আঙুলে আঙুল
পর্ব (১৫)
অরুণিমা হাসপাতালে পৌঁছাতে তার বাবা ব্যস্ত পায়ে একটি রুমে নিয়ে এলো। সে ভেবেছিল, এখানে রোগী থাকবে। রোগী নেই, একজন নার্স আছে৷ অসীউল্লাহকে দেখতে পেয়ে নার্স জিজ্ঞেস করল,
” রক্ত যোগাড় হয়েছে? ”
” হ্যাঁ, আমার মেয়ে দিবে। ওর রক্তের রুপ ও পজেটিভ। ”
অরুণিমা অবাক হলো। হতভম্ব দৃষ্টিতে বাবার দিকে চেয়ে আছে। তিনি আঁচ করতে পেরে অসহায় ভঙ্গিতে বললেন,
” রাগ করিস না, মা। আর কোনো উপায় নেই৷ ”
নার্স রক্ত নেওয়ার জন্য অরুণিমার শরীরে সুই প্রবেশ করল। সে ব্যথায় চোখ বন্ধ করে নিল। সেকেন্ড পেরুতেই ব্যথার ছাপ উবে গেল মুখমন্ডল থেকে। ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে মনে মনে বলল, ‘ কিছুক্ষণ আগেও যার জন্য বিরক্ত হচ্ছিলে, রাগ দেখাচ্ছিলে তাকে সুস্থ করার জন্যই মেয়ের শরীর থেকে রক্ত দিয়ে দিচ্ছ। একটুও ভয় পাচ্ছ না। অথচ কিছুদিন আগেও ব্লেডে কেটে এক ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ায় সে কি অস্থিরতা দেখিয়েছিলে! ভালো মানুষরা বুঝি এমনই হয়? ‘
রক্ত দেওয়ার সময়টুকুতে অসীউল্লাহকে দৃষ্টি সীমার মধ্যে পাওয়া গেল না। নার্স চলে যেতেই হাওয়ার মতো ছুটে এলেন। মেয়েকে পাশ থেকে এক হাতে জড়িয়ে বললেন,
” চল, বাসায় যাই। ”
” তোমার রোগী সুস্থ হয়ে গেছে? ”
” জানি না। কিন্তু সুস্থ হওয়ার জন্য যা যা দরকার সব ব্যবস্থা করেছি। ”
অরুণিমা বাবার স্নেহ ডোরে থেকেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো। করিডোর পেরুতে পেরুতে ভাবছে, যাকে নিজের রক্ত দান করল তাকে এক নজর দেখবে না? ইচ্ছাটা গোপন রাখল না। উড়িয়েও দিল না। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে বাবাকে বলল,
” রোগীর কি জ্ঞান ফিরেছে, বাবা? ”
তিনি মনখারাপের সুরে উত্তর করলেন,
” না। ”
” উনার পরিবারকে খরব দিয়েছ? ”
” কীভাবে দিব? কাউকে চিনি না তো। ”
অরুণিমা ঘড়ি দেখার বাহানায় মোবাইলটা বের করল। তারপরে বলল,
” খুব বেশি রাত হয়নি। জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করি? পরিবারের কেউ নেই। যদি ভালো-মন্দ কিছু হয়ে যায়, আমাদের উপরই তো দোষ আসবে। ”
মেয়ের প্রস্তাবে অসীউল্লাহ খুশি হলেন না। আবার ফেলতেও পারছেন না। অরুণিমা ভুল কিছু বলছে না। দুর্ঘটনা তার রিকশার সামনেই ঘটেছে। সে মানবতা দেখাতে গিয়ে আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনলেও রিকশাওয়ালাকে ধরে রাখতে পারেনি। তাকে না জানিয়ে সুযোগ পেয়ে পালিয়েছে। ইচ্ছা না থাকলেও বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়ে রোগীর রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে ডাক্তার আছে, সম্ভবত চিকিৎসা চলছে। অসীউল্লাহ অপেক্ষা করতে করতে ঝিমাতে শুরু করলেন। অরুণিমা এই সুযোগে দরজার নিকটে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতরে একটা ঢুঁ মারার ফন্দি। দূর থেকে নার্স ও একজন ছেলে ডাক্তারকে দেখা যাচ্ছে। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকায় অজ্ঞান লোকটির অর্ধেক শরীর আড়ালে ঢাকা পড়েছে৷ কোমর থেকে পা অবধি দেখা যাচ্ছে শুধু। সে সরে যাওয়ার জন্য দৃষ্টি সরিয়ে নিবে তখনই ডাক্তার ঘুরে দাঁড়াল দরজার দিকে। অরুণিমার চঞ্চল দৃষ্টিজোড়া অজান্তেই আটকে গেল আড়াল মুক্ত হওয়া মুখটায়। নিষ্পলক চোখে ঠোঁট কাঁপিয়ে উচ্চারণ করল, ‘ মিয়া ভাই! ‘
” আপনার পরিচিত? ”
