আঙুলে আঙুল পর্ব ৩২

0
371

#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৩৩)

যেই সময়টায় শূভ্রার মুখ দেখানোর জন্য সকলে ব্যস্ত ছিল সেই সময়টায় সঞ্জয়ান নিজের রুমে ঘুমাচ্ছিল। গভীর ও শান্তির ঘুমটায় কেউ আঘাত করল অকস্মাৎ। কানের কাছে ফিসফিস সুরে বেজে ওঠল, ‘ পুলিশ এসেছে। ছায়ানীড়ে পুলিশের পা পড়েছে। উঠো। ‘ তার ঘুম ছুটে গেল। লাফ দিয়ে উঠে বসে তাকাল পুরো রুমটায়। কেউ নেই। ফিসফিসের স্বরের মানুষটিও। দরজায় সিটকানি টানা না থাকলেও কাঠের পাল্লাটা ভিজানো। মা, বাবা ছাড়া এই রুমের ভেতরে কেউ ঢোকে না। খুব প্রয়োজন পড়লে দরজায় কড়া নেড়ে বাইরে থেকে কথোপকথন চলে। সে বেড সাইড টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে পানি ঢালল কাচের গ্লাসটায়৷ বুকের ভেতরটা মরুভূতির বালির মতো উত্তপ্ত ও পানিশূণ্য হয়ে আছে। এক ফোঁটা জল ঢালা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। পানিতে ঠোঁটের স্পর্শ পড়েই সরিয়ে ফেলল চট করে। বিরক্ত স্বর বেরিয়ে এলো সঞ্জয়ানের গলা থেকে, ‘ ধুর! এত গরম? ‘ সে গ্লাসটা আগের স্থানে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য খাট থেকে নামল। যে খবরটা তার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল সেটা দুঃস্বপ্নের থলিতে ফেলে দিয়েছিল গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে। তাই মুখের ভাবে কোনোরূপ দুশ্চিন্তার ছায়া নেই। এক ছটা বিরক্তের ভাব ভ্রূজোড়ার মাঝে, চোখের তারায়। দরজা মেলে বাইরে বেরুতে বজ্রাহতের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল। হাঁটা-চলা থামিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল মূর্তির মতো। বসার রুমে তিন সোফার সেটটায় দুজন পুলিশ বসে আছে। মুখের ভাব অত্যন্ত গম্ভীর হলেও বসার ভাবে অলসতা ও আয়েশি। তার মস্তিষ্ক দ্রুত জানিয়ে দিল, পুলিশের আগমন বার্তাটি স্বপ্ন নয়, সত্যি ছিল।

” সঞ্জু বাবা, বাইরে আসছেন যে! আপা আপনাকে বাইরে বেরুতে মানা করেছিল তো। ভিতরে যান। আপা ডাক পাঠালে বের হবেন। ”

সঞ্জয়ান মূর্তিভাব কাটিয়ে তাকাল সামনের মানুষটির দিকে। মায়ের নিষেধাজ্ঞা পায়নি সে। তারপরও মনে করে দেওয়ার চেষ্টায় থাকা মানুষটাকে প্রশ্ন করল,
” বাড়িতে পুলিশ কেন, ইকবাল মামা? ”

ইকবাল এই বাড়ির পুরোনো লোক। এবাড়ির আর্থির হিসাব-নিকাশসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মে নিয়োজিত আছে অনেক বছর ধরে। বয়সে স্বর্ণলতার কাছাকাছি হবে। থাকা, খাওয়া এখানেই। বিয়ে করেননি এখনও। সঞ্জয়ানকে যেমন ছেলের মতো ভালোবাসেন, স্নেহ করেন, বাবা ছাড়া কথা বলেন না তেমন নিজের অবস্থান ও কর্মকে স্মরণ রেখে তাকে আপনি সম্বোধন করে থাকেন। সম্মান দিয়ে থাকেন। সঞ্জয়ান শুনেছিল, ইকবালের সাথে তাদের আত্মীয়ের সম্পর্ক আছে। ঠিক কেমন আত্মীয়ের সম্পর্ক এটা এখনও স্পষ্টভাবে জানতে পারেনি। যতদূর মনে পড়ে, ইকবাল ছোটবেলা থেকে তার নাম ধরে ডাকা শিখিয়েছিল। কিন্তু বড় হওয়ার পর সঞ্জয়ান বুঝতে পারল তাদের বয়সের ব্যবধান বিশাল। নাম ধরে ডাকলে অভদ্র, শিষ্টতাহীনতার পর্যায়ে পড়বে। তাই নামের সাথে মামা শব্দটা যুক্ত করেছে।

” তেমন কোনো কারণ নেই। একটা ভুল তথ্য পেয়ে এসেছে। ”

কথাটা ইকবাল মৃদু হাসি নিয়ে হালকা স্বরে বললেও সঞ্জয়ান হালকাভাবে নিতে পারল না। দ্রুত প্রশ্ন করল,
” ভুল তথ্যটা কী? কে দিয়েছে? ”

ইকবালের হাসিটা মুছে গেল। চাহনি নিচে নামিয়ে খানিক সময় নিয়ে ধীরে বলল,
” নতুন বউ। ”

