আঙুলে আঙুল পর্ব ২৮

0
372

আঙুলে আঙুল
পর্ব (২৬)

অরুণিমা বাসা থেকে বেরিয়ে ছাদে এসেছে। একপাশে আড়ালে দাঁড়িয়ে ছোট বোনের বিদায় কান্না দেখছে। তার চোখেও কান্নার তৃষ্ণা এসেছে। সে পাত্তা দিল না। নিষ্ঠুরের মতো সংবরণ করে নিল। শূকনো চোখজোড়া শুধু র’ক্ত’বর্ণ হচ্ছে ধীরে ধীরে।

” মন খারাপ? ”

হঠাৎ অন্য কারও গলা পেয়ে সে চমকে কেঁপে ওঠে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় সচকিত বদনে। অন্ধকারে ডুবে থাকা পুরুষ অবয়বটি অনুরণিত কণ্ঠটির মতোই পরিচিত।

” এগুলো তোমার জন্য। ”

মাইমূনকে চিনতে পেরে তার আ’ত’ঙ্ক কমেছে, ভ’য় দূর হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়টা এখনও কাটেনি। এই সময়ে এই জায়গায় তার উপস্থিতিটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয়।

” ফুলগুলো পছন্দ হয়নি? ”

অরুণিমা বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে তার হাতের দিকে তাকাল। দুই হাতের কোষ ভর্তি ঝরা বকুল ফুল। বেশ সতেজ, স্নিগ্ধ। সুগন্ধ ছড়াচ্ছে একটু একটু করে। মাতাল করে তুলছে চারপাশ। মাইমূন মনখারাপের সুরে বলল,
” তোমার পছন্দের ফুলের নাম জানা হয়নি এখনও। তাই এবারও আমার পছন্দের ফুল নিয়ে এসেছি। এজন্য খুবই দুঃখিত। ”

অরুণিমা হাত পাতল। মাইমূন ফুলগুলো তার হাতে দিতে দিতে বলল,
” জানো তো, ফুল ও মনখারাপ দুটোর একসাথে থাকতে নেই? ”

সে উত্তর দিল না। উদাস চোখে তাকিয়ে আছে দূরের রাস্তাটায়। যেদিক দিয়ে মাত্রই শূভ্রা ও সঞ্জয়ান একই গাড়িতে চড়ে চলে গেছে। মাইমূনও তাকাল সেদিকটায়। পরক্ষণে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল নিজের ভালোবাসার মানুষটির দিকে। বলল,
” এমনি এমনি ফুল নিতে হয় না। এতে তাদের সৌন্দর্যের অপমান করা হয়। ভালোবাসা, এই ফুলগুলোর বিনিময়ে আমি কী পাব? ”

অরুণিমার দৃষ্টিও ফিরে এলো। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি রাখলে সে পুনরায় বলল,
” আমার চাওয়ার সুযোগ থাকলে তোমার মনখারাপটা চাইব। এতে কিন্তু তোমারও লাভ। ফুল ও মনখারাপ একসাথে থাকতে পারবে না। ”

মাইমূন খালি হাত জোড়া নিয়ে আঁজল আকারে অরুণিমার মুখের সামনে এমনভাবে ধরে আছে যেন, তার মুখ থেকে মনখারাপ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে! অরুণিমা এই অদ্ভুত প্রেমবাচন, দরদ আচরণে মুগ্ধ হতে পারছে না। খুব একটা গুরুত্ব দিল না। তার মন ও মস্তিষ্কে দুটো কথায় ঘুরপ্যাচ খাচ্ছে। প্রথমটা শূভ্রার বিয়ে হয়ে গেছে, এ বাড়ি ছেড়ে চলেও গেছে অথচ কেউ তার খোঁজ করেনি। আপন পরিবার থেকে কি সে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে? দ্বিতীয়টা এত রাতে এখানে মাইমূন কী করে এলো? সে কী করে জানল, অরুণিমা ছাদে আছে। তার মনখারাপ। প্রথমটার উত্তর এখন না পাওয়া গেলেও দ্বিতীয়টা পাওয়া সম্ভব। মাইমূনকে প্রশ্ন করলেই পেয়ে যাবে। কিন্তু তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। একেবারেই না। এমন নীরব, চুপচাপ থাকতে ভালো লাগছে।

