আঙুলে আঙুল
পর্ব (১৭)
শূভ্রা সিগারেট খায়! এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটাও বিশ্বাস করতে হচ্ছে অরুণিমাকে। প্রথমত, সঞ্জয়ান মিথ্যা অভিযোগ করার মতো মানুষ নয়। দ্বিতীয়ত, শূভ্রার সম্মুখেই অভি যোগ এসেছে সে প্র তিবাদ করেনি। উল্টো পালিয়ে গিয়েছে। ব্যাপারটি অরুণিমাকে লজ্জিত করেছে, কষ্টও দিয়েছে। সঞ্জয়ানের সাথে চোখ মিলিয়ে কথা পর্যন্ত বলতে পারেনি। যত বার সামনে পড়েছে ততবার চোখ নামিয়ে নিয়েছে। ব্যস্ততা দেখিয়ে সরে গিয়েছে। যেন, অপ রাধটি শূভ্রা নয় সে করেছে!
কলেজ ছুটির সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্টিনও বন্ধ করা হয়। অরুণিমা নিজের কাজ শেষ করে বাইরে বেরুতে দেখে তার বাবা দাঁড়িয়ে আছে। সাথে শূভ্রাও। সে কয়েক মুহূর্ত বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের কোনো বিষয়ে বাবার কাছে কখনও অনুরোধ করেনি, জোরাজুরি করেনি। এই বোনের জন্য শতবার করেছে। আজ কলেজে আসতে পেরেছে তারই জন্য। কাল রাত থেকে বাবার পেছন পেছন ঘুরে, নানানভাবে মিনতি করেছে, শূভ্রার পড়ালেখাটা চালু রাখার জন্য। প্রয়োজনে সে দায়িত্ব নেবে। তিনি ঠিকভাবে মত না দিলেও আজ কলেজে আসার অনুমতি দিয়েছিলেন। অরুণিমা বাবার নিকটে এসে দৃঢ় স্বরে বলল,
” শূভ্রার ক্লাস করার দরকার নেই। শুধু পরীক্ষা দিবে। ”
তার এই অভিমতের পেছনে লুকানো আছে আকাশ মাপের অভিমান ও রাগ। যা বাবা ও বোন কেউই টের পেল না।
_______
অরুণিমার দোকানদার চাচার মান সিক অবস্থা ভালো নেই। তার দোকান ফাঁকা। বাইরে বেরিয়েও ক্রেতা আনতে পারছেন না। বেচা-কেনা শূণ্যের পথে। ব্যবসা ক্ষ তির সাগরের উপর ভাসছে। এরকম চললে দোকান বন্ধ করে দিতে হবে। অথচ এক মাস পূর্বেও সবকিছু ঠিক ছিল। রমরমা ব্যবসা চলছিল। এর একমাত্র কারণ, অরুণিমা। স্বল্প বেতনে তার মতো কর্মঠ, নিষ্ঠাবান কর্মচারী পেয়েছিল ভাগ্য গুণে। তন্মধ্যে মিয়া ভাইয়ের আগমনে আরও উন্নতি হয়েছিল। অরুণিমার বেতনের দায়িত্ব সে নিয়েছিল। সেই হিসেবে অরুণিমা হয়েছিল তার বিনা বেতনের কর্মচারী। এই সৌভাগ্য বেশিদিন টিকল না! হঠাৎ করে মেয়েটা চাকরি ছেড়ে দিল। চাচা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, অরুণিমা অন্য চাকরি করছে। খাটুনি কম, বেতন বেশি। এমন চাকরি ফেলে কি সে আসবে? যদিও তিনি একবার বেতন আরও বাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাতেও মেয়েটা রাজি হয়নি। শেষে বাধ্য হয়ে মিয়া ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করেছিল। সে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলেছিল, ‘ ওর যেখানে ভালো লাগবে সেখানে চাকরি করবে। ‘ ফিরিয়ে দেওয়ার সময় শাসানির সুরে বলেছিল, ‘ অরুণিমাকে বির ক্ত করবেন না। তাহলে ভালো হবে না। ‘ দোকানদার চাচা বিরস মুখে ক্রেতা খুঁজছিলেন তখনই নজরে এলো, অসীউল্লাহকে। অসুস্থ অবস্থায় একবার চোখের দেখা দেখতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই চিনে ফেলেছেন। হাত উঁচিয়ে ডাকলেন,
” ভাই সাহেব যে! ভালো আছেন? ”
অসীউল্লাহ স ন্দেহ চোখে তাকালেন। দ্বিধা নিয়ে উত্তর করলেন,
” জি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনাকে চিনতে পারছি না। ”
চাচা একগাল হাসলেন। দোকানটা দেখিয়ে বললেন,
” এই দোকানটা আমার। আপনার মেয়ে, আগে আমার এখানেই কাজ করত। ”
অসীউল্লাহ জানতেন, অরুণিমা এই মলে চাকরি করে। কিন্তু স্বচক্ষে দেখা হয়নি কখনও। তাই সহজে মেনে নিলেন। দ্বিধা দূর করে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