এই বাড়িতে নতুন বউ একজনই। শূভ্রা। সঞ্জয়ানের মে’জা’জ চ’টে গেল নিমিষে। আ’ক্রো’শ জমা হলো দমে, বন্ধ ঠোঁটের চাপে। মেয়েটা থামছে না। রকেটের মতো তার অভদ্র ও উদ্ধত স্বভাবটা উপরে দিকে ছুটে চলছে। বিরতি পর্যন্ত নিচ্ছে না। তার কী ক্লান্তি লাগে না? সে অত্যন্ত ক্ষ্যা’পা স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” শূভ্রা কী করেছে? ইকবাল মামা, আমাকে সত্যটা বলবে। এখনই। ”
” ঠিক আছে বলব। আগে রুমের ভেতরে চলেন। ”

ভেতরে যাওয়ার সময়টুকু ধৈর্য্য হচ্ছে না সঞ্জয়ানের। তবুও যেতে হলো। যাওয়ার পূর্বে এক ঝলক বসার রুমের সকলের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। পুলিশের মুখোমুখি বাবা বসে আছেন। মাকে দেখা যাচ্ছে না। সে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জানতে চাইল,
” মা কোথায়? ”
” নতুন বউয়ের কাছে। ”

ইকবাল ধীরে ধীরে জানাল, নতুন বউয়ের মুখ দেখার যে আয়োজন করা হয়েছিল সেখান থেকে শূভ্রা মুখ না দেখিয়ে পালিয়ে যায়। নিজেকে একটা রুমে বদ্ধ করে চিৎকার করে বলে, সে এবাড়ির বউ নয়। তার বিয়ে হয়নি। সকলে পরিকল্পনা করে বিয়ের নাম করে তুলে এনেছে। কথাগুলো এতটাই উচ্চ স্বরে বলে যে, সেখানে উপস্থিত সকলে শুনতে পেয়েছে। সম্ভবতঃ সেখান থেকে কেউ এই সংবাদটা বাইরে পাচার করেছে। যার সূত্র ধরে পুলিশ পৌঁছে গেছে ছায়ানীড়ে৷ সঞ্জয়ান শুনছে আর গ’র’ম লোহার মতো রা’গে পুড়ছে, জ্বলছে। সবশেষে দাঁড়িয়ে পড়ল সটাং। তে’জা’ল স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” শূভ্রা কোন রুমে আছে? ”

ইকবালও দাঁড়িয়ে পড়ল। পুত্র তুল্য রা’গা’ন্বিত মানুষটার বাহু চেপে ধরে বলল,
” শান্ত হোন, সঞ্জু বাবা। এখন রা’গ করলে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাবে। আপা, ওর কাছে গেছেন বুঝাতে। সফল হবেন নিশ্চয়। শুধু একবার পুলিশের সামনে বললেই হবে, তার বিয়ে হয়েছে৷ শূভ্রামা ও তার পরিবারের সম্মতি নিয়েই হয়েছে। ”
” স্বীকার করবে না। তোমার কি মনে হয় ও মজা করে মিথ্যা বলেছে? না। বুদ্ধি করে বলেছে। তুমি জানো না, শূভ্রা কতটা খারাপ মনমানসিকতার মেয়ে। আমি জানি। আর সেজন্যই আবারও জিজ্ঞেস করছি। বলো, শূভ্রা কোন রুমে আছে। ”

ইকবাল এবারও জানানোর জন্য প্রস্তুত নয়। তার দ্বিধাভরা চোখদুটিতে চেয়ে সঞ্জয়ান মিনতি স্বরে বলল,
” ইকবাল মামা, আমাকে বিশ্বাস করো। ঝামেলা আমি না, শূভ্রাই বাড়াবে। মা হাজার বুঝালেও ও বুঝবে না। আমার ভ’য় হচ্ছে, মায়ের সাথে না আবার দুর্ব্যবহার করে ফেলে! ”

তার এই মিনতি, শঙ্কাকে অগ্রাহ্য করতে পারল না ইকবাল। বলল,
” আমার রুমে। ”

সন্ধান পেয়ে সঞ্জয়ান তৎক্ষনাৎ নিজ রুম থেকে বেরিয়ে পড়ল। তাকে অনুসরণ করে চলল ইকবাল। দুজন ঘন ও দ্রুত পায়ে বসার রুম পার হয়। বাড়ির মূল ও প্রধান দরজাটা দিয়ে বারান্দায় নেমে আসে। ইকবালের রুমের দিকে অগ্রসর হতে স্বর্ণলতার গলার স্বর পাওয়া গেল,
” আপনি আবারও সেই অসৎ পথটায় বেছে নিলেন? ”