” মনে হচ্ছে, কারণ না জানলে মনখারাপ দূর হবে না। অরুণিমা, কী হয়েছে আমাকে বলবে? ”

অরুণিমার হালকা দৃষ্টি এবার গাঢ় হতে বাধ্য হলো। মাইমূন তাকে সচরাচর ভালোবাসা বলেই ডাকে। অরুণিমা নামে আগে ডেকেছিল নাকি মনে নেই কিংবা আজকের মতো খেয়াল করে শুনেনি। সে ভালো করে সামনের মানুষটার মুখের দিকে তাকাল। চোখদুটিতে পাহাড়ের মতো নিটোল গাম্ভীর্য, প্রবৃত্ত। কিছু একটা অর্জন করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।

” আমি জানি, আজ শূভ্রার বিয়ে হয়েছে। মনখারাপটা এই কারণে নাকি অন্য কিছু? ”

মাইমূন কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ব্যাকুল স্বরে সুধাল,
” আংকেলকে আমার ব্যাপারে বলেছ? তিনি কি আরও রেগে গেছেন? ”

অরুণিমার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। শুরু থেকেই মাইমূনকে তার বাবা পছন্দ করেনি। সম্পর্কটাকে মেনে নেওয়ার কোনো লক্ষণও দেখতে পারছে না। এরমধ্যে যদি মাইমূনের জন্ম ইতিহাত তুলে ধরে তাহলে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাবে। যে মুঠো পরিমাণ আশা নিয়ে চলাফেরা করছে সেটাও হয়তো আর থাকবে না। মাইমূন উত্তরের অপেক্ষা করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠল। খানিক অভিমানি সুরে প্রশ্নটা করল,
” তুমি কি এমন চুপই থাকবে? কিছু বলবে না? ”

অরুণিমা চোখের পলক ফেলল। মুখটা সরিয়ে নিল অন্যপাশে। একটু বামে সরে গিয়ে আগের মতোই নিস্তব্ধ হয়ে আছে। মাইমূন নিজ জায়গা থেকে নড়ল না। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
” আসছি। কথা বলতে ইচ্ছে হলে কল করো। ”

তার কণ্ঠ ভার, শীতল। বাক্যভাবে হতাশা, অবসন্ন। ধীর পদক্ষেপে ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার দরজাটার নিকটে গিয়ে পৌঁছাল। নিচে না নেমে আচমকা পেছন ফিরে ডাকল,
” ভালোবাসা? ”

অরুণিমা চমকে তাকাল। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি রাখলে সে জিজ্ঞেস করল,
” তোমাকে ‘ ভালোবাসা ‘ নামে ডাকি কেন, জান? ”

সে আবছা আলো-আঁধারির মধ্যে মাথা দুপাশে নাড়ল। মাইমূন দূর হতে মৃদু হেসে বলল,
” কারণ, তুমি হলে আমার ছোট্ট হৃদয়ের সবটা ভালোবাসার একমাত্র মালিক। যার ভাগ আমি কাউকে দিতে পারিনি, কেউ নিতেও পারেনি। এ আমার দুর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্য আজও বুঝতে পারিনি। বুঝার দায়িত্ব তোমাকে দিতে চাই। ভালোবাসা, দায়িত্বটা নিয়ে আমার ভাগ্যটাকে নির্ণয় করে দেও। ”

তার এই আকুল আবেদন, হৃদয় বিদারক প্রার্থনায় অরুণিমার বোবা ভাব কাটিয়ে দিল। নিশিরাতের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মতো জড়িয়ে ফেলল গভীর মায়ায়। নিজস্ব চিন্তা-চেতনা থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
” আরেকটু আমার কাছে থাকুন। ”

মাইমূন দৌড়ভঙ্গিতে তার পাশে এসে দাঁড়াল। চাঁদের জোসনার মতো চোখ ও ঠোঁটে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাচ্ছে। মিষ্টি হেসে মুক্ত স্বরে বলল,
” আর একটু না সারাক্ষণ তোমার কাছে থাকতে চাই। এই নিয়ে আমার মধ্যে বিরক্ত কিংবা অনিহা খুঁজে পাবে না কখনও। ”

