আঙুলে আঙুল পর্ব ২৯

0
367

আঙুলে আঙুল
পর্ব (২৮)

কলেজের বাইরে এসে মাইমূন খালি রিকশা থামাল। অরুণিমাকে উঠার জন্য ইশারা করল। সে সংকোচসহিত এক অংশ জায়গা দখল করতে মাইমূনও উঠে বসল। রিকশা উল্টো পথে ছুটতে অরুণিমা জিজ্ঞেস করল,
” ঐদিকে কেন? আমরা বাসায় যাচ্ছি না? ”

মাইমূন মৃদু হাসল। রহস্য করে ছোট্ট করে উত্তর দিল,
” না। ”
” তাহলে? ”

প্রশ্নটা করে ঘড়ির দিকে তাকাল অরুণিমা। বাবা এতক্ষণে বাসায় পৌঁছে গেছে। দেরি করে বাসায় ফেরা কি ঠিক হবে? এমনিতে তাদের সাথে বাক্যলাপ বন্ধ। মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখে সর্বক্ষণ। সে নিজ থেকে কিছু বলতে চাইলে কিংবা করতে চাইলে বিরক্ত দেখায়। যেন সে এই বাড়ির কেউ না! উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।

” জানতেই হবে? আমি যে সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছি! ”

বাক্য দুটো এত নরম স্বরে উচ্চারণ করল যে, তার মায়া হলো। সিদ্ধান্তগ্রস্থ হয়ে পড়ল। প্রত্যুত্তরে নীরব থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। তার এই মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ হিসেবেই গ্রহণ করল মাইমূন। রিকশাওয়ালাকে গন্তব্য স্থানের নাম শুনিয়ে দিয়ে বলল,
” ফুলগুলো কী করেছ? ”
” কোন ফুল? ”

মাইমূনের নয়নজোড়া স্থির হলো সঙ্গীনীর দিকে। কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে ম্লান হাসল। বলল,
” আমার ব্যাপারে তুমি খুব উদাস হয়ে পড়ছ, ভালোবাসা। বিষয়টা আমার পছন্দ হচ্ছে না। ”
” এমন মনে হওয়ার কারণ? ”
” কাল রাতে ফুলগুলো ভালোবেসে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, তুমিও ভালোবেসে খুব যত্ন করে মালা গাঁথবে। তারপর সেই মালা পরে আমার সামনে আসবে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখব, ফুল দিয়ে ফুল সাজলে কতটা সুন্দর দেখায়। তুমি সাজবে তো দূর ফুলের নামই ভুলে গেছ! ”

অরুণিমার স্মরণে এলো, কালরাতে মাইমূন তাকে ঝরা বকুল ফুল দিয়েছিল। এগুলো দিয়ে যে মালা গাঁথা যাবে এই বিষয়টি তার মাথায় আসেনি। বাসায় ফিরে ফুলগুলো টেবিলের উপর রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে তাকিয়ে দেখাও হয়নি। এতক্ষণে হয়তো শুকিয়ে গেছে। মা ঘরদোরে ঝাঁট দিতে গিয়ে ফেলে দিয়েছে। মায়ের কথা ভাবতে গিয়ে এটাও মনে পড়ল, তিনি এখন আর অরুণিমার রুমে যায় না। তার অনুপস্থিতিতে ঘরদোর ঝাঁট দেয় না। অগোছাল জিনিসপত্র গোছায় না। মনখারাপ হতে হতে নিয়াজের মুখটা ধরা দিল মস্তিষ্কে। মা ফেলে না দিলেও নিয়াজ ঠিকই এগুলো নিয়ে কিছু একটা করবে। পুরো রুমে ফসল ফলনের মতো ছড়িয়ে রাখবে। মাইমূনের ভালোবাসার দানের সাথে এতটা অবহেলিত হওয়ায় অরুণিমার মনখারাপটা তীব্র হলো। হয়তো সে ঠিকই বলেছে, মাইমূনকে নিয়ে সে বড্ড উদাসীন হয়ে পড়ছে। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। তবুও হচ্ছে। এর কারণ কী হতে পারে? প্রশ্নটা মনের বাক্সে ফেলে পরিস্থিতি সামলাতে তৎপর হলো। বলল,
” আমি জানতাম না, আজ আমাদের দেখা হবে। ”

