#আঙুলে_আঙুল
পর্ব (৩১)
‘ ছায়ানীড় ‘ এর প্রবেশ দ্বারে গাড়ি পৌঁছাতে বেশ কিছু নারীর সমাগম দেখা গেল। স্বর্ণলতা গাড়ির কাচ নামিয়ে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে গেলেন, তার ছেলের বউকে দেখার জন্য কতটা উন্মুখ হয়ে আছে সকলে! সে নামার পূর্বে পেছনের সিটে তাকাল। সেখানে সঞ্জয়ান ও শূভ্রা বসে আছে। প্রথমে ছেলে ও পরে বউমার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললেন,
” ঘোমটা বড় করে টানো, মা। ছোট-বড় মাপবে না। সকলকেই সালাম দিবে, কেমন? ”
শূভ্রা ঘোমটা নামাবে তো দূর মুখ বাঁকিয়ে নিল অন্য দিকে। সঞ্জয়ান ব্যাপারটি লক্ষ্য করে নিজ হস্তে ঘোমটা টেনে দিল জোর করে। ঠাণ্ডা গলায় শা’সি’য়ে বলল,
” এখানে বে’য়া’দবি করলে আমি সহ্য করব না। মা যা বলবে, তা শুনবে। ”
সে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে উত্তর করল,
” শুনব না। আমি আপনাদের কেনা গোলাম নাকি! ”
সঞ্জয়ান অত্যধিক ঠাণ্ডা স্বরে প্রত্যুত্তর করল,
” কেনা গোলাম হলে এত মাপ পেতে না। পি’টি’য়ে পিঠের ছাল তু’লে ফেলতাম প্রথম বারেই। ”
গ’র’ম তেলে পানির ছিটা পড়ার মতো ছ্যাঁত করে ওঠল শূভ্রার উড়নচণ্ডী হৃদয়টা। আ’গু’ন রা’ঙা চোখে তাকাল। সেই চাহনিকে এক আনা দামও দিল না সঞ্জয়ান। গাড়ি থেকে নেমে মায়ের পাশের দরজাটা মেলে দিল। স্বর্ণলতা নামতে নামতে পেছনের গাড়ী থেকে মুনসুর সাখাওয়াতও নেমে এলেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে অভিযোগ করলেন,
” আমার পছন্দের বউমা ঘরে তুলছে বলে তোমার ছেলেকে ছাড় দিলাম। নাহলে স্বর্ণলতা আলাদা গাড়ি তো দূর, আলাদা কদম ফেলারও অনুমতি পেত না। ”
স্বর্ণলতা স্বামীর দিকে আশ্চর্য ভঙ্গিতে তাকালেন। সঞ্জয়ান চেয়েছিল, এক গাড়িতে পুরো পরিবার আসুক। মুনসুর সাখাওয়াত এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন শোনামত্রই। নতুন বিবাহ। এত দূরের পথ! গাড়িও দুটো। তাহলে বর-কনের সাথে শ্বশুর-শাশুড়ি কেন? সঞ্জয়ান বাবাকে বুঝাতে পারবে না। তাই মাকে বলে, শূভ্রাকে সে একা সামলাতে পারবে না। যেভাবেই হোক, বাবাকে বুঝিয়ে এই গাড়িতে নিয়ে আসুক। তিনি ছেলের অসহায়ত্ব, দুর্বলতা এক চাহনিতে বুঝে ফেলেছিলেন। তাই এক গাড়িতে উঠার জন্য স্বামীকে পীড়াপীড়ি করলে মুনসুর সাখাওয়াত বলেন, ‘ তুমি যাও। আমি অন্য গাড়িতে আসছি। দুটো গাড়ি থাকতে, এক গাড়িতে ঠেসে বসতে পারব না আমি। আমার সম্ভ্রমে খোঁচা লাগবে। ”
সঞ্জয়ান গাড়ির পাশ ঘুরে শূভ্রাকে গাড়ি থেকে নামায়। হাতে ধরে মায়ের কাছে এনে বলল,
” বাবার কথামতো বউকে এনে দিয়েছি। এবার তোমরা সামলাও। আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে! ভেতরে গেলাম। ”
সে চলে যেতে পারল না। ডান হাতটা বাবা চেপে ধরলেন। ধ’ম’কের সুরে বললেন,
” সংসার শুরু হলো না এখনই ক্লান্ত হয়ে পড়লে কীভাবে হবে? জামাই বেঁচে থাকতে বউ একা হাঁটবে কেন? দুজন একসাথে যাবি। চুপচাপ দাঁড়া এখানে। ”
উন্মুখ হয়ে থাকা সমাগম ভাঙতে শুরু করেছে। সরগরম হচ্ছে একাধিক কণ্ঠস্বরের কথপোকথনের চাপে। সেখান থেকে একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন স্বর্ণলতার সামনে। ভাঙা স্বরে আহ্লাদ ঢেলে বললেন,
” নয়া বউ রে নিয়া আইছ? মুখখানা অমন ঢাইকা রাখছ ক্যান? ঘোমটা সরাও, মুখটা দেহি। ”
