আঙুলে আঙুল
পর্ব (২২)
বর্তমান,
মাইমূনকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে বাবার রুমে ঢুকে অরুণিমা। অসীউল্লাহর সঙ্গে তার স্ত্রী ও ছোট মেয়ে আছে। সে কারও দিকে তাকাল না। সোজা গিয়ে পড়ল বাবার পায়ের উপর। দুই হাতে পা’দুটি সযতনে আগলে ধরে অশ্রু ঝরাচ্ছে আর ক্ষ’মা চাচ্ছে। তিনি পা টেনে নিলেন। মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে বললেন,
” আমার চোখের সামনে থেকে যা। ”
” ক্ষ’মা করে দেও। চলে যাব। ”
” ক্ষমা পেতে হলে সঞ্জয়ানকে বিয়ে করতে হবে। করবি? ”
অরুণিমা জলে ভরা নয়ন দু’খানা নিয়ে বাবার দিকে তাকাল। দৃষ্টি মিলেছে। বাবার দৃষ্টি নিজের দিকে ফিরিয়ে এনেও খুশি হতে পারছে না। জন্মের পর বাবার এই চোখজোড়ার মধ্যে যে অপরীসীম স্নেহ দেখেছে, ভালোবাসার সন্ধান পেয়েছে তা আর নেই। রয়েছে শুধু রা’গ আর ঘৃ’ণা। এক পলকে এতটা পরিবর্তন! সে আশাহত স্বরে সুধাল,
” এত কিছুর পরও তুমি এটাই চাচ্ছ? ”
” হ্যাঁ, চাচ্ছি। তোকে দূরে সরিয়ে দিলেও বাবার দায়িত্ব থেকে সরে যেতে পারি না। বাবা হিসেবে সন্তানের সর্বোচ্চ কল্যাণ চাওয়াটাই আমার সর্বপ্রথম দায়িত্ব। ”
অরুণিমা দৃষ্টি নিচু করে ক্ষীণ স্বরে বলল,
” মাইমূনকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না। ”
গলার স্বরে একটু জোর ঢেলে পুনরায় বলল,
” আমার জীবনে মাইমূন না থাকলেও আমি সঞ্জয়ান স্যারকে বিয়ে করতাম না। তাকে আমি সম্মানের যে স্থানে বসিয়েছি, সেখানে স্বামী হিসেবে কল্পনা করাও গুনাহ। ”
অসীউল্লাহ চ’টে গেলেন। বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। উত্তে’জিত স্বরে বললেন,
” একজন মেয়ের কাছে সম্মানের সর্বশ্রেষ্ঠ আসনটি তার স্বামীর জন্য নির্ধারিত থাকে। যেটা সঞ্জয়ান দখল করেছে। তুই নিজেই স্বীকারোক্তি দিয়েছিস। নেশাখোরের পাল্লায় পড়ে তোর জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। তাই পুণ্যকে গুনাহর নজরে দেখছিস। ”
অরুণিমা প্রতিবাদ করে ওঠল,
” মাইমূন নেশাখোর না, বাবা। তোমরা ও কে চিনো না, জানো না। তাই ভুল ভাবছ। ”
” আমি ভুল ভাবছি? নাকি তুই মিথ্যা দিয়ে সত্যিকে ঢাকতে চাচ্ছিস? ”
অরুণিমা বাবার নিকটে এগিয়ে গেল। শান্ত স্বরে জানাল, মাইমূন আগে নেশা করত এখন করে না। কেন ছেড়েছে, কিভাবে ছেড়েছে এগুলোও উল্লেখ করল। অসীউল্লাহর মন গলল না। বাঁকা হেসে বললেন,
” ও তোকে বলল, আর বিশ্বাস করে ফেললি? যাচাই করার প্রয়োজন মনে করলি না? ”
” করেছি, বাবা। আমি নিজে গিয়ে দেখেছি। ”
” ভুল দেখিয়েছে। মাইমূনকে তুই এখনও চিনে উঠতে পারিসনি। ”
বাবার কথার বিপরীতে কথা রাখতে চাইল সে। সুযোগ পেল না। তার পূর্বেই তিনি প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
” কাল রাত থেকে আজ বিকেল পর্যন্ত মিয়া ভাইয়ের সাথে কতবার যোগাযোগ হয়েছে? ”
