তুমি অপরূপা পর্ব ৩৪

0
777

#তুমি_অপরূপা (৩৪)

রূপা বসে আছে পার্কের একটা বেঞ্চে।রূপার সাথে বেঞ্চের এক কোণে সমুদ্র বসেছে।সমুদ্রের মধ্যে বেশ উগ্রতা লক্ষণীয়। রূপা হতবাক সমুদ্রর দিকে তাকিয়ে।

প্রথম বার যখন সমুদ্রকে গ্রামে দেখেছিলো তখন সমুদ্র ছিলো অন্য রকম অথচ দিন দিন কেমন হয়ে উঠছে সমুদ্র!
একটা মানুষ কতটা ভায়োলেন্ট হলে মাঝরাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে পারে আমি তোমাকে ভালোবাসি কপালকুণ্ডলা।
অথবা কলেজের সামনে, বাসার সামনে ব্যানারে লিখে রাখতো না ” তুমি আমার কপালকুণ্ডলা হইও,আমি সহস্রবার, সহস্র জনমে তোমার প্রেম তপসা করে কাটাবো। ”

সারাক্ষণ রূপার পিছন পিছন ঘুরঘুর করাটাই তার এখন প্রধান কাজ।
সমুদ্রকে এই মুহুর্তে ভীষণ শান্ত মনে হচ্ছে। দেখে বুঝার উপায় নেই এই লোকটা কি পরিমাণ জ্বালাতন করতে পারে রূপাকে!

৩ দিন ধরে রূপক বাসায় নেই,রূপা খেয়াল করে দেখলো রূপক নেই দেখেই মনে হয় সমুদ্র এরকম সাহস পেয়েছে।
বাড়ি থেকে বাবার কল পেয়েছে রূপা,রূপক যে গ্রামে হাজির হয়েছে সবই শুনেছে। রূপকের প্রতি সম্মান এবং শ্রদ্ধা দুটোই বেড়ে গেলো রূপার।

রূপা শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “কি সমস্যা আপনার? কি চান আপনি? ”

সমুদ্র তার চেয়ে বেশি শান্ত স্বরে বললো, “আমি চাই তুমি খুশি থাকো। তোমার মুখের হাসিটা দেখতে চাই বারবার, হাজারবার। ”

রূপা দাঁত দিয়ে নখ কামড়ে বললো , “আমার সম্পর্কে জানেন কিছু?
আমি কে চেনেন আমাকে?”

সমুদ্র হেসে বললো, “তুমি আমার কপালকুন্ডলা।”

রূপা মুচকি হাসলো। আবার বললো, “আচ্ছা, রূপকদার সাথে আপনার কি নিয়ে ঝামেলা হয়েছিলো?আমি শুনেছি আপনারা একেবারে জানের দোস্ত ছিলেন,এখন কেনো একে অপরের ছায়া ও মাড়ান না।”

সমুদ্রের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা নিমিষেই কালো হয়ে গেলো। মনমরা হয়ে বললো, “ওসব কথা এখন থাক। আমার এসব বলতে ভালো লাগে না। ”

রূপা আগ্রহী হয়ে বললো, “আমার যে জানার ভীষণ ইচ্ছে। ”

সমুদ্র মাথা নিচু করে বললো, “রূপকের সাথে আমার মায়ের একটা বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়।যদিও আমি জানি যাকে নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় তিনি রূপকের জন্য ভীষণ স্পেশাল, রূপকের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। আন্টি যখন ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন তিনিই ছিলেন রূপকের জন্য একমাত্র আশ্রয়স্থল। রূপকের ছোট বেলাটা আমার বা অন্যদের মতো আনন্দের ছিলো না।
তাই ও ওর ফুফুর ব্যাপারে ভীষণ সেনসেটিভ।
ওনাকে নিয়েই রূপক আমার মায়ের সাথে উগ্র ব্যবহার করে যেটা আমি মেনে নিতে পারি নি। আসলে, বাবা মায়ের সাথে বন্ধুর মিসবিহেভটা মেনে নেওয়া যায় না।তাও আমার সামনে দাঁড়িয়ে রূপক যখন আমার মায়ের সাথে বেয়াদবি করলো আমি সহ্য করতে পারতাম না।আমার মায়ের আমি ছাড়া আর কেউ নেই রূপা।আমার যেহেতু আর কোনো ভাই বোন হবে না বলে দিয়েছিলো ডাক্তার তারপর থেকে আমিই আমার মায়ের সম্বল। মা আমাকে ভীষণ আদরে বড় করেছেন, এখনো মা আমাকে ছোট বাচ্চার মতো শাসন করেন।আমার মা আমার কাছে আমার আদর্শ, আমার জীবন। মা’কে কেউ চোখ রাঙিয়ে কথা বলবে তা আমার জন্য সহ্য করার মতো না।