সঞ্জয়ান ও ইকবাল দুজনেই মাঝপথে থেমে গেল। দূর থেকে দেখল, মা ও বাবা গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ দুজনকে দেখা যাচ্ছে না। রাস্তা থেকে গাড়ি চলার শব্দ ভেসে আসতে বুঝা গেল তারা চলে গেছে। শূভ্রাকে আশপাশে দেখা যাচ্ছে না। তাকে দেখার কোনো ইচ্ছাও নেই সঞ্জয়ানের। একবার পেছনে থাকা মামার দিকে চোখ রেখে মা, বাবার কাছে ছুটে গেল। সেখানে পৌঁছাতে মায়ের গলাটা আবারও শুনতে পেল। তিনি বলছেন,
” আমার জন্য একটু অপেক্ষা করা গেল না? সেই আগের মতোই আছেন। অধৈর্য, অসৎ উপায় সন্ধানী। বয়সের সাথে সাথে মানুষের ধৈর্য্য বাড়ে। সৎপথের সন্ধানী হয়। আপনার কিছু হয়নি। কিছু না! ”

কথাটা বলে সঞ্জয়ানের সামনে দিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। ইকবাল তার পেছন পথে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে মন্তব্য করল,
” আপা ভীষণ রে’গে গেছেন। অনেক বছর এমন রা’গ দেখিনি, ভাইজান। ”

তার সাথে তাল মিলিয়ে সঞ্জয়ান বলল,
” আমিও না। রা’গের কারণ কী, বাবা? ”

মুনসুর সাখাওয়াত উত্তর করলেন,
” ঘু’ষ। টাকা দিয়ে পুলিশের মু’খ বন্ধ করে বিদায় করেছি। এই আমার অপরাধ। ”
” পুলিশকে টাকা দিতে হলো কেন? ”
” তাহলে কী করব? বসে বসে মা’ম’লা খাব? ”

রাগের জন্য কথাটা একটু জোরে শোনায়। কণ্ঠের সঙ্গে শরীরটাও কাঁপছে মুনসুর সাখাওয়াতের। একা একস্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। সঞ্জয়ান বাবার হাত ও বাহু চেপে ধরে জোর বাড়াল। অতঃপর বলল,
” শূভ্রাকে দিয়ে বিয়ের বিষয়টা স্বীকার করালেই সমস্যাটা মিটে যেত। মা এই কাজটাই করতে চেয়েছিলেন। ”

ছেলের কথা শুনে তিনি আরও রে’গে গেলেন। অত্যন্ত বিরক্ত স্বরে জানালেন,
” তোরা কি শূভ্রার বয়স ভুলে যাচ্ছিস? আমি সঠিক বয়সটা না জানলেও এই ব্যাপারে নিশ্চিত, ওর বয়স আঠারো হয়নি এখনও। এই অবস্থায় একমাত্র সত্য হলো, এই বিয়েটা বাল্যবিবাহ হয়েছে। তোর মায়ের নৈতিকতা আর সততায় ভরা মাথায় এই বিষয়টা যেমন এখন আসেনি, বিয়ের সময়ও না। তখন আসলে অন্য ব্যবস্থা করা যেত। আমি নাহয় বুড়ো মানুষ, মনে ছিল না। তোর মা তো বুড়ো নয়। চেহারায় যেমন ধার, স্মৃতিশক্তিতেও তেমন তাহলে এটা ভুলে গেল কেন? আমাকে কথা শোনানোর জন্য? অনেক বছর পর যেমন তাকে রা’গি’য়ে’ছি, তেমন অনেক বছর পর অন্যায়ও করেছি। আজ আমার অন্যায় ও তার রা’গ’টায় সবার চোখে পড়ল! ”

সঞ্জয়ান চুপ হয়ে গেল। বাবা অযৌক্তিক কিছু বলছে না। ছোটবেলা থেকে মায়ের কাজকর্ম দেখে আসছে সে। কোনো অবস্থায় তিনি অনৈতিক কাজ করেন না। কেউ করলে তাকে সমর্থনও করেন না। তাহলে ছেলের বেলায় কিভাবে করলেন? সত্যি কি বাল্যবিবাহের কথাটা মাথায় আসেনি। নাকি ইচ্ছে করে লুকিয়েছেন। সঞ্জয়ানের ভারি আফসোস হলো। মায়ের মতো তার মাথায়ও এই বিষয়টি আসেনি। স্মরণে ছিল, শূভ্রা তার থেকে অনেকটা ছোট। কিন্তু বিয়ের ক্ষেত্রেও যে ছোট এই বিষয়টা মাথায় আসলে ও মায়ের সামনে তুলে ধরলে হয়তো আজ শূভ্রা নামক ঝামেলায় জড়াত না!

এই আফসোসে ঘেরা ভাবনা নিয়ে বাবাকে নিয়ে সঞ্জয়ান বাড়ির ভিতর ঢুকছে। ইকবাল আর এগোয়নি। নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে বাবা ও ছেলের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আপনমনে বলল, ‘ যে অন্যায়টা বাবা জেনে-বুঝে স্বইচ্ছায় করেছিল সেই একই অন্যায়টা ছেলে অনিচ্ছায় করেছে। বাবার মতো ছেলের জীবনটাও কি একই পথে গড়াবে? স্বর্ণলতার মতো শূভ্রাও কি অসীম ধৈর্য্য ও সহনশীল হতে পারবে? যদি না হয় তাহলে সঞ্জু বাবার ভবিষ্যৎ কেমন হবে? ‘

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here