স্বর্ণলতা কোনো প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ পেলেন না। মুনসুর সাখাওয়াত দূর থেকে হুং’কা’র ছাড়লেন,
” আমার বাড়ির বউয়ের মুখ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখবে! তোমার এত বড় স্প’র্ধা! ”
বৃদ্ধ মহিলা ভ’য়ে ছি’ট’কে ওঠলেন। ভীতসন্ত্রস্ত পদে সরে দাঁড়ালেন এক কোণে। বৃষ্টিতে ভেজা মুরগির মতো কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে পড়লে স্বর্ণলতার মায়া হলো। নজরে পড়ে এমন রা’গ নিয়ে তাকালেন স্বামীর দিকে। কাছে চেপে এসে আস্তে কিন্তু তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
” গ্রামের হাওয়া শরীরে লাগতে গলার স্বর বদলে গেছে, তাই না? কার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয় আজও শিখলেন না! ”
চাপা শাসন বুলিতে মুনসুর সাখাওয়াত থতমত খেলেন। চঞ্চলিত চোখজোড়া নিস্তব্ধ হয়ে পড়া মানুষগুলির দিকে ঘুরাতে ঘুরাতে গলার তাপ কমিয়ে ফেললেন তৎক্ষনাৎ। মাথাটা স্ত্রীর দিকে বাড়িয়ে সামান্য নিচু করে বললেন,
” তুমি তো আছ, আমাকে শিখিয়ে দেওয়ার জন্য। ”
” শেখাতে শেখাতে বুড়ি হয়ে গেছি আমি। ”
তিনি স্বর্ণলতার বিরক্তভরা মুখটায় চেয়ে মৃদু হেসে বললেন,
” কোথায় বুড়ি হয়েছ? আমার চোখে তুমি সেই বারো বছরের আদুরীই আছ। যার দুটো চোখ, দুটো কান, দুটো ঠোঁট, শুধু নাক একটা। ”
মুনসুর সাখাওয়াতের তুলনা শুনে তিনি অবাক হলেন। আশ্চর্যান্বিত স্বরে সুধালেন,
” বুড়ো হলে মানুষের নাক দুটো হয় নাকি চোখ, কান, ঠোঁট তিনটা হয়? ”
” কী করে জানব? আমি কি তোমার মতো এমএ পাশ শিক্ষিতা? আমি হলাম, টু’য়ে ফেল করে স্কুল ছাড়া মূর্খ মানুষ। এসব অংক কষা প্রশ্ন আমাকে করবে না, আদুরী। আমার সম্ভ্রমে লাগে! ”
কথাটা বলেই বৃদ্ধ মহিলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। হাতদুটো ধরে বললেন,
” চাচি, ভেতরে আসেন। আমার রুমের খাটে বসে মিষ্টি খেতে খেতে নাতবউয়ের মুখ দেখবেন। মন না ভরলে সেখানে ঘুমাবেন, সকালে উঠে আবার দেখবেন। ”
স্বর্ণলতা তার কৌশলী খোঁচাটা ধরে ফেললেন। হতাশ মনে ভাবলেন, সে এই মানুষটার শরীরটা ধুতে পারলেও মনটা আজও ধুতে পারেনি। শুধু পাহারা দিতে পারছে মাত্র। যতদিন এই পাহারা দিতে পারবেন ততদিনই মানুষটার অন্তরের ক’ঠো’রতা ব’ন্দী হয়ে থাকবে।
ছায়ানীড়ের বাইরের ভীড়টা ভেতরে ঢুকতে বিশালতায় রূপ নিল। কোনো এক রুমে বসানো সম্ভব নয় সকলকে। তাই নতুন বউকে লম্বা বারান্দার এক মাথায় বসানো হলো। বাড়ির সবচেয়ে উঁচু ও নিখুঁত ভারী নকশা করা কাঠের চেয়ারটায় তার আসন হয়েছে। বাকিদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে পাটিতে। সকলের সামনে কাচের থালায় দু’রকমের মিষ্টি ও সরবত রেখে শূভ্রার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন স্বর্ণলতা। ঘোমটা খুলতে খুলতে কানে কানে বললেন,
” সালাম দেও। ”
সে সালাম দিল না। ঘোমটার অংশ শাশুড়ির হাত থেকে টেনে নিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেলল। চেয়ার ছেড়ে উঠে মানুষজনকে ডিঙিয়ে হেঁটে চলল বারান্দার অপরপাশে। দরজা খোলা আছে এমন একটা রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিয়ে চিৎকার করল,
” আমি এ বাড়ির বউ না। এরা আমাকে জোর করে তুলে এনেছে। ”
______________
” মানুষের মনের সাথে শরীরের সুগভীর একটা সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে পেটের। ”