মাইমূন সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল,
” জানলে, মালা বানিয়ে পড়তে? ”

অরুণিমা মুখে জবাব দিল না। চোখের দৃষ্টি নিচু করে মাথা দু’পাশে নাড়ল। মাইমূন অত্যন্ত আনন্দ ও উৎসাহের সাথে বলল,
” তাহলে আজও তোমাকে বকুল ফুল দিয়ে আসব। রাতে ছাদে এসো। ”

____________
সঞ্জয়ান ব্যবসায়িক মিটিংয়ে অংশ গ্রহণ করার জন্য খুব সকালেই বেরিয়েছিল। বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়। এসেই শুনতে পায়, শূভ্রা নাস্তা করেনি। দুপুরের খাবারও খায়নি। মুহূর্তেই মেজাজটা চ’টে গেল তার। মায়ের কাছ থেকে সরে এসে নিজের রুমে ঢুকল। ভেতরে প্রবেশ করতে মুখের ভাব হলো কঠিন, দৃঢ়। ভয়ানক রাগ নিয়ে বলল,
” সমস্যা কী তোমার? ”

শূভ্রা বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ছিল। হুংকার শুনে পড়ি-মরিতে উঠে বসল। তার বধূ সাজ এলোমেলো হয়ে এলেও বদলায়নি। চুলের বাঁধন খুলে গেছে। এক কানে দুল নেই। লাল বেনারশি কুঁচকে পাক ধরেছে। মুখে এক চিমটিও লাবন্য নেই। ক্লান্ত ও নোংরা দেখাচ্ছে। এক রাতেই একহারা শরীরটাতে মাংসের অভাব বুঝা যাচ্ছে। সঞ্জয়ান এতটাই বিরক্ত হলো যে, চোখদুটিতে রা’গে’র আগুন জ্বলজ্বল করে উঠল। শূভ্রার এক বাহু চেপে ধরে খাট থেকে নামাল। স্থির দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” খাওয়া-দাওয়া করছ না কেন? ”

সে গোঁ ধরে বলল,
” করব না। বাড়ি না যাওয়া পর্যন্ত কিছু করব না। ”

সে সাবধানী সুরে বলল,
” একদম জে’দ করবে না। যাও, গোসল করে এসো। একসাথে খাব। ”
” আগে বাড়ি যাব, তারপর খাব। ”
” শূভ্রা, আমাকে রাগাবে না। ভালোমতো বলছি, কথা শোনো। ”

তার এই শান্ত শা’স’ন ও ধ’ম’ক’কে একদমই গায়ে মাখল না শূভ্রা। ভ’য় পাওয়া তো দূর আগের চেয়েও আরও বেশি নাছোড়বান্দা ভাব ধরা পড়ল চোখদুটিতে। সঞ্জয়ানের চোখে চোখ রেখে অটল গলায় বলল,
” শুনব না। আপনার কোনো কথা শুনব না। ”

সঞ্জয়ানের রা’গ সংবরণ করতে কষ্ট হচ্ছে। ঠোঁট চেপে, চোখ খিঁচে রুমের মধ্যে পায়চারি করল কিছুক্ষণ। এতেও কাজ হলো না। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে শূভ্রাকে টেনে নিয়ে গেল স্নাগারে। কল ছেড়ে দিয়ে তার নিচে দাঁড় করাল জোর করে। গায়ের গয়না, শাড়ি যেভাবে পারল খুলে ছুঁড়ে ফেলল নিচে। ঘাড়টা একহাতে চেপে ধরে মুখে সাবান লাগাল প্রথমে। তারপরে হাত মুড়িয়ে পেছনে এনে সাবান ছোঁয়াল গলা, পিঠ ও পেটে। সাবান মাখানো শেষে তাকে ছেড়ে দিল। স্নাগার থেকে বেরিয়ে রাতের দেওয়া শাড়িটা তার মুখে ছুঁ’ড়ে মে’রে বলল,
” ইচ্ছে হলে কাপড় পরে বদলে বেরিয়ে এসো, নাহয় যতক্ষণ পার ভিজো। ”

