আঙুলে আঙুল পর্ব ৮

0
515

আঙুলে আঙুল

পর্ব (৮)

সঞ্জয়ান ঢাকা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করেছে দুই বছর হতে চলল। এর মধ্যেই বাবার কৃষি-পণ্য ব্যবসায়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, পালনও করছে। চাল থেকে শুরু করে লেবু পর্যন্ত পাঠাচ্ছে সারা বাংলাদেশে। এই কাজের সূত্রে প্রায়শই শহরে যেতে হয়, থাকতেও হয়। রাত্রীযাপনের জন্য বাবার পক্ষ থেকে দুই কামড়ার বিশাল প্লটও উপহার পেয়েছে। আসবাবপত্র সুসজ্জিত সেই বাসায় কদাচিৎ থাকা হয়; সেটাও বেকায়দায় পড়লে। অন্যথা কাজ শেষ করে ছুটে চলে যায় পিতৃভিটা ‘ ছায়া নীড় ‘ এ। পিতা ও মাতার স্নেহছায়া আকণ্ঠ ডুবে থাকে পরম নিশ্চিন্তে। সুখ, শান্তি, নির্ভরতা সবটায় একই সাথে অনুভব করা যায় এখানটায়। সঞ্জয়ান ছায়ানীড়ে পৌঁছায় প্রায় শেষ রাতে। জননী দরজা মেলে হাসিমুখে বললেন,
” হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসে যা একেবারে। তোর বাবা অপেক্ষা করছে। ”

সঞ্জয়ান গায়ের কোটটা খুলতে খুলতে বলল,
” বাবা খায়নি? ”
” তুই আসবি শুনলে একা একা খেয়েছে কখনও? ”

সে তাৎক্ষনাৎ ঘড়ি দেখল। তিনটা পার হয়েছে। বিস্ময় প্রকাশ করার সুযোগ পেল না। তার আগেই বাবার গলা পাওয়া গেল,
” আদুরী? তোমার ছেলে কি ফিরল? ”

সঞ্জয়ানের মায়ের নাম স্বর্ণলতা। তার বাবা মুনছুর সাখাওয়াত ভালোবেসে ডাকেন আদুরী। স্বর্ণলতা ছেলের কোটটা হাতে নিয়ে স্বামীর দিকে অগ্রসর হলেন। কাছাকাছি পৌঁছে বললেন,
” হ্যাঁ, ফিরেছে। আপনি বসে পড়ুন। ও আসছে। ”

সঞ্জয়ান খাবার টেবিলে বসে বলল,
” তুমি খেয়ে নিলেই পারতে, বাবা। ”

মুনছুর সাখাওয়াত এক ঝলক তাকালেন ছেলের দিকে। তারপরে কাঁপা হাতে ভাত মাখতে মাখতে বললেন,
” তুইও তো ঢাকার বাসায়টায় থেকে যেতে পারতি। ”

মাঝখান থেকে স্বর্ণলতা বললেন,
” আমাকে দিন, ভাতটা মেখে দিচ্ছি। ”

মুনছুর সাখাওয়াত বিনা প্রতিবাদে প্লেটটা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিলেন। মাখামাখির কাজ থেকে মুক্ত পেয়ে ছেলের দিকে ঝুকে এলেন। কানের কাছে মুখ এগিয়ে ফিসফিস স্বরে বললেন,
” আমার চিরুনি এনেছিস? ”

সঞ্জয়ানের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। স্মরণ হলো, সকালে বাসা থেকে বেরুনোর সময় বাবা চিরুনি আনতে বলে দিয়েছিলেন। রুহানিয়া কলেজ থেকে ফুটপাত ধরে একটু এগুলে একটা খুচরা দোকান পাওয়া যায়। সেখানে বিভিন্ন রঙের ছোট চিরুনি পাওয়া যায়। গ্রামের দিকটায় এই চিরুনিগুলো আগে পাওয়া গেলেও এখন পাওয়া যায় না। তাই বাবার ফরমায়েশ পেলে শহর থেকে সঞ্জয়ান এনে দেয়। আজ কাজ শেষ করে কলেজে যাওয়ার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল এটাও। তন্মধ্যে শূভ্রার সাথে দেখা, কথা কাটাকাটির মধ্যে পড়ে বেমালুল ভুলে গেছে। ছেলের নীরবতায় মুনছুর সাখাওয়াত উত্তর পেয়ে গেছেন। লুকোছাপা ভুলে চওড়া স্বরে বললেন,
” একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারিস না! ”