আসলে কি থেকে হয়ে গেলো, আমার ও মাথা গরম হয়ে গেলো তাই সেই মুহুর্তে। রূপক আমার আত্মার বন্ধু ছিলো। অথচ সেই মুহুর্তে আমিও ওর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেললাম।

তারপর যখন চাইলাম সব মিটমাট করতে তখন অনেক দেরি হয়ে গেলো। রূপক ততদিনে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ”

রূপা বললো, “আমি ও শুনেছি সবটা আগেই।এবার একটা কথা শুনেন,আমরা চার বোন। আমার বাবা মায়ের বিয়েটা ছিলো ভালোবাসার। সসবার অমতে বাবা মা পালিয়ে বিয়ে করেন।আমার বড় আপা ও একই কাজ করেন।তার পর মেজো আপাও তা করেন।
নিজর করা কাজ,বড় মেয়ে,মেজো মেয়ের একই কাজ করা,সমাজে লজ্জা পাওয়া,অনুশোচনা সব মিলিয়ে আমার মা এসব মেনে নিতে পারেন নি।মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।এখনো অসুস্থ উনি।

তাই আমার পক্ষে কখনো সম্ভব না কাউকে ভালোবাসা। আমি দেখেছি আমার মায়ের মনের কষ্ট, আমার বোনেরা চলে যাওয়ার পর মা’য়ের ভেঙে পড়া।তারপর আমি বাবাকে কথা দিয়েছি কখনো আমি এই কাজটা করবো না। দুই মেয়েকে দিয়ে বাবা মা লজ্জা পেয়েছে আমাকে দিয়ে যাতে না পায়।

আর সবচেয়ে বড় কথা, আপনার সাথে আমার কখনোই কিছু হওয়া সম্ভব নয়।কেনো জানেন?
প্রথমত বাবা মায়ের পছন্দেই আমি বিয়ে করবো।আর সবচেয়ে বড় কথা, রূপকদা আমার মামাতো ভাই। রূপকদার যেই ফুফুকে নিয়ে আপনাদের মধ্যে ঝামেলা হলো, আমি তারই মেয়ে।আমার মায়ের নাম সালমা।

এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন আপনার বাবা মা ও কখনো চাইবে না আপনি আমাকে বিয়ে করেন?

আশা করছি এরপর থেকে আমার আশেপাশে আর দেখবো না।তা না হলে আমি কলেজ+বাসা চেঞ্জ করতে বাধ্য হব।”

সমুদ্র হতভম্ব হয়ে গেলো শুনে।কি বলছে এসব রূপা!
রূপা সালমা ফুফুর মেয়ে!
সেই সালমা ফুফু যাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!
সমুদ্রের তালগোল পাকিয়ে গেলো।

রূপা চলে গেলো সোজা হেটে।আগামীকাল মা’কে ঢাকায় আনা হবে।রূপার উত্তেজনার সীমা নেই।অবশেষে সবাই সবার সন্ধান পেলো।মা খুঁজে পেলো তার বাবার বাড়ি আর তার পরিবার খুঁজে পেলো তাকে।

রূপা বাসায় ঢুকতেই মাহি বিরক্ত হয়ে মুখ বাঁকালো।মনে মনে বললো, “এই মেয়েটা কি পাথর না-কি! একটা ছেলে এরকম পাগলামি করছে অথচ সে কেমন নির্বিকার। আমার জন্য এরকম যদি কেউ করতো তবে আমি অনেক আগেই তার হয়ে যেতাম।”

রূপার সাথে ইদানীং মাহি কথা বলে না। খোঁচা দিয়ে ও কিছু বলে না,সবাই জানে এখন রূপা যে রূপকের ফুফাতো বোন। সন্ধ্যায় রত্না পান্না এলো রূপার কাছে।দুজনেই এসে টানাহেঁচড়া শুরু করলো রূপাকে নিয়ে তাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।
রূপা রাজি হচ্ছে না শুধু।রত্নার মা তানিয়াকে রূপার কেমন কেমন যেনো লাগে।কেমন করে তিনি তাকায় রূপার দিকে রূপার সহ্য হয় না সেসব।

কিছুক্ষণ টানাটানি করে দু’জনেই চলে গেলো। রূপা কিছুক্ষণ শুয়ে ছিলো।এরই মধ্যে সে ঘুমিয়ে গেলো। রূপার ঘুম ভাঙলো বেশ কিছুক্ষণ পর। নিপা এসে ডেকে বললো, রূপক ডাকছে তাকে।

ঘুম থেকে উঠে রূপা প্রথমে চমকে গেলো রূপকের কথা শুনে। পরমুহুর্তে মনে হলো যে রূপক তো তার মামাতো ভাই এখন।
রূপা উঠে গেলো। গিয়ে দেখে রূপক ডাইনিং রুমে চেয়ারে বসে আছে। দুই চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে তার।
রূপা যেতেই রূপক বললো, “রত্না পান্না কোথায় রূপা?”

