#তুমি_অপরূপা (৩৩)
একজন একজন করে পুরো এলাকার মানুষ জড়ো হলো উঠানে। অনিতা ভয়ে কাঁপছে। তার ভীষণ ভয় করছে।এতো মানুষ তাদের উঠানে, মানুষ নানারকম কথা বলছে তার বড় আপাকে নিয়ে। অনিতা অনেক কিছু বুঝে না।
তেমনই এটাও বুঝে না মানুষের এতো মাথা ব্যথা কেনো?
সে তো কোনো দিন দেখে নি তার মা’কে কারো বাড়ি গিয়ে এসব কথা বলতে কাউকে নিয়ে?
সিরাজ হায়দার বাড়ির সামনে এসে চমকে গেলেন।এতো লোক জড়ো হয়েছে। মেয়েটাকে মানুষ অপদস্থ করছে না তো!
ভীড় ঠেলে ভেতরে যেতেই দেখলেন অন্তরা ভীত হরিণ ছানার মতো ভয়ে,লজ্জায় একটুখানি হয়ে আছে।পাশে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে, বেশ ভদ্র ঘরের ছেলে মনে হচ্ছে দেখে।
মেয়ের ভয়ার্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে বাবার বুক ভেঙে গেলো যেনো।সবকিছু উপেক্ষা করে সিরাজ হায়দার এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।
বাবা মেয়ের মিলন দৃশ্য দেখে রূপকের ভীষণ ভালো লাগলো। এই কিছুক্ষণের মধ্যে রূপক মোটামুটি সবটা জেনে গেলো।
গলা খাঁকারি দিয়ে রূপক বললো, “অনেকক্ষণ ধরে অনেকের অনেক কথা শুনেছি। আমাকে নিয়ে, অন্তরাকে নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু বলেছেন।এবার আমি বলছি,আপনারা শুনবেন।”
সবাই চুপ হয়ে গেলো রূপকের কথা শুনে। অবাক ও হলো কিছুটা। এরকম একটা কাজ করে ছেলেটা আবার কথা বলছে সবার মাঝে!
এতো বড় সাহস!
রূপক বললো, “আমি রূপক।আর এই যে অন্তরা,ও এতো দিন আমাদের বাসায় ছিলো। আমাকে হয়তো আপনারা জানেন না বা চেনেন না।অন্তরার মা সালমা,আমার একমাত্র ফুফু।আমি ওনার ভাইপো।
আপনারা সবাই এতো ন্যারো মাইন্ডের কেনো?একটা মেয়ে বাড়িতে নেই বলে সবাই ধরে নিলেন সে কোনো ছেলের সাথে পালিয়ে গেলো?
আপনারা কেউ কি তাকে কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে দেখেছেন বা যার সাথে পালিয়েছে তাকে দেখেছেন?
কেউ-ই দেখেন নি।তাহলে না জেনে কিভাবে এসব কথা বলছেন?
আপনারা নিশ্চয় জানেন ফুফার অবস্থার কথা। এজন্যই মূলত অন্তরাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছি আমরা। আর তার কিছু দিন পর রূপাকে ও নিয়ে গিয়েছি।
ওরা দুই বোন এক সাথেই ছিলো। আপনারা কে বিশ্বাস করলেন অথবা কে বিশ্বাস করলেন না তা নিয়ে আসলে আমার বা আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।কেননা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো সময় আমাদের নেই।আপনাদের হাতে অফুরন্ত সময় আছে,চায়ের দোকানে বসে আপনারা এসব নিয়ে গসিপ করেন যত খুশি তত,কিন্তু মনে রাখবেন তাতে সত্য বদলে যাবে না।আপনাদের কথা সত্যি হয় তাহলে প্লিজ প্রমাণ দিয়েন।অন্তত কার সাথে পালিয়েছে তার নামটা বলেন কেউ।”
যেহেতু কেউ জানে না সেহেতু কেউ বলতে পারলো না অন্তরা কার সাথে পালিয়েছে। কিন্তু রূপকের কথা বিশ্বাস ও করতে পারছে না আবার ফেলতে ও পারছে না।
যদি কারো সাথে অন্তরা পালিয়ে যেতো তবে অবশ্যই সেই ছেলের কথা কেউ না কেউ জানতো গ্রামের।
অথচ একটা মানুষ ও তাকে দেখলো না!
