আঙুলে আঙুল
পর্ব (২৫)
” আমি বিয়ে করব না, আপু। বাবাকে বলো, এই বিয়ে ভেঙে দিতে। ”
অরুণিমা বাকরুদ্ধ। বিস্ফারিত নেত্রদ্বয়ে আবিষ্কার করল, শূভ্রার শরীরে লাল বেনারশী ও স্বর্নের গয়না। বুঝতে পারল, সঞ্জয়ান তাকে নয় শূভ্রাকে বিয়ে করতে আসছে। এই মানুষটার দেওয়া একের পর এক ঝটকায় তার ভেতরটা বরফের মতো জমে গেছে। বাহিরটা হয়েছে স্পাতের মতো শক্ত, ক’ঠিন। অনুভূতি শূণ্য হয়ে থাকল কয়েক মুহূর্ত। অত:পর শুধুমাত্র ঠোঁটদুটোতে প্রাণ এনে বলল,
” আমি বলতে পারব না, তুই গিয়ে বল। ”
” আমার ভ’য় করে। ”
শূভ্রাকে নিজ থেকে সরাল। বাহু জোড়া চেপে ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বলল,
” অন্যায় করার সময় তো ভ’য় পাস না। ভুলের পর ভুল করে এসেও বাবার মুখোমুখি হয়েছিস। তর্ক করেছিস অসংখ্যবার। ”
সে মাথা নত করে ফেলল। অরুণিমা খেয়াল করল, শূভ্রার চোখদুটি ভেজা, ফোলা। দীর্ঘ সময়ের কান্নাকাটির ফল। তার মায়া হলো। স্নেহ এসে জমছে চোখজোড়ায়, অন্তরের সর্ব পাশে। দরদ উতলে উঠে আসছে কণ্ঠস্বরে৷ সে দমিয়ে ফেলল। তৈরি হওয়া সকল অনুভূতিকে উপেক্ষা করে বলল,
” অন্যায় করে এসেও যখন নিজের জন্য ল’ড়’তে পেরেছিস তখন ন্যায়ের জন্যও ল’ড়’তে হবে। এই বিয়েতে শুধু তোর না আমারও মত নেই। যা বাবাকে গিয়ে বল, এই বিয়ে তুই করবি না। ”
” আমি পারব না, আপু। বাবা কষ্ট পাবে, খুব রা’গ করবে৷ ”
” কবে থেকে তুই বাবার কথা চিন্তা করছিস? ”
অরুণিমার কণ্ঠস্বরে বক্রোক্তি, শ্লেষ্মা। চোখের চাহনিতে কটাক্ষভাব। শূভ্রা মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। আড়ষ্টভাবে লজ্জিত স্বরে বলল,
” যেদিন থেকে বাবা আমাকে ‘ মা ‘ বলে ডাকতে শুরু করেছে সেদিন থেকে। মায়েরা কি ছেলেকে কষ্ট দিতে পারে? ”
বোনের মুখে এমন মমতাময় প্রত্যুত্তর পেয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হলো। মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ হয়ে এলো দৃষ্টি জোড়া। কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ থেকে বলল,
” তাহলে বিয়ে করে ফেল। কান্নাকাটি করছিস কেন? ”
অরুণিমা তাকে পাশ কাটিয়ে বিছানায় বসল। মাথায় মুড়িয়ে রাখা হিজাব খোলায় মনোযোগ দিল। শূভ্রা তার এই নিরুদ্বেগ ভাবটাকে সহ্য করতে পারছে না। দৌড়ে এসে পাশে বসল। হাত চেপে ধরে বলল,
” এত নি’ষ্ঠু’র হয়ো না, আপু। আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো। কথা দিচ্ছি, তুমি যেমন বলবে তেমন শুনব। যেভাবে থাকতে বলবে সেভাবেই চলব। ”