” আপনি ভালো আছেন? ”
প্রত্যুত্তর করতে করতে অসীউল্লাহকে ভেতরে ডেকে নিলেন। টুলে বসতে দিয়ে চা-বিস্কুটের ব্যবস্থাও করলেন। আপ্যায়নের ফাঁকে গল্পের নাম করে মাইমূনকে টেনে আনলেন। অরুণিমা ও মাইমূনের বিয়েটা হতে হতেও ভেঙে গেল কী করে সেটাও খুব সুন্দর করে গুছিয়ে বললেন। অসীউল্লাহ এসেছিলেন, ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে। পাঁচ বছর যাবত একটি বেসরকারি ব্যাংকে অল্প পরিমানে টাকা জমাচ্ছেন। আগে মূল ভবনে গিয়েই জমা করেছেন। এই বছরই এই মলের চার তলাতে একটি শাখা খুলেছে। সেটি খুঁজে বের করে একটু আলাপ-আলোচনা করবেন ঠিক করেছেন। কথা-বার্তা ভালো লাগলে, পরবর্তীতে এখানে এসেই টাকা জমা রাখবেন। সময় ও টাকা নষ্ট করে মূল ভবনে যাবেন না। দোকানদার চাচার কথা শুনে ভড়কে গেছেন। বুকের একপাশে ক্ষীণ ব্যথাও শুরু হয়েছে। বসে গল্প করার মতো সাহস হচ্ছে না। চটজলদি বিদায় নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলেন। ব্যাংকের কাজটাও বাকি পড়ে গেল।
___________
শূভ্রার পড়ার টেবিলটায় একটা ছবির ফ্রেম আছে। যার মধ্যে সে ও অরুণিমা বন্দি। দুজনেই হাসছে। সুখী সুখী ভাব। শূভ্রা ফ্রেমটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখল। দেখতে দেখতে তার চোখদুটো অশ্রুতে টলমল হলো। আপনমনে বিড়বিড় করল, ‘ সাজনা শাক ঠিকই বলেছে, তোমার সাথে আমার কোনো মিল নেই। তুমি আমার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সুন্দরী। শুধু লম্বায় না সবদিক দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে গেছ। এজন্যই সবাই তোমাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে। ‘
” কেঁদে লাভ নেই। তোর শাস্তি এমনই হওয়া উচিত। আজ সিগারেট খাচ্ছিস, কাল মদ খাবি। ”
অরুণিমার গলা পেয়ে শূভ্রা ছবির ফ্রেমটা রেখে দিল তড়িঘড়িতে। চোখের পানি মুছল না। দুই চোখ থেকে সমান তালে অশ্রু ঝরিয়ে বলল,
” তাই খাব। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকব। তারপর সকলে বলবে, অরুণিমার বোন মদ খায়। ছি! ”
বোনের মুখে এমন উত্তর পেয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। হতভম্ব দৃষ্টি রেখে সুধাল,
” আমাকে বদনাম করার জন্য মদ খাবি? ”
” হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। সবসময় তো প্রশংসা শোন। এবার নিন্দা শুনবে। ”
অরুণিমা কথা হারিয়ে ফেলল। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বোনের দিকে। তাকে বদনাম করার জন্য শূভ্রা মদ খাবে। এত রাগ! এত হিংসে! এই সময় অসীউল্লাহর আগমন ঘটল। শূভ্রার দিকে চেয়ে বললেন,
” একটু বাইরে যা। অরুণিমার সাথে আমার কথা আছে। ”
শূভ্রা মুখ বাঁকিয়ে চলে যেতেই তিনি বড় মেয়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
” মাইমূন কে? তার সাথে তোর কী সম্পর্ক? ”
বাবার কণ্ঠে মিয়া ভাইয়ের নাম শুনে অরুণিমার পিল চমকে ওঠে। হৃৎস্পন্দনের গতি তীব্র হয়। ভয় দেখা দেয় চোখে ও মুখে। হাত-পা ক্রমশ ঠাণ্ডা হতে শুরু করেছে। প্রশ্ন দুটো করে অসীউল্লাহ পায়ে পায়ে মেয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। অরুণিমার দৃষ্টি বাবার পায়ের দিকেই নিবদ্ধ। যত এগিয়ে আসছেন ততই তার নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে এমন অনুভূতি হচ্ছে। একদম নিকটে চলে আসলে অকস্মাৎ অবিশ্রামে বলল,
” কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্বাস করো, বাবা। তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ”
