আঙুলে আঙুল পর্ব ৪০

0
360

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৪০)

” শূভ্রা? উঠো। ওষুধটা খেয়ে নাও। ”

সে ঘুমের ঘোরে অচেতনের মতো জবাব দিল,
” শীত করে তো! ”
” করবে না। ওষুধটা খাও, শীত চলে যাবে। ”

শূভ্রা নড়ল। উঠে বসতে গিয়ে একহাত গিয়ে লাগল সঞ্জয়ানের হাতে থাকা গ্লাসটিতে। অকস্মাৎ ধাক্কায় সেটি পড়ে গেল নিচে! গ্লাস ভাঙার শব্দে সঞ্জয়ান চমকে কেঁপে ওঠে। শূভ্রার চোখের পাতা আলগা হয়। আধো ঘুমে দুর্বল চাহনি রাখে তার উপর। সঞ্জয়ান কিছুটা বিরক্ত হয়ে ধমক দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। তখনই শুনতে পেল,
” আপনি! আমার কাছে? আমার ঘরে? আসুন, এখানে বসুন। ”

শূভ্রা প্রথমে বিস্ময় প্রকাশ করে। পর মুহূর্তে আনন্দে আপ্লুত হয়। ব্যস্ত হয়ে পড়ে সঞ্জয়ানকে তার পাশে বসানোর জন্য। সে অবাক চোখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। শূভ্রার নিকট থেকে এমন নরম, ভদ্র আচরণ পায়নি কখনও। এটাই প্রথম। বিস্মিত না হয়ে পারছে না।

” কী হলো, আসুন না। বসুন এখানে। ”

বসার আমন্ত্রণ জানানোর সময় শূভ্রা হাত দিয়ে স্থানও দেখাচ্ছে। সঞ্জয়ান বসছে না দেখে সে নিজের হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে বসাল জোর করে। বসার সঙ্গে সঙ্গে কোলের উপর নিজের মাথা রেখে বলল,
” আমি আপনার কবুতর। ”

শূভ্রার এই সেধে এসে কোলে মাথা রাখা, আহ্লাদী কণ্ঠস্বরে সঞ্জয়ান বিমূঢ় হয়ে পড়ল যেন! মূক হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সুধাল,
” তুমি কবুতর? ”
” হ্যাঁ। সেদিনের মতো আমাকেও ভালোবেসে আদর করে দিন। ”
” কোন দিনের মতো? ”

সঞ্জয়ানের কণ্ঠে সংশয়, সন্দেহ। চোখে-মুখে অস্বস্থি, দ্বিধা। শূভ্রার সাথে আজ পর্যন্ত ভালোভাবে কথা হয়নি। তাহলে আদরের বিষয়টি আসছে কী করে?

” ঐদিনের মতো৷ কৃষ্ণচূড়ার গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটা সাদা কবুতরকে যে আদর করছিলেন? তেমন করে আমাকেও আদর করে দিন। ”

কবুতরের কথা আসায় তার মনে পড়ল, বাড়িতে অনেকগুলো কবুতর থাকলেও সাদা রঙের একটি কবুতর তার পোষ মেনেছে অনেক দিন ধরে। এই কারণেই হয়তো এটির প্রতি আদর-ভালোবাসা-যত্ন একটু বেশি। এবার ঢাকা থেকে ফিরে দেখে সেই কবুতরটি নেই। তার খুব মনখারাপ হয়। জুমু’আর নামাজ শেষ করে আশপাশে খোঁজ করে পায় না। সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরতে দেখে যাকে বাইরে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে কৃষ্ণচূড়ার ফুলের রূপে মুগ্ধ হয়ে গাছের ডালে বসে আছে। সে ডাকতে উড়ে আসে। না পেয়ে ভেবেছিল, হারিয়ে গেছে৷ তাই খুঁজে পেয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে ভালোবেসে আদর দিচ্ছিল সারা শরীরে। শূভ্রা কি সেই আদরের কথা বলছে? কিন্তু সে দেখল কীভাবে! সঞ্জয়ানের ভাবনা কাটল শূভ্রার হাতের স্পর্শে। উষ্ণ ও কোমল হাতটা দিয়ে তার ডান হাতটা মাথায় রেখে বলল,
” আদর দিন। ”

