেসবুক থেকে প্রথম খণ্ড শেষ করে তবেই বাকি খণ্ডগুলো পড়বেন।