ক্রো’ধে শূভ্রার শরীর জ্বলে উঠে। ইচ্ছে করছিল, পানির নিচেই দাঁড়িয়ে থাকবে। শুধু ভিজেই যাবে। কিন্তু সম্ভব হলো না। তার শরীর মনের বিপক্ষে চলে গেছে। পুরো শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। রীতীমতো কাঁপছে! সম্পূর্ণ মুখটা কালো হয়ে আসলেও চোখদুটি আ’গু’নের মতো লাল। সে চটজলদি শুকনো শাড়িটা শরীরে জড়িয়ে শীত নিবারণে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। স্নাগার থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল, সঞ্জয়ান রুমে ঢুকছে। তার দুই হাতে দুটো থালা। একটাতে রুটি ও অপরটিতে ভাত। তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে চলেছে শূভ্রা বুঝে ফেলল। সে তাৎক্ষণিক দুই হাতে মুখ চেপে ধরে খাটের নিচে লুকিয়ে পড়ল। সঞ্জয়ান খাটের উপর থালা দুটি রাখল। খাটে বসা অবস্থায় নিচে উঁকি দিয়ে বলল,
” পালিয়ে লাভ নেই। তোমাকে এই সব খেতে হবে। সেটাও আমার সামনে বসে। ”

__________
অরুণিমাদের রিকশা এসে পৌঁছাল একটি আটতলা বিল্ডিংয়ের সামনে। মাইমূনকে অনুসরণ করে মূল ফটকের ভেতরে প্রবেশ করতে করতে জিজ্ঞেস করল,
” এখানে কে থাকে? কার কাছে এসেছ? ”

মাইমূন লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাটন চেপে অপেক্ষা করতে করতে বলল,
” শূভ্রার কাছে। তার স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ি এখানেই থাকছে কয়েকদিন ধরে। সম্ভবত এটা তার শহুরে শ্বশুরবাড়ি। ”

লিফটের মধ্যে থাকা পুরো সময়টা বিস্ময়ে কাঠ হয়ে থাকে অরুণিমা। আপনমনে ভাবে, যে মানুষটা তার প্রতিটা পদক্ষেপকে গুরুত্ব দেয় সে মানুষটার দিকে সামান্যতম আগ্রহ নিয়েও তাকায় না। এ যে অন্যায়! অরুণিমা বিবেকের সাথে সন্ধি করে মাইমূনের দিকে তাকাল আড়চোখে। সেই সময়ে লিফটের দরজা খুলে যায় তারা চার তলায় চলে এসেছে।

_________
মায়ের ডাকে বসার রুমে আসে সঞ্জয়ান। প্রথমেই চোখ পরে অরুণিমার উপর। হঠাৎ আগমনে অবাক হয়। বিস্মিত ভাবটা উবে গেল মাইমূনকে দেখে। তার পাশে সামান্য দূরত্ব রেখে বসে আছে। সঞ্জয়ান পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো তাদের কাছে। মাইমূন উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
” আমি মাইমূন। ”

সঞ্জয়ান বিনয়ী হাসল। হাত মিলিয়ে বলল,
” আপনি কতটা ভাগ্যবান, জানেন? ”

মাইমূন পাশ ফিরে অরুণিমার দিকে তাকাল। হাসিটা চওড়া করে বলল,
” যতটা ওজন করা যায় না। ”

সঞ্জয়ান হাতটা ছাড়ল না। বুকে টেনে নিয়ে কানে কানে বলল,
” আপনাকে দেখার পর জানতে পারলাম, সঞ্জয়ান সাখাওয়াতের মধ্যেও হিংসে নামের অনুভূতিটা আছে। ”

চলবে

[ কাল দিব বলেও দিতে পারিনি। দুঃখিত। আবার নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করছি। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here