অপরিচিত পুরুষ গলা পেয়ে অরুণিমা ছিটকে ওঠল। অচৈতন্য ভাব মুছে গেল সঙ্গে সঙ্গে। অপ্রস্তুত হয়ে সুধাল,
” জি? ”
ডাক্তার খানিক বিরক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” রোগী আপনার কে হয়? আপনি কি উনার বাড়ির লোক? ”
প্রশ্নটা শুনে অরুণিমার দেহখানা পাথরের মতো হয়ে এলো। মস্তিষ্কে প্রচণ্ড চাপও পড়ছে। উত্তরটা ঠিক কী হলে ডাক্তার ও সে দুজনেই খুশি হবে সেটাই ভাবছে। তার এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিল অসীউল্লাহ। এদিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
” জি। আমরা উনার বাড়ির লোক। ”
কাছে পৌঁছে উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন,
” ওর কি জ্ঞান ফিরেছে? সুস্থ হয়ে যাবে তো? ”
” না, এখনও জ্ঞান ফিরেনি। ফেরার সময় হয়েছে। ”
অসীউল্লাহর চিন্তা একটু কমল বুঝি। মুখে হাসি হাসি ভাবটা দৃশ্যায়িত হতে ডাক্তার বলল,
” আপনাদের সাথে জরুরি কথা আছে। চেম্বারে আসুন। ”
অরুণিমা খেয়াল করল, তার বাবার ঘর্মাক্ত মুখটা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তাই বলল,
” তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি শুনে আসি, ডাক্তার কী বলে। ”
ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে একটু স্বস্থি বোধ করল সে। এক্সিডেন্টের জন্য মাইমূনের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু স্বস্থি বোধটা বেশিক্ষণ টিকল না। কারণ, আপাতদৃষ্টিতে মাইমূনকে যতটা সুস্থ দেখা যায়, সে ততটা সুস্থ নয়। অতিরিক্ত ধূমপান ও মদ্যপানের ফলে তার ভেতরের অধিকাংশ যন্ত্রাংশ নষ্টের পথে। এই মুহূর্তে এসব থেকে দূরে সরতে না পারলে প্রাণহানিও ঘটতে পারে। এই অবস্থায় এই ছেলে কয়েক ঘণ্টা পূর্বে কাউকে রক্ত দান করে এসেছে। জ্ঞান হারানোর মূল কারণই ছিল রক্তস্বল্পতা ও দৈহিক দুর্বলতা। অরুণিমা হালকা দৃষ্টিতে মলিন মুখে ডাক্তারের বলা কথাগুলো শুনছিল। সহসা প্রশ্ন করলেন,
” পেশেন্টের শরীরের কন্ডিশন দেখে ভেবে নিয়েছিলাম, সে একা। পরিবার বলতে কিছু নেই। তাই এই অবস্থা। এখন তো দেখছি, পরিবার আছে। আপন মানুষ আছে৷ তারপরও এই অবস্থা হলো কী করে? খোঁজ-খবর রাখেন না নাকি🫣? ”
সে উত্তর দিতে পারল না। চাহনি টেবিলের উপর ফেলে মাথা নত করে ফেলল। এরমধ্যে নার্স এসে জানিয়ে গেল, রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার তড়িঘড়িতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
” যত দ্রুত সম্ভব আপনার স্বামীকে খারাপ অভ্যাস থেকে ফিরিয়ে আনুন। নাহলে মৃত্যু অনিবার্য। ”
ডাক্তারের পিছু পিছু অরুণিমাও বেরিয়ে এলো। অসীউল্লাহ একটু দূরেই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। অরুণিমা তার কাছে হেঁটে গিয়ে বলল,
” বাড়ি চলো, বাবা। অনেক রাত হয়েছে। ”
” ডাক্তার কী বলেছে? ”
বাবার প্রশ্নের উত্তর দিল না। বড় বড় কদম ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। অসীউল্লাহও মেয়েকে অনুসরণ করে নিচে নামছেন। তার শরীরটাও খুব একটা ভালো লাগছে না। ভীষণ ক্লান্ত অনুভব করছে। বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচে। বাবা-মেয়ে একদম নিচে নেমে এসেছে। সামনেই হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার মূল দরজা। সেদিকে পা এগিয়ে নিতে আচমকা অরুণিমার কানে পৌঁছাল একটা পরিচিত কণ্ঠ,
” মিয়া ভাইকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে? কোন ফ্লোরে? রুম নাম্বার কত? ”