বাক্যদুটোতে ভীষণ আবেগ, অনুভূতির প্রাবল্য। অরুণিমা টের পেল, তার মানব-চর্মের ফাঁকে ফাঁকে শিলাবৃষ্টির মতো তুমুল বেগে কিছু একটা পতিত হচ্ছে। শিউরে ওঠা শরীরটাকে দুই হাতে বেঁধে নিল। মাইমূন ব্যস্ত স্বরে সুধাল,
” শীত করছে? চাদর এনে দেব? ”

অরুণিমা এক ঝলক তাকিয়ে দৃষ্টি নিচু করে ফেলল। মাথা দুলিয়ে না বলতে সে পুনরায় বলল,
” এভাবে চুপ করে থাকলে থাকি কী করে? আমার খারাপ লাগে। মনে হয়, তুমি বিরক্ত হচ্ছ। ”

অরুণিমা দৃষ্টি উঁচু করল। সুধীর গলায় বলল,
” মাঝে মাঝে চুপ করে থাকার মধ্যেও স্বস্থি থাকে, আরাম পাওয়া যায়। তুমি কি চাও, আমি সেই স্বস্থি ভেঙে কথা বলি? ”
” সেরকম হলে কথা বলার প্রয়োজন নেই। আমি নাহয় তোমার নীরবতার সঙ্গী হয়ে থাকি। ”
” বাইরে হাঁটতে যাব? ”
” অবশ্যই। এসো। ”

মাইমূনের পেছন পেছন সেও ছাদ থেকে থেমে রাস্তায় এলো। এক কিনার ধরে চুপচাপ হাঁটল অনেক্ষণ। অরুণিমা যত সামনে এগুচ্ছে ততই যেন মাইমূনের উপস্থিতিটাকে ভুলে যাচ্ছে। মন ও মস্তিষ্ক দখল করে নিয়েছে সঞ্জয়ান ও শূভ্রার বিবাহের মুহূর্তটা। যে মানুষটা তাকে বিয়ে করতে এসেছিল সেই মানুষটা আজ তার ছোট বোনের স্বামী। হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদলের কারণ কী হতে পারে? প্র’তি’শো’ধ?

” আর সামনে যাওয়া কি ঠিক হবে? বারোটা পার হয়ে গেছে। আংকেল-আন্টি নিশ্চয় খুব চিন্তা করছেন। ”

অরুণিমা থেমে গেল। মাইমূনের দিকে চেয়ে আছে। নিষ্পলক চাহনি। মুখমন্ডলে মেঘের আবির্ভাব। ইচ্ছে হলো বলতে, বাসায় তার জন্য কেউ চিন্তা করছে না। চিন্তা করার মতো যে একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল সেটি ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু বলা হলো না। নিরুত্তরে পা ঘুরিয়ে নিল ফেরার পথে। মাইমূন তাকে অনুসরণ করতে করতে একদম বাসার নিকটে এসে গেছে। মূল ফটকে ঢোকার পূর্বে বলল,
” অনেক ভেবে দেখলাম, সেদিন তোমাদের বাসায় আমার আসা উচিত হয়নি। ভাং’চু’র করাও খুব অন্যায় হয়েছে। আমি ভীষণ লজ্জিত ও অনুতপ্ত। তোমার বাবার কাছে কি ক্ষমা চাইব? ”

অরুণিমা ভেতরে ঢুকল। একটুক্ষণ নীরবে ভেবে বলল,
” আগে আমি ক্ষমা পাই, তারপরে তুমি চেষ্টা করো। ”
” আচ্ছা। ”

মাইমূনও ভেতরে ঢুকল। অরুণিমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,
” সেই খারাপ মুহূর্তের মাঝেও একটি আনন্দিত মুহূর্ত ছিল। কী জানো? ”
” কী? ”
” তোমার ‘ আপনি ‘ থেকে ‘ তুমি ‘ তে নেমে এসে আমাকে গ্রহণ করা। ”

কথা বলতে বলতে দুজনে সামনে এগুচ্ছে। অরুণিমাদের ফ্ল্যাটের সামনে আসতে দুজনে থমকে গেল। অসীউল্লাহ দরজা মেলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে দেখে সে ভয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। মাইমূন পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। এই সময় অরুণিমার স্মরণ হলো, মাইমূন এই বাড়ির ছেলে।

___________
শূভ্রাকে নিয়ে বাসায় আসার পর বিস্ময়ের অন্ত খুঁজে পাচ্ছে না সঞ্জয়ান। তার রুমে ফুল ও বেলুন দিয়ে সাজানো। বিছানায় সাদা চাদর, মধ্যখানে গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছড়ানো-ছিটানো। সে ভেবেই পাচ্ছে না এত অল্প সময়ে বাবা-মা এত কিছু করল কখন!