সে আপত্তি দেখাতে চাইল। শূভ্রার মাথাটা কোল থেকে সরিয়ে উঠে যেতে চাইল, পারল না। ওর শরীর ও নিশ্বাস এতটাই গরম যে সঞ্জয়ানের শরীরে ঘাম জড়ো হতে থাকে। কিঞ্চিৎ ঘাবড়েও যায়। মায়ের কথামতো ওষুধ খাওয়ালে হয়তো এমন হতো না! এই অপরাধ থেকে মাফের আশায় শূভ্রার আবদার রাখল সে। মাথায় হাত বুলানোর সময় চোখটা গিয়ে পড়ল তার মুখটায়। খেয়াল করল, মা ঠিকই বলেছে। মেয়েটা এই কয়দিনে অনেকটা শুকিয়েছে। চোখদুটি দেবে গিয়ে চারপাশে কালচে ছাপ পড়েছে। ঠোঁট শুকনো, ফাটা। সম্পূর্ণ মুখটায় উজ্জ্বল আভা হারিয়েছে। ওজনও কমেছে হয়তো। বয়সের তুলনায় অনেক শুকনা লাগছে। চোখ বন্ধ রেখে সে ক্ষীণ স্বরে বলল,
” আপনি সবসময় সাদা রঙের কাপড় পরেন? ”

সঞ্জয়ান নিজের দিকে তাকাল। সে সাদা রঙের পাতলা পোলো শার্ট পরে আছে। স্মরণে এলো, সেদিনও সে সাদা পাঞ্জাবি পরেছিল। কিন্তু এর মাঝে সে অন্য রঙের শার্ট পরেছে। শূভ্রা কি দেখেনি? শুধু এই সাদা রঙটাকেই মনে রেখেছে।

শূভ্রার শরীরের কাঁপন ধীরে ধীরে বাড়ছে। সঞ্জয়ান টের পেয়ে, বিছানায় থাকা কাঁথাটা গায়ের উপর দিয়ে বলল,
” শূভ্রা, ঘুমাবে না। ওষুধ খাওয়া হয়নি তোমার। ”

সে কোনো সাড়াশব্দ দিল না। সঞ্জয়ানের হাতে ওষুধ থাকলেও পানি নেই। পানির ব্যবস্থা করার জন্য শূভ্রার মাথাটা সরিয়ে উঠতে চাইল, পারল না। সে দুই হাতে খামচে ধরল প্যান্টের শক্ত কাপড়। মৃদু কাঁপুনি তুলে ফুপিয়ে উঠে বলল,
” আমি এখানে ঘুমাব, এখানেই। ”

________

সকালে সঞ্জয়ানের ঘুম ভাঙে কারও মিহি সুরে কান্নার শব্দে। সে চোখ ডলে উঠে বসে দেখল, শূভ্রা কাঁদছে। তার শরীরে কাঁথা নেই। জামার গলার দিকটা ছেঁড়া। ছেঁড়া দিয়ে শরীরের যে অংশটা উন্মুক্ত হয়েছে সেখানে নখের আঁচড়। সে আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কী হয়েছে? কাঁদছ কেন? ”

শূভ্রা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছিল। এবার হাতটা সরাল। অশ্রুতে ভেজা চোখদুটি বড় বড় করে জবাব দিল,
” আমার সব কেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, কাঁদছি কেন? ”
” আমি তোমার সব কেড়ে নিয়েছি? ”
” হ্যাঁ, নিয়েছেন। ”
” কখন? কীভাবে? ”