সে ডানপাশে ঘাড় বাঁকাতে পরিচিত মুখটা দেখতে পেল। মাইমূনের খোঁজ পেয়েছিল, এই ছেলেটির কাছ থেকেই। নামটা এখন মনে পড়ছে না। কিন্তু চেহারা ঠিক চিনেছে। মিয়া ভাইয়ের জন্য তার অস্থিরতা ও উগ্র ভাবটা চোখে পড়ছে। সে রিসিপশন থেকে মিয়া ভাইয়ের খোঁজ করলেও তারা দিতে পারছে না। এতে যেন সে আরও বেশি উগ্র হয়ে যাচ্ছে। আক্রমণাত্মক হয়ে যাচ্ছে। অরুণিমা বুঝতে পেরে দূর থেকে বলল,
” মিয়া ভাই তৃতীয় তলায়। রুম নাম্বার তিনশ দুই। ”
ছেলেটি ঝটিতে পেছনে তাকাল। চাহনি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। খোঁজ পেয়ে দৌড়ে চলে গেল সিঁড়ি মুখে। অরুণিমা সাহায্যের কাজ শেষ করে পুনরায় বেরিয়ে যাওয়ার উদযোগ শুরু করে। তখনই প্রশ্নবাণে জর্জরিত হলো,
” মিয়া ভাই কে? ”
অরুণিমা ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। অসীউল্লাহ পুনরায় বললেন,
” তিনশ দুইয়ে তো ঐ মাতালটা শুয়ে আছে। ওর নাম মিয়া ভাই? ”
অরুণিমা মুখে উত্তর করার সাহস পেল না। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝাতে পরের প্রশ্নটি তীরের মতো ছুটে এলো,
” তুই জানলি কিভাবে? মিয়া ভাইকে চিনিস? ”
অরুণিমা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দ্রুত কদমে সামনে এগুতে এগুতে হালকা স্বরে জবাব দিল,
” তেমন পরিচয় নেই। আমাদের এলাকায় থাকে। শুনে শুনে চিনেছি। ”
” তাই নাকি! আমি তো দেখিনি কখনও। আজই প্রথম দেখলাম। ”
___________
বাসায় ঢুকে মাইমূনকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে অরুণিমা। পারেনি। অন্য সময় যেমন-তেমন, ক্লাবের সামনে আসলেই তার বুকের ভেতর অস্থিরতা শুরু হয়। মায়া কাজ করে। ইচ্ছে হয়, একবার খোঁজ নিয়ে জানে, মানুষটা এখন কেমন আছে। ডাক্তারের কথাগুলোও মনে পড়ে। মনের ভেতর জ্বালা ধরে, মস্তিষ্ক ঝিম ধরে যায়। তাকে পরিবারের লোক ভেবে যে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিয়েছিল, সেটা মাইমূনের পরিবারের কারও কাছে পৌঁছে দেওয়ার তীব্র বাসনা তৈরি হয়। কিন্তু সে তো মাইমূনকে ছাড়া কাউকে চিনে না!
দুপুরবেলা। মল থেকে বাড়ির দিকে আসছে। সহসা নজরে পড়ল সেই ছেলেটিকে, যাকে হাসপাতালে দেখেছিল। ফোনে কারও সাথে কথা বলছে। অরুণিমার মনে হলো, এই ছেলে মাইমূনের পরিবারকে চিনবে। তাই ডাক দিল,
” এই ছেলে? ”
ছেলেটিও বোধ হয় অরুণিমাকে চিনে ফেলেছে। তাৎক্ষনাৎ মোবাইল পকেটে ভরে তার কাছে ছুটে গেল। মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে বলল,
” আমাকে ডাকতে এত দেরি করলেন কেন, ভাবি? আপনার ডাকের অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন। ”
অরুণিমার ভ্রূ কুঁচকে এলো। জিজ্ঞেস করল,
” তুমি জানতে আমি ডাকব? ”
” আমি না, মিয়া ভাই জানত। ”
মিয়া ভাইকে নিয়ে কোনো কথা উঠাতে চায়নি সে। শুধু তার বাসার ঠিকানা জানতে চেয়েছিল। উঠেই যখন গেল তখন এড়িয়ে যেতে পারল না। পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
” কিভাবে? ”
” এটা তো আমি জানি না। মিয়া ভাই বলতে পারবে। ”
উত্তর দিতে দিতে ছেলেটি পকেট থেকে ভাঁজ করা একটি কাগজ বের করল। অরুণিমার হাতে দিয়ে বলল,
” এটা আপনার জন্য। ”
অরুণিমা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে সে পুনরায় বলল,
” মিয়া ভাই দিয়েছে। বলেছিল, আপনি যেদিন আমাকে ডাকবেন, সেদিনই যেন দিই। ”
চলবে
[ মনে হচ্ছে আশপাশের চরিত্রের নাম গুলিয়ে ফেলছি। কারও চোখে পড়লে ধরিয়ে দিবেন। অগ্রিম ধন্যবাদ। ]