” আমি বাড়ি যাব। এখনই যাব। ”

কাঁদতে কাঁদতে কথা দুটি বলেছে শূভ্রা। সঞ্জয়ান বিছানা থেকে নজর নামিয়ে আনল মেঝেতে। শূভ্রা এখানে বসে কাঁদছে। পরনের শাড়ি, গয়না ঠিক স্থানে নেই। পুরো মুখ, গলা ও বুকের একঅংশ ভিজে গেছে চোখের পানিতে। ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছে আর নাক টানছে। তার এত মায়া লাগল! চাহনি বদলে গেল সহানুভূতিতে। বেদনা ও দরদ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। বয়সের মাপে মেয়েটি তার থেকে অনেকটাই ছোট, কথাটা পূর্বেই অবগত ছিল। এখন যেন, বয়সটা আরও কমে এসেছে। কিছুতেই স্বীকার করতে পারছে না এই মেয়েটি তার বিবাহিত স্ত্রী। সারা জীবনের সাথী। জেদের বশে পড়ে একি করল! এমন একটা ভুলে জড়িয়ো পড়ল যা শোধরানোর সুযোগ ও সময় কোনোটায় পাবে না। অনুতাপে সঞ্জয়ানের বুকের ভেতরটা পুড়ছে। মাথার ভেতরটা ঝিমিয়ে আসছে। চিন্তা-ভাবনার শক্তি লোপ পেয়ে যাচ্ছে। হাত-পা হয়ে আসছে অসাড়। সে দরজার নিকটেই দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে এগুতে পারল না আর। তার এই অনুভূতিশূন্য অবস্থায় শূভ্রা দৌড়ে এলো। সঞ্জয়ানের কলার চেপে ধরে বলল,
” আপনি এটা কেন করলেন? কেন? আমি আপনাকে ছাড়ব না। ”

তার কণ্ঠে একই সাথে তীব্র ধ’ম’ক, শা’সা’নি। সঞ্জয়ান রা’গ করতে চেয়েও করল না। ঠাণ্ডা স্বরেই বলল,
” শূভ্রা ছাড়ো। এ ধরনের ব্যবহার আমার পছন্দ নয়। ”

সে ছাড়ল না। আরও শক্ত করে চেপে ধরল। চিৎকার করে বলল,
” না ছাড়ব না। আপনাকে মে’রে ফেলব। ছোটলোক, বদমাশ, লুচ্চা, বুইড়া ব্যাডা। মেয়ে মানুষ দেখলে শরীরে আগুন জ্বলে ওঠে। প্রথমে আপুকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। তা না করে আমাকে কেন করলেন? কচি মেয়ে দেখেই মাথাটা বিগড়ে গেছে, তাই না? ”

বলতে বলতে সঞ্জয়ানের হাতের কনুইয়ের উপর কা’ম’ড়ে দিল। একবার, দুই বার। তিন বারের সময় বাঁধা পেল। সঞ্জয়ান তার মাথা হাত দিয়ে ধরে পেছনে ধা’ক্কা মেরে বলল,
” পাগল হয়ে গেছ নাকি? কা’ম’ড়াচ্ছ কেন? ”
” হ্যাঁ, পাগল হয়ে গেছি। আপনি আমাকে পাগল বানিয়ে দিয়েছেন। ”

উত্তর দিয়ে সে দরজার দিকে ছুটল। বাইরে বেরুতে বেরুতে বলল,
” আপনার সাথে থাকব না। কখনও না। আমি এখনই বাড়ি চলে যাব। এখনই। ”

সে ছুটতে চাইলেও পারল না। সঞ্জয়ানের হাতে বাঁধা পড়ে গেল। ভেতরে টেনে আনল জোর করে। দরজায় খিল টেনে বলল,
” তোমার সাথে একঘরে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। চুপচাপ বসো, মাথা ঠাণ্ডা করো। আমি একটা উপায় বের করছি। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here