সঞ্জয়ান অপরাধ স্বীকার করে নিল সঙ্গে সঙ্গে। বলল,
” কাল এনে দিব। সত্যি বলছি, বাবা। এবার ভুল হবে না। ”

মুনছুর সাখাওয়াত ছেলের কথায় ভুললেন না। রাগটাও সংযত করতে পারলেন না। ভাত রেখে উঠে পড়লেন। রুমের দিকে এগুতে এগুতে বিড়বিড় করলেন,
” বাবার প্রয়োজন ভুলে যায়। এ কেমন ছেলে? আদুরীকে এত করে নিষেধ করলাম, বাচ্চা নেওয়া দরকার নেই। তবুও নিল। এখন সেই ছেলে পদে পদে আমাকে অপদস্ত করছে। ”

স্বামীর উঁচু কণ্ঠ পেয়ে ভাত মাখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন স্বর্ণলতা। এবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
” আবার কী করেছিস? ”

সঞ্জয়ান অভিমানে স্বরে বলল,
” চিরুনি আনতে ভুলে গেছি। এজন্য এতগুলো কথা শুনাল! এটা কী ঠিক, মা? সামান্য চিরুনির জন্য…”

স্বর্ণলতা কথা শেষ করতে দিলেন না। মাঝে বললেন,
” তোর কাছে সামান্য চিরুনি হতে পারে, তাঁর জন্য না। তাঁর জন্য বউকে বশ করার মন্ত্র। জানিস না? ”

কথাটা বলে তিনি হেসে ফেললেন। নিশী রাতে তার হাসির শব্দে সারা বাড়ি চমকে উঠল যেন! সঞ্জয়ানের সারা শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। চল্লিশোর্ধ্ব রমণী ঝংকার তোলা মুক্ত হাসির মধ্য থেকে বললেন,
” কলপ আর চিরুনি দিয়েই তো তিনি চিরতরুণ থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ”

সঞ্জয়ান বিরক্ত না হয়ে পারল না। তার বাবার বয়স ষাট পেরিয়েছে। চুল, গোফ, ভ্রূ সব পাকা। হাঁটা চলায় শারীরিক দুর্বলতা ধরা যায়। তবুও সপ্তাহে একবার চুলে কলপ দেওয়া চাই। শত কাজের মধ্যেও দুই মিনিট অন্তর অন্তর চিরুনি চালাতে ভুল হয় না।

” এখনও! কী দরকার, মা? ”

স্বর্ণলতা ভাতের প্লেটটা হাতে তুলে নিলেন। স্বামীর রুমের দিকে পা বাড়ানোর পূর্বে বললেন,
” ভয়। যদি আমি চলে যাই। অন্য কাউকে বিয়ে করে নিই? ”
” বাড়াবাড়ি লাগে না? ”

ছেলের প্রশ্নে তিনি মিটিমিটি হাসলেন। খুব সুন্দর করে বললেন,
” না। মনে হয়, বয়স বাড়েনি। পরিবর্তন আসেনি। ”

সঞ্জয়ান বাবাকে ভালোবাসে না এমন নয়। বরঞ্চ উল্টো। বাবাকে খুব ভালোবাসে, মানেও। শুধু বাবা-মায়ের মধ্যকার যে সম্পর্কটা সেটা অদ্ভূত লাগে। মনে হয়, পুরো পৃথিবী ঘুরে বেড়ালেও তাদের মতো এমন স্বামী-স্ত্রী খুঁজে পাবে না। সে খাওয়া শেষ করে রুমে ঢুকল। কোটটা পরে বেরুতে নিলে মায়ের সাথে দেখা। তিনি অবাক হয়ে সুধালেন,
” কোথাও যাচ্ছিস? ”

সঞ্জয়ান অপরাধি সুরে বলল,
” বাবা খুব কষ্ট পেয়েছে। ঘুম আসবে না। মন্ত্রটা নিয়ে আসি। ”