” একবারও না। ”
” কেন? ”
অরুণিমাকে এই প্রশ্নটা ভাবিয়ে তুলল। মাইমূনের সাথে কথা-বার্তা এখনও স্বাভাবিক হয়নি তার। আগের মতোই যোগাযোগটা একদমই সীমিত পর্যায়ের। মাইমূনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর একবার ফোনে কথা হয়েছিল শুধু। এরপর তাদের দেখা হয়নি, ফোনে কথাও হয়নি। বাড়িতে ঝামেলা হচ্ছিল দেখে, সে নিজ থেকেও আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু আজ সকালে ঘুম থেকে উঠার পর অজানা শ’ঙ্কায় বার বার বুক কাঁ’পছিল। পাত্রের সামনে যেতে ভ’য় করছিল। তাই মাইমূনকে কল করে পুরো ব্যাপারটা জানিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু সম্ভব হয়নি, তার ফোন বন্ধ দেখাচ্ছিল। সঞ্জয়ানের পাশে বসার আগ পর্যন্ত কল করে যাচ্ছিল সে, শেষ বারেও বন্ধ দেখিয়েছে। সে সত্যটাই জানাল,
” ফোন বন্ধ ছিল। ”
অসীউল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে বললেন,
” কেন বন্ধ ছিল, জানিস? ”
অরুণিমা মাথা দু’পাশে নাড়লে তিনি মেয়ের হাত চেপে ধরলেন। বাইরে টেনে দাঁড় করালেন মাইমূনের মুখোমুখি। তারপরে জিজ্ঞেস করলেন,
” অরুণিমা জানতে চাচ্ছে, কাল রাত থেকে তোমার ফোন বন্ধ কেন? ”
মাইমূন তাকাল অরুণিমার দিকে। তার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিজোড়ায় চেয়ে বলল,
” পুলিশ আমার ফোন ছিনিয়ে নিয়েছিল। ”
অরুণিমার পক্ষ থেকে অসীউল্লাহ প্রশ্ন করলেন,
” ফোন ছিনিয়ে নিল কেন? ”
মাইমূন কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল প্রশ্ন কর্তার দিকে। তিনি ভ’য় পাওয়ার বদলে হেসে ফেললেন। কটাক্ষ করে বললেন,
” উত্তরটা আমিই দিচ্ছি। তোর মিয়াভাই কাল থানায় আটক ছিল। ”
অরুণিমা অবিশ্বাস্য দৃষ্টি রাখল বাবার দিকে। পর মুহূর্তে সরে এলো মাইমূনের দিকে। জিজ্ঞেস করল,
” বাবা সত্যি বলছে? ”
সে উত্তরে মাথা নত করে ফেলল। অসীউল্লাহ পাশ থেকে উস্কা’নীমূলক মন্তব্য ছুঁড়লেন,
” আ’ট’ক থাকার কারণটাও কি আমি বলব? ”
মাইমূন হ্যাঁ- না কিছুই বলল না। পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চুপ আছে। এই সুযোগটাকে হাত ছাড়া করলেন না অসীউল্লাহ। মেয়েকে জানালেন, সে কাল রাতে ম’দ্যপ অবস্থায় এক লোককে পি’টা’চ্ছিল। পুলিশের নজরে পড়ায় গ্রেফতার হয়েছে। ঘটনাটা শুনে অরুণিমা স্তম্ভিত হলো। চোখের কোণে নতুন করে অশ্রু জমা হলো। টলমল চোখ দুটি মাইমূনের নত মুখটায় নিবদ্ধ করে সুধাল,
” এসব সত্যি? ”
সে আগের মতো নীরব থাকলে অরুণিমা ভীষণ কষ্ট পেল। করুণ স্বরে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কেন করেছ এমনটা? তুমি তো সব ছেড়ে দিয়েছিলে? ”
এই পর্যায়ে মাইমূন কথা বলল,
” বলব। সব বলব। আমি প্রথম থেকে তোমার সামনে সত্য রূপে উপস্থিত হয়েছি। এখনও তাই হব। ভবিষ্যতেও। ”