আবার যদি না পালিয়ে থাকে তবে অন্তরার মা এরকম অসুস্থ হয়ে গেলো কেনো?
সে কথা বলতেই রূপক হেসে বললো, “সবাই তো জানেনই ফুফা ফুফুর বিয়েটা কিভাবে হয়েছিল।তাই অন্তরার আমাদের বাসায় যাওয়া ফুফু মানতে পারে নি, তারপর আবার অনামিকা চলে যাওয়ায় ফুফু একেবারে ভেঙে পড়েন।আল্লাহ অসুখ ও দিয়েছেন আবার তার জন্য চিকিৎসা ও দিয়েছেন। ”
অন্তরার ফুফু সুরভী বললো, “ছেলেভুলানো কথা এগুলো না?আমরা সবাই কি দুধের বাইচ্চা যে যা বুঝাইবা তা বুঝমু?যদি সত্যি তা হইতো তাইলে আমরা কি শুনতাম না না-কি? ”
সিরাজ হায়দার বললেন, “তোরা?হু!
তোদের আসল রূপ তো সেদিনই দেখছি যেদিন থাইকা আমার বউ অসুস্থ হইছে।যতদিন আমার বউ কাম কইরা খাওয়াইতে পারছে তোরা একলগে খাইছস,যেই বুঝলি সালমা কাজ করতে পারবো না তোরা নিজেরা আলাদা রান্দন শুরু করলি তোগো কাছে আমি আমার ঘরের কথা কইতে যামু?এজন্যই কই নাই।তোগো শুননের মতো কিছু নাই।”
রূপক মুচকি হাসলো। এতক্ষণে সিরাজ হায়দার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজেও রূপকের কথা তাল মেলাচ্ছেন দেখে রূপকের খুব ভালো লাগলো।
সুরভি হুংকার দিয়ে বললো, “নিজের মাইয়ারা নষ্টামি করবো, আর তাগোর কগে থাইকা আমার মাইয়া নষ্ট হইতো?আমার মাইয়ারে আমি চোক্কে চোক্কে রাখি।”
রূপক হেসে বললো, “ফুফু,বাতির নিচটা সবসময় অন্ধকার হয় জানেন তো?
এই যে এত বড় বড় কথা বলছেন,আপনি ২৪ ঘন্টা মেয়ের সাথে থেকেও মেয়ের খবর জানেন না।অথচ এই যে দেখেন,আমি এই বাড়িতে পা দেওয়ার পর থেকে দেখছি আপনার মেয়ে আর ওই যে বারান্দার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা কালো টিশার্ট পরা ওই ভাইটা দুইজনেই সেই শুরু থেকে ইশারা ঈঙ্গিতে কথা বলছে ”
মিতা চমকে উঠলো, সেই সাথে চমকে উঠলো সুজন ও।সুজন আর মিতা একে অন্যকে ভালোবাসে।৫ মাসের সম্পর্ক দুজনের। কেউ-ই জানে না। অথচ এই ছেলেটা এসেই বুঝে গেলো!
সুজন পালিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু এতো মানুষের মধ্যে পালাতে পারলো না।কয়েকজন মিলে ধরে ফেললো তাকে।
মুহুর্তে ঘটনা বদলে গেলো। এতক্ষণ যারা অন্তরা আর রূপককে নিয়ে কথা বলছিল তারাই এবার সুজন আর মিতাকে নিয়ে পড়লো। আস্তে আস্তে অন্তরাদের উঠান থেকে ভীড় কমতে লাগলো।।
যাকে দেখার জন্য এতো দূর এসেছে অবশেষে তার দেখা পেলো রূপক।ঘরে গিয়ে দেখলো সালমা কেমন জড়সড় হয়ে বসে আছে। রূপক ছুটে গিয়ে ফুফুকে জড়িয়ে ধরলো। ছেলে মানুষ না-কি কাঁদে না।অথচ অন্তরা দেখলো তার মা’কে বুকে চেপে ধরে ছেলেটা কেমন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
অন্তরার কাছে সব এখনো অস্পষ্ট লাগছে।এই ছেলেটা তার মামাতো ভাই?