স্বর্ণলতা ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন। আদুরে স্বরে বললেন,
” এখন যেতে হবে না। কাল একসময় নিয়ে আসিস। তিনি আর রাগ করে নেই। ”

মায়ের বাঁধাটাকে ডেঙাতে পারল না। একটুক্ষণ নীরব থেকে জিজ্ঞেস করল,
” বাবা খেয়েছে? ”

তিনি মৃদু স্বরে উত্তর করলেন,
” খেয়েছে। ”
” রাগ ভাঙলে কী করে? ”

ছেলের কণ্ঠে কৌতূহল, জানার তীব্র ইচ্ছা। স্বর্ণলতা উত্তর দিলেন না। মিষ্টি হেসে চলে গেলেন।

সেই রাতে সঞ্জয়ান পুরো ঘরে তল্লাশি চালাল। কিন্তু শূভ্রার আইডি কার্ড পেল না কোথাও। ভোরের দিকে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ল।

__________
‘ কোথায় আসব? ‘

মেসেজটা এসেছে অচেনা নাম্বার থেকে। অরুণিমা পুরো নাম্বারটা কয়েকবার পড়ল। তবুও চিনতে পারল না। মেসেজটা ডিলেট করার জন্য চেপে ধরতে আরেকটা মেসেজ আসল,

‘ খুব ঝামেলায় ছিলাম। তাই যোগাযোগ করতে দেরি হলো। আমি চাচ্ছিলাম না, ঝামেলা সঙ্গে নিয়ে দেখা করি। প্রথম বার আলাদাভাবে দেখা করতে চাচ্ছ। যতক্ষণ তোমার সাথে থাকব ততক্ষণ শুধু তোমাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চাই। ‘

এতক্ষণে অরুণিমার টনক নড়ল। বুঝতে পারল, এটা অন্য কেউ নয়। মাইমূন। কিন্তু সে তার নাম্বার কোথায় পেল? কাগজটাতে কোনো নাম্বার লিখে দেয়নি। কিছু সেকেন্ড পেরুতে নিজের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল। যে তার গতিবিধি সর্বক্ষণ নজরে রাখে, তার পক্ষে নাম্বার যোগাড় করা কোনো ব্যাপার না।

অরুণিমা চিরকুট পাঠিয়েছিল দুইদিন আগে। এত দেরি করে উত্তর পাওয়া সত্ত্বেও সে পরবর্তী পরিকল্পনা করেনি। সে ভেবেছিল, অন্য সময়ের মতো এবারও মাইমূন হুট করে তার সামনে চলে আসবে। তেমনটা না ঘটায় এবার চিন্তায় পড়ে গেল। দেখা করার মতো কোনো জায়গা খুঁজে বের করতে পারছে না। শেষে ফিরতি মেসেজ পাঠাল,
” আপনি বলুন। ”

সঙ্গে সঙ্গে মাইমূন লিখে জবাব দিল,
” সময়টা বলো। ”

অরুণিমা একটু ভেবে নিয়ে লিখল,

” আমার ছুটির পর। ”
” তাহলে তোমাদের ছাদে আসব। অপেক্ষা করো। ”

অরুণিমা খুব খুশি হলো। মল থেকে বেরুতে বেরুতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। এই সময় একটা ছেলের সাথে অন্য কোথাও গিয়ে দেখা করা বিপদ্দজনক। মাইমূন নিজেই তো এক আস্ত বিপদ। বিপদ সঙ্গে থাকলেও জায়গাটা নিরাপদ হয়েছে। অরুণিমা নিশ্চিন্তে কাজ করতে লাগল। ফাঁকে ফাঁকে এটাও ভাবছে, কী বলে মাইমূনকে মানাবে। নিজের থেকে দূরে সরাবে।

[ ‘ গোপনে গোপনে ‘ বইটির জন্য যারা অপেক্ষায় ছিলেন তাদের অপেক্ষা শেষ হয়েছে। আগামীকাল থেকে বইমেলায় বইটি পাওয়া যাবে। প্রি-অর্ডারকারীদের নিকটও পৌঁছে যাবে ইনশাআল্লাহ। ]

আমার যেকোনো বই সম্পর্কে তথ্য পেজে মেসেজ করুন৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here