শূভ্রা কান্না থামিয়ে দিল। ভীষণ অবাক হচ্ছে এমন ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে কতক্ষণ। তারপর বলল,
” আমার সর্বনাশ করে এখন মজা নিচ্ছেন? নিবেনই তো। আপনাদের স্বভাবই এমন। আমি আরও আগে থেকে জানতাম বুড়োরা লুচ্চা হয়। এজন্যই বিয়ে করতে চাইনি। ”

সঞ্জয়ানের মাথায় কেউ ভারী পাথর ফেলল যেন! চাপা পড়ে যাচ্ছে এরকম ব্যথা নিয়ে সুধাল,
” তোমার সাথে লুচ্চামি করেছি? ”
” করেছেনই তো। সেজন্যই জোর করে আমার সাথে একখাটে শুয়েছেন। আমি ছোট মানুষ। বুদ্ধি কম। তাই আপনার কুবুদ্ধি ধরতে পারিনি। ”
” শূভ্রা, সাবধানে কথা বলো। তুমি কি বুঝতে পারছ, আমার উপর কী অপবাদ দিচ্ছ? ”

শূভ্রা চোখের পানি মুছল। নাক টেনে ধেয়ে এলো তার কাছে৷ মুখের কাছাকাছি মুখ নিয়ে বলল,
” চোরের মায়ের বড় গলা! আপনি বয়সে আর শরীরে বড় হলেও জোর করে সত্যকে মিথ্যা বানাতে পারবেন না৷ আমার কাছে প্রমাণ আছে। ”
” কিসের প্রমাণ? তুমি এতক্ষণ ধরে কী বলছ, আমি সেটাই ঠিকমতো বুঝতে পারছি না। প্রথমে বললে, সব কেড়ে নিয়েছি, তারপর বললে, সর্বনাশ করেছি। এখন বলছ, লুচ্চামি করেছি। পরিষ্কার করে বলবে আমি আসলে কী করেছি? ”
” ধ’র্ষ’ণ। আপনি আমাকে একা পেয়ে ঘুমের মধ্যে ধ’র্ষ’ণ করেছেন। এই হলো তার প্রমাণ। ”

মুক্ত গলায় তার অন্যায়টা শুনিয়ে শূভ্রা জামার ছেঁড়া অংশটা সরিয়ে ফেলল। নখের একাধিক আঁচড় দেখিয়ে পুনরায় বলল,
” এটা কোনো মিথ্যা অপবাদ নয়। সত্যিকারের অন্যায়। আপনি আমার সাথে অন্যায় করেছেন। ”

সঞ্জয়ানের দৃষ্টি একভাবে পড়ে আছে শূভ্রার ক্ষত অংশটায়। রাতে জোর করে একখাটে ঘুমিয়েছে সত্য। অসুস্থ মেয়েটার আবদার রাখতে শরীরে ছুঁয়েছেও। এর বিনিময়ে এটাই প্রাপ্য ছিল তার? ধ’র্ষ’ক! এক মুহূর্তে তাকে ধ’র্ষ’ণের অপবাদ দিয়ে দিল?

” চুপ করে আছেন কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না এখনও? নিজের দিকে তাকান পুরোপুরি বিশ্বাস হবে। ”

শূভ্রার কথামতো সে নিজের দিকে তাকাল। রাতের সেই সাদা রঙের পোলো শার্টটি নেই। অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে, এটা পরে ঘুমিয়েছে।

শূভ্রা নিজের জায়গায় ফেরত গেল। কান্নার ভাব ধরে আবারও বলল,
” দেখতে কালো, খাটো মেয়েটাকেও ছাড়লেন না? ছি! একরাত, মাত্র একরাত তার পাশে শুয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলেন না? এই মানুষটাকে আমার পরিবার এত ভালোবাসে, সম্মান করে? বলেছিলাম না? আপনার ভেতরের খারাপ রূপটাকে সামনে আনব? এনেছি। কিন্তু নিজের ক্ষ’তি করে। ”