” তাহলে বলো। ”
মাইমূন এক ঝলক সামনে তাকাল। অসীউল্লাহর পেছনে নাজিয়া বেগম ও শূভ্রা দাঁড়িয়ে আছে। দরজার আড়াল থেকে নিয়াজের আংশিক মুখটাও দেখা যাচ্ছে। সবার দিক থেকে চোখ বুলিয়ে এনে বলল,
” সবাইকে না, আমি শুধু তোমাকে বলতে চাই। তুমি কি একটু বাইরে আসবে, প্লিজ? ”
অরুণিমার মুখ দেখে সে বুঝে ফেলল, সে রাজি না। তাই পুনরায় বলল,
” তুমি আগে শোনো। যদি মনে হয়, সবাইকে বলা যায়, তাহলে আমি সবাইকে বলব। কথা দিচ্ছি। অরুণিমা, তুমি জানো আমি যেমন মিথ্যা বলি না তেমন কথার খেলাফও করি না। ”
অসীউল্লাহ মেয়ের কনুই চেপে ধরে বললেন,
” ও কোথাও যাবে না। তোমার কিছু বলার থাকলে এখানে বলো। নাহলে বিদায় হও। ”
অরুণিমা একবার বাবার দিকে তাকাল। পরক্ষণে চাহনি ফিরিয়ে আনল মাইমূনের মুখটায়। কোনো শব্দ ব্যয় না করে চোখের ইশারায় বুঝাল, ‘ যাও। আমি পরে আসছি। ‘
____________
সঞ্জয়ান বাবা-মাকে নিয়ে তার শহরের ফ্ল্যাটটিতে ওঠেছে। একদিন কেটে যাওয়ার পরও যখন অরুণিমাদের বাড়ি থেকে আর কোনো খোঁজ-খবর আসেনি তখন বাধ্য হয়ে বলল,
” মা, তোমাদের এখানে থেকে কষ্ট করা দরকার নেই। বাড়িতে ফিরে যাও। ”
স্বর্ণলতার পূর্বে মুনসুর সাখাওয়াত ধমকে ওঠলেন,
” বাড়ি যাব মানে? ছেলের বউকে ছাড়াই বাড়ি ফিরে যাব? অসম্ভব! ”
স্বণলতা জবাব দিলেন,
” ছেলের বউকে ছাড়াই যেতে হবে। দেখলেনই তো বিয়েটা ভেঙে গেছে। ”
” ভাঙবেই। হাল চাষার বয়সে বউয়ের জন্য পাগল হলে, বিয়ে ভাঙবেই। ”
সঞ্জয়ান অপমানিত হলো। লজ্জায় চিবুক নামিয়ে নিল। স্বর্ণলতা তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে স্বামীকে বললেন,
” ছেলেটা এমনি কষ্টে আছে, আপনি কষ্ট কমানোর বদলে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। ”
তিনি স্ত্রীর কথার প্রেক্ষিতে কিছু বললেন না। সোফা ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠলেন। ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
” মুখ কালো করে লাভ নেই। তোর বউকে না নিয়ে এ বাড়ি থেকে আমি নড়ছি না। ”
স্বর্ণলতা পেছন থেকে বললেন,
” আপনার জন্য কি ও এখন যাকে-তাকে বিয়ে করে নিবে? ”
তিনি ঘাড় বাঁকিয়ে উত্তর করলেন,
” যাকে-তাকে করবে কেন? আমার পছন্দকে করবে। ”
” আপনি আবার কাকে পছন্দ করে রেখেছেন? ”
তার উত্তরের অপেক্ষা করল না সঞ্জয়ান। জানিয়ে দিল,
” মা, বাবাকে বলে দাও, আমি অরুণিমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না। ”
মুনসুর সাখাওয়াত হেরে যাওয়ার লোক নন। মুক্ত স্বরে নিজের সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দিলেন,
” তাহলে বিয়ে ছাড়াই তোর বউকে নিয়ে যাব। ”
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আদেশের সুরে বললেন,
” তৈরি হয়ে নাও। বাড়ির বউকে বরণ করতে হবে। ”
চলবে