#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৪১)
” আপনি কি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন? ”
বেশভূষায় পুরুষ লোক বোধ হলেও মুখটা দেখা হয়নি অরুণিমার। দরজার দিক থেকে হেঁটে আসায় পেছনটা দেখা যাচ্ছে শুধু। সে প্রশ্নটা করতে করতে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল। একপাশে দাঁড়িয়ে মুখটায় তাকাতে অজ্ঞাত লোকটি ঝট করে ফিরল তার দিকে। অরুণিমার একহাত টেনে নিয়ে কাতর স্বরে বলল,
” আমাকে ক্ষমা করে দাও! ”
মুখ ফেরাতে অরুণিমা চিনে ফেলেছে। তন্মধ্যে হাত টেনে নিয়ে এভাবে মাফ চাওয়ায় সে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ল। প্রায় আধা মিনিট নীরব থেকে সচকিত গলায় উচ্চারণ করল,
” মাইমূন! ”
মাইমূন অরুণিমার কণ্ঠে নিজের নাম শুনে আরও ভেঙে পড়ল যেন! চোখের কোল ভিজে ওঠল। সকাতরে পুনরায় বলল,
” ভালোবাসা, আমাকে মাফ করে দাও। ”
এবার অরুণিমার চিত্ত চঞ্চল হলো। সচেতনে বলল,
” কোথায় ছিলে এতদিন? কল দেওনি কেন? আমি দিয়েও পাইনি তোমাকে, বন্ধ দেখাচ্ছিল। ”
মাইমূন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল ঝট করে। বিনা নোটিশে গিয়ে বসল নিচে, নোংরা মেঝেতে। মাথা নিচু করে কৈফিয়তের মতো বলল,
” ইচ্ছে করে বন্ধ রেখেছি। চাচ্ছিলাম না, তোমার সাথে যোগাযোগ হোক। ”
” কেন? ”
” আমি যে দো’ষ করেছি! ”
বিস্ময়ের রেশ কাটার বদলে বেড়েই যাচ্ছে। অরুণিমাও স্থান ও অবস্থান ভুলে বসে পড়ল মাইমূনের সামনে। মুখটা তুলে জিজ্ঞেস করল,
” কী দো’ষ করেছ? ”
মাইমূন এক মুহূর্ত চুপ থাকে। ভালোবাসার মানুষটির উদগ্রীবের আভাস ছড়ানো মুখটায় চেয়ে থেকে জবাব দিল,
” তোমার বাবার শর্ত ভেঙেছি। অরুনিমা, আমি সিগারেট খেয়েছি। ম’দও। ”
অসাড় ব্যক্তির মতো হাতের জোর হারাল সে। মাইমূনের মুখ থেকে হাতটা সরে পড়ল আপনাআপনি। ঠিক তখনই নাকে এসে লাগল তী’ব্র বি’দঘু’টে গন্ধটা। না চাইতেও চোখ-মুখ বিকৃত করে মাথাটা পিছিয়ে নিতে হলো। দূর হতে সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল,
” মদ খেয়ে আমার সামনে এসেছ? ”
মাইমূন চট করে দুইহাতে মুখ ঢেকে ফেলল। সেই অবস্থায় অস্পষ্টভাবে বলল,
” কী করব? আর দূরে থাকতে পারছিলাম যে! তাই এভাবে ছুটে এসেছি। ক্ষমা প্রার্থনা করছি। ”
অরুণিমার মে’জা’জ গ’র’ম হলো। দেহভঙ্গিতে কঠিনত্ব ফুটে ওঠল। একটু আগের নরম, কোমল, স্নেহার্দ্র ব্যবহারটা বদলে ক’ঠো’র গলায় বলল,
” আগে শুনি, এই অ’ন্যা’য় করার কারণটা কী। ”
মাইমূন তখনই বলতে শুরু করল। অরুণিমা খেয়াল করল, ক্যান্টিনে কর্মরত সকল কর্মচারীরা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সে হাত দিয়ে ধরে মাইমূনকে নিচ থেকে তুলে চেয়ারে বসিয়ে দিতে দিতে তাদের উদ্দেশ্যে বলল,
” সবাই কাজে যাও। এখনই। ”