রুহানিয়া কলেজে চাকরি পাওয়ার পর থেকে দুপুরে বাবার সাথে খাওয়া হতো অরুণিমার। এখন আর হয় না। কিন্তু অভ্যাসটাও ত্যাগ করার মতো না বলেই হয়তো সে বাবার বসার স্থানে এসেছিল। অসীউল্লাহ আপনমনে টিনের বাক্স থেকে খাবার খাচ্ছেন। অরুণিমা দূর হতে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিল সহসা আবির্ভাব ঘটে মাইমূনের। অরুণিমা চমকে যায়। জিজ্ঞেস করে,
” তুমি কখন এলে? ”
মাইমূন উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে বলল,
” এজন্যই মনখারাপ হলে পেটের ক্ষুধা মরে যায়। ঠিক যেমন তোমার মরে গেছে। অবশ্য মনের সাথে পেটের এই সুগভীর সম্পর্কটা শুধু তোমার ক্ষেত্রে না সকলের ক্ষেত্রেই হয়। ”
তার এই কথাগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দিল না। মাইমূনকে নিয়ে এই স্থান থেকে অরুণিমা সরে এলো। ভবনটির বারান্দায় নীরব জায়গায় থেমে বলল,
” আবারও আমাকে না বলে এখানে এসেছ? মানা করেছিলাম না? ”
“করেছিলে। কিন্তু মন মানছিল না। ”
” কেন? ”
” দুপুরে খেতে বসেছিলাম হঠাৎ মনে হলো, আমার ভালোবাসাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। মনে হয়, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছে না। এরপর কি আর খাওয়া যায় বলো? না খেয়েও বসে থাকতে পারছিলাম না। তাই দৌড়ে চলে এসেছি। ”
অরুণিমা একটু নিভল। উদাস হলো। সত্যি তার খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে না। বাসায় একসাথে বসে খাওয়ার নিয়ম তাদের। সে এই নিয়মের বাইরে চলে গেছে। রান্নাঘরে যেমন মায়ের পাশে থাকতে পারে না, তেমন খাওয়ার সময়ও। ব্যাপারটি এমন নয় যে, তাকে খেতে নিষেধ করেছে। কিন্তু খেতে বলেও না। তাদের সাথে বসলে থালায় ভাত বেড়ে দেয় না। প্রথম দিকে সে নিজে বেড়ে নিলেও পরবর্তীতে আগ্রহটা হারিয়ে ফেলে। মাইমূনের ধারণামতো, ক্ষুধাটায় হয়তো মরে গেছে। তাই দুইদিন ধরে রাতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে না।
” তোমার বাসার সমস্যাটা মিটেনি? রাগ চলছে এখনও? ”
অরুণিমার সম্বিৎ ফিরল। অপ্রস্তুত চেয়ে আছে। ইতস্তত করে বলল,
” কমেছে। ”
” এরপরও মনখারাপ? ”
প্রশ্নটি পড়তে ঘণ্টার শব্দ শোনা গেল। অরুণিমা তাড়াহুড়োয় বলল,
” আমার মনখারাপ নেই। তুমি এখন যাও, আমি পরে দেখা করব। ”
মাইমূনের হাতে টিফিন ক্যারিয়ার। সেটা উপরে তুলে বলল,
” এগুলোর কী হবে? আমি যে ক্ষুধা জীবিত করার জন্য তোমার প্রিয় খাবার রেঁধে এনেছি। ”
” আমার প্রিয় খাবার? ”
” এই না। ভুল বলেছি, তোমার প্রিয় খাবারের নাম জানি না। তাই আমার প্রিয় খাবার এনেছি। ”
” তুমি রেঁধেছ? ”
অরুণিমার প্রশ্নটা শুনেনি এমন ভাব করে মাইমূন পুনরায় বলল,
” আমরা একে-অপরের প্রিয়-অপ্রিয়ের সম্পর্কে কবে জানব? আমার যে আর ধৈর্য্য হচ্ছে না। ভালোবাসা, কিছু একটা করো। নাহয় আমাকে কিছু করতে বলো। ”
তার কণ্ঠস্বরে একইসাথে অভিযোগ, অনুরোধ। আকুতিভরা নয়ন দুটোতে চেয়ে অরুণিমা বলল,
” আমি করব। তার আগে বলো, তুমি সত্যি বাবাকে অসম্মান করে কিছু বলোনি? ”
মাইমূন অগাধ আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রত্যুত্তর করল,
” না। নিজেকে অসম্মানিত করে তাকে সম্মানিত করেছি। শুধুমাত্র তার মেয়েকে ভালোবাসি বলেই ‘ মিয়া ভাই ‘ পদবিটা উপড়ে ফেলে মাথা নত করেছি। ”
চলবে