শূভ্রা নানানভাবে অনুরোধ করল, পূ্র্বের অপরাধ স্বীকার করল। নিজেকে বদলে ফেলবে এমন প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছে বারবার। অরুণিমা চুপচাপ শুনছে আর ভাবছে, বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে সবার চোখে খারাপ হয়েছে। দোষী হয়েছে। অপরাধি সেজে ঘুরঘুর করছে সারা বাড়িতে। পায়ে ধরেও সেই দোষক্ষালন করতে পারছে না। বোনের জন্য নাহয় আরও একটু দোষী হলো। সে উঠে দাঁড়াল। ওড়নাটা গলায় ও মাথায় ভালো করে জড়িয়ে দরজার দিকে এগুল। বের হতে পারল না। কোথাও থেকে মা এসে উপস্থিত হলেন দ্বারের মুখে। চোখ পা’কি’য়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায় যাচ্ছিস? ”
অরুণিমা নির্ভয়ে দৃঢ়স্বরে বলল,
” বিয়ে ভাঙতে। তোমরা একই ভুল আবারও করছ। এই বিয়েতে শূভ্রার মত নেই। ”
উত্তরটা নাজিয়া বেগমের কানে পৌঁছাতে মেয়ের কনুই চেপে ধরলেন। নিচু স্বরে শাসিয়ে বললেন,
” বাবাকে যদি আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে চাস তাহলে এখান থেকে এক কদমও নড়বি না। আমাদের হয়ে অনেক করেছিস, এবার থাম। ”
কথাটা বলেই তিনি চলে গেলেন সঞ্জয়ানদের কাছে। হাসি বদন ও তুষ্টচিত্তে তাদের সাথে মিশে গেলেন।
__________
প্রথম দিন থেকেই শূভ্রা অ’ভ’দ্র আচরণ করে আসছে সঞ্জয়ানের সাথে। সে সয়ে এসেছে। ছাড় দিয়েছে। খুব বেশি অসহ্যের হয়ে গেলে অরুণিমার কাছে নালিশ করেছে। কিন্তু এই বার আর সয়তে পারল না। ধৈর্যের বাঁধ ভে’ঙে গেল। রা’গ’টাকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এইটুকু মেয়ে তাকে কল করে হু’ম’কি দিচ্ছে! মা’রার কথা বলছে! এরপরও কি ছাড় দেওয়া যায়? সঞ্জয়ান দিতে পারল না। কিংবা পরিস্থিতির চাপে পড়ে নিজের মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। দুর্বল চিন্তা-ভাবনায় পড়ে হাজির হয়েছে শূভ্রাদের বাড়ি। নিজের ব্যক্তিত্ব, প্রকৃত সত্তাকে ভুলে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে। শুরুতেই তারা রাজি না হলেও সঞ্জয়ানের বাবা-মাও যখন পিছু পিছু হাজির হলো তখন আর ফিরিয়ে দিতে পারেনি। মত ও অমতের মধ্যে পড়ে বিয়ের আয়োজনটা জমেই গেল। কাজী সাহেব যখন বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন সঞ্জয়ানের নজর পড়ল দূরে, অরুণিমার পানে। দরজার মাঝামাঝি স্থানে আঁট হয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছে একভাবে। সে দূর থেকেও যেন সে চাহনির অর্থ বুঝে গেল। নিজের কান্ডে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে। মাথা হেঁট হয়ে এলো আপনাআপনি। চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইল, পারল না। স্বর্ণলতার কাছে বাঁ’ধা পড়ে গেছে। সে নিচু স্বরে বলল,
” মা, ছাড়ো। ”
তিনি ছাড়লেন না। আরও শক্ত করে হাতটা চেপে ধরে বললেন,
” না। ”
সে করুণ স্বরে বলল,
” এই বিয়ে আমি করতে পারব না। ”
” তাহলে এখানে এসেছিস কেন? ”
” সয়তানের প্ররোচনায় পড়েছিলাম। এখন মুক্ত হতে চাচ্ছি। ছাড়ো। ”
” বিয়ে সয়তানের ইচ্ছে হয় না। আল্লাহর ইচ্ছে হয়। পৃথিবীতে এর মতো পবিত্র নেয়ামত আর কিছু নেই। ”