কথাটা ধ’ম’কের মতো শুনালে তারা সকলে ছুটে চলে নিজ নিজ কর্মস্থানে। এই ফাঁকে মাইমূনের কথাগুলো মন দিয়ে শুনার সুযোগ হয় অরুণিমার। জানতে পারে, মাইমূন কাজের প্রথম দিন সজীব নামক এক পুরোনো কর্মচারীর কাছ থেকে ব’কা শুনে। বয়সে ও মাপে তার থেকে ছোট। যা সে সহজে হজম করতে পারেনি। প্রথম দিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখলেও দ্বিতীয় দিন উত্তর দিয়ে বসে। ঝা’মে’লার শুরু হয় এখান থেকে। সজীব সেখানে কাজ করছে দুই বছর যাপত। মালিকের চেনা ও বিশ্বস্ত। সুযোগ পেয়ে মাইমূনের নামে সত্য-মিথ্যা নানান না’লি’শ করে। এর বিচারে মাইমূন হেরে যায়। চাকরিও চলে যায়। ব্যাপারটা এখানে সমাপ্ত হতে পারত, হয়নি। মাইমূনের ভেতরের সত্যপরায়ণতা জেগে ওঠে। তার মতে, মিথ্যা দো’ষে চাকরি গিয়েছে। যা সে মানতে পারেনি। প্র’তি’বাদ করতে গিয়ে গলা ধা’ক্কা খেয়েছে দারোয়ানের কাছ থেকে। ব্যস! আরও অঘটনের সৃষ্টি হলো। সে ভুলেই গেল, এটা তার জন্মস্থান নয়। এখানকার মানুষজন তার চেনা নয়, ভিতু নয়, সহজ নয়। উল্টো হাত চালিয়ে দিল। শুধু দারোয়ান নয়, সজীব এমনকি মালিককেও ছাড়েনি। সবাইকে মে’রে হাসপাতালে পাঠানোর পর হুঁশ এসেছে। বাড়িতে সে পৌঁছানোর পূর্বে পুলিশ পৌঁছে গেছে। ভাগ্য ভালো, যার সাথে রুম ভাগ করে থাকছিল, সে ফোন করে জানিয়েছে। তাই তখনই জেলে ঢোকেনি। এতটুকু শোনার পর অরুণিমা নিজের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল,
” পুলিশ কেসেও জড়িয়ে পড়েছ? ”
মাইমূন অসহায় মুখ বানিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে বলল,
” তারপরেই তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। তোমার বাবা যদি এসব জানে, তাহলে স্বপ্নেও তোমাকে বিয়ে করা হবে না। এই চিন্তা ও ভ’য়ে কখন যে সিগারেট খেয়ে ফেললাম! টেরও পাইনি। ”
” আর মদ? ওটা কেন খেলে? তুমি তো মদ খাওয়ার কারণ অন্য কিছু বলেছিলে। ”
মাইমূন লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিয়েও তুলল আবার। অ’ভি’যো’গের মতো করে বলল,
” ওরা বাবা তুলে গালাগাল দিচ্ছিল। ”
” দিক। তোমার সমস্যা হবে কেন? তুমি তো জন্মদাতা কিংবা পালিত বাবা কাউকে ভালোবাসো না। সম্মান করেও চলো না। ”
অরুণিমার কথাটা শুনে চোখ নামিয়ে নিল সে। ভার স্বরে বলল,
” আমাকে বিজন্মা বলেছে বার বার। ”
‘ বিজন্মা ‘ শব্দটা ধা’রা’ল ফলার মতো আ’ঘা’ত করল তাকে। একটা অদ্ভুত অসহণীয় ব্যথা তৈরি হলো বুকের মাঝে। যা চোখে পানি এনে ছাড়ল অরুণিমার চোখজোড়ায়। ইচ্ছে হলো মাইমূনকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরতে, আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিয়ে মনটাকে শান্ত করে দিতে। এই দুর্নিবার ইচ্ছাটাকেও সে সামলে নিল। কঠোর হয়ে বলল,
” বলার সুযোগ দিয়েছ, তাই বলেছে। তোমাকে কে বলেছিল, সজীবের সাথে তর্ক করতে? ও বয়সে ছোট হলেও কাজের ক্ষেত্রে বড়। তাছাড়া কাজটাও তোমার জন্য নতুন। হয়তো সত্যি ভুল হয়েছে। সেজন্যই ব’কে’ছে। ”
কথার ফাঁকে অরুণিমা মাইমূনের গালে হাত রাখল। প্রথম স্পর্শটা নরম হলেও ধীরে ধীরে সেটি শক্ত চাপে রুপান্তর হলো। জোরপূর্বক নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,
” একটা কথা মনে রাখ, চাকরি মানে পরাধীনতা। সেখানে তোমার যেমন স্বাধীনতা নেই তেমন ক্ষ’ম’তাও নেই। ”
এটুকু বলে অরুণিমা তার সামনে থেকে একটু সরে গেল। গোপনে প্রলম্বিত নিশ্বাস টেনে বলল,
” যদি এই পরাধীনতাকে মেনে নিতে না পার, তাহলে চাকরি করার চিন্তা ছেড়ে দাও। ”
মাইমূন উঠে এসে দাঁড়াল তার সমুখে। বলল,