অসীউল্লাহ মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। মৃদু হেসে নরম স্বরে বললেন,
” বিশ্বাস করেছি। আমি জানি, আমাকে না জানিয়ে তুই কোনো সম্পর্কে জড়াতে পারিস না। ”
বাবার নিকট থেকে আস্থা পূর্ণ অভিব্যক্তি পেয়ে অরুণিমার ভয় কমল খানিকটা। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হচ্ছে ধীরে ধীরে। অসীউল্লাহ একটু সময় নীরব থেকে সুধালেন,
” এমন ভয়ংকর ঘটনাটা আমার থেকে লুকালি কেন, মা? যদি খারাপ কিছু ঘটত? ”
অরুণিমা বলতে চাইল, ‘ মিয়া ভাই খারাপ কিছু ঘটানোর মতো মানুষ নয়, বাবা। একটু উগ্র, বেপরোয়া কিন্তু বিবেকহীন নয়।’ বলতে পারল না। মনে চেপে রেখে সামনাসামনি বলল,
” তুমি দুশ্চিন্তা করতে তাই বলিনি। ”
অসীউল্লাহ মুগ্ধ হলেন। পরম স্নেহে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
” আমার বাবা ভাগ্য খুব ভালো। সেজন্যই আল্লাহ তোর মতো একটা মেয়ে উপহার দিয়েছেন। ”
__________
” চাচা, কোনো সমস্যা? আপনার মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন? ”
ক্যান্টিন খোলার পর থেকে সঞ্জয়ান প্রায় প্রতিদিনই কলেজে আসছে। ঘণ্টা দুয়েক ভেতরে বসছে। খাবার-দাবার পর্যবেক্ষণও করছে। সেই ফাঁকে অরুণিমার পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কেও জানছে। সবশেষে একবার অসীউল্লাহর সাথে দেখা করে স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেয়। আজও এই কাজটা করতে এসে দেখে, তিনি কিছু নিয়ে চিন্তায় মগ্ন। কৌতূহলবশত প্রশ্নটা করে।
” না, স্যার। তেমন কিছু নয়। ”
” প্রেশার ঠিকঠাক? ”
” জি। ”
সঞ্জয়ান আর কথা বাড়াল না। তিন দিন ধরে সে ঢাকায় আছে। আজ বাড়ি যাওয়ার মনস্থির করেছে। তাই একটু বেরিয়ে যাওয়ার তাড়া। অসীউল্লাহ বড় মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করছিলেন। যদিও সে বলেছে, মিয়া ভাই তাকে এখন বিরক্ত করে না। যোগাযোগ নেই। তবুও তিনি শান্তি পাচ্ছেন না। একেবারে ভুলে যেতে পারছেন না। মনের কোথাও একটা শঙ্কার বীজ বুনে ফেলেছেন। এটা থেকে মুক্তির পথই খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু পাচ্ছেন না। যত ভাবছেন ততই যেন অসহায় হয়ে পড়ছেন! সঞ্জয়ান চলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হতে তিনি ডেকে ওঠলেন। সে থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” কিছু বলবেন, চাচা? ”
অসীউল্লাহর মনের ভেতর চেপে রাখা অসহায়ত্বটা এবার দুই চোখে প্রকাশ পেল। তার হঠাৎ করেই মনে হলো, এই মানুষটাই পারবে তাকে মুক্তির পথ বলে দিতে।
” হ্যাঁ। ”
সঞ্জয়ান মনোযোগী হয়ে বলল,
” বলুন। ”
” কথাটা অরুণিমাকে নিয়ে। যদি একটু সময় দিতেন! ”
তার কণ্ঠস্বরে অনুরোধ, প্রার্থনা। সঞ্জয়ান অধিক আগ্রহ নিয়ে বলল,
” সময় নিয়ে ভাববেন না। কী হয়েছে, আপনি নির্দ্বিধায় বলুন। ”
অসীউল্লাহ একটু সাহস পেলেন। ধীরে-সুস্থে মাইমূনের বখাটেপনা ফাঁস করলেন। এর থেকে মুক্তির পরামর্শ চাইলে সঞ্জয়ান বলল,
” আমি আইনি ব্যবস্থা করতে পারব। কিন্ত আমার মনে হচ্ছে, বেশিদিন জেলে আটকে রাখা যাবে না। এই ধরনের ছেলেগুলো শোধরানোর পরিবর্তে আরও বেশি উগ্র হয়ে যায়। মিয়া ভাইয়ের ক্ষেত্রেও যদি তেমনটাই হয়, তাহলে অরুণিমার জন্য বিপদ হবে। ”
অসীউল্লাহ আগের চেয়েও অধিক ঘাবড়ে গেলেন। সভয়ে সুধালেন,
” তাহলে উপায়? ”
চলবে
[ আমার লেখা সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা করতে পারবেন আমার ব্যক্তিগত গ্রুপে। লিংক কমেন্টবক্সে ]