সঞ্জয়ানের মন গলছে না৷ সিন্ধান্ত থেকে টলছে না৷ মায়ের হাত ছাড়ানোর জন্য জোরাজুরি শুরু করল। স্বর্ণলতা জানেন ছেলের সাথে জোরের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না। হেরে যাবেন। তাই হাত সরিয়ে নিয়ে বললেন,
” ঐ মানুষটার দিকে তাকা। তার ধৈর্য্য সম্পর্কে নিশ্চয় তুই অবগত? শারীরিক ও মানসিক দুইভাবেই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ”
মায়ের ইশারা পেয়ে সঞ্জয়ান তাকাল শূভ্রার বাবার দিকে। স্বর্ণলতা বললেন,
” অরুণিমার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ঘটনাটা যত সহজে সামলে নিয়েছেন। তত সহজে কি শূভ্রার বেলায়ও পারবেন? পারবেন না। এক বা’ড়িতে পাথর না ভাঙলেও ফাটল ধরে। দ্বিতীয় বাড়িতে খুব সহজেই ভেঙে যায়। ”
সঞ্জয়ান প্রতিবাদ করল,
” অরুণিমার বিয়ে ভাঙার কারণ আমি নই, মা। সে নিজে। ”
” শূভ্রার বেলায় তো তুই ভাঙছিস। মেয়ের বাড়ি বিয়ে ভেঙে যাওয়া ব্যাপারটি কিন্তু আমাদের সমাজ ভালো চোখে দেখে না। সারাক্ষণ আঙুল তুলে, খোঁচাতে খোঁচাতে ঘা বানিয়ে ফেলে। ”
” এই বিয়েতে আমার মত নেই। তোমার মনে হচ্ছে না এটা অন্যায়? ”
” না। এই বিয়েটা একজন বাবাকে মৃ’ত্যু মুখ থেকে ফিরিয়ে আনবে। একটি পরিবারকে সুস্থভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। আমার মনে হয় না, এত বড় ভালো কাজটা অন্যায়ের তালিকায় পড়বে। ”
এত কিছুর পরও সঞ্জয়ানের মন শান্ত হয় না। বুকের অস্থিরতা থামে না। নিজের সিদ্ধান্তকে বদলাতে পারে না। সে বিনা বাঁ’ধায় দাঁড়িয়ে পড়ল। অসীউল্লাহ বিপদ অনুমান করে ফেললেন বোধ হয়। চেয়ার থেকে উঠে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
” কী হয়েছে, স্যার? বসতে অসুবিধা হচ্ছে? ”
সঞ্জয়ান নিজের সিদ্ধান্তটা জানানোর পূর্বে অরুণিমার দিকে তাকাল। ঠিক তখনই নজরে এলো শূভ্রাকে। সে বধূ সাজে অরুণিমার পেছনে দাঁড়িয়ে উঁকি মারছে এদিকে। সঞ্জয়ানের সাথে চোখাচোখি হতে সে হাত উঁচিয়ে একটি লাঠি দেখাল। চোখ রা’ঙি’য়ে, ঠোঁট কা’ম’ড়ে কিছু একটা বিড়বিড় করছে আর মুখ বাঁকিয়ে ইশারা করছে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে। এই সময় তার এই উদ্ধতস্বভাব ও বেয়াদবি আচরণটা সহ্য করতে পারল না। তার মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক পাখার মতো ঘুরতে লাগল একটি কথায়, এই মেয়েকে শায়েস্তা করতে হবে। যেভাবেই হোক, বেয়াদবি ছুটাতে হবে। সে অসীউল্লাহর দিকে চেয়ে বলল,
” না। রাত হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ হলে ভালো হয়। ”
তিনি দাঁড়ানো অবস্থায় কাজীকে বিয়ে পড়ানোর অনুমতি দিলেন। মায়ের আদেশমতো অরুণিমা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ছোট বোনের বিবাহ কার্য সম্পন্ন হলো। বিদায়ের সময় সকলের অগোচরে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ল দ্রুতপায়ে।
চলবে