” তাহলে ব্যবসা করব? কিভাবে? আমার তো টাকা নেই। ”
অরুণিমা সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। ব্যবসা সে করেনি। কিন্তু একেবারে অজ্ঞ নয়। এখানেও সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে না। সবসময় মাথা উঁচু করে চলা যায় না। ব্যবসার স্বার্থে কখনও কখনও মাথা নত করতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিপক্ষ তৈরি হয়। সর্বক্ষণ তাদের সাথেও গোপনে ও প্রকাশ্যে ল’ড়া’ই চালাতে হয়। এসব ভাবনা-চিন্তা করতে করতে তার বুকটা ভার হয়ে গেল। মনে হলো, এই ছেলের স্বাধীনতা হরণকারী সে! অন্য কেউ নয়, অন্য কিছু নয়। হয়তো তাদের দেখাটা ভুল, প্রেমে পড়া ভুল, বিয়ের কথা ভাবাও ভুল।
” আমার চাকরি ছাড়া উপায় নেই। এবারের মতো তুমি মাফ করে দাও। কথা দিচ্ছি, পরবর্তীতে এমন কিছু ঘটবে না। ”
অরুণিমা সচেতনে বলল,
” শুধু আমার কাছে না। তোমার ওদের কাছেও ক্ষমা চাইতে হবে। পুলিশের ঝা’মে’লা মেটাতে হবে। আমি চাই না, বাবা আরেকটা কারণ দেখিয়ে বলুক, আমার পছন্দ খারাপ। ”
” ওরা কি মাফ করবে? ”
” সেটা তো মাফ চাইলে তবেই জানা যাবে। ”
মাইমূনের কুঁচকে থাকা শার্টটা টেনে ঠিক করল সে। হাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করে বলল,
” বসো এখানে। আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি। খাওয়া শেষ করে গাজীপুরের বাস ধরবে। ”
অরুণিমা ব্যস্ততা দেখিয়ে ক্যান্টিনের রান্নার দিকটায় যেতে চাইল। মাইমূন বাঁধা দিল। পেছন থেকে বলল,
” এখনই চলে যাব? আরেকটু থাকি? কতদিন পর তোমাকে দেখলাম! ”
তার এই প্রেম বুলিকে পাত্তা দিতে দিল না অরুণিমা। নিষ্ঠুরের মতো বলল,
” হ্যাঁ, এখনই যাবে। ”
কথাটা বলে সে হাঁটা ধরে। তন্মধ্যে শুনল,
” অনেকদিনই হবে। সেজন্য এত যত্ন করছ, ভালোবাসছ। ভালোবাসা, তোমাকে এভাবে সারাজীবনের জন্য পাওয়ার জন্য আমি সব করব। শুধু দোয়া করো, তোমার মতো আল্লাহও যেন আমার পাশে থাকে। ”
_________
অরুণিমা রাতে বাসায় ফিরে সঞ্জয়ানের খোঁজ করল। যে রুমটায় শূভ্রা ও সঞ্জয়ানকে থাকতে দিয়েছিল সেখানে ঢুকে দেখল, সে নেই। শূভ্রা আর নিয়াজ ইশারায় ঝগড়া করছে। তাদের মাঝে বসে জিজ্ঞেস করল,
” স্যার চলে গেছেন? ”
শূভ্রা বিরক্ত মুখে উত্তর দিল,
” হ্যাঁ, চলে গেছে। ”
অরুণিমা আরেকটা কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও থমকে গেল। তার নজর গিয়ে পড়েছে শূভ্রার গলায়। আঁচড় কাটা অংশটায় হাত লাগিয়ে উদ্বিগ্নচিত্তে বলল,
” অনেকটা কেটে গেছে তো! কিভাবে হলো? ”
শূভ্রা চোখ পা’কি’য়ে তাকাল নিয়াজের দিকে। না’লি’শের মতো করে বলল,
” তোমার এই আদুরে ছোট ভাই করেছে। আসতে না আসতে খামচে র’ক্ত বের করে দিয়েছে। ”
অরুণিমা নিয়াজের দিকে তাকাল শা’স’নের ভঙ্গিতে। কিছু বলার পূর্বে হাসির শব্দ শুনতে পেল। ঘাড় ফিরে দেখল, শূভ্রা হাসছে। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি রাখতে শূভ্রা বলল,
” তোমার স্যারকে বোকা বানিয়েছি, আপু। ”
কথাটা বলে হাসি থামাল। মুখের ভাব বদলে বলল,
” প্র’তি’শো’ধ নিব। সবসময় আমাকে ছোট করে কথা বলে, ধমকায়, শাস্তি দেয়! এবার আমার পালা। শাস্তি কাকে বলে, কত ধরনের হয়, সব আমি দেখাব। ”
চলবে