সঞ্জয়ান খাট থেকে নামল। মেঝেতে পড়ে থাকা পোলো শার্টটা খুঁজে বের করে গায়ে পড়তে পড়তে বলল,
” আমাকে অপমান করার জন্য তুমি কতটা নিচে নামতে পার সেটারই প্রমাণ পেলাম। শূভ্রা, আমি মুখে যাই বলি না কেন, মনে মনে তোমার ভালোটাই চেয়ে এসেছি। এর সাক্ষী স্বয়ং আল্লাহ। ”

সে দরজা খুলে বাইরে বেরুতে অরুণিমার সঙ্গে দেখা হলো। সে হেসে বলল,
” আপনাকে ডাকতে এসেছিলাম। নাস্তা দিয়েছি। হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আসুন। ”

অরুণিমা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেল। জিজ্ঞেস করল,
” ওর কোনো খোঁজ পেয়েছেন? ”

‘ ও ‘ দিয়ে যে মাইমূনকে নির্দেশ করেছে সঞ্জয়ান বুঝতে পারে। তারপরও কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,
” হ্যাঁ। আমার পাঠানো লোক বলল, মাইমূন ভাই গত সপ্তাহে বাসা ছেড়ে দিয়েছে। বর্তমানে কোথায় থাকছে কেউ জানে না। ”

তথ্যটা শুনে অরুণিমার মুখের রঙ বদলে গেল। বাদল দিনের বজ্রপাতের মতো চমকাতে লাগল বুকের আকাশটায়। যার আভাস কিছুটা টের পাচ্ছে সঞ্জয়ান। সান্ত্বনা দিতে বলল,
” চিন্তা করো না। খোঁজ চলছে এখনও। শীঘ্রই তাকে পাওয়া যাবে। ”

অরুণিমা বিপরীতে কিছু বলল না। চুপচাপ তার সামনে থেকে সরে যেতে চাচ্ছে। সহসা আবারও থামল। পেছনে চেয়ে বলল,
” আপনি কী যেন বলতে চেয়েছিলেন? খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু? ”

সঞ্জয়ানকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ দিল না। রুমের দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল,
” শূভ্রা উঠেনি এখনও? ওর সামনে বলা যাবে? তাহলে ভেতরে বসে কথা বলি? ”
” না। ”

অরুণিমা থেমে গেল। বলল,
” তাহলে তো রাতের আগে সময় দিতে পারছি না। নাস্তা করে আমি বেরুব। রাতে থাকবেন তো এখানে? ”

সঞ্জয়ান সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর করল না। শূভ্রা তাকে যে অ’ন্যা’য়ে দো’ষী করেছে সেটি ভাবাচ্ছে। যদিও সে মানতে পারছে না, এমন কাজ করেছে। তবুও শূভ্রার দেখানো প্রমাণ মিথ্যা নয়। এমনকি হতে পারে, সত্যি সে দোষী? তার অসুস্থতার জন্য অনেকটা সময় কাছাকাছি ছিল। তন্মধ্যে মেয়েটা আদর পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। এসব সামলাতে গিয়ে সে তার কঠিন ব্যক্তিত্ব থেকে পিছলে যায়নি তো! যদি সত্যি পিছলে পড়ে তাহলে বিয়ে ভাঙাটা বিরাট বড় অন্যায় হবে। প্রকৃত সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে এই ব্যাপারে আলোচনা করা ঠিক হবে না এমন মনস্থির করল। অরুণিমাকে বলল,
” এখন না। মনে হয়, আমার নিজেকে আরও একটু ভাবনা-চিন্তা করতে হবে। ”
” আপনার যেমন ইচ্ছে। ”

__________
অরুণিমা স্বর্ণলতা ক্যন্টিনের কাছে আসতে একজন দৌড়ে এলো। হাঁপিয়ে উঠে বলল,
” আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। ”
” কে? ”
” জানি না। সেই ভোরবেলা থেকে বসে আছে। ”

অরুণিমা দ্রুতপদে ক্যান্টিনের মধ্যে ঢুকল। অজ্ঞাত লোকটি একপাশের একটি টেবিল দখল করে বসে আছে। তার উদ্দেশ্যে বলল,
” আপনি কি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন? ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here