এই ছেলেটা না থাকলে এলাকার মানুষ সবাই অন্তরাকে আজ ছিড়ে খেতো। তাদের বাক্যবাণে জর্জরিত করে ফেলতো।
সিরাজ হায়দার মেয়ের সাথে রাগলেন না।কেনো জানি মেয়েকে দেখেই সব রাগ পানি হয়ে গেলো।
তার বড় মেয়ে,তার বড় আদরের মেয়ে ছিলো অন্তরা।সেই মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝেছেন মেয়েটা ভালো নেই।
মেয়েটা না হয় একটা ভুল করেছে,এখন তিনি বকাবকি করলে তো তা পালটে যাবে না।
নিশ্চয় কিছু হয়েছে তার স্বামীর সাথে, তাই বাবার বাড়ি চলে এসেছে। তিনি ও যদি রাগারাগি করেন তবে মেয়ে কোথায় যাবে!
সব ভেবে সিরাজ হায়দার মেয়ের হাত ধরে বললো, “কেনো করলি এরকম?আমাকে একবার জানাতে পারতি অন্তত। ”
অন্তরা বাবার দুই পা (চেপে ধরে বললো, “আমার অনেক বড় ভুল হয়েছে আব্বা।আমি জেনেশুনেই এই ভুলটা করেছি। আব্বা,আমার ভূলের কোনো ক্ষমা হয় না আমি জানি,ক্ষমা না করলেও আমারে আপনি দূরে সরাই দিয়েন না।আমার এই দুনিয়ায় আর কেউ নাই আপনারা ছাড়া। ”
সালমা রূপককে শক্ত করে ধরে রেখেছে। রূপক সিরাজ হায়দারের কাছে এসে বললো, “ফুফা,আমি ফুফুরে ঢাকায় নিয়ে যেতে চাই।ফুফুর চিকিৎসা দরকার। একটু যত্ন আর চিকিৎসা পেলেই ফুফু অল্পদিনের মধ্যে সেরে যাবে।”
সিরাজ হায়দার চুপ থেকে বললেন, “ঠিক আছে, তাই হবে।তবে আমার স্ত্রীর চিকিৎসার সব খরচ আমি দিমু।আমার বিলের ধানি জমিটা বিক্রি কইরা দিমু।”
রূপক মুচকি হেসে বললো, “বেশ তাই হবে।”
অন্তরা গিয়ে মায়ের পাশে বসলো। এতক্ষণে সবকিছুই জেনেছে সবাই।অন্তরা গিয়ে মা বলে ডাকতেই সালমা উদগ্রীব হয়ে বললো, “কে,কে?আমার অন্তু?”
অন্তরা চোখের পানি ছেড়ে বললো, “হ গো মা,আমি তোমার অন্তরা।তোমার অন্তর পুরোটা। ”
সালমা শক্ত করে মেয়ের হাত চেপে ধরলেন। যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে সে।রূপক মুগ্ধ হয়ে দেখছে ফুফুকে।
অন্তরা বললো, “আপনি আমাকে বললেন না কেনো আপনি আমার মামাতো ভাই? ”
রূপক হেসে বললো, “তাহলে তো আর সারপ্রাইজড হতেন না।”
অন্তরা মুগ্ধ হলো রূপকের ব্যবহারে। রূপক এমনভাবে ব্যবহার করছে যেনো সবাই তার অনেক দিনের চেনা।কোনো কৃত্রিমতা নেই তার মধ্যে। মা যেমন তার ভাইয়ের ছেলেকে ভুলেন নি তেমনই রূপক ভাই ও মা’কে ভুলেন নি।
চলবে……