রূপা ঠোঁট উল্টে বললো, “আমি তো জানি না।সন্ধ্যায় তো বাসায় ছিলো। ”

রূপক একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো, “আমাকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও তো ফ্রিজ থেকে।”

রূপা গিয়ে পানি আনলো।পানি রূপককে দিতে গিয়ে রূপা চমকে গেলো ভয়াবহভাবে।
রূপকের সারা শরীর ভীষণ গরম হয়ে আছে। ভীষণ জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা। অথচ কেমন নির্বিকার সে।
রূপা বুঝতে পারলো না কি করবে।এদিকে এরা কেউ-ই নেই বাসায়।

রূপক চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইলো। পায়ে তার অসম্ভব ব্যথা, সারা শরীর অসম্ভব ব্যথা। সেদিন অসুস্থ শরীর নিয়ে ফুফুকে খুঁজতে বের হয়ে গেছিলো। তারপর আর নিজের যত্ন নেয়ার সময় হয়ে উঠে নি।গতকাল রাত থেকে ভীষণ জ্বর,দুপুরে ফুফুকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে।
তারপর বাসায় এসেছে প্রচন্ড জ্বর নিয়ে।

রূপা ফ্রিজ খুলে লেবু সিদ্ধ করে রূপককে এনে দিলো, মালটা কেটে দিলো।
রূপক কিছুই খেলো না।শান্ত স্বরে বললো, “তুমি চলে যাও রূপা।”

রূপা চেয়ার টেনে বসে বললো, “আন্টি কোথায়?”

রূপক হেসে বললো, “আমাকে তো বলে যায় নি রূপা।”

“রাতে আপনি একা থাকবেন?কোনো অসুবিধা হলে কি করবেন?”

“আমায় নিয়ে ভেব না রূপা,এরকম পরিস্থিতিতে আমি আগেও পড়েছি।আমার জন্য কখনো কেউ ভাবে নি, কেউ আমাকে ভেবে দুফোঁটা চোখের জল ফেলে নি।এই দুনিয়ায় আমার অনেক প্রিয় মানুষ আছে রূপা কিন্তু জানো,আমি কারো প্রিয় না।কোনো দিন আমাকে কেউ প্রিয় বলে ডাকে নি।আমাকে ভেবে উদ্বিগ্ন হয় নি। ”

রূপা সাহস করে বললো, “আপনার আর আন্টির মধ্যে কিসের এতো সমস্যা? ”

রূপক কিছু বললো না। চুপ করে রইলো। রূপা আবারও জিজ্ঞেস করতেই বললো, “ফুফুর চিকিৎসা শুরু হয়ে গেছে, ফুফুর থেকেই না হয় শুনে নিও।”

রূপা আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে এলো।

সমুদ্র উত্তেজিত হয়ে বাসায় গিয়ে বললো, “মা জানো,রূপকের ফুফুকে পাওয়া গিয়েছে। ”

রেখা বিরক্ত হয়ে বললেন,”তাতে তোমার এতো উত্তেজনার কিছু নেই সমুদ্র।”

সমুদ্র হেসে বললো, “আরে মা শুনো না।আমি একজনকে ভালোবাসি।আমি ঠিক করেছি কয়েকদিনের মধ্যে তার বাবার কাছে তোমাকে প্রস্তাব নিয়ে পাঠাবো।
জানো সে কে?”

রেখা সরু চোখে তাকালো।সমুদ্র হেসে বললো, “সালমা ফুফুর মেয়ে মা।আমি তাকেই বিয়ে করবো। ও আমার সাথে সম্পর্কে যেতে রাজি হচ্ছে না তাই সোজা বিয়ে করে ফেলবো ভাবছি।”

রেখার বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো ছেলের কথা শুনে। সমুদ্র হাসতে লাগলো অসংলগ্ন ভাবে।রেখা যেনো সমুদ্রের মধ্যে কবিরকে খুঁজে পেলেন।
এই ভাবেই একদিন এসে কবির সালমার কথা জানিয়েছিলো।
আজ আবারও সমুদ্র ও একই কাজ করছে।
তিনি কিছুতেই এই ব্যাপারে সম্মতি দিবেন না।কবির যদি জানতে পারে তাহলে কে জানে কি হবে।তাছাড়া সালমাকে যেভাবেই বাড়ির বউ হতে দিতে চান নি তিনি,সালমার মেয়েকে ও তিনি দিবেন না।কিছুতেই না।
দরকার হলে তিনি অনেক কিছু করবেন।

চলবে…….

রাজিয়া রহমান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here